পর্ব ৯
একটা মেয়ে বিয়ের মাধ্যমে যেন শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলে। চেহারায় ফুটে ওঠে প্রতুল লাবণ্য। হৃদয়ের আকাশে অতদ্র প্রহরীর মত রংধনু জাগ্রত হয়ে ওঠে। গোধূলির পূর্বে রোদের ঝিলিকে যেমন সাতরঙা রংধনু আকাশকে রাঙিয়ে তোলে, তেমনি রাঙা হয়ে ওঠে নববধূর ভরাযৌবন। কাঁচা হলুদের সুবর্ণ রঙের স্পর্শে রূপে নেমে মাধুর্যতা। গায়ে জড়ানো নতুন শাড়ি, শরীরের সাথে মানানসই ব্লাউজ, নাকে হিরণের নাকফুল, কি অপূর্ব মোহিনীশক্তি অর্জন করে ধীরেধীরে সে রমণী হয়ে ওঠে!
একইসাথে একটা পুরুষের বিয়ের মাধ্যমে আসে দৃঢ়তা। সর্বদা হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা মানুষটাও লাজুক হাসিতে মাথা নুইয়ে বসে থাকে। পরনে শেরোয়ানী, মাথায় পাগড়ী, আঙুলে আংটি। কাঁচা হলুদের লেপনে তার শরীরের দীপ্তিময়তা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ভালোবাসার বর্ষণে সিক্ত হতে থাকে হৃদয়। নতুন কাউকে আপন করে পাবার তীব্র তৃষ্ণায় মন তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। জীবনের পরিপূর্ণতার এই পর্যায়ে এসে নবজীবনের আস্বাদনে সেও যেন হাজার বছর বাঁচবার স্বপ্ন দেখে।
বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি
বিয়ে বাড়ির হৈ হুল্লোড় জমে দ্বিগুণ। যাকে বলা যায় জমে একেবারে ক্ষীর। একদল ছেলেমেয়েরা নাটক ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, আত্মীয় স্বজনরা সবাই দর্শক সাড়িতে বসে তাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করায় মগ্ন। এই সুযোগে এক বাচ্চা আবার চকলেট বিক্রি করতে নেমেছে। দশ টাকার চকোলেট বিক্রি করছে বিশ টাকায়। অনেকেই কিনতে আপত্তি দেখালে জোর করে তার কোলের উপর চকোলেট ছুঁড়ে মারে আর মিনিট দশেক পরে এসে বলে, দেন টাকা দেন। বাচ্চাটার পরনে লুঙি, গায়ে ফতুয়া আর মাথায় বাঁধা গামছা। ছোট্ট বাচ্চাটিকে দেখলেই আদর লাগছে। কেউ আবার দ্বিগুণ দামে বেশি করে চকোলেট কিনছে। চকোলেট বিক্রির আইডিয়াটা কোথায় পেলো এই নিয়েও অনেকের চিন্তা আবর্তিত হচ্ছে। অম্লানের বন্ধুরা বলাবলি করছিলো, যে বাচ্চা এত ছোট বয়সেই বিজনেস করছে সে বড় হলে নামকরা বিজনেসম্যান হতে পারবে।
অম্লান বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে নাটকের মহড়া উপভোগ করছে, তবে নাটকের ফাঁকে ফাঁকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে নীলাক্ষীর দিকে। নীলা বসে আছে মুরুব্বীদের সাথে। মাথায় ঘোমটা, মেহেদী রাঙা হাত, হাতে মোটা স্বর্ণের চুড়ি, গলায় স্বর্ণের চেইন, নতুন বউয়ের সাজের ষোলকলা পূর্ণ করে চারিদিক আলোকিত করে সে বসে আছে। নীলাক্ষীরও তাই মনে হচ্ছে। শরীরে এক শিরশিরে অনুভূতি, মন উচাটন, চোখে ঘুম ঘুম ভাব, শাড়ি ও গয়নায় নিজেকে জড়িয়ে ওর মনে হচ্ছে ভুল করে কারো স্বপ্নে ঢুকে পড়েছে। তবে নিজের সদ্য পরিপূর্ণতা যেন ওকে খুব করে রাঙিয়ে উজ্জ্বল করে তুলছে। এ যেন রমণীর রূপের মাধুরীতে মেশানো এক বালিকার নব সঁজীবনী।
