#ভাগ্যবতী
#লাবিবা_তানহা_এলিজা
#পর্ব_১১

১৫.
বেলকনীতে দুটো বেলীফুলের গাছ রয়েছে। গাছ দুটোর বয়স বছর দুয়েক হলো । গাছ দুটোর দুইটি বিশেষত্ব রয়েছে। এক, কখনো দুয়েকটা ফুলের বেশী ফুল গাছে দেখা যায়নি। দুই, কখনো গাছ দুটো ফুলবীহিন থাকে নি। রুকু সেই দুই একটা ফুলের ঘ্রাণ নেয় প্রাণ ভরে। বেলীফুল রুকুর সবচেয়ে প্রিয় ফুল। রুকুর জীবনের মতোই সাদা শুভ্র রংয়ের। সুবাসহীন জীবনে সুবাস ছড়ায়। জীবনের উত্থান পতনের সাথে মিশে আছে যে এইফুল। আজকের এই প্রিয় ফুলটি চার বছর আগেও তার এতোটা প্রিয় ছিলো না। ছিলো প্রিয় মানুষটির প্রিয় ফুল। আজো সেই স্মৃতিগুলো সজীব দেখায়। বারিধারা রুকুকে প্রথম প্রপোজ করেছিলো বেলীফুলের বুকে হাতে ধরে। অকেশন গুলোয় খোপায় বেলীফুলের মালা গুলো বারিধারা ই পড়িয়েছিলো। বিয়ের দিনটিতেও ডেকোরেট করা হয়েছিলো এই বেলীফুলে। বেলীফুল আকৃতির ডায়মন্ড রিং টা হাতে পরিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিলো, ” Spread the fragrance like this white belly flower and enter my life darling.” আজো শরীরে কাটা দিয়ে উঠে রুকুর। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন নিক্ষেপ করে , আমি কি সৌরভ ছড়াতে ব্যর্থ হয়ে ছিলাম যার কারনে বারিধারা অভিমান করে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো ?
রুকু কখনোই ফুল ছিড়ে হাতে নেয়না। তার ভাষ্যমতে যদি কখনো ঘুম থেকে উঠে দেখে গাছ ভরে ফুল ফুটে আছে সেদিন সে ফুল তুলবে। সেই ফুলের মালা গেঁথে নিজেকে সাজাবে। মৃদু হাসে রুকু। মোড়ায় বসে বেলকনির গ্ৰীলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ। হটাৎ ই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যায়। ফোনের স্কিনে গ্ৰামীন সিমের একটি নাম্বার ভেসে উঠে। লাস্ট পাঁচটি ডিজিট একনাগাড়ে শূন্য । নাম্বারটি বিদঘুটে লাগে রুকুর কাছে ঠিক নাম্বারটির মালিকের মতো। সেই বিদঘুটে ব্যক্তিটি হচ্ছে রুকুর অফিসের সিইও আতিকুর ইসলাম। বেচারার দুই মেয়ে রেখে বউ মরেছে। মেয়েদুটোই রুয়েট থেকে পাস দিয়েছে। শেষ বয়সে এসে মেয়ে বিয়ে না দিয়ে নিজে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। যেখানেই ডিভোর্সী এবং বিধবা মহিলাদের সন্ধান মিলবে সেখানেই তাকে ছুক ছুক করতে দেখা যাবে। এই বুড়োর জালায় অতিষ্ঠ রুকু। যখন তখন ফোন দিবে। সামনে এলে নানান বাহানায় ইমপ্রেস করার চেষ্টা করবে। বুড়োর এসব ভীমরতি দেখে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে রুকু। নাহ এবার বুড়োর মেয়েদের নালিশ জানাতেই হবে। কয়েকবার ফোন বেজে বন্ধ হয়ে যায়। অসহ্য লাগছে রুকুর। হাতের কাছে রাখা বইটার পৃষ্টা উল্টায়। বইটির নাম নিবার্সন। রুকুর পছন্দের বইয়ের মধ্যে একটি।
” ফুপি আসবো? ”
বেলকনির দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি পাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে পূরবী। রুকু অনুমতি দিবে তারপর সে রুকুর কাছে যাবে। রুকু চোখের পাতা বন্ধ করে পরপর খুলেই ইশারা করে তার পাশে এসে বসতে। পূরবীকে রুকুর বেশ ভালোই লাগে। মেয়েটা মায়াবতী। কথাবার্তার ধরন ও সুন্দর। পূরবী যাওয়ার পথে একটি বেলীফুলে হালকা ছোয়া দেয়। রুকু লক্ষ্য করে কিন্তু কিছুই বলে না। রুকু পূরবীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
