—ভাইয়া,, এই ছেলেটাই গতকাল আমার ওড়না ধরে টান দিয়েছিলো।
আমি শুধু এটুকু কথাই স্বজ্ঞানে শুনেছিলাম। এরপর থেকে কিল-ঘুষি আর লাথি খেতে খেতে কলেজ গেটের সামনেই লুটিয়ে পড়ি।
এবার পুলিশ জিজ্ঞেস করলো,,
—আচ্ছা তারপর কি আর কিছু টের পাননি আপনি..?(পুলিশ)
–নাহ্..। তবে, মেয়েটির কণ্ঠটা খুব পরিচিত মনে হয়েছিলো।(আমি)
—আচ্ছা যারা আপনাকে মেরেছিলো তাদের কারোর চেহারা দেখেছিলেন কি..?
–নাহ্ স্যার….দেখিনি।
কথাটি শুনে পুলিশটি মুচকি হাসি দিলো। এবং পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীদের দিকেও তাকালো। নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কি যেন কথোপকথন করে নিলো ওরা। আমি এই এলাকায় নতুন। নতুন বলতে, আড়াই মাস হয়েছে এসেছি। বাবার ট্রান্সফার হওয়াতে টিসি নিয়ে এখানকার কলেজে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুরা কেউ নেই। টিুটু, জামিল, রাহাতরা সবাই চট্রগ্রাম। ওদেরকে এসবকিছু এখনো জানাইনি। জানলে, দলবেঁধে সবাই চলে আসবে।
বাবা ঔষধ আনতে গেছেন। মা আমার পাশেই বসা। আমার উপর তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে, আমি কখনো এমনটি করতে পারিনা। তবে, ঠিক কারা আমাকে এভাবে পেঠালো…?
আর কেনইবা পেঠালো সেটার রহস্য ভেঁদ করতেই হবে। আর মেয়েটি কে ছিলো যে আমাকে ইচ্ছে করে নিজের ভাই আর তার বন্ধুদের হাতে এভাবে মার খাওয়ালো? এমন নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো আমার।
পুলিশ চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বাবা আসলেন। বাবা আসতেই বাবাকে মা জিজ্ঞেস করলেন,
—ছেলেটাকে নিয়ে কবে বাসায় যেতে পারবো ডাক্তার কি কিছু বলেছে?(আম্মু)
বাবা তার হাতে থাকা কলা-ব্রেড আর ঔষধগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
—তিনদিন থাকতে হবে এখানে। এর আগে নেয়া যাবেনা। পায়ের আঘাতটা গুরুতর। লাঠি দিয়ে মনে হয় আঘাত করেছিলো। এক্সরে রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললো, ‘সপ্তাহ খানেক পর স্টিকের সাপোর্ট নিয়ে হাঁটতে পারবে। তবে, পুরোপুরি সেরে উঠতে মাস দেড়েক লেগে যাবে।(আব্বু)
আমার পায়ে ব্যথা অনুভূত হচ্ছিলো ঠিকই।
তবে, এতটা গুরুতর আঘাত পেয়েছি সেটা বাবার মুখে শোনার পর নিশ্চিত হলাম। আমাদের ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে। যদিও কিছুদিন হলো এখানে এসেছি মাত্র খুব কম সময়ই লেগেছে সবার সাথে মিশে যেতে। বাবার সামনে আর মাকে বললাম না ফোনটা দিতে। বাবা মাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
এবং বলে গেলেন, তিনি রাতে আসবেন আবার। এবং রাতের খাবার নিয়েই আসবেন।
তারপর বাবা চলে যাবার পর মাকে বললাম,
–আম্মু আমার ফোনটা দাওতো!(আমি)
—তোর ফোনের ডিসপ্লে দেখলাম ফেটে গেছে। নষ্ট গেছে মনে হয়। (আম্মু)
কথাগুলো বলতে বলতে ব্যাগ থেকে ফোনটি বের করলেন আম্মু। এবার ফোনটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। হাতে নিলাম ফোনটা। সত্যিই ফেটে গেছে। প্যাটার্ন লক খুলে ডাটা অন করলাম। ডাটা কানেকশন পাবার সাথে সাথেই যেন তুফান শুরু হয়ে গেল টুংটাং টুংটাং শব্দে। বেশিরভাগই গ্রুপ মেসেজ।
তারপর গ্রুপে ঢুকলাম। আলোচনার টপিক আমিই। সবাই আমার মার খাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করছে।
তাদের মধ্যে একেকজন একেক কথা বলছে,
—নাহ্, নীলয় এমনটি কেন করবে..? ওকে তো এই কদিনে এরকম কিছু মনে হয়নি।(বান্ধবী রিতু)
—আরে নীলয় কেন নীলার ওড়না ধরে টান দিতে যাবে? আর তাছাড়া, নীলার তো বয়ফ্রেন্ড আছে। আর সেটা নীলয় সহ আমরা সবাই জানি। তাহলে কি করে এটা হতে পারে…?(শিউলি)
—“আরে শোন তোরা,, নীলয় যদি নীলার ওড়না ধরে টান দিয়েও থাকে তাহলে সেটা আমরা কেউ বা কলেজের আর কেউ দেখলোনা কেন..?
