#ভাগ্যবতী
#পর্ব_১
__________________

১.
আগামীকাল পূরবীর বিয়ে এক হিন্দু ছেলের সাথে। পূরবীর মামা মুসলিম হয়েও টাকার লোভে হিন্দু ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে পূরবীকে। পূরবীর বাপ ভাইয়ের কানেও এই বিয়ের খবর দেওয়া হয়নি । একপ্রকার গোপনেই এই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি ভর্তি গম গম করছে লোকজন। অর্ধেক হিন্দু তো অর্ধেক মুসলিম। কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না। সবার মুখেই কুলুপ আটা। মোল্লা-মুসুল্লিরা এ পাড়া আগেই ত্যাগ করেছে। বাইরে গিয়ে ছি ছি করছে। পঁচিশ বছর আগে এ গ্ৰামে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে অনর্থ ঘটিয়েছিলো সাজু। তারপর ধরে বেধে সেই মেয়েকে ঈমান আনিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ আবার সেই সাজুই তার বউয়ের এক দুর-সম্পর্কের ভাইপোর সাথে ভাগিনীর বিয়ে দিয়ে অনর্থ ঘটাতে যাচ্ছে। এ ব্যপারে কিছু যেনো তাদের হাতে নেই। মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে বিয়ে দিচ্ছে ভাগিনীকে এটা বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই জানে। তার উপর যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে থানার মধ্যে নাম করা গুন্ডা। পাঁচ ছয়টা মাডার কেস ও থানায় আছে তার নামে। কিন্তু কেউ তার ধারে কাছে ঘেসতে সাহস পায়না। সব টাকা আর ক্ষমতার জোরে। আশু দা বলে সবাই তাকে একনামে চিনে। শকুনের নজরে পড়েছে নিষ্পাপ মেয়েটা। নিজ জাতের মেয়ের দিকে এক বার নয় হাজারবার দিক তাতে কিছু যায় আসেনা কিন্তু অন্য জাতের মেয়ের দিকে নজর কেনো দিবে? একথা যে বলবে তার যে ঘাড়ে আর মাথা থাকবে না সেটা সবাই ভালো করে জানে। তবুও যেনো ছটফটানি কমছে না। বার বার আল্লাহকে ডাকছে যেনো এই অনর্থ না ঘটে।
পুরোহিত সহ অনান্য হিন্দু ব্যক্তিবর্গ চুপচাপ আছে । এবার তাদের পাল্টা জবাব দেবার পালা। সাজুর থেকে জাহ্নবীকে আলাদা করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। মোল্লারা তা হতে দেয়নি। বরং ধর্মান্তরিত করেছে তাদের জাতের মেয়েকে। এবার তারাও ধর্মান্তরিত করিয়ে পাল্টা জবাব দিবে। এ এলাকায় অর্ধাঅর্ধী হিন্দু মুসলিমের বাস। তাই যেনো ছেলেমেয়েদের চোখা চোখী বেশীই হয়। সেভাবেই একদিন আশুর নজরে আসে পূরবী। রুপ লাবণ্যময়ী যৌবন ছুই ছুই এই কিশোরীর রুপেই মোহিত হয়ে গেলো। তারপর থেকে শুরু হলো প্রতিনিয়ত ইভটিজিং। এসব থেকে বাঁচার জন্য পূরবী বেছে নেয় বোরখা। তবুও ছাড় নেই তার। বোরখা খুলে স্বাভাবিক ভাবেই কলেজ যাতায়াত করতে বাধ্য করে আশু। তার কুদৃষ্টি চলে পূরবীর পুরো শরীরের উপর। চোখ বন্ধ করেই যেনো সে দেখতে পায় পূরবীকে। অনেক চেষ্টা করেও সে পূরবীকে হাতের নাগালে পায়না। অবশেষে জাহ্নবীকে হাত করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার জন্য ঘুস দেয় মোটা অংকের টাকা। সেদিন থেকে পূরবীকে আটকে রাখা হয় ঘরে। বাপ-ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় ও জাহ্নবী সাথে সাথে থাকে যেনো পূরবী কিছু বলতে না পারে। দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে আসে। আজ গায়ে হলুদ তো কাল বিয়ে। এসব সহ্য না করতে পেরে পূবরী খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সে। জানতে পেরে সাজু ডাক্তার ডেকে এনেছে। রুমে ঢুকে দেখে তার আদরের ভাগিনী বিছানায় অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। বুকটা ধরফর করে উঠে তার। মা মরা ভাগিনীকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে সে। ভাই বৌয়ের সংসারে থাকতে কষ্ট হবে জন্যে নিজের সংসারে এনে রেখেছে। মায়ের ভালোবাসা না পাক মামীর ভালোবাসা টুকুতো পাবে। কিন্তু সেই মামীই যে তার জীবনের সর্বনাশ করবে তা কে জানতো? দু-চোখে জল টলমল করে উঠে তার। ডাক্তার পূবরীকে দেখে ঔষধ লিখে দেয়। সাথে একটা ইনজেকশন ও পোষ্ট করে দেয়। অভয় দিয়ে বলে,
” কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে। ভয়ের কিছু নাই। শরীর অতিকায় দূর্বল। না খেয়ে এই অবস্থা। তো সাজু সাব কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম। আমরা এলাকায় থাকি। সবই জানি। মেয়েটারে এইভাবে জলে ভাসিয়ে দিতেছেন কিভাবে আপনারা? নিজের মেয়ে হলে কি পারতেন? ”

