বাদামী সংসার
শেষ পর্ব

অম্লান নীলাক্ষীর বিছানায় শান্ত হয়ে বসে আছে। নীলাক্ষী দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওর মুখোমুখি বসে স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘এখন আমরা আলোচনা করতে পারি।’
অম্লানের মুখ থমথমে। তবে আলোচনার গুরুত্বটুকু সেও বুঝতে পারছে কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে কেবল সেটাই বুঝতে পারছে না। নীলাক্ষী ওর চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো, ‘তুমি কী চাও অম্লান? সরাসরি বলো তো?’

‘আমি চাই আমরা আবার আগের মতো হয়ে যাই।’

‘আগের মতো? মানে তুমি ভেতরে একজনকে ধারণ করে বসে থাকবে আর বাইরে আমার সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা প্রেমিকের অভিনয় করবে, আমার কেয়ার করবে। যাতে আমি সুখী হই আর তুমি ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকবে। সেরকম?’

অম্লান মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো, ‘তুমি আমার বিষয়টা বুঝতে পারছো না নীলু। আমি বিয়ের দিন থেকেই তোমাকে ভালবাসার চেষ্টা করেছি। আমি মন থেকেই তোমার কেয়ার করেছি, তোমাকে সবসময় খুশি রাখতে চেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম একসময় আমার ভেতর থেকে অতীতের সব চিন্তা চলে যাবে। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছিল, আমি নিজের ভেতর অশান্তিতে ভুগছিলাম। এটা তো তুমি জানো? আমি তোমাকে খুলে বলেছি সবকিছু।’

নীলাক্ষী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হুম। তুমি কী আবার সেরকম থাকার কথা বলছো?’

‘না। আমি চাইছি আমরা আগের মতো সুন্দর করে বাঁচি। একে অপরকে ভালবাসি, কেয়ার করি। আমরা একসাথে কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি তুমি কী ভুলে গেছো? আমরা কি আবার সেরকম থাকতে পারি না?’

‘জানি না। তুমি যেমন আমাকে ভালবাসার পরও অশান্তিতে ভুগছিলে, আমিও এখন তোমার উপস্থিতিতে অশান্তি অনুভব করি। আমার ভেতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। তোমাকে গ্রহণ করতে পারছি না।’

‘তাহলে তুমি কী চাও নীলু? তুমি যা চাও সেটা আমাকে বলো।’

‘আমি যা চাই সেটা কী তুমি দিতে পারবে? কখনো পারবে না। হোক সেটা ছেলে কিংবা মেয়ে, যারা বিয়ের পরও নিজের স্ত্রী বা স্বামীকে ভালবাসতে পারে না, তারা কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবে না। শুধুমাত্র সম্পর্কের খাতিরে একসাথে থাকা হবে। মানসিক শান্তিতে কেউই থাকবো না।’

অম্লান চুপ করে রইল। বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে হাঁটুগেরে বসলো সে। নীলাক্ষীর হাত ধরে বলল, ‘তোমার কথাটা ভুল। আমি কিছু একটা ফিল করছি নীলু। না করলে আমি ফিরে আসতাম না।’

নীলাক্ষী চমকে উঠলো, ‘কী ফিল করছো তুমি?’

‘আমি তোমাকে ফিল করছি। তোমার কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা ফিল করছি। তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্ত থাকার কথাও আমি ভাবতে পারছি না। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। তুমি কী চাও যা আমি কখনো দিতে পারবো না?’

