বাসন্তী
শেষ_পর্ব
লেখা-লিমু
—” গলার স্বরটা শুনে পুষ্পর ভেতরটা কেঁপে উঠলো। মাথা তোলে তাকানোর সাহসটুকু পর্যন্ত পাচ্ছে না। সারারাত তার কথা ভেবেছে দেখে কি,এখন কন্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছে?
তুই কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছিস পুষ্প?
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে লাগলো সে।
ঠিক তখনি পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। হতচকিত হয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে তাকালো পুষ্প। আর সে মুখে কেমন যেন একটা রহস্যময় হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে পুষ্পর দিকে। পুষ্পর মাথাটা কেমন যেন ঘুরাচ্ছে। একে তো সারারাত জেগে ছিল,তারমধ্য এইমুহুর্তে ওর সাথে কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। ঘরের দরজা কি খোলা রেখেই ঘুমিয়েছিল রাতে? অবশ্য ঘুমায় নি তো,বসেই রাত পার করে দিয়েছে। কি জানি,হয়তো খোলাই ছিল।
কিন্তু প্রণয়কে ওর সামনে দেখে মনে হচ্ছে ভূত দেখছে। আর প্রণয় কোন কথা বলা তো দূরে থাক,ঠু শব্দটাও করছেনা। যে কারনে পুষ্পর মনে আরো বেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—” আপনি কি সত্যিই এখানে দাঁড়িয়ে আছেন,নাকি মরীচিকা?
—” ছুঁয়ে দেখতে পারো,এটা বলে প্রণয় ওর হাতটা বাড়িয়ে দিলো পুষ্পর দিকে। এবার পুষ্পর ঘোর কেটে গেল,তবে স্পর্শ করলোনা। তখন প্রণয় বললো,
—” ওপস….সরি, আপনি তো এখন অন্য কারো সম্পদ,সেখানে তো আমার কোন অধিকার নেই আর।
—” তাই না?
প্রণয়ের কথাটা,আর এমন ব্যাঙ্গ করে বলার ধরনটা পুষ্পর বুকে তীরের মতন বিঁধলো। সেই তীরে মনে হচ্ছে বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। এ যেন এক অন্য প্রণয় পুষ্পর সামনে দাঁড়িয়ে। এ প্রণয়কে পুষ্প চিনেনা। একদম চিনেনা।
—” আর চিনেইবা কি হবে এখন! ”
পুষ্প প্রণয়ের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু এ চোখে যে আজ ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছে না। কেমন তপ্ত,রুক্ষ হয়ে আছে। যেন অনেকদিন ভালোবাসা খুঁজে খুঁজে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। মরুভূমিতে জলের অন্বষণে থেকে থেকে মুসাফির যেমন হয়,ঠিক তেমন। চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
হঠাৎ মনে হয় সংবিত ফিরে পেল পুষ্প। কি ভাবছে ও।
আর কেনইবা ভাবছে?
এসব ভাবার কি আদৌ কোন মানে আছে এখন।
কি ভাবছে,প্রণয় এখনো ওকে ভালোবাসে?
একদম না।
পুষ্পর সেদিনের হুট করে নেয়া সিদ্ধান্তটা পুষ্পকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে তিনটা বছর ধরে। সবসময় মনে হয়,মেহের হয়তো অন্য কোন উদ্দেশ্যে ঐদিন কথাগুলো বলেছিল। পুষ্প বোধহয় বড্ড ভুল করে ফেলেছে।
একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবা উচিত ছিলো সেদিন। ঝোঁকের মাথায় নেয়া কোন সিদ্ধান্তই কখনো সঠিক হয় না। পুষ্পর সিদ্ধান্তটাও ওর জীবনের মারাত্মক ভুল হয়ে গেল। কারন প্রণয়ের চোখে কখনো কোন ফেক ভালোবাসা চোখে পড়েনি। একবারের জন্যও মনে হয় নি,প্রণয় ওকে ছেড়ে চলে যাবে। আর নিজের ইমেজ বাড়ানোর জন্য তো নয়ই। প্রণয় এমন ছেলেই নয়। তাহলে কেন এতোবড় বোকামিটা সে করলো!”