পূরবীর হাত ধরে বসেছিলো জাহ্নবী। ডাক্তারের কথা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সে। কটমট করে বলে, ” পূরবী আমাদের মেয়ে জন্যই তো অত বড় ঘরে বিয়ে দিতেছি। এটারে জলে ভাসানো বলেন কেন? আমাগো মেয়ে আমরা বুঝমু। ”

” এইটা কখনোই সম্ভব না। হিন্দু মুসলিমে বিয়ে আল্লাহর দরবারে কবুল হয়না। আশু গুন্ডা ধর্মান্তরিত না হয়ে বিয়ে করতে পারবো না। ”

” খবরদার গুন্ডা ডাকবেন না আমার ভাইপোকে। জামাই হতে যাচ্ছে এবাড়ির। মুখ সামলে কথা বলবেন। আপনার কাজ শেষ হলে বিদায় হন। ”

ভারী মুখে বিদায় নেয় ডাক্তার। জাহ্নবী রাগে গজ গজ করতে করতে বলে, ” এদের এইসব কথা বার্তায় মাইয়াটা না খাইয়া অসুস্থ হয়ছে। কত সুন্দর করে বোঝাইতে বোঝাইতে এতোদিন ঠিকঠাক রাখছি এখন বাগড়া দিতাছে কথায় কথায় আশেপাশের মানুষগুলো। বিভীষণ এরা সব বিভীষণ । কতগুলা টাকা পাইছি। সামনেই আমার বকুলটার বিয়ে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্বর্ণে মোড়িয়ে দিবো আমি। ডিমানের টাকা সহ ফার্ণিচার দিয়ে ভরপুর করে দিবো। মেয়েটার সুখেই যে আমার সুখ। ”

সাজু থু থু ফেলে। ছিহ জাহ্নবী ছিহ। এইনা তুমি নিজের মেয়ে মনে করো আমার ভাগনীকে? মা মরার পর তো তুমিই মায়ের আদর দিবা বলে নিজের কাছে নিয়ে আসলে । কত যত্ন করে বুকে এতোদিন ধরে রাখলে। আজ তোমার এই রুপ!

জাহ্নবী মৃদু হেসে বলে, তো যত্ন করবো না? মাসে মাসে যে অতগুলা করে টাকা পাঠাতো ননদাই সেইগুলা তো আমার হাতেই থাকতো।

হিস হিস করে উঠে সাজু। তোমার ভিতরটা এতো কালো জানলে আমি কোনদিন তোমাকে বিয়ে করতাম না। তোমার মাঝে ধর্ম নেই ,ন্যায় নীতি, মায়া মমতা কিচ্ছু নেই। পাষান তুমি। তোমার মতো লোভী মহিলা আমি কখখোনো দেখি নাই। তোমার প্রতি ঘৃণা ছাড়া কিছুই আসছে না আমার।

