“প্রেমে পড়া বারণ”
পর্ব ৭
ড্রাইভার জলিল গাড়ীর সাইড মিরর দিয়ে নিজেকে দেখছে আর গুনগুন গান গাইছে ,
—ঢাকার পোলা ভেরী ভেরী স্মার্ট ….
ঢালিউড নায়ক, অনন্ত জলিলকে তার খুব পছন্দ । তাদের নামে যেমন মিল তেমনি তার মতে দুজনার চেহারা সুরত একই রকম , “ড্যাশিং হিরো” টাইপ !
এই জন্য তো এলাকার সব ছুকড়িরা ওর জন্য ফিদা ! কিন্তু জলিলের মন কেড়েছে শুধুমাত্র রমিলা ।ফিলম এ্যাকট্রেসদের মত মহা সুন্দরী হলেও কি মায়াবতী ! এরকম মেয়ে সচরাচর বাড়িতে কাজের বুয়ার কাজ করে না । কিন্তু রমিলার ভাগ্য খারাপ, বাপ মরা মেয়েটির জন্য বড্ড মায়া হয় তার। অভাব – অনটনের সংসারে বড় হয়েছে।
জলিল বলেছে ওকে বিয়ে করবে। সে আসলেই রমিলাকে সুখী করতে চায়। রমিলা অবশ্য এখনও কোন উত্তর দেয়নি। জলিলেরও তেমন কোন তাড়া নেই। আশেপাশে প্রজাপতি তো অনেক আছেই !
—আপনি কি চুল কাটছেন ?
রমিলা নিচে এসেছিল দারোয়ানকে কিছু একটা বলতে। দূর থেকে জলিলকে দেখছিল সে। বার বার জলিল আয়নায় নিজেকে দেখছে আর চিরুনি বের করে চুল আচরাচ্ছে ।
—হ, ‘নেইমার কাট’ দিছি , হ্যাভি “কুল” লাগতাসে না ?
জলিল খুশী হয়ে জিগেস করলো।
—সাইডের চুলগুলা বেশি ছোট হইয়া গেছে। তয় খুব খারাপও লাগতাছে না ।
এ কথা বলেই রমিলা মুখ টিপে হাসতে লাগল ।
জলিল একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—তুমি কি আর এই সব ইস্টাইল বুঝবা, জান ? গত বছর মেসি কাট দিছিলাম। মনে আছে ?
এদিকে জলিল কথার ফাঁকে দেখলো সামনের সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্ট থেকে কালো মারসিডিস গাড়ীটা বের হয়ে গেল। জলিল তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে সেই কালো মারসিডিসের পিছু নিলো ।
বড়ো আপার বান্ধবী, রূপসা আপা একটা বিশেষ কাজ দিয়েছে তাকে। এতো দিনে সে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করেছে ।আজ জানতে হবে আরও বৃত্তান্ত ।
কালো মারসিডিস গাড়ী গুলশান ছাড়িয়ে তিনশ ফুট রাস্তায় উঠলো। মনে হয় বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের দিকে যাচ্ছে। জলিল একটু দূরত্ব নিয়ে ফলো করছে।
যা ভেবেছিল কালো মারসিডিস গাড়ী এসে থেমেছে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে। গাড়ী থেকে নামল একজন সুদর্শন সুঠাম যুবক। হাতে বেহালার কেইস, চোখে কাল সান গ্লাস । তার সাথে নামল আরেক জন ভদ্রলোক, একটু বয়স্ক ।
গাড়ী আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং গ্যারেজে চলে গেল ।জলিলও পিছু পিছু গেল । কালো মারসিডিস গাড়ীর ড্রাইভার একটু পর বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর সে বেশ আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাল।
জলিল ‘হঠাৎ দেখা’ ভাব করে সেই ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে গেল।
—ভাই একটু লাইটার টা দেবেন ?
জলিল বলল।
কালো গাড়ীর ড্রাইভার লাইটার এগিয়ে দিয়ে বলল ,
—আপনি তো আমাদের সামনের ‘বনলতা সেন ‘ এ্যাপার্টমেন্টে তিন তলায় ডিউটি করেন, তাই না ?”