নীলাক্ষী চুপ করে রইলো। বিছানা থেকে নেমে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়াল ও। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে নিজের গায়ে মাখলো নীলু। তারপর বেলকুনির দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
অম্লান জানতে চাইলো, ‘কিছু বলবে না? আমাকে বিশ্বাস করো। আমি কখনো তোমাকে মিথ্যা বলি নি। হয়তো কিছু বিষয় লুকিয়েছি, কিন্তু মিথ্যা কথা কখনো বলিনি নীলু। আমি তোমাকে সম্মান করি। তোমাকে ঠকাতে চাইনি বলেই চেয়েছিলাম একা থাকতে। যাতে করে একদিন তুমি নিজ থেকেই সরে যাও। কিন্তু ভালোবাসার পরে ভালোবাসার মানুষকে কখনো মুখ ফুটে বলা যায় না, আমি তোমাকে নিয়ে শান্তিতে নেই। এটা নিষ্ঠুরতা।’

‘ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে দূরে সরে যাওয়াটাও নিষ্ঠুরতা।’

‘আমি তোমাকে সবকিছু বলে দিলে তুমি নিতে পারতে না।’

‘তোমার বিয়ে করাটাই ভুল হয়েছে। অনেক বড় ভুল। কেন করেছো বিয়ে?’

অম্লান নীলাক্ষীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি কখনোই চাইনি বিয়ে করতে। আমার মা, ভাবী ওরা সারাক্ষণ চাইতো যেন আমি ভালো থাকি। আর সেজন্যই প্রতিদিন বিয়ের জন্য ভীষণ চাপ দিতো। ওদেরকে আমি অনেক বুঝিয়েছি, অনেক বলেছি যে বিয়ে করলে মেয়েটাকে যদি ভালোবাসতে না পারি তাহলে একটা মেয়ের জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। আমার মা বলতেন, ভালোবাসতে না পারার কারণ নেই। একসাথে থাকলে ভালোবাসাটা আপনা আপনিই চলে আসবে। আর আমি সেটাই চেষ্টা করেছি। বাসর ঘরে তোমাকে যদি বলতাম, আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে মেনে নিতে পারছি না, সেটাতে কি তুমি ভালো থাকতে? সেদিন থেকেই তোমার জীবন একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যেত। আমি শুধু চেয়েছি তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে, নিজেও ভালো থাকতে। এর বেশী কিছু না। আমি জেনেশুনে তোমার জীবন নষ্ট করতে চাইনি।’

নীলাক্ষীর চোখ ছলছল করছে। ও অম্লানের আরও কাছে এসে চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলতে পারলো না। গলা ধরে এসেছে ওর। অম্লানের এই স্বীকারোক্তির প্রয়োজন ছিল। তাতে ওর যত কষ্টই হোক!

অম্লান বলল, ‘তুমি অন্য কারও স্ত্রী হলে হয়তো অনেক সুখী হতে। আমি তোমাকে অনেক অশান্তিতে রেখেছি। আমাকে ক্ষমা করো। কিন্তু আজকে আমি জানি আমি আসলেই তোমাকে পাশে চাই। আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন আছে। তুমি প্লিজ আমার সঙ্গে থাকো।’

‘ পাশে চাও? আমাকে প্রয়োজন?’

‘হুম নীলু।’

‘আর ভালোবাসা?’

অম্লান নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে নিলো সে। নীলাক্ষী বলল, ‘সেটা কি আছে একটু? তাহলে শোনো, আমার একটু ভালোবাসাতে হবে না। এর চাইতে একা থাকা ভালো। তুমি আমার সাথে সবসময় সুন্দর আচরণ করবে মানলাম কিন্তু আমার সবসময় মনে হবে, তোমার মনে আমি নেই। মন থেকে তুমি আমাকে চাও না। এই জিনিসটা নিয়ে ভালো থাকা যায় না অম্লান।’

অম্লান বলল, ‘আমি এখন কিছু বলবো? সেটা শুনলে তুমি ঠিক থাকতে পারবে তো?’

নীলাক্ষী চমকে উঠলো। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো সে, ‘বলো?’

