বাসন্তী
পর্ব- ৩৫
#লেখা-লিমু
গত তিন বছর প্রণয় দেশে ছিলো না। কয়েকদিন হলো দেশে এসেছে, তাও প্রিয়মের অনুরোধে। ওর মা বাবা আমেরিকাতেই আছে। দেশে মাঝে মাঝে আসে। তারাও অনেক অভিমান করে আছেন প্রণয়ের উপর। কারন যে এভাবে কিছু না বলে হুট করে ছেড়ে চলে গেছে,তার জন্য বোকার মতো অপেক্ষা করার কোন মানেই হয় না। সে কোন আশা রেখে যায়নি,সব শেষ করে গেছে। তবুও তার ছেলেটা কেন যে বুকে আশা বেঁধে রেখেছে, তা বুঝতে পারেন না। এটা কোন জীবন হলো। এতোদিনে বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার করতো। আর এখন,কেমন হয়ে গেছে। কথাই বলেনা বেশি। যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। গানটা নিজের প্যাশন ছিলো,সেটাও ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে কেউ বাঁচতে পারে!”
ছেলের কষ্ট পাপড়ি সইতে পারছেন না। চোখের সামনে কেমন বিমর্ষ হয়ে থাকে।
প্রিয়ম প্রণয়কে আবার গান শুরু করার কথা বলছে। অন্তত নিজের এতটুকু ভালোলাগা নিয়ে বেঁচে থাকুক। প্রণয় হ্যা না কিছুই বলছেনা। রাতে হঠাৎ গিটার নিয়ে ছাদে যায়। প্রিয়মও পিছু পিছু যায়। প্রণয় অনেকক্ষণ গিটারটা নাড়াচাড়া করলো,আগের মতো সুর উঠছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা লিরিক একটু গাইলো। সেটা শুনে প্রিয়ম বললো,
—” ব্রো ট্রাই ইট,ইউ ক্যান ডু ইট। প্লিজ একবার চেষ্টা তো করো। নিজের প্যাশনের সামনে অন্য কিছুর গুরুত্ব দিতে নেই,তুমিই তো সেটা বলতে। তাহলে আজ তুমি কেন পারছোনা?
—” প্রণয় একটা মলিন হাসি দিলো। তারপর বললো,
জানিস,কথা বলা সহজ কিন্তু সেই কথার মূল্য দেওয়া খুব কঠিন। আমরা সবাই মোটিভেট করতে জানি কমবেশি। কিন্তু যখন নিজে ডিপ্রেশনে চলে যায়,তখন সব ফেক মনে হয়। নিজেকে মোটিভেট করা যে খুব সহজ নয়।
—” প্রিয়ম কি বলবে বুঝতে পারলনা,মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর বললো,
—” ব্রো তোমার ফ্যানদের সাথে কিন্তু তুমি এটা অন্যায় করছো। তারা এখনো তোমাকে খুঁজে। তাদের জন্য হলেও অন্তত নতুনভাবে শুরু করো। তোমার সব সোশাল সাইট বন্ধ,সেগুলো আবার চালু করো প্লিজ। আর নয়তো আমাকে পারমিশন দেও,আমি তোমার ইউটিউব একাউন্ট অন করি।
প্রণয় কিছু বললোনা,চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করলো। তারপর আবার গিটার হাতে নিয়ে ফ্লোরেই বসলো। কিছুক্ষণ গিটার বাজিয়ে খালি কন্ঠেই গান ধরলো,
-” কেন…পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু,
ছেড়ে যাইবা যদি…
-” কেন…পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু,
ছেড়ে যাইবা যদি…
-” কেমনে রাখিব তোর মন,
আমার আপন ঘরে বাদী রে বন্ধু..
ছেড়ে যাইবা যদি,
-” পাড়া পড়শী বাদী আমার-
বাদী কালন নদী,
পাড়া পড়শী বাদী আমার….
বাদী কালন নদী,
-” মরণ জ্বালা সইতে নারী,
দিবানিশি কাঁদিরে বন্ধু…
ছেড়ে যাইবা যদি!”
-” কারে কি বলিব আমি,
নিজে অপরাধী (২)
কেঁদে কেঁদে চোখের জ্বলে,
বহাইলাম নদীরে বন্ধু…
ছেড়ে যাইবা যদি!”
-” পাগল আব্দুল করিম বলে,
হলো একি ব্যাধি…(২)
তুমি বিনা এ ভুবনে
কে আছে ওষধি রে বন্ধু,
ছেড়ে যাইবা যদি!”
