বাদামী সংসার
পর্ব ১৭
মিশু মনি

অম্লানের ঘুম ভাংলো ঠিক বেলা এগারো টায়। শেষ রাতে ঘুমানোর কারণে সকাল সকাল ঘুমটা ঠিক ভাঙতে চাইছিলো না। বিছানায় হাতড়ে দেখে নীলাক্ষী নেই।

ঘরের এদিক সেদিক তাকালো অম্লান। বাথরুমের দরজা খোলা। দু চারবার নীলাক্ষীর নাম ধরে ডাকার পরও সাড়া পাওয়া গেলো না। বুকটা ধক করে উঠলো। ছুটে বাইরে এসে দেখলো দূরে লেকের পাড়ে সিঁড়িতে বসে আছে নীলু। দূর হতে দেখে মনে হচ্ছে সীমাহীন দুঃখ নিয়ে বসে আছে। চারপাশে নীল, বেগুনি দুঃখেরা ভিড় করে রেখেছে ওকে। সেই দুঃখের আলো গায়ে মেখে রোদ্দুরের মাঝেও দিব্যি আরাম করে বসেছে।

অম্লান দৌড়ে নীলাক্ষীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। লেকের জলে দুটো কিশোর ছেলে বোট পরিষ্কার করছে। একজন বাটি দিয়ে পানি সেঁচে ফেলে দিচ্ছে। আরেকজন নৌকার গায়ে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। নীলাক্ষী সেগুলোই দেখছে।

অম্লান বললো, ‘তুমি এখানে কখন আসছো?’

‘এইতো কিছুক্ষণ আগে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে, ঘরে একা ভালো লাগছিলো না।’

‘ঘরে একা ছিলা? তা এখানে কি দোকলা নাকি? না ওই মাঝি দুটো সঙ্গ দিচ্ছে?’

‘হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম, আমারে নিবা মাঝি লগে?’

অম্লান নীলাক্ষীর পাশে বসতে বসতে বললো, ‘তা ওরা কি উত্তর দিলো?’

– ‘আমরা বিবাহিত রমণীকে নৌকায় নেই না।’
-‘আহারে। এটা তো বড়ই দুঃখের কথা। বিবাহ করে তাহলে তো আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি।’

অম্লান নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। নীলাক্ষী অম্লানের দিকে মুক্তি করে হেসে ফেললো। অম্লান একহাতে নীলাক্ষীকে ধরে নিজের কাঁধে টেনে নেয়। ওর কাঁধে মাথা রেখে নীলাক্ষী বললো, ‘এই রিসোর্টে আজ তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই জানো?’
‘সত্যি নাকি? কই আমি তো জানতাম না।’
‘হ্যাঁ সত্যি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।’
‘কাকে?’
‘ম্যানেজারকে।’
‘ওহ আচ্ছা। এতক্ষণ ধরে তাহলে এসব চলছিলো?’
‘তুমি লোকটা ভালো না। বড্ড ফাজিল।’

নীলাক্ষী রাগ করতে করতে হেসে ফেললো। রোদ বাড়ছে ঝাঁ ঝাঁ করে। ছেলে দুটোর নৌকার জল সেঁচা শেষ। ওরা দড়ি দিয়ে নৌকা টেনে ঘাটে বাঁধার উপক্রম করছে।

অম্লান বললো, ‘এই পুঁচকিরা, আমাদেরকে নৌকায় করে ঘুরাবে?’

ছেলে দুটো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একজন বললো, ‘জি স্যার ঘুরতে পারবেন। নৌকা তো আপনাদের জন্যই। ঘন্টায় দুইশো টাকা স্যার। ম্যানেজারের সাথে কথা বলেন।’
‘ম্যানেজার কই?’
‘অফিস রুমে।’
‘তোমরা চুপিচুপি আমাদেরকে নিয়ে চলো। পঞ্চাশ টাকা দিবো।’

নীলাক্ষী অম্লানের দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বললো, ‘ওদের সাথেও দুষ্টুমি তোমার তাই না? থামবে তুমি? এই বাচ্চারা, ও মজা করছিলো। তোমরা কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে?’
‘যতদূর যেতে চান।’

অম্লান বললো, ‘তোমাদের নৌকায় করে নায়াগ্রার জলপ্রপাতে যাওয়া যাবে?