অম্লান দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। কারণ এই কথাগুলো নীলাক্ষীকে ভেঙে গুড়িয়ে দিবে। যা নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবে না অম্লান। হয়তো ভালো হবে অথবা খারাপ। কিন্তু কথাটা বলার সময় এসেছে।
অম্লান দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমিও খুব দক্ষ অভিনয় করেছো। এমন না যে তুমি আমার প্রেমের জোয়ারে সুখে ভেসে গেছো। তুমিও সুখী হওয়ার অভিনয় করে গেছো দিনের পর দিন। আমি জানতাম আমি তোমাকে সুখে রাখতে পেরেছি। কিন্তু না, আসলে তুমি ভেতর থেকে সুখী ছিলে না। সুখী হওয়ার ভান করে থাকতে তুমি।’

নীলাক্ষী অম্লানের দিকে অবাক হয়ে তাকালো, ‘সেটা তুমি কীভাবে জানলে?’

অম্লান বলল, ‘বিয়ের একদিন পর, বৌভাতের প্রোগ্রাম শেষ করে আমরা তোমার বাসায় এসেছি। তখনো তো আমার প্রেমে তুমি পড়োনি, সারাক্ষণ লাজুক মুখে আমার সামনে বসে থাকতে। লজ্জায় আমার দিকে তাকাতে না, এমনকি লজ্জায় কথাও বলতে পারতে না। সেইদিনই কিন্তু তুমি জেনে গেছো আমার জীবনে কেউ ছিল, যার অস্তিত্ব এখনো আছে। আমি যখন বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে প্রফুল্ল’র সাথে ফোনে কথা বলেছি তুমি সব শুনেছো। শুনে তোমার উচিৎ ছিল সেদিনই আমাকে জিজ্ঞেস করা, আমি কার সাথে এসব কথা বললাম? তুমি আমার নতুন বউ, আমি কী বিয়ের পরেরদিন তোমাকে বলবো আমার প্রেমিকা কল দিয়েছে? আমি আড়ালে কথা বলেছি সেটাই তো যেকোনো পুরুষই করতো। কিন্তু তুমি কী করেছো? সব শুনেছো, বুঝেছো, এমনকি আমার ফোনের কল লিস্টে ঢুকে ফাইরুজের নাম্বারটা পর্যন্ত দেখেছো। তারপর ফাইরুজকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছো, আমার কার সাথে সম্পর্ক আছে? ফাইরুজ তোমাকে প্রফুল্ল’র ব্যাপারে সব বলেছে। এমনকি প্রফুল্ল’র নাম্বার দিয়েছে। তুমি প্রফুল্ল’র জীবন থেকে দুঃখ দূর করতে ওকে একজন সঙ্গীও পাঠিয়েছো। আমি এসব টেরও পাইনি, এমনকি প্রফুল্লও কোনোদিন জানতে পারবে না, সে যার সাথে সংসার করছে সে আসলে অম্লানের স্ত্রী’র ঠিক করে দেয়া একটা ছেলে। যাকে অম্লানের স্ত্রী বলেছিল, প্রফুল্ল’কে হাসিখুশি রাখো, ওর ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করো। কী অদ্ভুত! একটা মেয়ে এসব জেনেশুনে করছে, নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছে। তারপরও সে আমার সাথে সংসার করে, আমার প্রেম দেখে সুখে ছিল? আমি এটা কীভাবে বিশ্বাস করবো নীলাক্ষী? দুনিয়ার কোন মানুষ এটা বিশ্বাস করবে? তুমি কখনো আমার সাথে সুখী ছিলে না, সুখী হওয়ার অভিনয় করেছো। অথচ আমিও সেটা কখনো বুঝতে পারি নি।’

অম্লান উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কথা বলা বন্ধ করলেও ওর কণ্ঠনালী, ওর দেহ কম্পিত হচ্ছে। যেন এই কথাগুলো কখনো নীলাক্ষীকে বলতে চায় নি ও। তবুও পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে বলতে হলো।

