#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ১৭) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা

বাইশ.
শুনতে শুনতে অন্বেষার বুকটাও ভারী হয়ে এলো, হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল ভারিক্কি চালে অভ্যস্ত আজন্ম কঠিন লোকটার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চাপা যন্ত্রণার আর্তনাদ, অশ্রু যেন বড্ড বেপরোয়া আজ, আবিদের কথাই যেন শুনছে না! অন্বেষার মনে হচ্ছিল আবিদের কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদা উচিত, নয়তো বুকে আসন গেড়ে বসা কষ্টের জগদ্দল পাথরটা কিছুতেই নড়বে না!

পুরুষের কাঁদতে নেই, আবেগের প্রকাশ করতে নেই এসব বুলি অন্বেষার কাছে ভীষণ অর্থহীন আর অন্তঃসারশূন্য মনে হয়। ওরা তো মানুষই, নাকি কষ্টেরাও নারীতে পুরুষে ভেদাভেদ করতে জানে? কষ্ট সবারই হয়, মাঝে মাঝে এতটাই সীমানা অতিক্রম করে যায় যে তা পুরো হৃদয় দখল করে শিকড় গেড়ে বসে যায়। তখন সে ব্যথা উগড়ে ফেলতে হয় শিকড়সমেত। এরজন্য খুলে দিতে হয় হৃদয়ের সমস্ত আগল। তাতেই না দুঃখ, ব্যথারা হৃদয়ের ফাঁক গলে কান্না হয়ে বেরিয়ে যাবার অবকাশ পায়। নয়তো তা বুক চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে মারে, সে হোক পুরুষ কিংবা নারী। তাই সেই পাথরচাপা কষ্টগুলো কান্নায় ঝেড়ে ফেলতে হয়। কান্না সবসময় দুর্বলতার প্রকাশ হয় না, এটা গা ঝাড়া দিয়ে নতুন করে উঠে দাঁড়াতে প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে।

আবিদকে দূর থেকে দেখে অন্বেষার মনে হয়েছিল ভীষণ নাক উঁচু, আত্মম্ভরি এক লোক। কিন্তু কাছে আসতেই ওর এই ধারণা ভেঙে যায়, আজকের পর তো কর্পূরের মতো উবে গেল! কী আশ্চর্য! দূরত্ব ছোট হতেই মানুষটা একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল, নাকি ওর দেখার চোখ বদলে গেল!

আবিদ বহুদিন পরে মনের রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়েছিল, বুঁদ হয়ে গিয়েছিল সেই বিবর্ণ অতীতে। সামনে স্বল্পপরিচিত একজন বসে আছে এটাই ভুলে বসে ছিল। আচমকা তা খেয়াল হতেই নিজেকে আবারও খোলসে মুড়িয়ে ফেলল। কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল যেন! নিজের আবেগ অনুভূতি আড়ালে রাখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন। অন্যের সামনে বহুদিন নিজেকে মেলে ধরা হয়নি ওর। নিজেকে দ্রুতই ধাতস্থ করে বলল,

“এই ছিল অতসী আর আমার গল্প।”
“এরপর কী হলো?”
“এর আর কোনো পর নেই…..”
শেষ না করতেই অন্বেষার গলায় শ্লেষ, “মানে কী? অতসীর শেষ অনুরোধ, জাকির পরিনতি…… ”

আবিদ ম্লান হেসে বলল, “জাকির পরিণতি যা হবার ছিল তাই হয়েছে, আমি দেশে ফেরার ঠিক সাত মাসের মাথায় ওর লাশ পাওয়া যায়, ও মারা যাওয়ায় ওর প্রভাব আর থাকে না। বাকিটা পুলিশই করে, নতুন যে ক্ষমতায় আসে সে দক্ষ হাতেই সব সামলেছিল। ওর সব খারাপ কাজের বয়ান উপরমহল বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছিল। সবাইকে উদ্ধার করা হয়, তারপর ভাগ্য বিড়ম্বিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।” এবার উত্তর পেল আবিদের ‘উইমেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’কে ডোনেশন দেবার কারণ। আরেকটা প্রশ্ন মনে খচখচ করতেই করে বসল,
“কিন্তু জাকি কীভাবে খুন হয়েছিল?”

