বাদামী সংসার
পর্ব ৩৩
মিশু মনি

নীলাক্ষী রেস্তোরাঁর ছাদে বসে সৌখিন আসার অপেক্ষায় আছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে, এখনও সৌখিন এলো না। বাসায় ফিরতে দেরী হলে আবার অম্লান ফোন করে হাজারটা প্রশ্ন করবে। নীলাক্ষী বারবার ঘড়ি দেখে উত্তেজিত বোধ করছিলো।

রেস্তোরাঁর ছাদের ওপর খোলা আকাশ। দুপাশে লতানো গাছের ডালপালায় ভরপুর, মাথার ওপর জ্বলছে কাঠের ল্যাম্পশেড। মোটামুটি প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করেছে বলা যায়। চারপাশের পরিবেশ অবলোকন করছে নীলাক্ষী। সাড়ে সাতটা বেজে গেলো, সৌখিনকে কল দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। কি জানি, আসবে কি না!

নীলাক্ষী এক মগ ক্যাপাচিনো অর্ডার করলো। সবেমাত্র কফির মগে চুমুক দিয়েছে সেই সময়ে সৌখিন এসে সামনের চেয়ারে বসলো। দ্রুত অভিযোগ স্বীকার করে আন্তরিকতার সহিত বললো, ‘সরি সরি নীলাক্ষী। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম ছিলো। তাই আসতে দেরী হয়ে গেলো আমার। এক্সট্রিমলি সরি।’

নীলাক্ষী উত্তর না দিয়ে অর্ডার মেনুতে দ্রুত চোখ বুলাতে থাকে। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ফালুদা অর্ডার করে দেয় সৌখিনের জন্য। সৌখিন আবার ভ্যানিলা ফালুদা খেতে ভীষণ পছন্দ করে।

পরবর্তী কয়েক মিনিট নিঃশব্দে অতিবাহিত হয়ে গেলো। কফির মগ ফাঁকা করে নীলাক্ষী বললো, ‘জ্যাম কি মোবাইলেও ছিলো নাকি?’

সৌখিন হাসলো, ‘না। মোবাইল পকেটে ছিলো। আর পাশে এমন একজন ছিলো যে মোবাইল বের করে কল রিসিভ করার সুযোগ পাইনি।’

নীলাক্ষী বাঁকা চোখে তাকালো সৌখিনের দিকে, ‘পাশে স্পেশাল কেউ ছিলো? সে কি আমার সাথে দেখা করার চাইতেও বেশী ইম্পর্ট্যান্ট ছিলো নাকি?’

সৌখিন আবারও একগাল হাসলো। সেই হাসির আভাসে যেন একটা রহস্যময়তা ডুবে আছে।
‘নীলা তুমি আর কিছু খাবে?’
‘না খাবো না। আমি উঠবো। অম্লান এতক্ষণে বাসায় পৌঁছে গেছে হয়তো। আমাকে দেখতে না পেলে আবার..’

সৌখিন হেসে বললো, ‘অম্লান তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?’
নীলাক্ষী বললো, ‘তা তো বাসে। তবে মাঝেমাঝে আমি নিজেই বুঝিনা ও আমাকে ভালোবাসে নাকি পুরোটাই ওর অভিনয়। কখনো মনেহয় সে আমাকে সবকিছুর চাইতে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে, আবার কখনো মনেহয় দোটানায় ভুগছে।’

সৌখিন ধীরেসুস্থে ফালুদা খেতে শুরু করেছে। মাথার ওপর জ্বলতে থাকা আলোটা হঠাৎ নিভে গেলো। নীলাক্ষী চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবখানেই অন্ধকার। হয়তো বিদ্যুৎ চলে গেছে। অন্ধকারের মাঝে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো নীলা।

সৌখিন চুপচাপ। রেস্তোরাঁর ছাদ যেন অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে উঠেছে। অন্ধকারে মাঝেমাঝে ভেসে আসছে হাসির শব্দ। নীলাক্ষী বললো, ‘সৌখিন, এবার কাজের কথা বলো। আমি চলে যাবো।’

সৌখিনের গলা শোনা গেলো, ‘কাজের কথা কিছু নাই। আমি এতক্ষণ প্রফুল্ল’র সাথে ছিলাম।’

