বিয়ের জন্য যেমন সবাই কম বয়সী মেয়ে খোঁজে ঠিক তেমনি গল্পের নায়িকাগুলোও হয় কমবয়সী সুন্দরী। আমার মতো পয়ত্রিশ বছর বয়সী শ্যামবর্নের মেয়েকে না কেউ বিয়ে করতে চাইবে না গল্প লিখতে। যার কেউ নেই তার এক আল্লাহ আর সে নিজে ছাড়া আর কেউ সহায় হয় না। সেজন্য আমি ভেবেছি নিজেই নিজেকে নিয়ে গল্প লিখবো। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে আর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে বিয়ে নামক সামাজিক প্রথায় মন দিতে পারিনি। দু’একটা বিয়ের প্রস্তাব পেলেও তা নিয়ে ভাববার অবকাশ হয়নি চাকরির ব্যস্ততায়। যখন বিয়ে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম তখন দেখি আমার বয়স তিরিশ পার হয়ে গেছে। আমি তিথী, ঢাকার বিখ্যাত এক কলেজের অংকের শিক্ষক। আমার এই পরিচয়টা কিন্তু আমার নিজের অর্জন, অনেক কষ্ট করে আজ এই পর্যায়ে এসেছি। অথচ এই কষ্টের অর্জনটাকেই এখন বৃথা মনেহচ্ছে বিয়ে না হওয়ার কারনে। আশেপাশের মানুষের নানারকম কথাবার্তায় নিজেকে ভীনগ্রহের মানুষ মনেহয়। নিজের বিসিএস পরীক্ষায় উতীর্ন হয়ে শিক্ষক হওয়ার গর্বটা যেন বয়স আর গায়ের রং এ এসে মিলিয়ে যায়। এতোদিন পাত্তা না দিলেও ইদানীং আমার নিজেরও ভীষন খারাপ লাগে। পাত্র হিসেবে যাদের আমার পচ্ছন্দ হয় তারা আমায় বয়স আর গায়ের রং এর কারণে পচ্ছন্দ করে না। আবার যারা আমাকে পচ্ছন্দ করে তাদের মনমানসিকতা আমার ভালো লাগে না। ইদানীং তো আরেক ঘটনা ঘটছে। আমার জন্য আসা বিয়ের প্রস্তাবে দেখি পাত্রের বয়স আমার থেকে এক দু’বছর কম। তারা আমার টাকা পয়সা চাকরি দেখে বিয়ে করতে চায়। কিছু কিছু পাত্র আর তাদের পরিবারের লোকের মনমানসিকতা দেখে বিয়ে নিয়ে ভয় ঢুকে গেছে মনে।হতাশ হয়ে এখন আর পাত্র দেখার ঝামেলায় যাই না তার আগেই মানা করে দেই। বিয়ে করবো না বলে মনস্থির করেছি। কিন্তু আমার কারনে ছোট বোনটারও বিয়ে হচ্ছে না। তিরিশ ছুই ছুই ছোটবোনটা মাস্টার্স পাশ করে ব্যাংকে জবে ঢুকেছে। একটা ছেলের সাথে সেই অনার্স লাইফ থেকে ওর সম্পর্ক। আমি ওকে বলেছি আমার বিয়ের জন্য অপেক্ষা না করে ও যেন বিয়ে করে নেয়। কিন্তু ওর এক কথা আমার বিয়ে না হলে ও বিয়ে করবেনা। মাঝে মাঝে ওর প্রেমিকের সাথে তীব্র ঝগড়া টের পাই। সেই সময় আমার অপরাধবোধ হয়। ভাগ্যকে গালি দিয়ে সাময়িক সান্ত্বনা খুঁজে নিলেও বোনের চোখে চোখ রাখতে পারি না। লজ্জা আর কষ্টে মরে যেতে মন চায় আমার। আমার কারণে ওরা বিয়ে করতে পারছেনা বলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে থাকছি। শুনেছি স্বামীর বাম পাঁজরের হাড় থেকে থেকেই নাকি নারীকে তৈরি করে খোদা। আচ্ছা, আমি কার পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি হয়েছি? আমার জোড়া কি নেই এই পৃথিবীতে? মনটা ভরাক্রান্ত হয়ে থাকে সবসময়। ক্লাসে মন দিতে পারিনা। প্রায়ই ভুলভাল অংক করে ফেলছি বোর্ডে। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ফিসফাস শোনা যায়, ম্যাডাম বিয়ের চিন্তা করতেছিলো তাই ভুল করছেহা হা হা হা। ম্যাডামের এতো বয়স আর কি বিয়ে হবে? কথাগুলো কানে আসা মাত্রই চকটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরি শক্ত করে। চোখের অবাধ্য জলকে বাগে আনতে অনেকটা সময় বোর্ডে আঁকিবুঁকি করি। নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কাউকে বলি অংকটা করতে। তারপর নিজে সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চে যেয়ে বসি। ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবি।