” সারাক্ষন একা একা বসে থাকেন আপনার বোরিং ফিল হয়না? অবশ্যই হয়। আগে তো আমি ছিলাম না কিন্তু এখন আছি। আমাকে একটা ডাক দিলেই তো হয়। নিচ থেকে এক দৌড়ে এখানে চলে আসবো। ” কথাটি বলেই চুপ হয়ে যায় পূরবী। রুকুর থেকে কি উত্তর আসবে তার জানা নেই। রুকু কেমন মেজাজের মানুষ তাও জানা নেই। যদি মি. ডক্টরের মতো হয় তাহলে তো চিল্লাচিল্লি শুরু করবে এখন। কিন্তু রুকু তা করলোনা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করলো,
” তোমার বয়স কতো? ”
” সতের প্লাস। ”
” আমার বয়স কতো জানো? ছত্রিশ বছর। তোমার বয়সের দ্বিগুনের ও বেশী। এবার বলো তোমার সাথে কি আমার কোন কথা থাকতে পারে? ”
” না।পারে না। ”
” কেনো পারে না? অবশ্যই থাকতে পারে। কথা বলার মাঝে বয়স কোন ফ্যাক্ট না। এবার বলো তুমি কি কথা বলতে চাও? ”
” আপনি কিছু খাবেন? ”
” না এখন খাবো না। ”
” আপনার অফিস শেষ? ”
” আজকের মতো শেষ। ”
” সাদা আপনার প্রিয় রং? ”
” হুম।”
পূরবী আর কোন কথা খুঁজে পায়না। কি কথা বলবে রুকুর সাথে? কোন টপিক ই তো মাথায় আসছে না।
চোখ পড়ে রুকুর হাতের বইটির উপর। বইটির নাম নির্বাসন। লেখক হুমায়ুন আহমেদ। ক্লাস নাইনে এই বইটি একবার লাইব্রেরীতে পড়েছিলো পূরবী। যদিও সাহিত্যের প্রতি তার উৎসাহ নেই। সাইন্স নিয়ে পড়াশোনার চাপে উৎসাহ কিছুটা থাকলেও তা চাপা পড়ে গেছে । পূরবীকে বইটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুকু নড়েচড়ে বসে। বইটা বন্ধ করে পূরবীর দিকে ঝুঁকে প্রশ্ন করে,
“পূরবী কখনো প্রেমে পড়েছো?”
“না। ”
“প্রেম হচ্ছে কিছু অনুভূতির সংমিশ্রণ। প্রেম কখনো করতে হয়না। অনুভূতি গুলো জড়ো হয়ে চুপি চুপি প্রেম হয়ে যায়। প্রেম যার তার সাথে হতে পারে। প্রেম হতে টাকা লাগে না গাড়ি বাড়ী লাগে না অথবা মানবদেহও লাগেনা। যদি মানবদেহ ছাড়া প্রেম না হতো তাহলে কেউ কখনো সুন্দর কিছু দেখে বলতোনা ইসস হাউ কিউট! প্রেমে পড়ে গেলাম। ওপেন রিলেশনশীপ চেনো? ওপেন রিলেশনশীপ হচ্ছে লোক দেখানো ব্যপার। সেই প্রেম বেশী পবিত্র যেই প্রেম প্রকাশ পায় কম হৃদয়ের গভীরতায় স্থান পায় বেশী। প্রেমে বাধা থাকবেই। যেই প্রেমে বেশী বাধা আসবে সেই প্রেম গাঢ় হবে বেশী। প্রেম মানে শুধু বিয়ে করা নয়। প্রিয় মানুষটিকে সর্বদা ভালোরাখাও হচ্ছে প্রেম। মানুষের জীবনে অনেক সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু সেই সমস্যার জন্য জীবনের আনন্দময় সময়টাকে নষ্ট করে দেওয়া উচিত নয়। প্রেমিক-প্রেমিকাকে হতে হবে ধৈর্যশীল ।আজকাল যুগলদের মাঝে এই ধৈর্য্যটার বড্ড অভাব। জীবনে কখনো কারো জন্য নিজেকে থামিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কারন সময় তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে আর জীবন সেই ধারাবাহিকতায় তার প্যার্টান চেঞ্জ করবেই। বুঝতে পেরেছো? ”
পূরবী মাথা নাড়িয়ে হা বলে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে,
” জীবন তার প্যার্টান চেঞ্জ করলেই হয় না সাথে সাথে নিজেকেও তার সাথে মানিয়ে নিতে হয়। প্রিয় মানুষটিকে সবসময় ভালোরাখাই যদি প্রেম হয় তাহলে হয়তো আমরা সবসময় সেই প্রেমের মর্যাদা দিতে পারি না। নিজেদের কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে সেই প্রেমের অবমাননা করি। আমাদের উচিত সেই প্রেমের মূল্য দেওয়া। ”
রুকু মুচকি হাসে।
” আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছো দেখি। ভালো। বেশ ভালো। ”
” আমার কথায় কিছু মনে করবেন না ফুপি। ভূল বললে ক্ষমা করবেন। ”
” পূরবী তুমি বরং কালো এসো। আমি এখন রেস্ট নিবো । ”
পূরবী নিঃশব্দে প্রস্থান করে ।

চলবে,


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here