নিজেও ধুঁকে মরছে,যাকে ভালোবাসে তাকেও মারছে।
নিজেকে আজ চূড়ান্ত অপরাধী মনে হচ্ছে।
নিজের হাতে কেউ নিজের ভালোবাসা কি করে দাফন করতে পারে!”
—” তাও অন্য কারো কথায়।
—” প্রণয় কি কোনদিনও পুষ্পকে ক্ষমা করবে?”
—” কেনইবা করবে? তুই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না পুষ্প,যোগ্য না। এখন সব বুঝতে পারছিস,তাহলে তখন কি হয়েছিল। তুই তো কখনো এমন বোকামি করার মেয়ে ছিলি না।
নিজের ভালোবাসা নিজের বোকামির কারনেই হারালি,এখন কেন কাঁদছিস?
তোর কাঁদার কোন অধিকার নেই।
একদম কাঁদবি না,একদম না।
—” দুজনই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে,যেন বোবা হয়ে গেছে। মনে মনে হাজার প্রশ্ন , অথচ মুখে কথা নেই। এ কেমন ব্যাথা!
দুজন চেনা মানুষ,কি করে এতো অচেনা হয়ে যায়।
—” নীরবতা ভেঙে প্রণয় সহসা বলে উঠলো,
—” সত্যিই কি ভালোবাসতে আমায়,নাকি সব ধোঁয়াশা ছিল। টুপ করে একফোটা চোখের জল গড়িয়ে পরার আগেই,পুষ্প সেটা লুকিয়ে মুছে নিলো। একদম কাঁদবে না সে। প্রণয়ের সব কথার আঘাত সহ্য করার মতো শক্ত করতে হবে নিজেকে। একদম দুর্বল হওয়া যাবেনা। পুষ্পর এগুলো প্রাপ্য,যে অন্যায় সে করেছে প্রণয়ের প্রণয়ের সাথে।
—” এতো ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে হয়তো, একসাথে থাকতে পারতাম না। তাই নিয়তি আমাদের, আলাদা করে দিয়েছে।
মানুষ ঠিকই বলে,যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
তাহলে আমি একা কেন কষ্ট পাচ্ছি?
তুমিতো ঠিকই তোমার জীবন গুছিয়ে নিয়েছো,আমি বোকা কোন আশায় আজও বসে আছি।
—” তোমাকে গভীর প্রণয়ে বাঁধতে চেয়েছিলাম,সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো,তাই না? ”
—” স্বীকার করো, আর না কারো। মানো আর না মানো,তুমি নিজেও জানো আমার চেয়ে বেশি ভালো কেউ তোমাকে বাসবে না। আর এটাই তোমাকে প্রতিনিয়ত পোড়াবে,এটাই তোমার শাস্তি। তুমি আমাকে পাবেও না,ভুলতেও পারবেনা।
—” আমার ভালোবাসা ভুলার মতো শক্তি তোমার হয়নি,কোনদিন হবেও না। এটা আমার অহংকার নয়,বিশ্বাস। নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস। যেটা তোমার ছিল না আমার প্রতি।
—” একটা অদ্ভুত চাহনি নিয়ে তাকালো পুষ্প। প্রণয়ও পুষ্পর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু পরক্ষণেই দৃষ্টি অন্যদিকে নিক্ষেপ করলো। ঐ চোখে চোখ রাখলেই যে, প্রণয় আবার ডুবে যাবে। খেই হারিয়ে ফেলবে নিজের।
—” কিন্তু আজ আর সেই সুযোগ নেই।
—” আর কিছু বলার আছে আপনার? অনেকটা কঠোরতা বজায় রেখে কথাটা বললো পুষ্প। নিজেকে কঠিন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে প্রণয়ের সামনে। কোনভাবেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। ওর মনে কি ঝড় বইছে,সেটা প্রণয়কে ঘুনাক্ষরেও টের পেতে দিবে না।
—” প্রণয় চলে যেতে নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো। পুষ্পর একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
—” এখনো তো তুমি অন্য কারো হওনি।
তুমি কি শেষবারের মতো একবার আমাকে জড়িয়ে ধরবে?