আজকের এই আমি দশবছর আগে ঘুনাক্ষরেও এমন কিছু টের পাইনি। সেই সময় চোখে কেবল একটাই স্বপ্ন ছিলো নিজে কিছু করতে হবে, নিজের একটা পরিচয় গড়তে হবে। আমার বাবা একজন সরকারি কেরানি। চারভাই দুই বোন বাবা আর মা নিয়ে আমাদের পরিবার। বুঝতেই পারছেন কি পরিমাণ আর্থিক টানাপোড়েন গেছে আমাদের পরিবারে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের কোন অভিযোগ ছিলোনা কখনোই। অল্পতেই আমরা খুশি ছিলাম। ছোটবোন ছাড়া আমরা বাকী ভাইবোন একদম পিঠাপিঠি। বাবা আমাদের বন্ধু আর মা হচ্ছেন সংসারের দূরের মানুষ। মাকে আমরা বেশ ভয় পাই। শাসনের জন্য গায়ে হাত দিতে হয় না মায়ের, তার চোখ রাঙানি যথেষ্ট। আমার মা বনেদী পরিবারের মেয়ে। এতিম অসহায় জায়গির থাকা বাবাকে মা নিজে পচ্ছন্দ করে বিয়ে করেছেন বলে পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। বাবা আমাদের সব ভাইবোনদের বলে দিয়েছেন, তোমরা তোমাদের মায়ের অবাধ্য হয়োনা। তার মনে এমনিতেই অনেক কষ্ট। যদি পারো তাহলে তার কষ্ট কমানোর চেষ্টা করো। মায়ের কষ্ট কিসে কমবো? প্রশ্নের জবাবে বাবা বলেছিলো, আমরা সমাজে মাথা উচু করে চলতে পারলে নাকি মায়ের কষ্ট কমবে। প্রচন্ড মেধাবি আমরা বাবার কথা রেখেছি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি অবধি স্কলারশীপ পেয়েই পড়ালেখা করেছি। খেয়ে না খেয়ে সব ভাইবোন মানুষের মতো মানুষ হয়েছি। মানুষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোন দিকে তাকাইনি। আমাদের একমাত্র লক্ষ জীবনে কিছু করা। হ্যা, আমরা বিফল হইনি কেউ। আমার চারভাই এর দুজন ডাক্তার আর দু’জন ইন্জিনিয়ার। একজন আমেরিকায় এক বিখ্যাত মেডিকেলে ডাক্তার আর বাকী দু’জন কানাডায়। একটা মাত্র ভাই দেশে থাকে। সে নামকরা সার্জারি ডাক্তার। আমার মা রত্নগর্ভা এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে আমাদের অর্জনে। এখন আমার নানাবাড়ির দিকের আত্মীয় স্বজনরা যেচে আলাপ করতে আসে আমাদের সাথে। আমার কেরানি বাবাকে জামাই হিসেবে যথাযথ সম্মান দেয়। আমাদের অর্জনে বাবা মা দু’জনেই ভীষণ গর্বিত। কিন্তু আমার কারণে যেন আমার বাবা মায়ের এই খুশি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কি এক অদৃশ্য কারণে আমার বিয়ে আঁটকে আছে। মামা খালারা টিপ্পনী কাটে শুনে মায়ের মন খারাপ হয়। মায়ের মন খারাপ দেখে আমার ভাগ্যের উপর অভিমান হয়। কেন এমন হলো? কি দোষ আমার? প্রতিবার রমজানে দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি যেন আমার জন্য ভালো জীবনসঙ্গীর ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে গেলো আর আমার বিয়েই হলোনা। দিন মাস বছর গড়িয়ে আজ আমি পয়ত্রিশে।
