বাসন্তী
পর্ব- ২৯
লেখা-লিমু
—” একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে ছাদে এইমুহুর্তে। ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষ একজন আরেকজনের মনে কি চলছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। শিরশির করে ঠান্ডা বাতাস বইছে,পুষ্প হালকা কাঁপছে। তবে সেটা ঠান্ডায় না ভয়ে,তা ঠিক ঠাহর করতে পারছেনা সে। যদিও জানুয়ারি মাসে যথেষ্ট শীত থাকে। তবে এইমুহুর্তে শীতের কাঁপাকাঁপির ভয়ের চেয়ে,সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে বেশি ভয় করছে পুষ্পর। একদম গম্ভীর মুখ করে পুষ্পর সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাপড়ি, পুষ্পকে পরখ করছে একধ্যানে। পুষ্প মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে,আর হাত কচলাচ্ছে একনাগাড়ে। পাপড়ি এবার ঘুরেঘুরে পুষ্পকে দেখতে লাগলেন। তারপর পুষ্পর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই বলতে লাগলেন,
—” আমার ছেলেটাকে ঠিক কতটা গভীরভাবে ফাঁসিয়েছো শুনি?”
—” কথাটা শোনার সাথে সাথে মনে হয় পুষ্পর শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল,এবং টুপ করে চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর অজান্তেই। সেটা তাড়াতাড়ি মুছে নিল পুষ্প। তারপর অবাক নয়নে তাকালো সামনের মানুষটার দিকে। কিন্তু পাপড়ি যেন সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না। উনি উনার মতো বলতে লাগলেন,আসলে কিছু মেয়ে আছেই এমন একটু লোভী,উচ্চবিলাসী প্রকৃতির। এদের নিজের সামর্থ না থাকলেও,পটাবে এমন একটা ছেলেকে যেন একেবারে নিজের সাথে সাথে নিজের পরিবারেরও একটা বন্দোবস্ত হয়ে যায়। খুব ধুরন্দর টাইপের হয় এই মেয়েগুলো। এদের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে,এদের পেটে পেটে ঠিক কি চলে। চেহারায় ভাবটা এমন থাকে যে,ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানেনা। অথচ মূলত এরা নিজে মাছ কেটে,ভেজে খেতে জানে একেবারে। আর এসব মেয়েদের টার্গেট থাকে আমার প্রণয়ের মতো ইনোসেন্ট ছেলেদের উপর। যারা ঐসব মেয়েদের অসহায় মুখটা দেখেই গলে যায়। আর মেয়েগুলো সেই সুযোগটাই নেই। আর তুমিও তাদের একজন। আই মাস্ট এডমায়ার এবাউট ইউর ক্যাপাবিলিটি। বিয়ের আগেই একেবারে স্বপরিবারে প্রণয়ের ঘাড়ে চেপে বসেছো। স্বপরিবারে কথাটা শোনামাত্রই পুষ্পর চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। নিজের আত্নসম্মান খোয়ায়ে কখনো নিজের ভালোবাসা পেতে চাইনা পুষ্প। আর পুষ্প তো এখানে আসেনি,প্রণয় জোর করে ওদের নিয়ে এসেছে। হ্যা পুষ্প তখন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল,তাই ও কিছু বলতে পারবেনা। কিন্তু এখন পুষ্প নিজেই অন্য কোন বাসায় চলে যেতে চেয়েছিল সবাইকে নিয়ে, কিন্তু প্রণয় যেতে দেয় নি। বিয়ের আগে এভাবে সবাই ওদের বাসায় থাকাটা পুষ্পর নিজের কাছেই পছন্দনীয় নয়। কিন্তু প্রণয় নাছোরবান্দা, সে কোথাও যেতে দিবেনা কাউকে। বলে যে ওদের এতোবড় বাড়ি,আর এ কয়জন মানুষ থাকতে পারবেনা। প্রণয়ের সাথে তর্কে পুষ্প পেরে উঠেনা,অগত্যা থাকতেই হচ্ছে।
কিন্তু আজকে এভাবে এমন কথা হজম করতে হবে, সেটা যদি পুষ্প ঘুনাক্ষরেও টের পেতো তাহলে কবেই চলে যেত। কিন্তু এখন!
—“এখন কি করবে পুষ্প?
—“উনার কথার জবাব দিবে?