নীলাক্ষীর গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছে ওর। কান্নায় ভিজে গেলো ওর চিবুক, ওষ্ঠ ও গলা। অম্লান ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। কথা বলতে গিয়ে ওর নিজেরও গলা ভিজে এলো।
‘নীলু, তুমি নিশ্চয়ই জানো ওই ছেলেটাকেই প্রফুল্ল বিয়ে করেছে। আমি জেনেছি মাত্র দুদিন আগে। তুমি হয়তো ভাবছো প্রফুল্ল’র বিয়ের কথা শুনে আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি। এটা যদি ভেবে থাকো, সেটা তোমার ভুল ধারণা। আমার ফিরে আসার সাথে প্রফুল্ল’র বিয়ে হওয়ার সম্পর্ক নেই। একটা ব্যাপারই আমাকে অবাক করেছে, তুমি প্রথম থেকেই সবকিছু জেনেও আমার সাথে থেকেছো। হাসিখুশি ছিলে, আমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছো সবসময়। কখনো আমাকে বুঝতেও দাওনি তুমি ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছো। এসব কেন করেছো? শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসো বলেই। আমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাও বলেই। টেকনাফে গিয়ে আমি যখন তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করি, তুমি সেদিন ঠিকই বুঝে গিয়েছিলে আমি তোমার সাথে দুরত্ব বাড়াচ্ছি। তুমি সব জেনেও ছুটে গেছো, চেষ্টা করেছো সবকিছু না জানার ভান করে সংসার সাজানোর। অন্য কেউ হলে তখনই সম্পর্ক শেষ করে দিতো। কিন্তু তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে গিয়ে আমার সেবায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে। কারণ তুমি আমাকে হারাতে চাও না। যে মেয়ে আমাকে এতটা ভালোবাসে, তাকে ভালো না বেসে আমি থাকতে পারলাম না নীলাক্ষী। এসব কারণেই আমি আবার ফিরে এসেছি। প্রফুল্ল’র বিয়ে হয়েছে বলে নয়। আর বিশ্বাস করো, আমি বিয়ের পর কোনোদিনও নিজে থেকে প্রফুল্লকে কল দেইনি, কোনোদিনও ওকে নিয়ে ভাবি নি। আমি শুধু একা থাকার জন্যই ওখানে গিয়েছিলাম। তুমি কী আমাকে বুঝতে পারছো নীলু?’

অম্লান নীলাক্ষীর হাত ধরামাত্রই নীলাক্ষী ওর বুকে ঢলে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর কান্না দেখে অম্লানেরও কান্না এসে গেলো। নীলাক্ষী বলল, ‘আমাকে কেউ কখনো এত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে নি। তুমি আমাকে কীভাবে বুঝলে অম্লান? আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। বিয়ের দিন তুমি আমাকে চা খাওয়ার জন্য ফুটপাতে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলে, মনে আছে তোমার? তখনই তোমার প্রেমে পড়ে যাই আমি। সেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তোমাকে প্রথম ভালো করে দেখি। একটু একটু করে তোমাকে আমি আপন করে নিচ্ছিলাম। তোমার মায়ার বাক্স, তোমার প্রত্যেকটা প্রেমের আলাপন, সবকিছু আমাকে আন্দোলিত করতো। আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি। তাই তোমাকেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি। তুমি প্রফুল্লকে যা যা বলেছো সব শুনে আমি বুঝেছিলাম তুমি ওকে চাও না। তোমার প্রেম আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। আমি চেয়েছি তোমার জীবন থেকে সবকিছু দূর করে দিয়ে দুজন মিলে অনেক সুখী হতে। আমি প্রতিদিন তোমার ফোন চেক করতাম, প্রফুল্ল কল দিয়েছে কিনা দেখার জন্য। আমি তোমার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড রিসেট করে নতুন পাসওয়ার্ড দিয়ে ল্যাপটপে লগ ইন করে রেখেছি, তুমি জানোই না সেসব। আমি রেগুলার খেয়াল রাখতাম তুমি কার সাথে কি কথা বলো। যখন দেখতাম কখনো কোনো বন্ধুর সাথেও প্রফুল্ল’র ব্যাপারে কথা বলো না, আমি দারুণ খুশি হতাম। আমি তোমাকে সবসময় আগলে রাখতে চেয়েছি। সারাক্ষণ এক ধরনের অনিশ্চয়তা আর টেনশনে ভুগলেও আমি তোমার সাথে সবসময় হাসিখুশি থেকেছি। আমি তোমাকে টেনশন দিতে চাইনি কখনো। ভালোবাসি যে!’

