#ভালবাসা_রং_পাল্টায়_না(২)
রুবানার সাথে তানজীদের বন্ধুত্ব আজ বেশ কয়েক বছর। তাদের দুজনের বাবা প্রায় কাছাকাছি সময়ে এই জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে আসেন। তানজীদ ভীষণ প্রান চঞ্চল একটা ছেলে। যে কাউকে সহজে আপন করে নেয়। রুবানার সাথে সেই এক সাথে খেলা করার সময় থেকেই বন্ধুত্ব। যদিও মারামারিই তারা বেশী করত কিন্তু একে অপরকে ছাড়া আবার থাকতেও পারত না।
সেই তানজীদ আর তার বড় বোনের মাঝে এমন কিছু একটা দেখে রুবানা যেন বোকা বনে গেল। আগে থেকে যে কোন কিছু জানত না রুবানা এমনটাও কিন্তু নয়। কিন্তু সে ভেবেছিল অল্প বয়সের ফ্যান্টাসি বলে যেমনটা হয় তেমন। তানজীদ যে এমন একটা কান্ড করে বসবে ঘুনাক্ষরেও টের করতে পারেনি রুবানা। পরক্ষনেই নিজেকে ধীক্কার দিল। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের মনে কি চলছে সে বুঝতে পারল না। বুঝতে পারলে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না কাউকে।
………………
অনেকটা সময় হলো রুবানা আর তানজীদ মুখোমুখী বসে আছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ অনেক চুপচাপ তানজীদ। নীরবতা ভেঙ্গে রুবানা বলল
-কি হলো এসব? তুই এমন কেন করলি?
-আমি রুমকিকে ভালবাসি।
-কবে থেকে?
-জানি না। সেই একসাথে ঘরঘর খেলার সময় থেকেই আমার ওকে ভাল লাগে।
ঘরঘর খেলার সময় গৃহকর্তা আর গৃহকর্ত্রীর ভূমিকা সবসময় তানজীদ আর রুমকি করত। তানজীদ ছেলেদের মধ্যে লম্বায় প্রায় রুমকির কাছাকাছি হওয়ার কারনে সে এই সুযোগ পেত।
রুবানা আর কিছু বলল না। কারন সে বুঝতে পেরেছে কিছু বলে কোন লাভ নেই।
…………
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। রুমকি এখন আর তানজীদকে খুব একটা দেখে না। কিন্তু তাই বলে তানজীদ রুমকিকে দেখা ছাড়েনি। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিন সে রুমকিকে দেখে। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল ভালো মন্দ মিলিয়ে ঠিক সেসময় একদিন তানজীদের বাবার পোস্টিং হয়ে গেল অন্য শহরে।
পোস্টিং অর্ডার আসার পর থেকেই তানজীদের অবস্থা পাগলপ্রায়। বেশ কয়বার রুমকির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আর কোন উপায় না পেয়ে চিঠির আশ্রয় নিল সে। রুমকি এমনিতে কয়দিন ধরে তানজীদের আচরণে বিরক্ত ছিল। চিঠি পেয়ে সরাসরি হেডমাস্টারের কাছে জমা দিয়ে আসল।
এরপর তানজীদকে ডেকে ভীষণ বকা দিলেন হেডমাস্টার মশায়, সাথে এ বলে সতর্ক করে দিলেন পরবর্তীতে এমন ঘটনা ঘটলে ওর বাসায় বাবা মাকে জানানো হবে। এই ব্যাপারটি এখানে শেষ হয়ে গেলে হতো। কিন্তু কি করে যেন তানজীদের বাবার কানে গেল কথাটা। পুরো ব্যাপার শুনে উনি ভীষণ রেগে গেলেন। যাচ্ছে নয় তা বললেন ছেলেকে।
এরপর বেশ কিছুদিন আর তানজীদ স্কুলে যায়নি। দেখতে দেখতে তাদের চলে যাবার সময় কাছে চলে এলো। এবার টিসি নেয়ার জন্য তো স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু কেন যেন তানজীদের যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভীষণ খারাপ লাগছিল। এই স্কুল, খেলার মাঠ, কোয়ার্টার এসবে কতো স্মৃতি রয়েছে। সবচেয়ে মন খারাপ হয় রুমকির কথা ভেবে। এক সাথে কত খেলা করেছে। প্রতিটা গাছ, ব্লকগুলোর রাস্তা যেন বারেবারে সেই স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয়। শেষ কয়দিন তেমন একটা ঘর থেকেও বের হয়নি। বন্ধুরা সবাই এসে দেখা করে গেছে।
স্কুলে এমন একটা সময় গেল যখন ক্লাস চলবে, সুতরাং রুমকির সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। হাজার হলেও মানুষের মন। যতই লাগাম টানুক এক সময় আর ধরে রাখা যায় না চির ধরেই। যাবার আগের দিন কোনভাবেই আর মনকে মানাতে পারল না। রুবানার সাথে দেখা করার বাহানায় গেল ওদের বাসায়। অনেক বার বলার পরেও রুমকি সামনে এলো না।