—জী , ঠিক বলেছেন ভাই। আমার নাম জলিল । ভাইএর নামটা কি?
—আমি নজরুল।
—আপনি যাদের ডিউটি করেন , এনারা কি সবাই বিদেশ থাকে ?
জলিল খুব হাল্কাভাবে জানতে চাইলো।
—জী না। শুধু এদের ছেলে আমরিকা থাকে ছোটকাল থেকে।
ড্রাইভার নজরুল সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে উত্তর দিল।
—আরেক জন কে দেখলাম ওনার সাথে, উনি কে ?
জলিল আস্তে করে জানতে চাইল।
—ও বুজছি! আপনি মামুন সাহেবের কথা বলতেসেন। উনি হলেন গিয়ে দোভাষী ।
—দোভাষী জিনিসটা কি ভাই ?
জলিল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
— আরে আমাদের ছোট স্যার বাংলা বলতে পারেন না , তাই দোভাষী সাথে থাকে।
ড্রাইভার নজরুল জানাল।
জলিল মনে মনে অবাক হয়ে ভাবল,
—এ কি আচানক কথা !
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ‘দোভাষী ‘ ? ইউ মিন ট্র্যান্সলেটার ?
তার মানে এই ছেলে একেবারেই বাংলা পারে না !
রূপসা ভীষন অবাক হয়ে গেল।
—জী আপা ! নজরুল তাই তো বললো।
—ছেলের নাম , বয়স এইসব বের করেছ ?
রূপসা আগ্রহসহকারে জানতে চাইল।
মজার ব্যাপার রূপসা আগেই ছেলের বাবার নাম গুগল করে দেখেছে । সার্চ দিলেই ওনার বিজনেসের অনেক রেফারেনস চলে আসে। কিন্তু ওনার ব্যক্তিগত জীবনের কিছুই নেই সেখানে । নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে সে সব তথ্য গুলো লুকানো আছে। মনে হচ্ছে কড়া প্রাইভেসি এদের পরিবারের ।
কিন্তু কেন ? কি গোপন করতে চায় এরা ?
—ছেলের নাম ‘আ’ দিয়া আপা , খুব কঠিন একটা নাম ! আর তার বয়স আন্দাজ ২৩-২৫ হইবে !
জলিল বলল।
—এইসব আন্দাজে কাজ হবে না। আই ওয়ান্ট হার্ড ট্রুথ !
রূপসা বিরক্ত হয়ে বলল।
—আপা, আমার জবানে আসে না ঐ পোলার নাম। আমি লিখ্যা নিয়া আসুম।
— আচ্ছা ঠিক আছে। যা করবে তাড়াতাড়ি করো।
রূপসা একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে তলে গেল।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
—ঐন্দ্রিলা, কেমন আছো ? আজ আমাদের দেখা হওয়ার তিন দিন
এ্যানিভার্সারী । তোমার পছন্দের লিলি ফুলগুলো পাঠিয়ে ছিলাম, পেয়েছ ?
টেক্সটে তন্ময় যথারীতি অসম্ভব ভদ্র আর অমায়িক।
—তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ! আমি কি আজ আসতে পারি তোমাদের বাড়িতে ?”
তন্ময় জানতে চাইল।
সেদিনের পর থেকে মনে হচ্ছে ঐন্দ্রিলা কেমন যেন তন্ময়কে এড়িয়ে চলছে । সে কি নিজের অজান্তে কোন ভুল করেছে ? অনেক চিন্তা করে দেখল, শুধুই হাত ধরেছে , কোন অন্যায় কাজ তো
করে নি।
ঐন্দ্রিলা নিজেই বুঝতে পারছে না সে যে কি চায় ?
সে চরমভাবে কনফিউজড ।মাঝে মাঝে ঐন্দ্রিলার কাছে তন্ময়কে একটু অতিরিক্ত পারফেক্টশনিস্ট মনে হয়। ছেলেরা হবে একটু এলোমেলো আর অগোছালো।
—আচ্ছা তন্ময় , তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাসো ?
