“প্রেমে পড়া বারণ”
পর্ব ৬

ঐন্দ্রিলা রূপসাকে বার বার ফোন করছে কিন্তু সে ধরছে না।
মনে হয় সে রাগ করেছে সেসময় ফোন কেটে দেবার জন্যে।
মাঝে মাঝে রূপসা কেমন যেন অবুঝ হয়ে যায়।এমনিতে ওর এ্যাটেনশন স্প্যান এত কম অনেকটা ‘ফাইন্ডিং নিমো’ মুভিটার ডোরি মাছটার মতো! তার উপর ভীষণ ইম্পালসিভ সে।

উফ! রূপসার রাগ ভাঙবে কখন কে জানে ? রূপসার কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা লম্বা টেক্সট পাঠালো ঐন্দ্রিলা। রূপসার সাথে মন কষাকষি ঐন্দ্রিলার একদম ভাল লাগে না। সে তার সব চেয়ে কাছের মানুষ।
ঐন্দ্রিলার যে আর তর সইছে না।
বেহালা বাদকটা আসলে কে, খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

এদিকে সকাল থেকে তন্ময় টেক্সট করেই যাচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে।
সে না কি গতকাল রাতে একদম ঘুমোতে পারেনি ঐন্দ্রিলার কথা ভেবে ভেবে।

ঐন্দ্রিলা নিজেও এক ফোঁটা ঘুমোয়নি। সারা রাত সেই বেহালার করুণ সুর তাকে জাগিয়ে রেখেছিল ।

ঐন্দ্রিলার মন এই মুহূর্তে কেমন যেন একটা দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে
আছে।
এক দিকে তন্ময়, যে কিনা তার পুরোনো বন্ধু। সে অত্যন্ত ভদ্র, ডিসেন্ট, আর সুদর্শন একজন ছেলে।
অন্যদিকে অচেনা বেহালাবাদক যার সম্মোহনী সুর তার হৃদয় স্পর্শ করেছে।
এই মুহূর্তে ঐন্দ্রিলা এখন পুরোপুরি কনফিউজড।

সংগীত ঐন্দ্রিলার জীবনের একটি বিরাট অংশ, অনেকটা তার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়েই আছে।

তার পছন্দের জেইন অস্টেনের বই , “এমা” চরিত্রটির কথা মনে পড়ে গেল ।

“You must be the best judge of your own happiness.”

এদিকে আগামীকাল একটা বড় এ্যাসাইনমেন্ট ডিউ আছে। ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে।কেন যেন কিছুই ভাল লাগছে না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

সেদিন রমিলা ঘরে ফিরে এসেছিল সন্ধ্যার কিছু আগে।
সারারাত সেও ঘুমতে পারেনি। বারবার মাথায় শুধু জলিলের কথাগুলো ঘুরছে।
জলিল কি সত্যিই তাকে বিয়ে করবে ?
না কি মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে প্রলোভন জাগাচ্ছে ?

রমিলা অনেক ভেবে চিন্তা করে দেখলো সে কথাটা বড়ো আপাকে জানাবে আর তার মতামত নিবে।
বিয়েসাদী তো ছেলেখেলা ব্যাপার নয়।
রমিলা খেয়াল করেছে পাশের বাড়ীর রহিম ড্রাইভারও সময়ে অসময়ে কেবলার মতো বার বার তার দিকে হা করে চেয়ে থাকে।দেখতে শুনতে জলিলের মত অত ভাল না হলেও রহিম ছেলেটাকেও বেশ ভদ্র বলে মনে হয়।

ঐন্দ্রিলার মোবাইল বেজে উঠেছে। রূপসা কল করেছে হয়ত !

—ঐন্দ্রিলা আম্মাজান, কি কর মা ?
দাদী ফোন করেছে। নিশ্চয়ই এখন এক ঘন্টার আগে ফোন ছাড়বেন না।

—আসসালামু আলাইকুম দাদী। এইতো পড়ালেখা করছিলাম একটু। আগামীকাল একটা বড় এ্যাসাইনমেন্ট ডিউ আছে । ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে ।
ঐন্দ্রিলা মৃদু স্বরে জানাল।

—ঐন্দ্রিলা, তোমার সব কিছু ঠিক আছে তো আম্মা ? তোমার গলাটা জানি কেমন শুকনো শোনাচ্ছে।
দাদী মনে হয় ঐন্দ্রিলার কণ্ঠের উদাস ভাবটুকু ধরতে পেরেছেন।