“জাকির মত লোকের শত্রুর অভাব হয় নাকি, ক্ষমতা নিয়ে অন্য গ্রুপের সাথে কামড়াকামড়িতে হয়তো শেষ হয়েছে!”

আবিদের চোখের দৃষ্টি যেন কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এই কথা বলার সময়, নাকি অন্বেষার দেখার ভুল! তবে আর কথা বাড়ায় না ও।

আবিদ আবারও মুখ খুলে, “জাকির খুন কিছু পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজেই ছিল কিছুদিন, তোমার মনে থাকার কথা নয়।”

আবিদ নিজের হাতে ওই মানুষরূপী অমানুষকে ওর প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছিল একথা সযত্নে এড়িয়ে গেল, যেমনটা এড়িয়েছিল সেই সময়। কিছু কথা না বলাই থাকুক না হয়!
“ফটোগ্রাফি ছাড়লেন কেন? আপনার ড্রীম প্রফেশন ছিল ওটা?”

“মন আর টানেনি, যার জন্য ভীনদেশে গিয়ে অতসীকে হারিয়েছি, সেটা করার জন্য আর মন থেকে সাড়া পাইনি! তাই ওটা বাতিলের তালিকায় ফেলে দিয়েছি সেই কবেই।”

“আপনি থাকলেই যে অতসীর সাথে এসব হতো না, তা তো আপনি বলতে পারেন না। তাছাড়া আপনি থাকলে হয়তো দুজনেই শেষ হয়ে যেতেন!”

“ওর খারাপ সময়ে ওর হাতটা তো ধরে রাখতে পারতাম, অভয় দিতে পারতাম কিছুটা হলেও। তাছাড়া এখনো যে বেঁচে আছি সেটাই বা কে বলল? এটাকে বেঁচে থাকা বলে কিনা আমার জানা নেই!”

আবিদের বিষণ্ন সুর অন্বেষাকে স্পর্শ করে ভীষণভাবে!
মুহূর্ত কয়েক নীরব থেকে প্রশ্ন করে,
“অতসীর আর আপনার পরিবারের লোকজন কোথায়? যতদূর জানি এই বাসায় আপনি একাই থাকেন!”

“একা কোথায়? সোহান থাকে, আরও দু’একজন তো থাকেই।”

“আমি আপনার নিজের লোকের কথা জানতে চাইলাম।”

“অতসীর বাবা এখন চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন, অবস্থার খুব একটা উন্নতি নেই। অতসীকে খোঁজেন বেশিরভাগ সময়। এখন তো অনেক বয়সও হয়ে গেছে। বেচারা, লোভ সব শেষ করে দিল!” দীর্ঘশ্বাস বেরোল একটা।

অন্বেষার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আবিদ বলল, “ওর মা মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে।”

“আর আপনার পরিবার?”

“ছোট ভাই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। বাবা ওর সাথেই থাকেন, নিজের সন্তানকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখতে কোন বাবা-মা চায় বলোতো? প্রাণপণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে ছোট ছেলের সঙ্গী হয়েছেন। নাতি নাতনিকে নিয়ে খুব ভালো আছেন, আমার জন্য প্রচন্ড রাগ জমে আছে। আর মা, সে-তো ছেলেকে সংসারী করার স্বপ্ন নিয়ে ব্যর্থ মনোরথে পারি জমাল ওপারেই!”

আবিদের চোখ চিকচিক করছে আবার, আজ আমি ঝরবই, এরকম একটা পণ নিয়ে নেমেছে যেন জলধারা!

অন্বেষার এবার সহানুভূতির চাইতে রাগটাই বেশি হলো, কী ভাবে নিজেকে এই লোক! নিগূঢ়তম কষ্ট অনেকেরই থাকে, তাই বলে তা আঁকড়ে কি কখনো বাঁচা যায়, না বাঁচা উচিত? নিজের কষ্টে আশেপাশের মানুষকে কেন কষ্ট দিচ্ছে এই লোক?