নীলাক্ষী হাসতে হাসতে অম্লানের বুকে একটা কিল বসিয়ে বললো, ‘তুমি লোকটা ফাজিল আছো।’

ছেলে দুটোর মুখ হাসিহাসি। সম্ভবত ওরা কখনো নায়াগ্রার জলপ্রপাতের কথা শোনে নি। কিংবা শুনেছে, কিন্তু এই নৌকায় যাওয়ার কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তাই দাঁত বের করে হাসছে।

নীলাক্ষী সিঁড়ি বেয়ে কিছুদূর নিচে নেমে গেলো। খালি পায়ে লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে বললো, ‘পানিগুলো গরম। ভেবেছিলাম ঠান্ডা হবে।’
‘বেলা কত হয়েছো দেখেছো? এখনো পানি ঠান্ডা থাকবে?’
‘তাহলে ভাবো তুমি কত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছো।’

নীলাক্ষীর আড়াল করা অভিমানের সুর শুনে অম্লানের দুঃখ হলো। নীলাক্ষীর কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘সরি সরি। আমি আরামের বিছানায় বেঘোরে ঘুমিয়েছি।’
‘তা তো দেখতেই পেয়েছি। আমাদের নাস্তা তৈরি করে ওরা দুইবার ডাকতে এসেছিলো।’
‘হায় হায় কি বলো! চলো নাস্তা খেয়ে আসি।’

সময়গুলো এমন করেই কাটছিলো। কখনো খুনসুটি, কখনো প্রেম, কখনো বন্ধুদের মতো শুধুই সাধারণ কথাবার্তা। তবুও নীলাক্ষী বেশ উপভোগ করছে সময়টাকে। আগে কখনো ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সৌভাগ্য বা সুযোগ কোনোটাই তার হয় নি। এই প্রথম বাইরে ঘুরতে এসে একটা আলাদা অভিজ্ঞতা হলো। যা সুন্দর, তা উপভোগ করতে দেরি করতে নেই। সুযোগ পেলেই সুন্দরকে উপভোগ করতে ছুটে যেতে হয়।

বিকেলে লেকের জলে নৌকা দিয়ে অনেক দূর হতে ঘুরে এলো। চারদিকে সবুজ টলটলে জল আর দূরে লেকের সীমানা ঘেষে বিস্তৃত পাহাড়। এমনতর সুন্দর প্রকৃতি আগে দেখার সুযোগ তো হয় ই নি, ছবি দেখেছিলো যা। দুচোখে বস্তুত সবকিছুর সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। যা ছবিতে ধারণ করা কিঞ্চিৎ মাত্রই সম্ভব।
অম্লানের পছন্দের খাবার, ভালোলাগার কাজ, অভ্যাস, বদভ্যাস সবকিছুকেই জানার চেষ্টা করছিলো নীলা। অবশ্য এটাও ঠিক যে একদিনে সব জানা হলে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অম্লান বলেছে ধীরেধীরে সব জানা যাবে। আপাতত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটানো যায়, কিভাবে একে অপরকে সাপোর্ট দেবে, কি কি প্লান থাকবে আগামী বছরের জন্য, সেসব। নীলাক্ষী খাতা কলম নিয়ে বসে গেলো সুন্দরভাবে পরিকল্পনা লিখে ফেলতে। নাহ, মাঝেমাঝে মনে হয় বিয়েটা খারাপ কিছু নয়।

প্রফুল্ল ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে পুরনো হাবিজাবি সব জিনিসপত্তর ফেলে দিলো। খালি সেন্টের শিশি, রং ওঠা এন্টিকের গয়না, মালা, মেয়াদোত্তীর্ণ আইশ্যাডো বক্স আর গলে যাওয়া লিপস্টিক। সব ঝাড় মোছ করার পর সুগন্ধি মেরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার একদম ফাঁকা করে ফেললো। এখানে নতুন সব জিনিস ঠাঁই পাবে। সতেজ, প্রাণবন্ত সব কিছু।

