বাদামী সংসার
পর্ব ৪৫
আকাশে মেঘ জমেছে। কিছুটা কালচে ধরনের ছাই রঙা মেঘ। মনে হচ্ছে এখনই নামবে বৃষ্টি। বাতাসে ধূলো উড়ছে, উড়ছে কামিজের নিচের অংশ, উড়ছে শুকনো পাতা। ছোট করে কাটা সামনের অংশের চুলগুলো বারবার মুখের ওপর এসে পড়ছে। চুল সামলাতে সামলাতে নীলাক্ষী দোয়েল চত্বরের মোড়ে ঘুরেঘুরে গাছের চারা কিনছে। সবুজ চারাগুলো উজ্জ্বলতায় ভরপুর। দোকানীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জিনিসপত্র পলিথিন দিয়ে ঢাকতে। তারই মাঝে এক দোকানীর কাছ থেকে জোরপূর্বক গাছ দরদাম করছিল নীলাক্ষী। দোকানী বলল, “আপা, আপনি এই আট টা চারা ছয়শোতে দিতেছি তারাতাড়ি নিয়া যান। ঝড় আইতাছে।”
নীলাক্ষী দোকানীর ব্যস্ত ভঙ্গীকে উপেক্ষা করে বলল, “মামা, চারশো রাখেন। আর দামাদামি কইরেন না।”
নীলাক্ষীর বলা দাম দোকানীর পছন্দ হয় নি। তিনি দ্রুত দোকানের ওপর পলিথিন টেনে দিলেন। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম করে শব্দ হচ্ছে। আশেপাশের সব দোকান বন্ধ হয়ে হলো। নীলাক্ষী দোকানগুলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বৃষ্টি নামবে, কোথায় আশ্রয় নেয়া দরকার। টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে এর মধ্যেই। এমন সময় কোথ থেকে একজন মাথার ওপর ছাতা এগিয়ে ধরলেন। নীলাক্ষী কিছুটা অবাক হয়ে আগন্তুকের দিকে তাকালো। এখন অতকিছু ভাবার সময় নেই। দ্রুতপদে একই ছাতার নিচে হাঁটতে হাঁটতে যাত্রী ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ালো তারা। যুবকের সাথে চোখাচোখি হতেই নীলাক্ষীর সমস্ত সত্ত্বায় কাঁপুনি ধরে গেল। অজান্তেই শিউরে উঠলো নীলাক্ষী। যুবকের ভেজা চিবুকে লেপ্টে থাকা জলের বিন্দুগুলো তার বহু পরিচিত। ইচ্ছে করলো হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেই সেই চোখ, সেই গাল। কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিলো নীলাক্ষী। ভেতরে একটা শুকিয়ে যাওয়া ফুলের অস্তিত্ব তাকে কঠিন শক্ত করে তুললো। খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছে। সামনেই বৃষ্টিতে ভিজছে দোয়েল চত্বরের সেই বিখ্যাত দোয়েল আর পলিথিনে মোড়ানো কিছু রিকশা।
বাদামী সংসার
লেখা- মিশু মনি
ক্লান্ত শরীরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অম্লান। রাত সারে দশটা বাজে। খিদেয় পেট মোচড় দিচ্ছে। কিন্তু কোনোকিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। সবকিছু বড্ড অর্থহীন, ভীষণ নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে। প্রথম কয়েকটা দিন নীলাক্ষীর স্পর্শ সারাক্ষণ ছুঁয়ে থাকতো ওকে। বিছানার চাদরে, বালিশের কভারে, প্রত্যেকটা থালাবাসনে নীলাক্ষীর ঘ্রাণ মিশে থাকতো। জানালার দিকে তাকালেই মনে হয়, ওখানে নীলাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে মুহুর্তের জন্যও নিজের থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। অথচ একটা মাস তাকে ছাড়া দিব্যি চলে গেল দিন। অম্লান ভালো আছে কি না জানেনা, কিন্তু কাউকে জোর করে ভালোবাসার দায় থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। আর মুক্তি দিয়েছে একটা পবিত্র মেয়েকে। তবুও কোথাও এতটুকুও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই।