নাকি চুপ করে শুনবে, উনি শেষপর্যন্ত কি বলেন। তবে এতটুকু শুনে পুষ্প এটা বুঝতে পেরেছে, উনার ছেলের জন্য উনি পুষ্পকে অন্তত চয়েস করবেন না। আর করার কথাও না,এটাই স্বাভাবিক। পুষ্পর মতো মেয়েদের এ সমাজ ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে,যেন সে মস্ত পাপী।আসলে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতই সংকীর্ণ। এখনো রেপের ক্ষেত্রে আমরা মেয়েটাকেই দোষী সাব্যস্ত করতে দুইবার ভাবি না। আর যে ছেলেটা রেপ করে, সে ধোঁয়া তুলসীপাতা। হিমালয় থেকে ফিরে আসা নাগাসন্ন্যাসী।
সবাই নিউজে চ্যানেলে মেয়েটাকেই হাইলাইট করে। ফেসবুকে মেয়েটার ছবিই ভাইরাল করে। আর সেখানে সবাই প্রতিবাদের ঝড় তুলে,সমবেদনা জানায়। অথচ এতে কিছুই হয় না,মেয়েটার ক্ষতি ছাড়া। দু’দিন পরই সবাই সব ভুলে যায়। কিন্তু যে মেয়েটা সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়,সে তো আর সমাজে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারেনা। পাড়া- প্রতিবেশী,আত্নীয়-স্বজন সবাই মেয়েটাকে বাজে বলে,মেয়েটার পরিবারকে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখে।
তাদেরকে মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে,
—” হ্যালো আংকেল, আন্টি এদেশে আপনার মেয়েও নিরাপদ নয়। তাই অন্য একটা মেয়েকে,মেয়ের পরিবারকে এভাবে কথার দ্বারা আঘাত করার আগে একবার অন্তত বর্তমান সামাজিক অবস্থাটার কথা ভেবে দেখবেন। আমরা কেউই নিরাপদ নয়। আপনার মেয়েও এসব হায়েনাদের স্বীকার হতে পারে,যেকোন দিন।
তাই আমরা বরং সেই নির্যাতিত,লাঞ্ছিত মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়,তাকে সাহস যোগায় এ পৃথিবীতে নতুনভাবে আত্নপ্রত্যয়ে বেঁচে থাকার জন্য।
এতে অন্তত মেয়েগুলো একটু ভরসা পাবে,আবার নতুন করে বাঁচতে চাইবে এ ধরার বুকে। এতটুকু তো আমরা করতেই পারি, তাই না?
আর নিউজ চ্যানেল গুলোর কথা কি বলবো,তাদের গরম গরম নিউজ সংগ্রহ হওয়া বলে কথা। তাদের চ্যানেলের খ্যাতি বাড়ানো বলে কথা। অথচ এটা একবারও ভাবে না, এভাবে মেয়েটাকে সবার চোখের সামনে এনে মেয়েটার ক্ষতিই করছে। পরবর্তীতে যখন মেয়েটা সমাজে চলাফেরা করবে,তখন সমাজের কিছু সুশীল মানুষই মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকাবে,ব্যাঙ্গ করবে,কানাঘুসা করবে। মেয়েটার নিত্য চলাফেরাটা হয়ে উঠবে অসহনীয়, দুর্বিষহ। তাই কিছু লাইক কমেন্টের আশায় মেয়েটার ছবি ভাইরাল না করাই শ্রেয়। পারলে রেপিস্টের ছবি ভাইরাল করুন,রেপিস্টকে ঘৃণার চোখে দেখুন। মেয়েটা কেন সমাজে মাথা নিচু করে চলবে? রেপিস্ট মাথা নিচু করে চলবে। সবাই রেপিস্টের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলবে,ঐ যে ও একজন রেপিস্ট। আর এটা শুনে শুনে সে তার বাকীটা জীবন অতিবাহিত করবে। তাকে ফাঁসি দেওয়ার দরকার নেই,শুধু চিহ্নিত করে ছেড়ে দেওয়া হোক। তারপর এখন যেখানে মেয়েটাকে সবাই ভৎসর্না করে,তখন রেপিস্টকে করবে। রেপিস্টের প্রতি সবার মনোভাব এমন হওয়া চাই,যেন সে নিজেই নিজের কৃতকার্যের জন্য প্রতিনিয়ত নিজের বিবেকের ফাঁসির মঞ্চে দন্ডিত হয়। যেন সে বেঁচে থেকেও নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। প্রতিনিয়ত সবার ভৎসর্না,অবহেলায় যেন সে মানসিকভাবে মরে যায়। কেননা রেপ করে একটা মেয়েকে তো মানসিকভাবেই হত্যা করে ফেলে। আর আজকাল তো একেবারেই মেরে ফেলে। যেন কোন বিষয়ই না এইটা। একটা,দুইটা,হাজারটা মেয়ে এভাবে মারা গেলেও কারো কিছু আসে যায় না। শুধু যখন নিজের উপর আসে,তখন আসে যায়।