বরাবরের মতো এবারের রোজার শুরু থেকেই সৃষ্টিকর্তার দরবারে নিজের বিয়ের ফরিয়াদ নিয়ে হাত তুলেছি। বুকের অব্যক্ত বেদনা কান্না হয়ে ঝড়ে পড়েছে মোনাজাতে। মা মাঝে একদিন জানতে চাইলো আমার ছুটি কবে থেকে। কলেজের ছুটি শুরু হওয়ার পর বাইশ রোজার দিন মা এলো-
“তিথী, আজ বীথির বিয়ের জন্য কথা বলতে আসবে সাদমানের পরিবার। তুই একটু সামলে নিতে পারবি না মা?”
আমি অবাক হয়ে মায়ের মুখপানে চাইলাম। বীথি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে অথচ আমাকে জানায়নি? জানালে কি আমি রাগ করতাম? কেন যেন অভিমান জমে উঠলো বুকে। মা হয়তো মনের কথা বুঝলেন। একটু ইতস্তত করে আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বললো-
“সাদমান ভীষণ অস্থির হয়ে গেছে। ও স্কলারশীপ পেয়েছে একটা, বিয়ে করে বীথিকে সাথে নিয়ে যেতে চায়। ওরা তোর জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করলো কিন্তু তোর কোন খবর হচ্ছে না। বীথি এখনো বিয়ে করতে রাজি না বলে সাদমান আমাকে ফোন দিয়েছিলো। সব শুনে আমি আসতে বলেছি। আমি কি ঠিক করেছি মা?”
আমার গলার কাছে উঠে আসা কান্নাটাকে জোর করে ঢোক গিলে ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। মাথা ঝাকিয়ে বললাম-
“না মা, তুমি ঠিকই করেছো। আমার জন্য বীথির জীবন কেন নষ্ট হবে? আমি নিজেও তো ওকে বলেছি অনেকবার।”
“তুই একটু বীথিকে বোঝাস মা। এতো ভালো ছেলেকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বীথি এখনো জিদ আঁকড়ে আছে।”
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যেতেই আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলাম। কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। বুকের ভেতর অসহ্য ব্যাথায় শ্বাস আঁটকে আসছে। আমার এই জীবন কি একাকি কেটে যাবে? সারাজীবন পড়ালেখার পেছনে ছুটতে ছুটতে কারো দিকে ফিরে তাকাইনি বলে আজ অনুতাপ হচ্ছে। ইউনিভার্সিটিতে যে ছেলেটা আমায় পচ্ছন্দ করতো, চাকরি পেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। বিসিএসের জন্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে আজ আফসোস হচ্ছে, ভীষণ আফসোস হচ্ছে।
মোট পাঁচজন এলো ইফতারের দাওয়াতে। আমি সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে নিজের কামরায় চলে এলাম। ভেবেছি একা একাই ইফতার করবো আজ। আমার ডাক্তার ভাই ভাবিও তাদের একমাত্র পুত্র নিয়ে হাজির। বীথিকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে। আমি আঁড়াল থেকে দেখলাম সে দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর নিজের হবু শশুর শাশুড়ীর সাথে গল্প করছে। এই মেয়ে নাকি বিয়ে করতে চায়না। আমি ভাবছি বীথি সবই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য করেছে হয়তো। সবাই গল্প করার ফাঁকে আমার ডাক এলো। আমাকে কেন ডাকছে আমি বুঝতে পারছি না। বিয়ের কথা বার্তা হবে বীথির সেখানে আমি গিয়ে কি করবো? আমি অনিচ্ছায় ওদের সামনে গেলাম। পরনে সাদামাটা সুতি শাড়ী। সাদমানকে আগে দেখেছি দুএকবার তাই চিনতে অসুবিধা হলোনা। ও আমাকে সালাম দিয়ে ওর বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ওনাদের পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি তখন আমার মুখপানে তাকিয়ে ছিলো মুগ্ধ হয়ে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে ওনাকেও সালাম দিলাম। উনি হাসিমুখে আমাকে ওনার পাশে বসতে বললেন। তারপর বিপরীত দিকের সোফায় বসে থাকা একজনকে দেখিয়ে বললো-