আয়নায় ধূলা জমেছে দেড় কেজি। সব সাবান জলে ন্যাকড়া মুছে পরিষ্কার করে ফেললো। এ বাসায় কাজের লোক নেই। মা কাজের লোক রাখা পছন্দ করেন না। নিজের কাজ নিজেই করেন। তবে প্রফুল্ল বেশ কয়েক মাস কিংবা বছর ধরে এলোমেলো ভাবে চলছে বিধায় তার ঘরটাও স্টোর রুমের মতোই জিনিসপত্র আর ময়লায় ঠাসা হয়ে আছে। এজন্য মায়ের কম ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনতে হয় নি। তবুও অভ্যাস পাল্টায় নি প্রফুল্ল’র। আজকে নিজে থেকেই সবকিছু পরিষ্কার করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেলো। প্রায় এক বস্তা অপ্রয়োজনীয় জিনিস বের হলো ঘর থেকে। এরপর শান্তিও লাগছে খুব।

শাওয়ারের নিচে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে সাবান দিয়ে গা ঘষে ঘষে একটা ঝাপটা গোসল সেরে নিলো। বের হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ওর নিজেরই মনে হলো, বাহ! সবকিছু কত ঝকঝকে। যেন নতুন জন্ম হলো তার।

ফেসবুকে ঢুকে একটা বিশ্বস্ত পেজ থেকে টোনার, ময়েশ্চারাইজার, নাইট ক্রিম, আই ক্রিম অর্ডার করলো। সানস্ক্রিন বাসায় আছে। অনেকদিন লাগায় না। চেহারাটা পুড়ে একেবারে কয়লার মতো দেখাচ্ছে। ছ্যাঃ

মুখে জায়গায় জায়গায় ব্রণের দাগ। এগুলো তো আর ঘরের ময়লার মতো টান দিলেই চলে যাবে না। সময় লাগবে। নিজেকে দেখতে ভালো না লাগাটা হতাশা বাড়ায়। নিজেকে আয়নায় দেখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে ভেতর থেকে আত্মবিশ্বাসও বাড়ে আর পাশাপাশি মনটাও ফুরফুরে হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে গুগল ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো প্রফুল্ল। নাহ, আর বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না। একটু পরেই আবার বিষাদ নেমে আসবে।

বাবার কাছে কিছু টাকা চেয়ে সোজা বাড়ির কাছের পার্লারে চলে এলো প্রফুল্ল। চুলের জট ছাড়াতে হবে। যেন কতদিন শ্যাম্পু আর তেলের ছোঁয়া না পেয়ে পুরোদস্তুর দয়াল বাবা হয়ে বসেছে। একটা হেয়ার স্পা করে, মাথাটা ভালোমতো ম্যাসেজ করে দিলো ওরা। ফেসিয়াল ওয়াশ করার পর অনেকটাই প্রাণবন্ত লাগছিলো। মনে হচ্ছে দাগগুলো খানিক হালকা হয়েছে। আহ! সবকিছু গোছানো থাকলে কত শান্তি শান্তি একটা ব্যাপার কাজ করে।

বাসায় ফিরে ইউটিউবে সার্চ করলো, ‘how to change yourself.’ পেয়ে গেলো অসংখ্য ভিডিও। একটা একটা করে দেখে নোট করে ফেললো। সবকিছুই তার জানা। অথচ অবহেলা আর আলসেমির কারণে করা হয় না। রাতে তারাতাড়ি ঘুমিয়ে সকালে তারাতাড়ি উঠতে হবে। এর জন্য এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়া দরকার।

দীর্ঘদিন পর আজ রাতে পেট ভরে ভাত খেলো প্রফুল্ল। খাবার খেয়ে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে মোবাইল দূরে রেখে বালিশ বুকে চেপে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