অম্লানের সাথে একবার নীলাক্ষীর চোখাচোখি হলো, দুজনে একে অপরের দিকে এমনভাবে তাকালো যে মনে এক ধরণের সুখ সুখ হিম হাওয়া বয়ে গেলো। নিষ্পলক দৃষ্টি, বড় মায়া নিয়ে তাকিয়ে রইলো দুজনে। অম্লানের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো সোহাগী হাসি। নীলাক্ষী সেই হাসিতে ক্রমশ নিজেকে হারাতে বসলো।
এক চাচী গ্রাম থেকে এসেছেন। ভীষণ পান খাওয়ার অভ্যাস। তার পানের পিক কিভাবে যেন আরেকজনের সাদা শাড়ির আঁচলে লেগেছে। তাই নিয়ে এক পশলা ঝগড়াও শুরু হয়ে গেলো। অম্লানের মা এসে শান্ত করলেন দুজনকে। ঝগড়ার সময় নীলাক্ষী অম্লানের দিকে তাকালে অম্লান চোখ টিপ মারলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো নীলা।
ঝগড়া শান্ত হওয়ার আগেই নীলাক্ষী উঠে ঘরের দিকে গেলো। অম্লান চারিদিকে চোখ ঘোরাচ্ছে। নাহ, আর কিছুই দেখতে ভালো লাগছে না। সবকিছুকে বর্ণহীন ফ্যাকাশে লাগছে। মনে হচ্ছে সমস্ত ফিলিংস নিয়ে নীলা উঠে চলে গেছে। বন্ধুমহল নতুন বিষয় নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাতেও মজাটা ঠিক পাচ্ছে না অম্লান। ওর মনটা উঠে ঘরে চলে গেছে যেন। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে অম্লান বললো, ‘তোরা একটু বস। আমি আসছি।’
ফাইরুজ নীলাক্ষীর বসার জায়গাটির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার। যাও যাও। হেল্প লাগলে বইলো।’
বন্ধুরা হেসে উঠলো। অম্লান দ্রুত চলে এলো নিজের ঘরে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো নীলাক্ষী ফোনে কথা বলছে। অম্লান নিঃশব্দে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
নীলাক্ষীর গলাটা ভেজা। বোধহয় বাবা মাকে খুব মনে পড়ছে ওর। ফোনে কথা বলতে গিয়ে বারবার ওর কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। নীলাক্ষী ফোনে বললো, ‘আব্বু তুমি নাস্তা করো প্লিজ। এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে তোমার গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হবে।’
অম্লান বললো, ‘ফোনটা দাও তো আমি একটু কথা বলি।’
অম্লান ফোন কানে ধরে সালাম জানিয়ে বললো, ‘আব্বু আপনি কেমন আছেন?’
আমজাদ সাহেবের গলায় আনন্দ ঝড়ে পড়তে লাগলো। তিনি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
– ‘আমি খুব ভালো আছি আব্বু। নীলাও খুব ভালো আছে। আপনি নাকি টেনশনে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন?’
– ‘না না। খাইছি তো দুপুরে।’
– ‘নাস্তা করেন নি কেন? আপনি খাওয়াদাওয়া করেননি শুনলে আপনার মেয়েও না খেয়ে বসে থাকবে। তখন আমাদের বাড়িতেও সবাই খাবে না। বিষয়টা কি ভালো হবে বলুন তো আব্বু?’
আমজাদ সাহেবের গলা শুনে মনে হলো তিনি হয়তো খুশিতে কেঁদেই ফেলবেন। বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা আমি এখনই খাচ্ছি। নীলা যেন ঠিকমতো খাবার খায় একটু খেয়াল রাইখো আব্বু।’
– ‘আচ্ছা আব্বু আপনি টেনশন করবেন না একদমই। কালকেই তো আমাদের দেখা হচ্ছে। আপনারা তারাতাড়ি চলে আসবেন।’
– ‘আচ্ছা বাবা। তুমি খাওয়াদাওয়া করেছো?’
– ‘হ্যাঁ। আম্মুর দিকে খেয়াল রাখবেন। ওনাকেও বলবেন যেন টেনশন না করে। আপনারা দুশ্চিন্তা করছেন এই ভেবে আপনাদের মেয়েও এখানে দুশ্চিন্তা করবে। বুঝেছেন?’