নাহ্, নীলা কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। তোরা কি বলিস..!(তানিয়া)
—আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এটি একটি চক্রান্ত। তবে, হলে হতেও পারে। নীলয়ও তো মানুষ। ফেরেশতা তো নয়। করতেও পারে এই কাজ..!(সিফাত বলছে)
সিফাতের এই কথাটিতে গ্রুপে এক্টিভ থাকা সবাই এ্যাংগ্রি রিয়েক্ট দিলো। বুঝতে পারলাম, বাকি সবাই ওকে উল্টো ভাবছে। মানে, তারা ভাবছে এমন কাজ আমি করতে পারিনা।
তারপর আমি মেসেজ সিন করছি দেখে কয়েকজন আমাকে মেনশন করে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি আর কোথায় আছি আমি। আমি এবার লিখলাম।
–দেখো, সবেমাত্র কদিন হলো এই কলেজে আমি এসেছি। সামনেই টেস্ট এক্সাম আর তারপর ফাইনাল। আমি নিজের হয়ে ওকালতি করতে চাইনা।
আমি কি আর কেমন সেটা এতদিনে সবারই জানা এবং বুঝার কথা। যাই-হোক, কে আর কেন আমাকে এভাবে মার খাওয়ালো সেটা এখনো জানতে পারিনি আমি। তবে শীঘ্রই জেনে যাবো।
আর আমি ভালো আছি। আরো তিনদিন হসপিটালে থাকতে হবে। তারপর বাসায় যেতে পারবো।
আর কলেজে কবে নাগাদ আসতে পারবো জানিনা। তোমরা দোয়া করো আমার জন্য।
আর, কোনরকম নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণ ছাড়া দয়া করে কোনরকম মিথ্যা অপবাদ কেউ আমাকে না দিলে খুশি হবো।
আর নীলা কি করেছে না করেছে সেটা স্পষ্ট নয় আমার কাছে। আমি সব না জেনে কিছু বলতে চাইনা। ভালো থেকো সবাই।
এরপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ত্রিশজন মেসেজটি সিন করলো। গ্রুপে আমার কথাগুলোর জবাবে আর কেউ কিছু বলেনি। আমি এবার ডাটা অফ করে বেরিয়ে পড়লাম চ্যাট থেকে।
রাত আটটার দিকে বাবা খাবার নিয়ে আসলেন।
এরই মধ্যে খবরটি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় কয়েকদফায় কলেজের পাতি নেতা থেকে শুরু করে ছাতি নেতারা আমাকে দেখতে আসলো।
এর পেছনের কারণ হলো, সামনে নাকি কলেজে নির্বাচন আছে। আমি সেলিব্রিটি না হলেও আহত একজন শিক্ষার্থীকে দেখতে এসে হাতে কেকের বাক্স, ফ্রুট বাস্কেট ধরিয়ে দিয়ে তারা ঠিকই অর্ধশত ছবি তুলে নিয়ে গেল। সাথে এখানে থেকেই আমার ফেসবুক আইডি বের করে রিকোয়েস্ট দিয়ে একসেপ্ট করিয়ে আমার ছবি দিয়ে তাদের সমবেদনার ছবিসহ পোস্ট দিলো। সন্ধা থেকে রাত আট টার মধ্যে মোটামুটি নিজেকে আহত সেলিব্রিটিই মনে হলো আমার। একবার তো আমি মনে ভাবলাম, ‘যাক, যাই হয় ভালোর জন্যই হয়। আজ মার না খেলে কি এসব পাতি আর ছাতি নেতারা এসে আমার সাথে ছবি নিতো? ভালোই হলো, একপ্রকার পাবলিসিটিও পেয়ে গেলাম!’
তারপর বাবার নিয়ে আসা খাবার খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। শুতেই কল আসলো একটা। ফোন হাতে নিয়ে দেখি জামিল কল দিয়েছে। রিসিভ করলাম আমি।
তারপর ওপাশ থেকে,জামিল
—কিরে দোস্ত, কি হয়েছে তোর? কে মেরেছে তোকে?
ওর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। বললাম,
–আরে বোকা কি বলছিস এসব! আমাকে আবার কে মারবে?
এবার জামিল রেগে গেলো। আর আমাকে বললো,
—আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ডের বড় ভাই তার বন্ধুর দেয়া পোস্ট শেয়ার করেছে। তাতে আবার আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড কমেন্ট করেছে আর সেটাই আমার নিউজফিডে শো করেছে।(জামিল)
–তো তাতে আমার কি হয়েছে?(আমি)
—নীলয় তোর কিছু হয়নি মানে? সেখানে ছবিতে জনৈক ছাত্র নেতাকে দেখলাম তোর হাতে ফ্রুট বাস্কেট তুলে দিচ্ছে আর তুই হসপিটালের বেডে শুয়ে আছিস। এতকিছু হয়ে গেল আর আমরা কিছুই জানিনা!
আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা জামিল কি করে কি জানলো। আজকাল ফেসবুকই যেন অন্যতম আর শক্তিশালী মিডিয়া হয়ে ওঠেছে।
নিমিষেই সবকিছু ছড়িয়ে পড়ছে। এবার জামিলকে বললাম,
—বন্ধু শোন মাথা গরম করিসনা। তেমন কিছু হয়নি। কয়েকদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাব। দোয়া করিস। আর টিটু রাহাতকে বলিস যেন দুশ্চিন্তা না করে।
—আমরা আগামীকাল আসছি। প্রয়োজনে আমরাও টিসি নিয়ে তোর কলেজে এসে ভর্তি হবো। তোর সাথে তোর বাসায় থাকবো। আসছি কাল।(জামিল)
জানি, ওরা বড্ড ভালোবাসে আমায়। এবার আমি মাকে বললাম,
–মা, এই নাও, জামিলটাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো। তোমার কথা শুনবে। আমার কথা কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা।(আমি)
মা এবার ফোনটা হাতে নিলেন এবং কেবিনের বাইরে চলে গেলেন।
তারপর রাত দেড়টার দিকে আমার ফোনে একটি কল আসলো। অপরিচিত নম্বর। রিংটোন বেশিক্ষণ বাজতে পারেনি। তার আগেই সাইট বাটনে চেপে সাইলেন্ট করে ফেলেছি। রিসিভ করলামনা। মেসেজ দিলাম ঐ নম্বরটিতে।
–কে আপনি?(আমি)
রিপলাই আসলো,
—আপনার শরীরটা কেমন এখন?
আমক এড়িয়ে গেল আমার প্রশ্নটা। আবার বললাম,
–আগে আপনার পরিচয় দিন! কে আপনি?
রিপলাই আসলো,
—ঔষধ খেয়েছেন..?
আমার প্রশ্নগুলো এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে কৌতুহল জাগলো মনে। বললাম,
–শুনুন..! আপনি যদি পরিচয় না দেন তাহলে আর কোন রিপলাই দিবনা আমি।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল। প্রায় মিনিট দশেক পরে রিপলাই আসলো,
—আপনাকে আমি মেসেজ রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। যদি একসেপ্ট করতেন তাহলে সেখানেই কথা বলতাম।
মেসেজটি দেখার পর ডাটা অন করে এক্টিভ স্টেটাস অফ করে মেসেজ রিকোয়েস্ট লিস্ট চেক করলাম। হ্যা, ‘জীবন তরী’ নামক আইডি থেকে লিখেছেন,
—আমি বলছি। মাত্র যে মেসেজে কথা বলছিলাম।
রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলাম। প্রোফাইল আইডি চেক করে এমনকিছু পেলাম না যা থেকে কোন আইডিয়া করতে পারবো যে ব্যবহারকারীর বাড়ি কোথায় কিবা সে কি করে। এবার আমি বললাম,
–জ্বী, এবার পরিচয় দিন আপনার!
—আমাকে চিনবেন না আপনি। আপনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন সেটা যদি বলতেন তাহলে খুব খুশি হতাম।(রিপ্লে দিলো
বুঝতে পারলাম, আর যতই বলিনা কেন পরিচয় দিবেনা। সেজন্য আমি বললাম,
–হ্যাঁ আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
—আলহামদুলিল্লাহ্, খুশি হলাম। তবে হ্যাঁ,,
আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন৷ মন থেকে ক্ষমা করবেন। কারণ, আপনার এমন অবস্থার জন্য আমিই পুরোপুরি দায়ী।
কেন আর কিভাবে দায়ী সেটা দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না। আমাকে আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারেন। আমি আবার আপনাকে অন্যকোন সময় মেসেজ করবো।
দয়া করে উত্তর দিয়েন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আপনি যেন শীঘ্রই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আপনি যেদিন কলেজে যাবেন শুনবো আমিও সেদিনই কলেজে যাবো। এর আগে নয়। এতে আমার কোন ক্ষতি হলে হোক। পরোয়া করিনা। ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।(রিপ্লে দিলো)
মেসেজটি পড়ার পর আমি রিপ্লে দিতে যাব এমন সময় দেখি আইডি ডিয়েক্টিভ করে ফেলেছে।
ঐ নম্বরে কল দিলাম কিন্তু নম্বরটিও বন্ধ বলছে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম আমি। কি ব্যপার, আমার এত খবর নিলো আবার আমার এই অবস্থার জন্য সব দায় নিজের উপরে নিয়ে ক্ষমাও চাইলো!
কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম আমি। কিন্তু কিছুই করার ছিলোনা। কোন সূত্র ছিলোনা আমার কাছে তাকে শনাক্ত করার জন্য। ভাবতে লাগলাম আমি।
–কে এটা?
.
.
চলবে……………♥♥
গল্প :- কালো মেয়েটি
পর্ব :- ০১
Writer :- Kabbo Ahammad