করুণভাবে কথাটা বললো প্রণয়। পুষ্পর ভেতরটা ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি যেন হলো পুষ্পর,শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রণয়কে। যেন ছেড়ে দিলেই,হারিয়ে যাবে।
—” এ কেমন যন্ত্রণা? হারাতে দিতে চাইনা,আবার ধরে রাখার সাহসটুকুও যে নেই। পুষ্প দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেও, প্রণয় ঠিকই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেটা পুষ্পর কষ্টটাকে দ্বিগুণ করে দিচ্ছে। পুষ্প সরে যেতে নিলে,প্রণয় একটা ভয়ানক কাজ করে বসে। পুষ্প ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো,কি হলো মাত্র কিছুই বুঝতে পারছেনা। ওর সারা শরীর কাঁপছে অনবরত। এতোক্ষণ ধরে আটকে রাখা চোখের জলেরা,এবার লাঘাম ছাড়া হলো বোধহয়। একনাগাড়ে ঝরছে।
পুষ্পর মাথার পিছনে হাত রেখে প্রণয় বললো,
—” খারাপ মনে হচ্ছে আমাকে? সেটা তুমি ভাবতেই পারো,এখন আর তাতে কিছু যায় আসে না আমার। তবে তোমার যাবে আসবে। বিয়ের পর যখন তোমার স্বামীর স্পর্শ পাবে ঐ ওষ্ঠে,তখন প্রতিমুহুর্তে তুমি আমার স্পর্শ অনুভব করবে। আর এটাই তোমার চূড়ান্ত শাস্তি। আর একটা কথাও না বলে, একবারও পেছন দিকে না তাকিয়ে, প্রণয় তার বাসন্তীকে তার প্রণয়ে না বেঁধে, মুক্ত করে দিলো। বরাবরের জন্য।
পুষ্প বরফের মত জমে দাঁড়িয়ে আছে।
এটা কি করে গেল সে!”
দেখতে দেখতে বিয়ের দিনটা এসেই গেল। ঢাকার বড় একটা সেন্টারে প্রোগ্রাম হবে। আজ হলুদ। একটা সফট জর্জেট শাড়ি পরানো হলো পুষ্পকে। বাসন্তী রংয়ের, তার সাথে হালকা ফুলের গয়না। চুল টুইস্ট করে দুইপাশে এনে রাখা। পুষ্পই এতো গর্জিয়াস সাজতে চাইনি, কোন একজনের অপছন্দ ছিলো এতো সাজ। সে তো চলে গেছে,তাহলে পুষ্প কেন ভাবছে তার কথা। অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। এখন চারটা বাজে। পার্লারে আছে পুষ্প। সাথে কলি আর প্রিয়ম। হঠাৎ পুষ্প বলে উঠলো,
—” আমি উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবনা। তাই আর কাউকে বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না। কলি আর প্রিয়ম দুজন একসাথে লাফিয়ে উঠলো এটা শুনে। তারমানে ওদের প্লান সাকসেসফুল হতে চলেছে। ওরা দুজন বিভিন্নভাবে পুষ্পকে ইমোশনাল করছে গত কিছুদিন ধরে। আর আজ সকাল থেকে তো প্রিয়মও পুষ্পর বিয়ে এটেন্ড করতে এসেছে,ছোট ভাই হিসেবে। কিন্তু উদ্দেশ্য তো ছিলো ভিন্ন। ওরা বিয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্তও ওদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে তার আগেই ওরা সফল হয়ে গেছে। ঠিক তখনি প্রিয়মের ফোন বেজে উঠলো। প্রণয়ের ফোন। রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলো প্রিয়ম।