অম্লানের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে মনের সব কথা খুলে বললো নীলাক্ষী। অম্লান নিজেও কাঁদছে আজ। ওর মনে হচ্ছে নীলাক্ষী ওকে বুঝতে পারে, ওকে পড়তে পারে বইয়ের মতো। নীলাক্ষীকে বুকের ভেতর শক্ত করে চেপে ধরতে ইচ্ছে করলেও অম্লান ধরলো না, নীলাক্ষী নিজেই ওকে ধরবে সেই অপেক্ষা করতে লাগল। কতক্ষণ এভাবে কেটে গেল ওরা কেউই বুঝতে পারলো না।

অনেক্ষণ পর নীলাক্ষী মাথা তুলে চোখ মুছলো। অম্লানের দিকে তাকাতে পারলো না নীলু। মাথা নিচু করেই বলল, ‘আমাকেও তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমার প্রাক্তনের সাথে অন্য কারও যোগাযোগ করিয়ে দেয়া, এসব আসলে ঠিক হয় নি। আমি জানিনা কেন এই কাজ করেছি! কিন্তু কথাটা কোনোদিনও প্রফুল্ল জানতে পারলে আমাকে ক্ষমা করবে না।’

‘উল্টোটাও হতে পারে। ওর জীবনটা একটা দুর্যোগ থেকে বেরিয়ে আবারও সুন্দর হয়ে গেছে, তাই তোমাকে ধন্যবাদও জানাতে পারে।’

‘আর আমরা?’

অম্লান কিছু বলল না। নীলাক্ষী নিজেই বলল, ‘আমার ওপর তোমার কী অনেক রাগ হচ্ছে?’
‘না। আমি অবাক হয়েছি। কিছুটা কষ্টও পেয়েছি।’

নীলাক্ষী চুপ করে রইল। অম্লান বলল, ‘আমরা দুজনেই কত চমৎকার অভিনয় করে গেছি তাইনা? তুমি সবসময় আমাকে বলো বাদামী সংসার, এর দায় আমাকেই দিতে। অথচ তুমিও..’

নীলাক্ষী অম্লানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্লিজ চুপ করো। আমি আমার দোষ স্বীকার করছি। আমার উচিত ছিল প্রথমেই তোমার সাথে সবকিছু খোলাখুলি কথা বলা। আমিও তাহলে এতদিন অশান্তিতে ভুগতাম না।’
‘কিন্তু প্রথম দিনে সব বলে দিলে আমাদের সম্পর্কটা হয়তো সেদিনই শেষ হয়ে যেতো।’
‘যা হয়েছে ভালো হয়েছে।’
‘তোমার তো শাস্তি হওয়া দরকার। যেমনটা আমার হচ্ছে। আমাকে তো তুমি শাস্তি দিচ্ছো। দূরে রেখে। আমি তোমাকে কী শাস্তি দিবো?’
‘তুমি আমাকে এতদিন ধরেই শাস্তি দিয়ে আসছো। আর কত শাস্তি দেবে?’