কয়েকদিন আগে সমুদ্রের তীরে হাঁটতে গিয়েছিল অম্লান। নীলাক্ষীর পাগলামি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বারবার। ওর সমুদ্রের দিকে ছুটে যাওয়া, প্রাণখুলে হাসা, উচ্ছলতায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল নীলু। সবকিছু কত স্পষ্ট, অথচ আজ দুজনের পথ দুদিকে।
সমস্ত পিছুটানকে ছাড়িয়ে ধীরেধীরে অম্লান এক নতুন অম্লানে পরিণত হলো। এই অম্লানের কোনো দায়িত্ব নেই, কোনো পিছুটান নেই, কাউকে স্বপ্ন দেখানোর তাগিদ নেই, স্বপ্ন পূরণের স্পৃহাও নেই। সবকিছুকে ছেড়ে দিয়ে জীবনের নতুন মানে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে এখন।
অফিসে বেশ কয়েকদিনের ছুটি। অম্লান ওর বন্ধু ফাইরুজকে চলে আসতে বলল। দু বন্ধু মিলে ঘুরতে গেল সেন্ট মার্টিন। ট্রলারের ধাক্কায় নৌকা যতবার উপড়ে উঠছিল, ততবারই নতুন এক শিহরণ দোলা দিচ্ছিল মনে। সবকিছুকে ছেড়ে একা থাকার আনন্দে দেহ মনে এক অন্যরকম সুখের জোয়ার বইছিল। কিন্তু সেই সুখও বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। নিজেকে সারাক্ষণ কেমন একা একা লাগছিল।
সমুদ্রের তীরে বালির ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে অম্লান ও ফাইরুজ। প্রকৃতি, আকাশ, সমুদ্র ছাড়া কথা বলার মতো তেমন কোনো বিষয় নেই। হঠাৎ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই ফাইরুজ বলে উঠলো, “প্রফুল্ল বিয়ে করেছে।”
“হুম জানি। শুনেছি।”
“সব খোঁজ খবরই রাখা হয় দেখছি।”
“আমি রাখি নি। যেকোনো ভাবে খবরটা আমার কানে এসে পৌঁছেছে।”
“ওহ আচ্ছা। তো যাকে বিয়ে করেছে তাকে চিনিস? প্রফুল্ল তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। দুজন দুজনের প্রতি বেশ মনোযোগী।”
“এটা তো ভালো খবর। প্রফুল্ল এই ট্রমা কাটিয়ে উঠবে সেটা আমি কল্পনাই করিনি। আমি নিজেই যেটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি সেটা প্রফুল্ল পারবে এটা অবিশ্বাস্য।”
ফাইরুজ এক গাল হেসে বলল, “প্রফুল্ল এটা কিভাবে কাটিয়ে উঠেছে সেটা জানিস তো বন্ধু?”
“না। বিশেষ কোনো কারণ আছে নাকি? থাকলে বল আমিও চেষ্টা করি।”
“হা হা হা। কারণটা হচ্ছে তোর বউ, নীলাক্ষী।”
“আমার বউকে দেখে হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে নতুন করে জ্বলে উঠেছে?”
“না বন্ধু। তোর বউ একটা ছেলেকে রিকোয়েস্ট করে পাঠিয়েছিল যেন প্রফুল্লকে এই ডিপ্রেশন থেকে টেনে তুলতে পারে। তারপর প্রফুল্ল স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ওদের ভালো বন্ধুত্ব হয়। সেটা কোনো এক কারণে ধীরেধীরে যোগাযোগও কমে যেতে থাকে। একসময় যোগাযোগ বন্ধও হয়ে যায়। এরপর প্রফুল্ল বিয়ে করে ফেললো। এবং বিয়েটা সেই ছেলেটাকেই করলো।”
বিস্ফারিত হলো অম্লানের চোখ। ফাইরুজের কথা শুনে ওর দম আটকে গেছে মুহুর্তের জন্য। ওর এই হতবিহ্বল অবস্থা দেখে ফাইরুজ বলল, “নীলাক্ষী সবকিছু জেনেশুনেও তোকে কতটা ভালোবেসেছে। আমি অবাক হয়ে যাই। অথচ তোকে কখনো বুঝতেও দেয় নি।”
“সবকিছু জানে এটা আমিই ওকে বলেছি। কিন্তু আসলে আমাকে কী বুঝতে দেয় নি বলতে চাচ্ছিস?”