— দাদী, আমি ভালই আছি। জাস্ট পড়ালেখা নিয়ে একটু স্ট্রেসড আছি আর কি ?
ঐন্দ্রিলা প্রসংঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো।

—তোদের জেনারেশনের ব্যাপারটা কি বলতো ? কেন যে এতো
স্ট্রেস নিস তোরা? জানিস, তোর বয়সে আমার দুইদুটো ছেলেমেয়ে হয়ে গিয়েছিল। একটু প্রেম ট্রেম করলেও তো পারিস ? এতো করে বললাম ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুলে ফেল। কত মানুষের বিয়ে হল ফেসবুকের পরিচয়ের মধ্য দিয়ে।

ঐন্দ্রিলার দাদীর মতে ফেসবুক এই যুগের একটা সবচেয়ে দারুণ আবিষ্কার ! সব কথাতেই উনি ফেসবুক-এর প্রসঙ্গ টেনে আনতে ভালোবাসেন।

—দাদী, আপনি কি বিশেষ কোন কারণে ফোন করেছিলেন ? আপনার শরীর ভাল তো ? ব্লাড প্রেসারটা কন্ট্রোলে আছে ? ঐন্দ্রিলা কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল।

—না রে মা শরীর ভালই আছে আজকাল।আর এই বয়সে যেরকম থাকে আর কি ! আসলে তোকে কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, খুব কাঁদছিস। তাই সকালে উঠেই তোকে ফোন দিলাম।

— আমি ভালো আছি দাদী। চিন্তা করো না।

—শোন, তোর মতো মহাসুন্দরী আর বোকাসোকা মেয়েদের নিয়েই যতো চিন্তা আমার। তোর মা কি আর তোদের কোন খবর রাখতে পারে? সে তো এনজিও নিয়ে মহাব্যস্ত। এদিকে তোর বাবাও সারাদিন কাজে ব্যস্ত। তাও ঐশীটা খুবই বুদ্ধিমতী আর
চটপটে হয়েছে।আলহামদুলিল্লাহ্ , তারে নিয়ে আমার চিন্তা কোন নাই।

—আহা দাদী ! শুধু শুধু চিন্তা করবেন না আমাকে নিয়ে। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি !
ঐন্দ্রিলা তার দাদীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে।
একটু বিরক্ত হয়ে মনে মনে ভাবলো সবাই যে কেন তাকে এত আন্ডারএস্টিমেট করে ?

আরও আধা ঘন্টা ফোনে দাদী নানা রকম উপদেশ দিলেন। ঐন্দ্রিলা চুপচাপ মন দিয়ে শুনলো।
মাথা ব্যথাটা বেড়েই চলেছে।
কিছুক্ষণ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হবে। মাইগ্রেনের এ্যাটাক হলে আর রক্ষা নেই ….একেবারে এক সপ্তাহ শয্যাশায়ী !

ঐন্দ্রিলার বেডরুমের দরজায় আলতো করে কেউ নক করছে। সে ভীষণ চোখ কুঁচকে তাকালো। দরজার বাইরে রমিলা দাঁড়িয়ে।

—আপা কি ঘুমাচ্ছিলেন ?
রমিলা আমতা আমতা করে বলল ।

—নাহ্ ! মাথা ধরেছে খুব, শুয়েছিলাম । কিছু লাগবে তোমার রমিলা?

—আপা, একটা বিশেষ জরুরী কথা ছিল, বলবো ?
রমিলা ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করল।

—হু বলে ফেল।কি হয়েছে? কি ব্যাপার ?
ঐন্দ্রিলা অনিচ্ছার সাথে বলল।মাথার দুপাশে দপদপ করছে।

—আচ্ছা আপা, কেউ যদি আমাকে এখন বিয়ে করতে চায় , আমার কি রাজি হওয়া উচিত ?
রমিলা মাথা নিচু করে সামান্য লজ্জা সামান্য ভয়ে জিজ্ঞাসা করল।

—বিয়ে ? এত অল্প বয়সে বিয়ের কথা আসছে কেন ? মা তোমাকে বলেছে পড়া লেখা করাবে।তোমাকে বিয়ের আগে শিক্ষিত আর
স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে রমিলা। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করলে পরের বছর হবে বাচ্চা, জীবন তো সেখানেই শেষ ! এখন প্লিজ যাও তো ।
ঐন্দ্রিলা ঠান্ডা স্বরে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল। সে রমিলাকে এতটা বেশি বোকা ভাবেনি সে ।