এতো বড় বড় কথা বলোনাতো। আমি লোভী কে বললো তোমাকে? আমি শুধু সুযোগে সদ্ব্যবহার করে কিছুটা হাতিয়ে নিলাম। মায়া দয়া আমার মধ্যে আছে জন্যই তোমার ভাগনীর বিয়ে দিচ্ছি। তুমি কি ভেবেছো ঐ আশু তোমার ভাগনীকে ছেড়ে দিবে? বিয়ে দিতে না চাইলে ধরে একেবারে কুকুরের মতো খেয়ে ছাড়তো। রাস্তায় ফেলে রাখতো। আমি মামী হয়ে তা কি করে হতে দেই? পূরবীকে বাচিয়ে রাখার জন্যই রাজী হয়েছি। আমি বাধ্য হয়েছি।

দু হাতে মুখ ডেকে হো হো করে কেঁদে উঠে সাজু। পূরবীর পাশে বসে বলে,
” আমি তোকে বাঁচাতে পারলাম না রে মা। শেষমেশ তোর এই রুপই তোর কাল হয়ে দাঁড়ালো। তুই কুৎসিত কেনো হলিনা মা.. তাহলে তো তোকে এই দুহাতে কোন শকুনের হাতে তুলে দিতে হতোনা আমার। আমাকে ক্ষমা করিস তুই। ”

জ্ঞান ফিরেই মামার কথাগুলো শুনতে পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে পূরবী। আমি ঐ গুন্ডাকে বিয়ে করবোনা মামা। আমি মরে যাবো। বলেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। জাহ্নবী সাজুকে টেনে বের করে নিয়ে আসে রুম থেকে।

২.
দুপুরের কড়া রোদ। যদিও ঠান্ডা বাতাস বইছে তাই অতোটাও গরম লাগছে না। ছেলের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব এসেছে বলেই একজন চিৎকার করে উঠে। বকুল, সাজু তাদের আদাব জানায়। ভেতরে আসতে স্বাগতম জানায়। নির্দিষ্ট জায়গায় তত্ব গুলো রাখে। বউ দেখবে বলে সবাই পূরবীর রুমে ঢুকে পড়ে। পূরবীর রুমে ছিলো জাহ্নবী। পূরবীকে কিছুতেই গায়ে হলুদের শাড়ি পড়াতে পারছে না জাহ্নবী। সেই কখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে। দু বার গায়ে হাত ও তুলেছে। তাতে কাজ হয়নি। পূরবির এক কথা সে গায়ে হলুদ করবে না। এই বিয়ে সে কিছুতেই করবে না। দাত দিয়ে শাড়ি ছেঁড়ার চেষ্টাও করেছে। ছেলের বাড়ির লোক এসে দেখছে এসব। জাহ্নবীর লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা। মান সম্মান বুঝি এবার তার খোয়া গেলোই। এখন যদি ওরা বলে বসে, এতোগুলো টাকা নিয়েও এখনো মেয়েকে বাগে আনতে পারেননি তখন কি উত্তর দিবে জাহ্নবী? পূরবীকে টেনে দাড় করায় সে। এবার শাড়ী পড়াবেই। ছেলেপক্ষের একজন বলে উঠে, ” এতো লাফালাফি না করে শাড়িটা পড় না বাপু। আমাদের আশুর গায়ের হলুদ তোমার গায়ে লাগাবে যে। ”
” লাগাবো না আমি। কিছুতেই লাগাবোনা। মানিনা আমি এই বিয়ে। ” চিৎকার করে বলে উঠে চোখের পলকেই তত্বের কাছে চলে যায়। একটা ছুরি খুঁজে নিয়ে বিছিয়ে রাখা তত্বগুলো কেটে কুচি কুচি করতে থাকে। আশুর গায়ের হলুদের বাটি তুলে ধরে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আশুর বোন আর জাহ্নবী ধরতে ধরতেই এই দূর্ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলে পূরবী। জাহ্নবী চিৎকার করে উঠে ততক্ষনে হলুদ সম্পূর্ণ মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। পূরবীর গা রাগে হির হির করে কাপছে। বাকি তত্ব গুলোও মাটিতে ফেলে দিবে বলে হাত দিতেই জাহ্নবী হাত ধরে টেনে গালে দুটো চড় কষিয়ে দেয়। আশুর বোন ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
” সমস্যা কি তোমার? কেনো এমন করছো? ”