“বন্ধু, নীলাক্ষী বিয়ের সময় থেকেই সব জানে। মনে আছে, তোর বিয়ের একদিন পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলি? সম্ভবত বৌভাতের দিন। ওখানে যাওয়ার পর এক রাতে প্রফুল্ল ছুটে এসেছিল আমার কাছে। আমি তোকে কল করে রিকোয়েস্ট করেছিলাম ওর সাথে কথা বলার জন্য?”
“হুম। মনে আছে। কী হয়েছিল বলতো?”
“তুই ফোনে কথা বলার সময় নীলাক্ষী চা বানাতে গিয়েছিল। ও চলে আসার পর তোর ফোনালাপের কিছু অংশ শুনতে পায়। কিছু মেয়েদের ব্রেইন এতটাই তুখোড় যে, এরা সামান্য একটা বাক্য শুনলেই পুরো ঘটনা বুঝে ফেলতে পারে। শুনলে অবাক হবি, নীলাক্ষী আমার কাছ থেকে প্রফুল্ল’র নাম্বার চেয়ে নিয়েছিল। আমি জানতাম না সে ওর নাম্বার দিয়ে কী করবে। আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিল যেন তোকে কিছুই না বলি।”
কথাগুলো বলার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফাইরুজ। “এখন তো সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন বলাই যায়। প্রফুল্ল অনেক ভালো আছে। ওর সাথে আমার কয়েকদিন আগেও দেখা হয়েছিল। ও প্রেগন্যান্ট।”
সমুদ্রের ঢেউ এসে অম্লানের গা ভিজিয়ে দিয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ফাইরুজ। কিন্তু অম্লান উঠলো না। ঠায় বসে রইলো সে। সবকিছু অচেনা লাগছে ওর। নীলাক্ষীকে হানিমুনে গিয়ে প্রথম প্রফুল্ল’র ব্যাপারে বলেছিল অম্লান। অথচ নীলাক্ষী সেদিন বুঝতেই দেয় নি যে, সে আগে থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এ কারণেই রুমে গিয়ে ওর ওপর লাফিয়ে উঠে ভীষণ রিয়্যাক্ট করেছিল নীলাক্ষী। “মেয়েটার জীবনের প্রথম ভালোবাসা আমি।” বিড়বিড় করে বলে উঠলো অম্লান।
ফাইরুজ বলল, “কি রে ওঠ? জোয়ার আসছে তো।”
“আসুক। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাক। প্রফুল্ল’র ভালো থাকার কথা শুনে আমার আফসোস হচ্ছে না। কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে। কারণ আমি ওকে ভেবেই এতদিন ধরে নিজেকে কষ্ট দিয়ে আসছি।”
“তুই ঘোরের মধ্যে ছিলি, এখনো আছিস। প্রফুল্ল’র ঘোর কেটে গেছে। তুইও এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আয়। বাস্তব পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এটাকে উপভোগ কর।”
“দোস্ত, ও চলে যাওয়ার পর থেকে আমি একবারও কল দেই নি।”
অদ্ভুত চোখে অম্লানের দিকে তাকিয়ে রইলো ফাইরুজ। সেই চোখের ভাষা বুঝতে পারলো না অম্লান। কেবল মৃদু স্বরে বলল, “সবকিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার।”
ফাইরুজ অম্লানকে ধরে ধীরেধীরে হোটেলে নিয়ে চললো। ধীরেধীরে উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করেছে অম্লান। রুমে গিয়ে বিয়ারের ব্যবস্থা করলো। বেশ কয়েক পেগ বিয়া খেয়ে টালমাটাল অবস্থায় বেহুশ হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ওর এখন একটা লম্বা ঘুম দরকার।
ঘুম ভাংলো ঠিক দুপুরবেলা। বিছানা ছেড়ে উঠলো অম্লান। একটা সিগারেট ধরালো। ফাইরুজ এসে হাতে কচি ডাব দিয়ে ঠোঁট থেকে সিগারেট টান মেরে নিয়ে বলল, “এটা খা। স্বাস্থ্যকর খাবার। কটকটা রোদে বাইরে হেঁটে আসলাম। জোস একটা ফিলিংস হচ্ছিল।”