………………
এদিকে রুমকি ভীষণ বিরক্ত। সেদিন চড় দেয়ার পর কয়দিন চুপচাপ দেখে ভেবেছিল তানজীদের মাথা থেকে ভূত নেমেছে। কিন্তু তানজীদ যে ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি রুমকি। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ আবার বারেবারে কি যেন বলতে চাইত। রুমকি অবশ্য পাত্তা দিত না।
সমবয়সী বা সিনিয়র হলে এক কথা ছিল। জুনিয়র একটা ছেলে তাকে প্রেমের কথা বলছে তাও আবার তার ছোট বোনের বেস্ট ফ্রেন্ড! কেমন আজব লাগছিল ব্যাপারগুলো। তাই তানজীদকে যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত এড়িয়ে চলতে শুরু করে রুমকি।
এরমধ্যে আবার শুরু হলো চিঠির উপদ্রব। প্রতিটা চিঠিতেই ভালবাসার কথা লেখা। একদিন এক চিঠি গিয়ে পরল তার এক বান্ধবীর হাতে। তাকে আবার সিআইডি বললেও কম বলা হয়। জেরার চোটে রুমকি সব বলে দিল। বান্ধবীর পরামর্শেই চিঠি সরাসরি হেডমাস্টারের কাছে দিয়ে পুরো বিষয়টা জানিয়ে এলো রুমকি।
এই ঘটনার পর আর তানজীদের দেখা নেই। জলজ্যান্ত একটা মানুষ কি করে এভাবে হাওয়া হয়ে যায় রুমকির ভীষণ অবাক লাগে। পরে একদিন রুবানার কাছে জানতে পারে তানজীদের বাবার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। এই খবর শুনে যেন বেশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রুমকি।
হঠাৎ একদিন বিকেলে তানজীদ এসে হাজির। লুকিং গ্লাসে তানজীদকে দেখে রুমকি ইচ্ছে করে দরজা না খুলে রুবানাকে পাঠায়। বেশ কিছুক্ষন পর রুবানা এসে যখন জানাল তানজীদ রুমকির সাথে কথা বলতে চায় রুমকি রাজি হয়নি। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও রুমকি যায়নি তানজীদের সামনে।
সময়টা আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। হুঠহাট করেই যেকোন সময় বৃষ্টি হয়। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আকাশে মেঘ করে আছে। যেকোন সময় ভারী বর্ষন শুরু হবে। আকাশে বিজলী চমকাচ্ছে। তানজীদ বিদায় নিয়ে চলে যাবার উপক্রম হলে রুবানা এবং তার মা দুইজনই বারবার বলে একটু অপেক্ষা করে বৃষ্টি হয়ে গেলে তারপর যেন যায়।
তানজীদও নাছোড়বান্দা সে যাবেই। আসলে তার আর এক মুহূর্তও বসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। নীচে জারুল গাছটার বরাবর রুমকির রুম। তানজীদ জানে রুমকি রুমে আছে। সে জারুল গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যদি একবার রুমকিকে দেখতে পায়।
আজ যেন সবকিছুই একটু বেশী বেশী। অন্যান্য দিন হাজার বিজলী চমকালেও বৃষ্টি কদাচিৎ হয় বা হলেও অল্প স্বল্প হয়। আজ হঠাৎ করে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়ে গেল। বাতাসের দমকে রুমকি তার রুমের জানালা লাগাতে গেলে দেখে একটা ছেলে জারুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি ঠিক তার জানালা বরাবর।
রুমকি ভীষণ অবাক হয়। এই ঝড়ের মধ্যে কোন পাগল এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটায় ছেলেটিকে চিনতে না পারলেও পরে বুঝে এ আর অন্য কেউ নয় তানজীদ। কিন্তু কি হাল হয়েছে এই ছেলের! শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে! ঘনঘন বিজলী চমকাচ্ছে সেদিকে তা যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে রুমকির দিকে।
কি ছিল সে চাহনীতে রুমকি জানে না, কিন্তু সেই চাহনি উপেক্ষা করে জানালা বন্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আকাশে মেঘের গর্জন সাথে দমকা হাওয়া আর ঝড় আর ধরনীতে দুইজন কিশোর কিশোরী সব ভুলে চেয়ে রয়েছে একে অপরের পানে।
চলবে………