—” প্রণয় বলছে, আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনদিনও আসবো না। দেশে আসলেই যে,তার দহনে পুড়তে হবে আমাকে। সে ভালো আছে,এটা ভেবে আমিও দূরে গিয়ে ভালো থাকতে চাই। পাঁচটায় ফ্লাইট,ইচ্ছে হলে দেখা করতে আসিস। পুষ্প খপ করে প্রিয়মের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। কিন্তু তার আগেই প্রণয় লাইন কেটে দিয়েছে। আবার ফোন দিলো,কিন্তু ফোন উঠাচ্ছে না। পুষ্পর হাত পা কাঁপতে লাগলো,এখন কি করবে ও। অসহায় মুখে ওদের দুজনের দিকে তাকালো। ওরা দুজন একসাথে বলে উঠলো, একঘন্টা সময় আছে হাতে। মুখ দেখছো কি,ভাগো ভাগো। কলি বলে উঠলো, যাক অবশেষে ঐ খাটাশ ডিকবাল কে বিয়ে করতে হবে না। প্রিয়ম তাড়াতাড়ি ওর গাড়িতে উঠলো ওদের নিয়ে। একঘন্টার আগে চলে যেতে পারবে,যদি রাস্তায় জ্যাম না থাকে। সেন্টার থেকে এয়ারপোর্ট খুব বেশি দূরে নয়। প্রিয়ম মোটামুটি স্পিডেই গাড়ি চালাচ্ছে। তবুও পুষ্প তাড়া দিচ্ছে, আর কাঁদছে। আর বলছে,দরকার হলে আমি কান ধরে ক্ষমা চাইবো, তবুও কি ক্ষমা করবে না। এতোটা কঠোর হতে পারবেনা,আমি জানি। কলি মুচকি হাসছে পুষ্পর আবোল-তাবোল কথা শুনে। আর প্রণয়কে একটা টেক্সট করে রাখলো,যেহেতু ফোন রিসিভ করছেনা। আর মনে মনে প্রে করছে যেন ফ্লাইটে ওঠার আগে মেসেজটা দেখে।
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে জ্যামে আটকে গেল। দশমিনিটের মতো পথ বাকী। কিছুক্ষণ বসে থেকে পুষ্প গাড়ি থেকে নেমে গেল। সময় দেখলো, চারটা চল্লিশ বাজে। বসে থাকলে সব শেষ,তাই নেমে দৌড়াতে শুরু করলো। প্রিয়ম,কলি দুজনই হতভম্ব!” কিন্তু ওদেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই
পুষ্প চলে গেল। এই মেয়ে কখন কি করে,নিজেও বোধহয় জানেনা। এয়ারপোর্টের সামনে এসে হাঁপাতে লাগলো পুষ্প। ঠিক তখনি মাথার উপর দিয়ে একটা বিমান শা শা করে উড়ে গেল। পুষ্প আবার সময় দেখলো,পাঁচটা পাঁচ বাজে।
—” সব শেষ!”
—” পা দুটো কেমন অবশ হয়ে আসছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো,সেখানেই বসে পড়লো পুষ্প। কান্নাগুলো গলায় দলা পাঁকিয়ে আটকে গেছে বোধহয়। মানুষজন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে,কিন্তু পুষ্পর সেসব খেয়াল নেই। হয়তো ভাবছে কোন নাটক,সিনেমার শ্যুটিং চলছে। কিন্তু কোন ক্যামেরাম্যান দেখতে পেলো না অবশ্য। তাই সবাই অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো।
প্রিয়ম আর কলি গাড়ি নিয়ে এসে দেখে পুষ্প এভাবে বসে আছে। এবার ওদের দুজনের মুখও কালো হয়ে গেল। তারমানে চলেই গেছে। ওরা একে অপরের মুখের দিকে যখন তাকিয়ে ছিলো,তখন হঠাৎ কোন একটা সাউন্ড শুনে চমকে তাকায় সামনের দিকে। ওদের চোখ তখন কপালে,আর খুশি দেখে কে। পুষ্প তখনো ঐভাবেই বসে ছিলো। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো…
—” হামনভা মেরে, তু হে তো মেরি সাসে চলে,
—” বাতা দে কেসে মে জিয়ুংগা, তেরে বিনা…
—” আসমা রাহা মুজে কিউ, আবি যা কাহি সে
—” কেসে মে জিয়ুংগা তেরে বিনা…..
—” সিনে মে জো ধাড়কানে হে,তেরে নামপে চলে হে
—” কেসে মে জিয়ুংগা তেরে বিনা…..