ঐন্দ্রিলা হঠাৎ জানতে চাইলো ।
—“তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।”
তন্ময় রবি ঠাকুরের লেখা পছন্দের দুটি লাইন শোনাল।
—আচ্ছা, তুমি কি গান কর বা কোন মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে পার ? “
ঐন্দ্রিলা জানতে চাইল ।
—নাহ্ ! গানের কণ্ঠ বিধাতা দেন নি , আর কোন মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টও বাজাতে শিখিনি কখনও । কিন্তু আমি সারাদিন গান শুনি …. আই লাভ লিসেনিং টু অল কাইন্ডস অফ মিউজিক ।
তন্ময় খুব প্রসন্ন মনে কথাগুলো বলল।
—ঐন্দ্রিলা , তুমি তো পিয়ানো বাজাতে আগে, এখনও কি বাজাও?
—হুম ! আমি সেই তিন বছর বয়স থেকে পিয়ানো বাজানো অনুশীলন করছি।
ঐন্দ্রিলা একটা ছোট্ট দীর্ঘ নি:শ্বাস লুকিয়ে নিল ।
—তন্ময়, আজ আর এসো না, কাল আমার একটা কুইজ আছে , পড়তে হবে অনেকক্ষণ । তুমি বরং আগামী কাল এসো , বিকেলে। কেমন ?
এরপর ঐন্দ্রিলা তন্ময়ের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিল ।
রাতে ডিনারের পর ঐন্দ্রিলার খুব অস্থির লাগছিল । সে অনেকক্ষণ পিয়ানো বাজাল।
একাগ্রচিত্তে বিটহভেনের মিড নাইট সোনাটা বাজিয়ে যাচ্ছিল । একটু সময় পর সামনের সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেহালায় একই সুর ভেসে এলো। সে ছিল যেন মধ্যরাতের সিম্ফোনী…. কি অসাধারণ সংগীতের মিশ্রণ পিয়ানো আর বেহালার !
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পরদিন জানা গেল রূপসা অসাধ্য সাধন করেছে । সে অনেক খোঁজ করে বেহালা বাদকের নাম বের করেছে।
ওর পুরো নাম আলি শাহাদাত রহমান, ডাক নাম আদিত্য।
বাবা মা তাকে আদি বলে ডাকেন । ছেলেটা ছোটকাল থেকে আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে ১০০ মাইল দূরে একটা বোর্ডিং স্কুলে লেখাপড়া করেছে। সে পড়ালেখায় অসম্ভব তুখোড়। এখন হার্ভাড ইউনিভার্সিটি থেকে ল’ পড়েছে।
—ছেলের বায়োডাটা শুনে আমি তো নিজেই পাগল হয়ে যাচ্ছি রে! রূপসা বলল।
—এই ছেলে নিশ্চিত নরম্যাল নয় ! সে হয় সুপার আনসোস্যাল নয় তো মাথা খারাপ জিনিয়াস ! তার উপর আবার এক ফোটা বাংলা বলতে পারে না, দোভাষী নিয়ে ঘুরে।
রূপসা হরবর করে বলে চলছে।
—আমার মতে ‘শিং মাছ’ তোর জন্য বেস্ট ম্যাচ ।
ঐন্দ্রিলা উদাসভাবে বলল,
—বাহ্ ! আদিত্য নামটা কি চমৎকার ! এর মানে হলো সূর্য।
আমি আদিত্য-এর সাথে দেখা করতে চাই । কি ভাবে সম্ভব হবে
বল তো ?
—তুই সত্যি এই ফরেনারকে দেখতে চাচ্ছিস ? অবশ্য তুই যখন এতোই জেদ করছিস, দেখি কি ভাবে ব্যবস্থা করা যায় ?
— ফরেনার কিংবা বিদেশী যা বলিস, তোর ইচ্ছে। আমার সাথে তার সংগীতের ভাষায় অনেক মিল।
—ওরে বাবারে ! বুঝলাম পানি অনেক ঘোলা হয়ে গেছে এতোদিনে!
দেখা যাক, চল আদিত্যের কোন এক কনসার্টের দিন সেখানে উপস্থিত হলে কেমন হয় ?
রূপসা এখন চিন্তা করছে কি করে এদের দু’জনার দেখা করানো যায়।
—বিপাশা বাশার
(চলবে )