-” কেন…পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি…
গানটা শেষ করে প্রণয় কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও শান্তি নেই। সেই মুখশ্রী যে দেহমনে খোঁদাই করা হয়ে গেছে। তাই এতো সহজ কি তাকে মন থেকে মুছে ফেলা।
প্রিয়ম মোবাইলে কি যেন করছে। তারপর প্রণয়কে বললো,
—” ব্রো, ভিডিউ হ্যাজ বিন পোস্টেড। এখন পাবলিক রিএকশান দেখার অপেক্ষায়। প্রণয় কিছু বললোনা,যেন তার এসব নিয়ে কোন আগ্রহই নেই।
সে তার মতো করে রুমে চলে গেল। আর প্রিয়ম বসে বসে লাফাচ্ছিল আর ইয়েস ইয়েস করছিল। কারন এতোদিন পর ব্যাক করার পরও গানের ভিউ সমানতালে বেড়ে যাচ্ছে। প্রিয়ম বেশ এক্সাইটেড সেটা নিয়ে। কারন অন্তত ফ্যানদের কথা ভেবে হলেও প্রণয় আবার মিউজিকে ফিরবে,এটাই প্রত্যাশা। দশ মিনিটেই ভিউয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। প্রিয়ম ভিডিওটাতে ক্যাপশন দিলো,
—” আফটার লং ব্রেক,এনজয় দ্যা সং।
বিছানায় বসে ফোন গুতাচ্ছে কলি। ইউটিউবে ফান ভিডিও দেখছিল,আর একা একাই হেসে কুটি কুটি হচ্ছিল। পুষ্প রুমে আসলে, কলি পুষ্পকেও টেনে সামনে বসায়। দুজনে একসাথে ভিডিও দেখছিল। যদিও পুষ্পর এতো আগ্রহ নেই,তবু জোর করে হাসার চেষ্টা করছে। কলিও সেটা বেশ বুঝতে পারছে। সবসময় কেমন মুখ গোমড়া করে থাকে। যেন হাসলে কেউ বকবে ওকে। এভাবে থাকলে তো কিছুদিনের মধ্যেই বড় ধরনের অসুখ বাঁধিয়ে ফেলবে। গত তিন বছরে কলি তিন বারও পুষ্পকে হাসতে দেখেছে কিনা, মনে করতে পারছেনা।
মেয়েটা এতো ব্যাথা চেপে রাখতে জানে। কবে যেন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। অবশ্য এখনি আর কতটা ভালো আছে। এটাকে ভালো থাকা বলে,এটা কোন লাইফ।
হঠাৎ একটা ভিডিও অন হতেই কলি বেশ চমকে যায়। আর পুষ্পর মনে হয় হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গিয়েছিল। সেই চিরচেনা কন্ঠ,সেই সুর। সময় চলে যায়,কিন্তু হৃদয়ের মানুষ হৃদয়েই থেকে যায়, খুব যতনে। হঠাৎ করে যেন পুষ্পর বুকের বাপাশটা চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করে। যে ব্যাথা বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিল এতোদিন,তা যেন আবার ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগলো। পুষ্পর গলা শুকিয়ে আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলো পুষ্প। আবেগকে কবেই কবর দিয়ে দিয়েছে সে,তাই সে আর দুর্বল হবে না।
চোখেমুখে কাঠিন্য ভাব এনে কলিকে ধমকে দিল।
—” তুই কি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার সাথে এমন করছিস? এসব করে কি বুঝাতে চাইছিস? আমি ভুল করেছি? করলে করেছি,তোকে এতো ভাবতে হবে না আমাকে নিয়ে। আমার কারনে যদি তোকে বিয়ে দিতে সমস্যা হয়,তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তবুও আমাকে শান্তিতে থাকতে দে। এটা বলে পুষ্প কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।
—” পুষ্পর এমন ব্যবহার দেখে কলি একটুও অবাক হলো না। কারন সে জানে,পুষ্প ভালো নেই। ও মানসিকভাবে সত্যি অসুস্থ। ওর মনে হয়তো ঝড় বইছে,কিন্তু সেটাতো আর প্রকাশ করতে পারবেনা। তাই কলির উপর চিল্লিয়ে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যার কন্ঠ শুনে মন ব্যাকুল হয়েছে,সে ব্যাতীত কি কেউ মন শান্ত করতে পারবে!”
বু টা বুঝছেনা কেন?
বুঝতে এতোটাও না দেরি করে ফেলে যে,মানুষটাই অন্য কারো হয়ে যায়।
কলি মনে মনে বললো,তোমাদের সম্পর্ক টা শুরু আমি করিয়ে দিয়েছিলাম। তাই এর শেষটাও আমি করবো। এবার হয় এসপার,না হয় ওসপার। এভাবে দুজন দু’জায়গায় লাইলী-মজনু সেজে থাকবা তা হবে না। অনেক অপেক্ষা করেছি,আর না। এবার আমাদেরকেই কিছু করতে হবে।
পুষ্প ফুঁপিয়ে কাঁদছে,কলি সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু কিছু বলবেনা সে। কাঁদুক, যত ইচ্ছে কাঁদুক। তবুও ওর মনটা একটু নরম হোক। কলির ফোনে তখনও গানটা বাজছে,অফ করার কথা মাথায় নেই। অথবা ইচ্ছে করেই করেনি। শেষের লাইনটা বাজছে তখন,
-“পাগল আব্দুল করিম বলে,
হলো একি ব্যাধি…(২)
তুমি বিনা এ ভুবনে
কে আছে ওষধি রে বন্ধু,
-” ছেড়ে যাইবা যদি…
এ অংশটুকু শুনে পুষ্পর বুকের দহনটা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল বোধহয়। প্রণয় একেবারে মনের গভীরের সবটুকু ব্যাথা ঢেলে দিয়ে এ অংশটুকু গেয়েছে। হঠাৎ পুষ্পর মনে হলো,সে কি কোথাও কোন ভুল করেছে?
প্রণয়কে বুঝতে!”
#চলবে…