—” সেই চিরচেনা সুর,যে সুরের প্রণয়ে বাঁধা পড়েছিল সে। পুষ্প চোখ তুলে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ডুকরে কেঁদে উঠলো। পুষ্প ভাবছে এটা ওর মনের ভুল,বরাবরের মতো। প্রিয়ম আর কলি পুষ্পর একটু পিছনে দাঁড়িয়ে। ওরাও বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করছে।
এক পা দু’পা করে প্রণয় পুষ্পর সামনে হাঁটুঘেরে বসলো। পুষ্পর সামনে সেই ফুলের মালাটা রাখলো,যেটা ওদের পরিচয়ের সূচনা করেছিল। শুকিয়ে গেছে ফুলগুলো,তবে এর রেশ সারাজীবন থাকবে। পুষ্প ফুলের গাজরাটা দেখে বেশ অবাক হলো,চেনা চেনা লাগছে। এবার চোখ তুলে তাকিয়ে কোন কথা না বলে, কান ধরে উঠবস করতে লাগলো পুষ্প। যদি এটা ওর কল্পনা হয়,তাহলে কোন কথা বলবে না সে । আর সত্য হলে, ধমকে দিবে।
—” পুষ্পর এমন কাজে,প্রণয় পুরো বোকা বনে গেল। এতো মানুষের সামনে কি করছে পাগলীটা!”
পুষ্পকে সত্যি সত্যিই জোড়ে একটা ধমক দিলো। পুষ্প কেঁপে উঠলো সাথে সাথে। আর কোন কথা না বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রণয়ের বুকে। প্রণয়ের প্রণয়েই নিজেকে বিলীন করে দিতে চাই। একনাগাড়ে সরি বলছে,আর কেঁদে যাচ্ছে। প্রণয় তার বাসন্তীকে বুকে জড়িয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
হঠাৎ হাততালির শব্দে দুজন সরে দাঁড়ালো। প্রিয়ম আর কলি হাত তালি শুরু করলে,আশেপাশের মানুষজনও তালি বাজাতে শুরু করে। সবাই ফ্রিতে একটা ফিল্মি সিন দেখে নিলো।
এবার পুষ্প লজ্জায় পরলো ভীষণ।
কলি কাছে এসে চিৎকার দিয়ে কনগ্রেচুলেশান জানালো দুজনকে। তারপর প্রনয়কে বললো,
—” ভাইয়া এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট কিন্তু আমার। পিছন থেকে প্রিয়ম কলির মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
—” বাহ,সেলফিস কোথাকার। এখন সব ক্রেডিট নিজের হয়ে গেছে। আমার সাথে যদি আপনার দেখা না হতো,তাহলে এসব কিছুই সম্ভব হতো?
কলি এবার চুপসে গেল। কারন আসলে সবটা ক্রেডিট প্রিয়মের। কলি ঢাকা থাকতে,ফ্রেন্ডদের সাথে রেস্টুরেন্টে গেলে,সেখানে প্রিয়মের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। প্রথমে কথা না বললেও,পরে প্রিয়ম কলিকে প্রণয়ের কথা সব বলে। তখন কলি আর প্রিয়ম দুজন মিলে সব প্লান করছিলো। কিন্তু পুষ্পর বিয়ে ঠিক হওয়াতে, টেনশনে পড়ে গেছিল। যাক,গাধীটা শেষ পর্যন্ত সঠিক কাজটা করতে পেরেছে। অবশ্য প্রিয়মের সাথে দেখা না হলে,পুষ্প কোথায় থাকে সেটা জানা পসিবল ছিলো না।
কলি বললো,ওকে দুজনেরই ক্রেডিট।
তখন প্রণয় বললো,যদি বলি কারো চেষ্টাই সফল হয় নি।
—” মানে!” প্রিয়ম,কলি একসাথে বলে উঠলো।
—” মানে হলো আমি ফ্লাইটে উঠে গেছিলাম। তখন এমনি নিজেই নেমে গেছিলাম। তোমার মেসেজ পরে দেখেছি।কারন আমি আমার বাসন্তীকে অন্য কারো জীবন রাঙাতে দেখতে পারবোনা। তাই ওকে বিয়ের মঞ্চ থেকে উঠিয়ে নিয়ে পালানোর প্লান করছিলাম। কেমন ফিল্মি হতো ব্যাপারটা,দেবের পাগলু টু সিনেমার মতো।
—” পুষ্প চোখ ইয়া বড় বড় করে তাকালো প্রণয়ের দিকে। কলি আর প্রিয়মও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।
—” তখন প্রণয় বললো,আরে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি ভেবেছিলাম ঐ মায়াচন্ডী আরো আগেই ক্ষমা চাইবে,কিন্তু উনি তো সবকিছুতেই লেইট। যদি চলে যেতাম, কি করতেন এখন তাহলে হুম?