” আমি কিছুতেই আপনার ভাইকে বিয়ে করবোনা। বুঝেছেন আপনি? ” ভয়ংকর রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে কাপছে পূরবী। এ রুপে শান্ত শিষ্ট পূরবীকে কেউ কখনো দেখেনি। তাই দমে যায় একটু।তারপর নরম সুরে বলে,

” দেখো পূরবী আমাদের দিক থেকে তোমাকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমার ভাইয়ের চোখে লেগে গেছো তুমি। আমার ভাই তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। এরপর কারো কিছু বলার থাকে না। তুমি না চাইলেও করার কিছু নেই। তোমার সমস্যা হবে এটা আমরাও বুঝি। এক ধর্মের লোক হয়ে অন্যধর্মের কাউকে বিয়ে করা সহজ কিছু না। তুমি যতই ধর্ম ভীরু হয়ে থাকো না কেনো সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। দু ধর্মে কি বিয়ে হয়না? তোমার মামা মামীই তো ভালোবেসে বিয়ে করেছে। তোমার মামী ধর্মান্তরিত হয়েছে। তুমি চাইলে তোমার ভালোবাসায় যদি আমার ভাইকে ধর্মান্তরিত করতে পারো তাহলে আমরা কোন বাধা দিবো না। অন্য ধর্মের প্রতি তোমার সম্মান থাকা উচিত। ”

” আপনি যেমন মানুষ আমিও তেমনি মানুষ আপু। পৃথিবীতে ভালোবেসে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে এরকম অনেক বিয়ে করছে। প্রত্যেক ধর্মের প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান আছে। কিন্তু কোন অমানুষের প্রতি সম্মান নেই। আপনার ভাইয়ের প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নাই ভালোবাসা তো দূরে থাক। ভাই একটা চরিত্রহীন, খুনি, লম্পট, গুন্ডা, মাতাল। তাকে দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করে। বমি আসে আমার। আমার ধর্মের হলেও আমি তাকে কোন ভাবেই গ্ৰহন করতাম না। নিয়ে যান এসব। আপনার ভাইও আমাকে ভালোবাসে না। এটা উনার জিদ ছাড়া কিছুই নয়। আমাকে ছেড়ে দেন। রেহাই চাই আমি। ”

এর পরে আশুর বোনের আর কিছু বলার থাকে না। পূরবী যা বলছে তা একদম ঠিক। তার ভাই একটা অমানুষ সে জানে। আজ পূরবীর পিছু ছুটেছে। পূরবীকে হাসিল করার পর যে সে আরেক পূরবীর জীবন নষ্ট করার পথে এগুবে তা সে ভালো করেই জানে। ভাইয়ের আচার আচরন চরিত্র যে তারও পছন্দের নয়। সে যদি পূরবীর জায়গায় থাকতো তাহলে কি মেনে নিতে পারতো আশুকে? কখনোই না। কিন্তু পূরবীর ভাগ্যটাই খারাপ। তার জন্য খারাপ লাগছে। তার নিয়তিতে হয়তো এটাই লেখা ছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। গায়ে হলুদ আর দেওয়া হলো না। হলুদ তো কবেই নষ্ট হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় শুধু এটুকুই বলে যায়,
” নিজেকে তৈরি করো। গায়ে হলুদ না হলেও বিয়েটা কাল হচ্ছে। ”

[ উপন্যাসটির ধরন সামাজিক এবং রোমান্টিক ক্যাটাগরি।কোনো ধর্মীয় গোড়াবৃত্তীক ভিত্তিতে লেখা নয়। এখানে দুই ধর্মের চরিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো উপন্যাস না পড়ে ধর্মীয় ভিত্তিতে কোন মন্তব্য করবেন না। এখানে দুই ধর্মের মধ্যে কোন বিবাহ হবে না। কোন ধর্মকে আঘাত করবে না। বরং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্মে অটুট থাকবে। আশা করি উপন্যাস টি আপনাদের ভালো লাগবে। ]

চলবে,

লাবিবা তানহা এলিজা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here