ঘুমটাও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রোজ রাত দুইটা/তিনটা নাগাদ ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দশটায় চোখ ভাবে এখন তো বিকেল। বারোটায় চোখের সন্ধ্যা নামে। কিন্তু প্রফুল্ল একদম মনস্থির করে ফেলেছে, আজ আর কোনোভাবেই সে মোবাইল হাত দিয়ে ধরবে না। প্রয়োজনে চারিদিক বন্যায় ভেসে যাক, দেশে যুদ্ধ লাগুক। সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবেই।

চুপচাপ শুয়ে থাকার একটা যন্ত্রণা আছে। মাথায় এলোমেলো দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। টেনে বের করতে চাইলে আরো জেঁকে বসে। কিছু একটা করা দরকার। আবার কিছু একটা করতে গেলে দপ করে ঘুম ছুটে পালাবে।

প্রফুল্ল কাগজ কলম নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে লিখলো,
১. কাল একজনের সাথে বন্ধুত্ব করবো। সেটা হতে পারে কোনো মেয়ে বা ছেলে। রাস্তাঘাটে, দোকানপাট বা লাইব্রেরি। যেখানে হোক, একজন বন্ধু বানাবো।
২. ভোরে উঠে বাইরে বেরিয়ে এক ঘন্টা হাঁটবো।
৩. একটা বই কিনে এনে পড়া শুরু করবো।

“আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো। সব স্বপ্ন একটা ঝড়ে মরমর করে ভেঙে গেছে। পাহাড় ধ্বসের মতো। কিংবা টর্নেডোর মতো সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। অথচ আমি তো এমন জীবন চাই নি। পরিস্থিতি কি সত্যিই এমন হবার ছিলো? নাকি আমিই এটার জন্য দায়ী? আমি চাইলেই আমার লাইফকে সুন্দর রাখতে পারতাম। অথচ আমি আমাকে কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয়েছি…”

এতটুকু লিখে ডায়েরি সরিয়ে শুয়ে থাকে প্রফুল্ল। চোখ ভিজে আসছে। কিন্তু না, সবকিছুকে সুন্দর করে গোছাতেই হবে। সুন্দর করে বাঁচতেই হবে তাকে। বইয়ের তাক থেকে একটা বই টেনে নিয়ে বুকের ওপর মেলে পড়তে শুরু করে।

জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইজ লস্ট’। দুই পাতা পড়ার পরপরই কখন যেন ঘুমে ঢলে পড়েছে..

সকালবেলা এক কাপ দুধ চা না খেলে চলেই না প্রবীর মিত্র’র। কিন্তু সুষমার অভ্যাস খারাপ। প্রতিদিন সকালে জোর করে তেতো তেতো এক কাপ গ্রিন টি খেতে দেন ওনাকে। এক ফোঁটা চিনিরও বালাই নেই তাতে। প্রবীর মিত্র’র বয়স হয়েছে কিন্তু বয়স হলেই চা আর চিনি বাদ দিতে হবে কেন, তিনি আসলে বোঝেন না। শেষ বয়সে এত বাছ বিছার করে খেলে, অতৃপ্তি নিয়ে মরে যাওয়াটা কি ভালো? তারচেয়ে নাহয় শরীরে দু চারটা রোগ ব্যাধি হলো, দু চারবার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি হলো। তাও তৃপ্তি নিয়ে মরা ভালো।
তিনি বারান্দায় বসে পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। এমন সময় খেয়াল করলেন প্রফুল্ল দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। ঘেমে একাকার অবস্থা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করতে লাগলো। প্রথমদিকে নিজের চোখকে ওনার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। দীর্ঘ চার/পাঁচ বছরে শেষ কবে মেয়েকে ব্যায়াম করতে দেখেছিলেন মনে নেই। সূর্য আজ কোনদিকে উঠলো?
না, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সূর্য এখনো ওঠে নি। তবে হলো টা কি?

পত্রিকার পাতা হাতে রয়ে গেলো, চায়ের কাপে ঠান্ডা হচ্ছে তেতো স্বাদের গ্রিন টি। প্রবীর মিত্র চোখ বড়বড় করে মেয়ের ব্যায়াম করার দৃশ্য দেখছেন। একজন হতাশাগ্রস্ত মেয়ের বাবার জীবনে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হয় না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here