—” পুষ্প ঢং দেখিয়ে বললো,ঐ নাফিস সাহেবকেই বিয়ে করে নিতাম। সারাজীবন সিংগেল থাকবো নাকি। পুষ্পর কথা শুনে সবাই হেসে দিল,শুধু প্রণয় রেগে তাকালো। হুট করে পুষ্পর হাতটা চেপে ধরলো। সিংগেল আছো দেখে খুব কষ্ট না তোমার?
—” পুষ্প হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বললো, নাহ তো। এমনি বললাম।
—” প্রণয় প্রিয়মকে বললো,এখানে কাজী ডাকতে। এইমুহুর্তে এখানে বিয়ে হবে,এই সাজেই। পুষ্প থ মেরে গেল।
—” এই শাড়িতে বিয়ে? কলি চোখ উল্টিয়ে প্রশ্ন করলো।
—” এই শাড়ী পরে কবুল বললে কি বিয়ে হবে না? প্রণয় বললো।
অতঃপর কেউ আর কিছু বললোনা। প্রিয়ম আর কলি গেল কাজী অফিসে কাজী খুঁজতে। এয়ারপোর্টে বিয়ে,সিরিয়াসলি!” দুটোর মাথায় গেছে, পুরো।
ওরা চলে যেতেই, প্রণয়ের ফোন বেজে উঠলো। প্রণয়ের মা ফোন করেছে।
—” হ্যা মা বলো।
—” ফুলকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিস। লাউড স্পিকার অন,তাই এটা শুনে পুষ্প বোকা বনে গেল। তারমানে মা ছেলে মিলে এই মারাত্মক প্লান করেছিলো,কি ভয়ানক!”
—” প্রণয় বললো,উঠায় নি তবে নিজেই উঠে চলে এসেছে। আচ্ছা শুনো,এতো কথা বলার সময় নেই। তোমার ফুলকে এইমুহুর্তে বিয়ে করে নিয়েই, কালকেই চলে আসছি। এখন তোমার ছেলে বিয়ে করতে বিজি আছে,দোয়া করো। রাখছি।
পুষ্প শুধু একের পর এক কান্ড কারখানা দেখছে। ফোন কেটে প্রণয় পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বললো,
—” ভেবোনা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমার শাস্তি তো শুরু হবে বিয়ের পর। আসলে কি বলো তো,ঐদিন শাস্তি হিসেবে একটু ট্রেইলার দিয়ে, লোভ লেগে গেছে। তাই ঐ শাস্তিটা আমিই দিতে চাই সারাজীবন। আমার শাস্তি পাওয়া জিনিস,অন্যের দখলে যেতে দেয় কি করে!”
পুষ্প ঘামতে লাগলো। এতো কিছুর পরেও,অসভ্যতামি একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে,আগের চেয়েও দ্বিগুণ।
—” পুষ্পর এই ভয়ানক লাজুক রুপটা দেখতেই তো প্রণয় এই কথাগুলো বলে সবসময়। বেশ লাগে তখন মায়াচন্ডী কে। একদম ভয়ানক সুন্দর!”