হেসে উঠলো নীলাক্ষী, ‘তাই নাকি? তোমাকে বলেছিলাম শুধু ওর ডিপ্রেশন দূর করে দাও। এখন দেখছি তুমি নিজেই ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো।’
‘আরে জানি না। হঠাৎ কেন জানি একটা ফিলিংস টের পাচ্ছি। তবে পাত্তা দিচ্ছি না। আমি ওসব প্রেম টেমে নেই, সোজা বিয়ে। তবে প্রফুল্ল আমাকে বিয়ে করবে বলে মনে হয় না। ওরা বড়লোক, আমরা গরীব।’

নীলাক্ষী কঠিন গলায় বললো, ‘বন্ধু, নিজেকে গরীব ভাব্বা না। মনের দিক থেকে তুমি অনেক বড়লোক। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভালো মানুষটা ছিলা তুমি।’
‘আর ভালো!’ একটা গভীর নিশ্বাস ফেললো সৌখিন। তারপর আবারও বলতে শুরু করলো, ‘ভালো আর কই হলাম। বান্ধবীর একটা উপকার করতে গিয়ে কথা রাখতে পারলাম না। প্রেমে পড়ে গেলাম।’

নীলাক্ষী বললো, ‘দূর বোকা। প্রেমে পড়ছো তো কি হইছে? এখন কাজ আরও ভালো হবে। প্রফুল্ল সব ভুলে নতুন করে শুরু করুক আমিও সেটাই চাই।’

সৌখিন একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘প্রফুল্ল’র মনটা ভালো। একটু চঞ্চল, ছেলেমানুষী করে। কিন্তু দিলটা অনেক ফ্রেশ। তোমার হাজবেন্ড ওকে ছেড়ে দিয়ে কাজটা ঠিক করে নাই।’

নীলাক্ষী অন্ধকারের মাঝে টেবিলে শব্দ করে বললো, ‘বন্ধু, কি বলা এইটা? অম্লান ওকে না ছাড়লে কি আমার বিয়া হইতো ওর সাথে? যাইহোক, যেটা কপালে ছিলো না সেটা হয় নি। এখন আমার দায়িত্ব হচ্ছে অম্লানকে আগলে রাখা।’
‘আগলে রাখো। ও তোমাকে ভালোবাসে বলেই আমার মনেহয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে আশাকরি। মানুষের লাইফে কত কালো অধ্যায় থাকে.. সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জীবন তো থামিয়ে রাখলে চলবে না।’

সৌখিন বললো, ‘হুম। তুমি অনেক মেধাবী এটা জানতাম। সব সেমিস্টারে তোমাকে ফার্স্ট হইতেই হবে। কিন্তু স্বামীর ব্যাপারে এত সচেতন এটা জানতাম না। ভাবতাম ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরা শুধু ক্যারিয়ার নিয়েই ভাবে। হা হা হা।’

নীলাক্ষী বললো, ‘ওসব জানি না। আমার অধিকার আমার চাইই। বিয়ে মানে যে শুধু দায় দায়িত্ব তা কিন্তু নয়। আমার ভালোবাসাও চাই। ওটা যেভাবে হয় আদায় করে নিবো আমি। এখন বলো, ওদের সম্পর্ক কিরকম ছিলো?’

সৌখিন বললো, ‘ওরা অনেক ভালো জুটি ছিলো। একে অপরকে অনেক বুঝতো। ফিজিক্যাল রিলেশন তেমন একটা ছিলো না। কিন্তু একে অপরকে মন দিয়ে ভালোবাসতো।’

নীলাক্ষী কৌতুহলী গলায় জানতে চাইলো, ‘ফিজিক্যাল রিলেশন ছিলো না?’
‘না।’
‘বাহ! অম্লান এত ভালো ছেলে তা তো জানতাম না।’
‘নিজের স্বামীর প্রতি রেস্পেক্ট থাকা উচিত নীলাক্ষী।’
‘আসলেই। এখন শোনো, তুমি তোমার মতো এগোও। যা ভালো লাগে তাই করো। কিন্তু ভাইয়া, প্রেম টেম করো না। সোজা বিয়ে কোরো।’

সৌখিন বললো, ‘হুম। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আর প্রফুল্ল অন্তত অম্লানকে কখনো বিরক্ত করবে না, এটুকু তুমি নিশ্চিত থাকো।’

নীলাক্ষী বললো, ‘অনেক উপকার করলা বন্ধু। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি একটা জিনিস সবসময় বিশ্বাস করি। আমার স্বামী আগে কী ছিলো সেটা তার ব্যাপার। এখন সে শুধুই আমার। তাকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। যদি এখনও সে আরেকজন মেয়ের দিকে ছুটে যায়, সেটা হবে আমার ব্যর্থতা। কেমন মেয়ে আমি, যে নিজের স্বামীকে কন্ট্রোলে রাখতে পারি না। আমি সেইদিনটা আসতে দেবো না। ওকে চতুর্দিক থেকে আগলে রাখবো আমি।’