অম্লান ডাবটা রেখে দিলো বিছানার ওপর। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে শুরু করলো বাইরে। যেন আজ এক নতুন জন্ম হয়েছে তার। সবকিছুকে অপরিচিত লাগছে। এমনকি চিনতে পারছে না নিজেকেও।
গরম বালি জুতার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটা ধরলো অম্লান। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। উত্তাপে গা ঘেমে একাকার। হাঁটছে তো হাঁটছেই।
নীলাক্ষী নীল শাড়ি পরে ছুটছে, সমুদ্র নীল, আকাশ নীল, আকাশের মতো একটা মেয়ে নীলাক্ষী। প্রাণবন্ত হাসিতে অম্লানকে কাছে ডাকছে। অম্লান ছুটে গেল তার দিকে। ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরে ওর ওষ্ঠে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে অম্লানের। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই শূন্যতা শুধু নীলাক্ষীর জন্যই। অথচ গতকালও অম্লান বুঝতে পারেনি, তার কেন এত অসহায় লাগে, এত এত শূন্যতা চারপাশে। কিসের বেদনা তাকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে তা এখন স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।
দোয়েলের চত্বরের মোড়ে বৃষ্টিতে ভিজছে দোয়েল। সেদিকে তাকিয়ে আছে নীলাক্ষী। ছাউনিতে গাদাগাদি করে অসংখ্য লোক দাঁড়িয়ে। চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে বৃষ্টির শব্দে। নীলাক্ষীর মনে হচ্ছে সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার শ্রবণশক্তি রুদ্ধ হয়ে এসেছে, বন্ধ হয়ে এসেছে হৃদয়ের দরজা। অম্লানের দেয়া কষ্ট ওকে একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল। প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটত, শুধু চোখের জল সাথে নিয়ে। সেই অভিশপ্ত রাতগুলোর জন্য ওকে কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। আর ক্ষমা না করে নীলাক্ষী ওর দিকে তাকাতেও পারবে না। শরীর ফুঁসে যন্ত্রণা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অম্লান বলল, “চলো বৃষ্টিতে ভিজি।”
চমকে উঠলো নীলাক্ষী। এত সহজ, এত স্বাভাবিক কণ্ঠে সে বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে!
অম্লান নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই চোখ দুটোও অনেকদিন ধরে নির্ঘুম, বুঝতে কষ্ট হয় না নীলুর। ওর বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিতে নীলাক্ষী বলল, “ছাতার নিচে আশ্রয় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আর বিরক্ত না করলেই খুশি হবো।”
“ওকে। বিরক্ত করবো না। বাসায় যাচ্ছি। ছাতাটা রেখে গেলাম। তারাতাড়ি বাড়ি এসো, অপেক্ষা করবো।”
ছাতা রেখেই ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তায় নেমে গেল অম্লান। লোকজন হা করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ভিজে জবজবে হয়ে টিএসসির দিকে হাঁটা ধরলো। নীলাক্ষীর শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। “অপেক্ষা করবো” কথাটা আন্দোলিত করে তুলছে ওর সমস্ত সত্তা।
চলবে..