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা কাজী নিয়ে ফিরে এলো। কাজী বোধহয় ভাবছে,এরা বিয়ে করতে এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘরে না নিয়ে,এয়ারপোর্টে! ”
বিয়ে পড়ানো শেষ। কবুল বলার সময় পুষ্প কেঁদে দিলো। প্রিয়ম আর কলি ওরা দুজনই সাক্ষী। তবে কলি প্রণয়ের দিক থেকে,আর প্রিয়ম পুষ্পর। কবুল বলার আগে প্রণয় পুষ্পর মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলো। আর বললো, এবার একদম ঠিক আছে। আমার বাসন্তী বউ-ই লাগছে, এই বাসন্তী রংয়ের শাড়িতে। এরচেয়ে সুন্দর কোন রং হতেই পারে না। পুষ্পর কানে কানে বলে উঠলো,লাভ ইউ বাসন্তী বউ।
পুষ্প চোখ রাঙিয়ে তাকালো। প্রণয় চোখ টিপে দিলো।
তখন কলি বলে উঠলো,আমরা কিন্তু কিছু দেখিনি।
—” না দেখাই ভালো। ছোটমানুষ কম কম দেখবা,না হয় পেকে যাবা।
—” প্রিয়ম বললো,বুঝছি আমাদের আর কোন প্রয়োজন নেই এখানে। ফুলকলি চলুন,আমরা কেটে পরি। প্রণয় গাড়িটা রেখে যেতে বললো,কিন্তু প্রিয়ম শুনলো না। গাড়ি নিয়ে চলে গেল,আর ওদের পাশেই একটা পার্কে নামিয়ে দিয়ে গেল।
বললো,এখানে বসে প্রেম করো। প্রেম করা শেষ হলে,বাসায় ফিরে এসো। হঠাৎ কলির ফোন বেজে উঠলো। ঐ ডিকবাল ফোন দিয়েছে। প্রথমে কলি একটু নার্ভাস হয়ে গেল। হুট করে মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। ফোন রিসিভ করে বললো,
—” কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,ভাইয়া বু কে নিয়ে যখন পার্লার থেকে আসছিলাম,তখন ওর এক্স এসে ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। আমি এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করছি। কলির একটিং দেখে, ওরা তিনজন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। এগুলো বলে ফোন কেটে, অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো কলি। তারপর বললো, ঐ ডিকবালের বিয়ে করার শখ মিটে গেছে নিশ্চিত।
প্রিয়ম গাড়ি চালিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছে। কলি তার আগে ওর মাকে ফোন দিয়ে বললো,প্রণয়দের বাসায় চলে এসো। কোন কথা বলবানা এখন,যা বলার আসার পর।
রাস্তায় একজায়গায় গাড়ি থামালো প্রিয়ম। গাড়ির উপর বসে,আইসক্রিম এনে খেতে লাগলো। প্রিয়ম খেতে খেতে বললো,
—” আচ্ছা তোমার মনে হয় না,গল্পে আরেকটা জুটি তৈরি হওয়া উচিত ছিল?
—” আপনার ঐ নিব্বি গফ এখনো বড় হয়নি? হলেই তো আরেকটা জুটি তৈরি হতো।
—” সে তো তিনবছর আগে ঐ দিনই ব্রেকআপ করে চলে গেছে। এখন আমি পিউর সিংগেল।
—” সো স্যাড। তবে আপনি সিংগেল,সেটা বিশ্বাস করতে হবে!
—” না করলে আর কি করার।
—” কলি হেসে দিল,প্রিয়মের কথাটা বলার ধরন দেখে।
—” প্রিয়মও ম্লান হাসলো। কলি প্রিয়মের চোখের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো। পুরাতন কোন কিছু জেগে উঠার ভয়ে। প্রিয়মও বোধহয় সেটা বুঝে গেল।
—” একটা সুযোগ দেয়া যায় কি? প্রমিস নিজেকে বদলে নিবো। কলি কেমন যেন একটা চাহনি নিয়ে তাকালো,যার মানে প্রিয়মের বোঝা দায়। তারপর দুষ্টুমি হাসি হেসে গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো,” মেডিকেল স্টুডেন্টদের এসবে ধ্যান দিলে হাতুড়ে ডাক্তার বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
—” প্রিয়ম মাথা চুলকালো। তারপর বললো,যদি কেউ অপেক্ষা করতে রাজি থাকে?
—” সেটা না হয় তখন ভেবে দেখবো।
—” ইয়েস বলে একটা লাফ দিতে গিয়েও দমে গেল প্রিয়ম,সামনে কলিকে দেখে। ভেবেছিলো গাড়িতে উঠে গেছে,নামলো আবার কখন,শিট!”