এমন সময় বিদ্যুৎ চলে এলো, আবারও আলোকিত হয়ে উঠলো চারপাশ। সৌখিন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা। নীলাক্ষী দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বললো, ‘আসি।’
‘আচ্ছা। ভালো থেকো বান্ধবী।’
‘ওহ আরেকটা কথা, তুমি ওকে নিয়ে রিসোর্টে গেছো ভালো কথা। আমাকে একবার জানাও নাই কেন? ওইদিন যখন সামনাসামনি তোমাকে আর প্রফুল্লকে দেখলাম। মাই গড! আমি হাসি আটকাতে পারছিলাম না।’

সৌখিন হেসে বললো, ‘তোমার হাসি আসছিল? আর আমি টেনশনে মরি। কখন অম্লান আবার প্রফুল্ল’র কাছে চলে আসে এই ভয়ে। পুরোটা সময় ওকে আমি চোখে চোখে রাখছি।’

নীলাক্ষী হেসে বললো, ‘তাও লাভ হয়নাই। আমাদের পাশের রুমেই প্রফুল্ল ছিলো। এজন্য পরেরদিন সকালেই অম্লান আমাকে নিয়ে ঢাকায় ব্যাক করেছে। ও আসলে সবভাবেই চেষ্টা করছে প্রফুল্লকে ভুলে যেতে, ছেলেটা ভালো আছে তাইনা?’

সৌখিন বললো, ‘হুম। প্রফুল্লও তাই বলে। অম্লান অনেক অনেস্ট একটা ছেলে।’
‘থ্যাংক ইউ বন্ধু। আসি তাহলে। এরপর কোথাও বেড়াইতে গেলে অন্তত আমাকে একবার মেসেজ দিয়ে জানাইয়ো। নয়তো আবার কোনদিন একসাথে দেখা হয়ে যায়..’

শব্দ করে হেসে উঠলো নীলাক্ষী। তারপর দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে। সৌখিন গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। মুখে মুচকি হাসি। নীলাক্ষীকে সে ইচ্ছে করেই অম্লানের সাথে প্রফুল্ল’র শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টা লুকিয়ে গেছে। কারণ ওটা জানার পর নীলাক্ষী প্রতিনিয়ত কষ্ট পাবে, অম্লানের ওপর থেকে সম্মান উঠে যাবে। স্ত্রী’রা সবকিছু সহ্য করতে পারে, কিন্তু অন্য কারো মুখে নিজের স্বামীর অন্য কোনো মেয়ের সাথে শোয়ার কথা শুনলে সহ্য করতে পারে না। তারচেয়ে বরং, অম্লান নিজেই তাকে সে কথা বলুক, নয়তো এটা তার অজানাই থাকুক। তবুও ভালো থাকুক ওদের সম্পর্ক। আর সবকিছু জেনেশুনেও প্রফুল্লকে কেউ যদি ভালোবাসতে চায়, সেটা আমি ছাড়া আর কেউই হবে না। সৌখিন বাকি ফালুদা শেষ করতে চেষ্টা করলো। এমন সময় বেজে উঠলো মোবাইল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো, incoming call.. Profullo.

অম্লান একটা কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ভীষণ শীত করছে তার। চোখে তন্দ্রাঘোর লেগে এসেছে, এমন সময় গায়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো নীলাক্ষী। কাথার ভেতর ঢুকে ফিসফিস স্বরে বললো, ‘আমি এসে গেছি, মিউমিউ..’

অম্লান আর্দ্র ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘ঘুমাচ্ছিলাম।’
‘ঘুমাও। আমাকে সাথে নিয়ে ঘুমাও।’
‘আসো।’
‘কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলা শুনি?’
‘তোমাকে নিয়ে।’
‘কি স্বপ্ন?’
‘কোনো স্বপ্ন না।’

ঘুমে ডুবে গেলো অম্লান। নীলাক্ষী অম্লানের বুকের ভেতর ঢুকে ওকে গভীর আবেশে জড়িয়ে ধরে রইলো। অম্লান শুধু তার স্বামী, তার অর্ধাঙ্গ। এই মানুষটা শুধু তাকেই ভালোবাসবে, আর কাউকে নয়। অম্লানকে একান্তই নিজের করে নেবে নীলাক্ষী। মুহুর্তের জন্যও কারও হতে দেবে না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here