রমিলার চোখে পানি চলে এল। বড়ো আপার কথাগুলো সত্য হলেও খুব রূঢ় শোনাল।
তার মনে আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে।
মাকে খুব মনে পড়ছে। অনেকদিন মায়ের সাথে দেখা হয় না। তারপর সে চোখ মুছতে মুছতে ভাবলো,

—আসলেই তো, এত বোকার মত ভাবছে কেন সে ? এ বাড়ীর সবাই তাকে কত ভালবাসে ! খালাম্মা এত আদর করে তাকে
পড়ালেখা শেখাচ্ছেন। সামনের বছর তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা।

দরজায় ধুম ধুম করে শব্দ হচ্ছে।
ঐন্দ্রিলা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানেও না।
হঠাৎ মনে হল অনেক দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। ঘুম ভেঙে গেল ধুম ধুম শব্দে।
মনে হচ্ছে তার নিজের বেডরুমের দরজায় কেউ সজোরে নক করছে।
ঐন্দ্রিলা গাউন পরে দরজা খুলে দেখে রূপসা দাঁড়িয়ে।

—কি হয়েছে তোর ? আরও কিছুক্ষণ না জবাব দিলে দরজা ভেঙে ঢুকতাম ! কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছি। কি মরাঘুম দিয়েছিস তুই ?
রূপসার চোখে আতন্কের ছায়া ।

—অনেক মাথা ধরেছিল রে তাই একটা রিলাকসিন খেয়ে
শুয়েছিলাম।আয় ঘরে আয়।
বাইরের আলো চোখে খুব কড়া লাগছে ঐন্দ্রিলার ।

—শোন, তুই একটা ডাক্তার দেখা । কতদিন আর এই মাইগ্রেনে ভুগবি ?
রূপসা এবার নরম স্বরে বলল।

—রূপসা, আই এম সরি দোস্ত , তোর কথা না শুনে ফোন কেটে দিলাম সেদিন । আসলে আমি ….
রূপসা আর কিছু বলতে দিলো না, দৌড়ে গিয়ে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো।
তারপর দুই বান্ধবী এক সাথে হেসে উঠল। এদের বন্ধুত্ব্রের এই সরলতা নির্মল সুন্দর !

—এখন বল, তুই কি বেহালা বাদকের পরিচয় জানতে চাস, না কি চাস না ?
রূপসা হাসতে হাসতে বলল ।

—চাই তো ! প্লিজ প্লিজ তাড়াতাড়ি বল সে কে, তার পরিচয়, তার সব বৃত্তান্ত জানতে চাই !
ঐন্দ্রিলার আর সাসপেন্স সহ্য হচ্ছে না।

—সেই বেহালাবাদক হল ‘স্বাধীন’টেলিকমুনিকেসন কোম্পানির মালিক জনৈক ধনকুবের, আলি রেজা রহমান সাহেবের, একমাত্র পুত্র, সদ্য আমেরিকা ফেরত। ছেলেটা একাধারে মিউজিক প্রডেজি আর ব্যারিস্টার। আমেরিকার নিউ ইয়র্কের কার্নেগি হলে তার একক বেহালা শো হয়েছে।
বাংলাদেশে সে এসেছে ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্সে।
রূপসা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল।

—ওয়াও ! ছেলেটার নাম কি ? বয়স কতো ? দেখতে কেমন ? ঐন্দ্রিলা অতিরিক্ত উত্তেজনা আর উৎসাহের সাথে জিজ্ঞাসা করল।

—দ্যাট পিস্ অফ দা পাজল ইজ নট সলভব্ড ইয়েট মাই ডিয়ার ! কিন্তু তোদের ড্রাইভার জলিল দারুণ কাজ করছে। সে শীঘ্রই সব খবর এনে দেবে।

—মানে কি ? জলিল বেআইনী কিছু করছে না তো ?
মা- বাবা জানলে কিন্তু ভীষণ রাগ হবেন ।
ঐন্দ্রিলার গলায় একটু ভয়।

“There is nothing more deceptive than an obvious.”
রূপসা রহস্য করে শার্লক হোমসের বাণী ঝাড়লো।

—-বিপাশা বাশার
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here