ভোলাভালা চেহারা নিয়ে কলির দিকে তাকিয়ে রইলো। কলি বললো,দয়া করে কাহিনী শেষ হলে এবার চলুন।
—” চলেন উডবি ডাক্তার আফা।
—” কলি একটা চাহনি দিলো শুধু,এতেই প্রিয়ম চুপ।
—” প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কন্যাসুন্দর আলো এসে ঠিকরে পরছে ধরণীতে। সেই আলোতে বাসন্তী শাড়িতে পুষ্পকে আরো মোহময় লাগছে। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে প্রণয়ের। অনেকক্ষণ কথা বলে দুজনের মান অভিমান পর্ব শেষ হলো।
হঠাৎ দুষ্টুমি ভাব নিয়ে তাকালো প্রণয়। সেটা দেখে পুষ্প তার মায়াচন্ডী রূপ ধারণ করলো। প্রণয় সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগলো,
—” ডিয়ার বাসন্তী, প্লিজ মেক মি ইমমোরটাল উইথ এ কিস!”
—” পুষ্পর চোখগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো।
—” আরে এখন তুমি আমার বিয়ে করা বউ,চাইতেই পারি। এটা আমার হক।
—” আসছে স্বামীর হক দেখাতে। এটা বলে মুখ ভেংচি কেটে উঠে অন্যদিকে চলে যেতে নিলো। কিন্তু কার আগেই প্রণয় আটকে দিলো। পুষ্পর দু’গাল ধরে কপালে চুমু খেয়ে,কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।
জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে, অবশেষে আজ দুজন একসাথে। দেরিতে হলেও,দুজন বুঝতে পেরেছে। আমরা হয়তো অনেকসময় ইগো দেখিয়ে সেটা শেষ করে দেয়। কিন্তু ওরা দুজনই ওদের ইগোকে পাশে রেখে,ভালোবাসাকে বড় করে দেখেছিল। নয়তো ওদের জীবনটাও অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্পের অন্তর্ভুক্ত হতো। সকল ভালোবাসা পূর্ণতা পাক,জীবন হোক ভালোবাসাময়।
#চলবে… ওপস শেষ তো!
@গল্প নিয়ে কিছু কথা।@
এটা আমার লেখা দ্বিতীয় গল্প। সে হিসেবে কাঁচা হাত। অনেকের মনে হতে পারে,গল্পটা বাস্তবের সাথে মিল নেই। কারন পুষ্পর মতো মেয়েদের এ সমাজ সহজে গ্রহণ করে না। আর সেখানে প্রণয়ের মতো কেউ তো আসেই না,পুষ্পদের জীবনে। এমন মেয়েকে সহজে কেউ ছেলের বউ করবেনা,কারন সমাজে তাদের মর্যাদা হারানোর ভয়ে। সেখানে পাপড়ি পুষ্পকে আরেকজন মেয়ে হিসেবে দেখেছে,ছেলের বউ হিসেবে নয়। এরকম শ্বাশুড়ি পাওয়া হয়তো অকল্পনীয়। তাহলে তো গল্পটা অবাস্তবই হলো, তাই ভাবছেন?
তাহলে বলি,আমি এখানে এটা বুঝাতে চেয়েছি, অপরাধীদের শাস্তি যখন তেমন একটা নেই এদেশে। তাই আমরা কি পারিনা,মেয়েগুলোর হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে। যা হারিয়েছে,সেটাতো অপূরণীয়। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদেরকে আমরা কি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিতে পারিনা?
এটাই মূল বিষয়। পরিবার,ভালোবাসার মানুষের সাপোর্টের মাধ্যমেই এমন একটা মেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। সুন্দর পৃথিবীতে, সুন্দর স্বপ্ন সাজিয়ে, বাঁচার আশা বুনতে পারে। অপরাধীদের শাস্তি যেহেতু দিতে পারবনা,অন্তত পুষ্পর মতো মেয়েদের সম্মান তো দিতে পারি।
আর শাস্তির বিষয়টা আমি আনিনি,কারন এগুলোর বিচার হতে হতে যুগ লেগে যায়। তাও বোধহয় হয় না।
এতোদিন কাউকে কমেন্ট করতে বলিনি আমি,সেটা আমার পছন্দ নয়। যার মন চাইবে, করবে। তবে এতো কষ্ট করে লিখার পর,কমেন্ট না করলে একটু হতাশায় লাগে। আজ সবার মতামতের অপেক্ষায়। অবশেষে বসন্তেই,বাসন্তী বিদায় নিলো। নতুন কোন গল্পের অপেক্ষায়। ভালো থাকবেন সবাই। 😐
আর ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো লাগলে গল্পের গ্রুপে রিভিউ দিয়েন। 🙂