আমজাদ সাহেব সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলেন। ওনার এখন ভীষণ শান্তি শান্তি লাগছে। জামাইয়ের সাথে কথা বলার পর বুকটা ভরে গেছে। কি সুন্দর করে ‘আব্বু’ ডাকছিলো। মনে হচ্ছে মেয়েটা খুব ভালো আছে ওখানে। আমজাদ সাহেব ফোন রেখে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মেয়েটা সুখী থাকলেই তো তিনি আর কিছু চান না।
অম্লান নীলাক্ষীর পাশে এসে বসলো। বললো, ‘কি ব্যাপার নীলক্ষেত?’
– ‘নীলক্ষেত?’
– ‘নীলাক্ষী, নীলক্ষেত। দারুণ মিল আছে না?’
– ‘নিজের বউ জন্য যা মুখে আসে তাই বলবেন?’
– ‘একশো বার বলবো। আমার বউকে আমি টউ বানিয়ে রাখবো। কার কি?’
– ‘কিচ্ছু না। আপনার যা ইচ্ছে আপনি ডাকেন।’
– ‘আচ্ছা ফেসবুকে আমাকে এড করো না, একটা বিবাহ স্ট্যাটাস দেই।’
– ‘বিবাহ স্ট্যাটাস দেয়া লাগবে না।’
– ‘রাতের ছবিটা আপলোড দেই, সাথে একটা মজাদার ক্যাপশন। সবাই খুব খাবে।’
– ‘আমার অত দরকার নাই তো।’
নীলাক্ষী ওঠার চেষ্টা করলো। অম্লান একটানে ওকে বিছানার ওপর ফেলে হাত দুটো শক্ত করে ধরে বললো, ‘এত পালাই পালাই করতেছো কেন শুনি? চড়ুই পাখির মত?’
– ‘আমার লজ্জা করে ‘
অম্লান নীলাক্ষীর হাতের ওপর হাত রেখে বললো, ‘শোনো আমার মাথায় একটা বিজনেস আইডিয়া এসেছে। তোমার লজ্জাগুলো উত্তোলন করবো ভাবছি। লজ্জা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে প্যাকেটে তুলে বিক্রি করবো। ফ্যাক্টরির সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, ‘এখানে লজ্জা বিক্রি করা হয়’। তুমি চাইলে একটা অনলাইন শপ খুলে ফেলতে পারবা। প্রচুর কাস্টমার পাবা। যার লজ্জা শরম নাই তার বাপ মা, স্বামী, বয়ফ্রেন্ড বা চৌদ্দগুষ্ঠির যে কেউ লজ্জা কিনে তাকে গিফট করবে। আইডিয়াটা দারুণ না?’
নীলাক্ষী হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, ‘আপনার মাথায় রাজ্যের সব আজগুবি চিন্তা আসে তাইনা?’
– ‘কোন রাজ্যের?’
– ‘আবার জিগায় কোন রাজ্যের? আমার মাথা রাজ্যের।’
– ‘তোমার মাথা রাজ্য? সেখানকার রাজা কে শুনি?’
– ‘ভোদলচন্দ্র।’
– ‘ভোদলচন্দ্র কি তোমার মাথায় চেয়ার নিয়ে বসে থাকে? কি বিশ্রী ব্যাপার। ভোদলের পেটটা নিশ্চয় অনেক উঁচু? সেফুদার মতো?’
– ‘উফফ আপনি একটা.. ‘
– ‘বাক্য শেষ করো। নয়তো আমি খারাপ শব্দ বসিয়ে নেবো। তুমি কি চাও আমি মনেমনে খারাপ কিছু ভাবি?’
– ‘উফফ থামুন তো। গত রাত থেকে আমাকে জ্বালাতে জ্বালাতে শেষ করে দিচ্ছেন।’
– ‘দেবো তো। শেষ করবো, আবার জ্বালাবো, আবার পোড়াবো। আবার জ্বালাবো, আবার শেষ করবো। যতদিন আছো ততদিন এ জ্বালা সইতে হবে।’
ব্যস্ততার কারণে আজকের পর্ব ছোট হয়ে গেলো। আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
চলবে..