পুষ্প চোখ মুছে একদম কঠিন করে নিলো নিজেকে। সহজে ভেংগে যাওয়ার মেয়ে পুষ্প নয়। নামটা পুষ্প হলেও,ফুলের মতো এতো কোমল নয়। কাঁটার মতোই শক্ত। এ পৃথিবীতে নরম মনের মানুষদের সবাই পা চাপা দিয়ে ধরে রাখতে চায়। পুষ্প নিজেকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রেখে ঠান্ডা মাথায় বলতে শুরু করলো;
—” দেখুন আনটি আপনি আমার গুরুজন,শ্রদ্ধার পাত্র। তাই আপনার সাথে তর্কে যেয়ে আমি কোন বেয়াদবি করতে চায় না। আসলে আপনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন,স্বপরিবারে প্রণয়ের ঘাড়ে চেপে বসেছি। তাই এবার স-সম্মানে সে স্থান ত্যাগ করবো। আর আমরা চলে যেতে চেয়েছিলাম আরো আগেই,আপনার ছেলেই যেতে দেয়নি। যাই হোক সে কথা বাদ।
তবে আর যাই হোক না কেন আনটি, আমি ঐ টাইপ মেয়ে নয় আপনি যেটা বর্ণনা করলেন। নিজের গুণ নিজে করছি না,আমি কেমন সেটা অন্তত আমি জানি৷ আর আপনাকেও জানানোর জন্য বলিনি। আপনার যেমন মনে হয়েছে, আপনি ঠিক তেমনটাই ভেবেছেন। আর কারো ভাবনাতে বাঁধা দেয়ার তো কোন সুযোগ নেই আমাদের, তাই না। তবে শুধু এতোটুকু হিসেব মিলাতে পারছিনা,প্রণয় আপনার নিজের ছেলেই তো!
—” কি বলতে চাইছো তুমি?”
—” শুধু এটাই,মা ছেলের ভাবনার মধ্যে এতো তফাৎ!”
—” মুখ সামলে কথা বলো।
—” জ্বি এখন পর্যন্ত আমি মুখ সামলেই কথা বলেছি। আর নয়তো আপনার সব কয়টা কথার উত্তর দিতাম। কিন্তু আপনি প্রণয়ের মা, তাই আপনার সম্মান বজায় রেখেই কথা বললাম। এটাকে আপনি আমার দুর্বলতা ভাববেন না। আর আমার আর প্রণয়ের মাঝে সবকিছু আজ এখানেই সমাপ্ত। নিজের আত্নসম্মানের চেয়ে প্রেম,ভালোবাসা বড় নয়। জীবনে ভালোবাসা আসবে যাবে,কিন্তু সম্মান একবার চলে গেলে সেটা ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। আর আমার কাছে সবার আগে আমার আত্নমর্যাদা। আর সেটা অক্ষুণ্ন রাখতে যেকোন কঠিন সিদ্ধান্তই নিতে প্রস্তুুত আমি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আমাকে বাস্তবটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য। আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আর দোয়া করবেন,যেন একটা হতদরিদ্র মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাই। তবে তার মনটা যেন অন্তত বড় থাকে,ব্যাস তাতেই হবে। কারন আজকাল মানুষ ধনেই বড় হয় শুধু, মনের দিক দিয়ে সেই সুঁইয়ের মাথার ছিদ্রের মতই ক্ষুদ্র থাকে। এটা বলেই পুষ্প চুপচাপ চলে গেল। আর পাপড়ি মুুখটা আরো গম্ভীর করে পুষ্পর যাওয়ার পথপানে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের জেদ আছে বলতে হবে,মনে মনে এটা আওরালেন পাপড়ি।
#চলবে…