তীব্র ঝাঝের সাথে অন্বেষা বলল, “আপনি কখনো আপনার কাছের মানুষদের কথায় গুরুত্ব দেন না কেন? অতসীর কথা আপনি ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আপনার পরিবারের লোকেরা আপনার জন্য কষ্টে আছেন। অতসীও আপনাকে সামনে এগুতে বলেছিল, আর আপনি…”

সহসা থেমে গেল অন্বেষা, রাগের মাথায় বড্ড বেশিই অনধিকার চর্চা করে ফেলেছে ও। সাথে এলেবেলে ধরনের বেফাঁস কথাও বলে ফেলেছে। অন্বেষার কেবলই মনে হচ্ছিল বলে ফেলা কথা ফেরত আনার জন্য কোনো সিস্টেম থাকা উচিত ছিল, তাহলে অন্তত আজ বেঁচে যেত!

অন্বেষার কথাগুলো আবিদের হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল, ওকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সবকিছুর জন্য আবিদই দায়ী। ওর মনে গেড়ে বসা ধারণা আরও পোক্ত হলো। অতসীর তীব্র আকুতি ভরা কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠল চোখে, কেন সেদিন ওর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারল না?

ভেসে উঠল ওর মায়ের অনবরত চাওয়া, “বাবা, এবার নিজের দিকে একটু ধ্যানটা ফেরা। তোকে এভাবে দেখে আমার কতটা অশান্তি হয় তা কি বুঝতে পারিস? অতসীর কথাটাও ভাব, ও তো তোকে সামনে এগুতেই বলেছিল। তবে কিসের জন্যে থমকে আছিস? তোর একটা গতি না দেখে গেলে মরেও শান্তি পাব না রে!”

প্রতিনিয়ত এই কথাগুলোই বলতেন উনি। ছেলের জন্য দোয়া করতেন প্রতি নামাজে। শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন সব মায়া কাটিয়ে।

অন্বেষার কথায় মনে হতে থাকল এই জন্যও তো ও নিজেই দায়ী। আশেপাশের কেউ ভালো নেই, কাউকে ভালো রাখতে পারেনি ও। মিথ্যে ওর এই জন্ম, মিথ্যে এই বেঁচে থাকা! কী ভীষণ ব্যার্থ এক মানুষ ও, পরাজিতও কী নয়?

আচমকা উঠে চলে গেল ভেতরে, অন্বেষা কিছু বলার সুযোগ পেল না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব, কেন যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ভুলভাল বলে আবিদকে কতটা যন্ত্রণায় ফেলেছে এখন তা হাড়েহাড়ে টের পেল। অনধিকার চর্চা তো করেছেই, সাথে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে। এসবে আবিদের হাত তো কোথাও নেই, পুরোটা দোষ ভাগ্যের। অপরাধবোধের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া একজনের উপর আরও ভার চাপিয়ে দিয়েছে ও, নিজের অজান্তেই!

বাসায় ফিরতে ফিরতে অন্বেষার মনে খচখচানিটা বাড়ছিল অনবরত। তীব্র অনুশোচনা কাঁটার মতো বিঁধে থাকল হৃদয়ে, মননে। অস্বস্তি ঘিরে থাকল পুরোটা সময়।

প্রগাঢ় এক মায়া অনুভব করল আবিদের প্রতি, মনে হলো যে করেই হোক এই লোকের কষ্ট কিছুটা হলেও যদি কমানো যায়! সাত সমুদ্র ভালোবাসা জমিয়ে রাখা যায় বুঝি, এত লম্বা সময় ধরে! চিনচিনে ব্যথা বাজতে থাকল অনবরত পুরোটা হৃদয় জুড়ে!

অন্বেষার মনে হলো, কিছুকিছু মানুষ ভালোবাসার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, আবিদ সেই দলেরই একজন। আবিদের মতো কিছু লোক এখনো আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর, পঁচে গলে যায়নি সব! নয়তো কবেই চলে যেত আশফাকের মতো কাপুরষ কিংবা জাকির মতো অমানুষের দখলে!
…….
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here