“আমি সম্পর্কে সাদমানের খালা। আর ও আমার একমাত্র পুত্র তুষার।”
আমি তাকাতেই চোখাচোখি হলো মানুষটার সাথে। উনি সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। আমার মনে হলো ওনাকে কোথায় যেন দেখেছি। চেহারা চেনার জন্য বারকয়েক তাকালাম। পরে নিজেই লজ্জা পেলাম। এভাবে তাকানো মোটেই ভালো ব্যাপার না। বাকী সবাই কি ভাববে? টুকটাক কথা বলতে বলতে ইফতারের সময় হলো। সবাই মিলে একসাথে বসে ইফতার করার সময় টের পেলাম তুষার মাঝে মাঝেই আড়চোখে আমায় দেখছে। ইফতার শেষে চা খেতে খেতে হঠাৎ তুষারের মা বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো-
“একটা কথা বলতে চাই ভাইসাহেব।”
“জ্বি আপা বলেন।”
বাবা তড়িৎ জবাব দিলো।
“তিথী মাকে আমার তুষারের জন্য পচ্ছন্দ হয়েছে খুব। আপনারা তো জানেনই ছেলে আমার সারাজীবন কষ্ট করেছে। ওর বাবার অবর্তমানে আমার সংসারের হাল ধরেছে। আমার তিনমেয়েকে পড়ালেখা শেষ করিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এসব দায়িত্ব পালন করে ছেলে নিজে বিয়ে করার সময় করতে পারেনি। যেহেতু দু’জনারই বয়স হয়েছে তাই আমি আর দেরি করতে চাই না। তাছাড়া এমন শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আজ আংটি বদল হোক আর শেষ রোজায় বিয়ে। পরে না হয় ঘটা করে অনুষ্ঠান করা যাবে। আমি চাই ঈদটা তিথী আমাদের বাড়িতে করুক। অবশ্য এতে যদি তিথী মায়ের আপত্তি না থাকে। আমার তুষারের কোন আপত্তি নেই। ও তো তিথীকে সেই প্রথমবার কলেজে দেখেই পচ্ছন্দ করে ফেলেছে।”
“তিথীর কোন আপত্তি হবে না আপা। আমাদের পচ্ছন্দের উপর মেয়ের আস্থা আছে।”
বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্রই আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে আমার অনামিকায় আংটি দেখা গেলো। লাল রুবি বসানো আংটিটা জ্বলজ্বল করছে আমার অনামিকায়। আমি বোকার মতো বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। আসলে আমি কখনো ভাবিনি এমনভাবে আমার বিয়ে হবে। বাবা মা আমাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করতে পারে এমনটা ধারণা করিনি। বাবা চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করতে চাইলো। অথচ আমার মনের মধ্যে শঙ্কা ঘিরে আছে। সংসার আর সম্পর্ক নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই। তুষারের সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কেমন স্বভাব লোকটার? আমি এডজাস্ট করতে পারবো তো? তুষারই কি সেই ব্যক্তি যার বাম পাঁজরের হাড় থেকে আমি তৈরি হয়েছি?
#বাম_পাঁজরের_হাড়
#পর্ব-১
#বড়গল্প
©Farhana_Yesmin
★আপনাদের জন্য ঈদ উপহার দিলাম।★