দুজনের কেউই আর কোনো কথা বললো না। নীলাক্ষীর কান্না থেমে গেছে। গালে জলের দাগ লেপ্টে রয়েছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হয় অম্লানের। অম্লান কাছে এগিয়ে এসে নীলাক্ষীর চিবুকে হাত রেখে বলল, ‘কী ভাবছো?’
‘আজকের রাতটা সুন্দর। এটাকে কান্নাকাটি করে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।’
দুজনে স্তব্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিদ্যুৎ চলে গেল সেই মুহুর্তে। অন্ধকারে নির্জনতা আরও তীব্র হয়ে উঠলো। অন্ধকার চোখ সয়ে এলে অম্লান ও নীলাক্ষী বুঝতে পারে দুজনে এখনো একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।

অম্লানের ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ। বাড়ি থেকে কল। অম্লান ফোন ধরতেই শুনতে পেলো মায়ের উদ্বিগ্ন গলা, ‘তুই কই?’
‘মা আমি নীলুদের বাসায়।’
‘দোয়েলকে হসপিটালে নিয়েছি। তোরা যাওয়ার পরপরই ওর ব্যথা আরম্ভ হয়েছে।’
‘আমরা এক্ষুনি আসছি। ভাইয়াকে খবর দিয়েছো?’
‘তোর ভাইয়াই দোয়েলকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমি মাত্র আসলাম। ডাক্তার দেখছে ওকে। নীলাক্ষীর সাথে কথা বলেছিস বাবা? ও তো রাগ করে চলে গেলো।’
অম্লান হেসে বলল, ‘চিন্তা কোরো না। তুমি ভাবীর দিকে খেয়াল রাখো। বছর খানেক পর আরেকটা নাতি দেখার অপেক্ষায় থাকো।’

মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলো অম্লান। নীলাক্ষী ওকে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবীর কী অবস্থা?’
অম্লান নীলাক্ষীর হাত ধরে বলল, ‘টেনশন কোরো না। ভাইয়া পাশে থাকলে ভাবীর জন্য সবকিছুই সহজ হয়ে যাবে। চলো বেরিয়ে পড়ি।’
অম্লান চলে যেতে উদ্যত হয়। নীলাক্ষী অম্লানের হাত টেনে ধরে বলল, ‘আর আমার জন্য?’

অম্লান অন্ধকারের ভেতর নীলাক্ষীকে বুকে চেপে ধরে বললো, ‘তোমার পুরো জীবনটাই সহজ হয়ে যাবে। আমি ভীষণ সরি। আমাকে মাফ করে দাও।’
‘আমিও সবকিছুর জন্য অনেক সরি। আমাকেও মাফ করে দাও।’
‘আজ থেকে আমি তোমার সাথে আর কখনো কিছু লুকাবো না। তোমাকে সবকিছু বলে দেবো। অনেক ভালোবাসবো তোমায়।’
‘আর আমিও ভালো থাকার ভান ধরবো না। আমার ভালোবাসাটাকেও লুকিয়ে রাখবো না।’
‘ সাক্ষী কে?’
‘বৃষ্টি আর তুমি। আর তোমার?’
অম্লান নীলাক্ষীর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘শুধুই তুমি।’

সমাপ্ত

আমি সবার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী কারণ গল্পটা দিতে অনেক বিলম্ব করেছি। দীর্ঘদিন পরপর পোস্ট করেছি, সবার নিশ্চয়ই অনেক রাগ হতো। আসলে ব্যক্তিগত কিছু কারণে আমার নিয়মিত এই গল্পটি লেখার অবকাশ পেতাম না। তবুও দীর্ঘদিন পর পোস্ট করার পরও যারা সুন্দর মন্তব্য করতেন, এটা সত্যিই আমার জন্য অনুপ্রেরণার ছিল। ভালো লাগা বা খারাপ লাগা যেটাই হোক, জানাবেন। তাহলে অনেক খুশি হবো। পরের গল্পগুলো আশাকরি নিয়মিতই পোস্ট করবো। ভালোবাসা সবার জন্য ❤️
– মিশু মনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here