#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|দ্বিতীয় পর্ব|
পশ্চিম আকাশে লাল আভার দেখা মিলেছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে হয়তো কোথাও গিয়ে ঠেকবে আর আঁধারের দেখা মিলবে।
সায়াহ্নের সময়ে রুপ ক্লান্ত অবস্থায় ফিরে আসে এতিমখানায়। বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পান করে নেয় পানি। তীব্র গরমে শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। রুপের এখন গোসল করা প্রয়োজন। চোখের চশমা বালিশের পাশে রেখে গোসল করতে চলে গেলো রুপ।
” আজও কি অভুক্ত থাকতে হবে রুপ?”
গোসলখানা থেকে বের হতেই প্রিয় বান্ধবী রাইসার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় রুপকে। লম্বা কেশবে গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে খোপা করে নেয় রুপ। বালিশের পাশ থেকে চশমা চোখে পরে উওর দেয়,
” আজ অনেক কষ্ট হয়েছে রে রাইসা। আরো একটা টিউশনের খোঁজ করতে হবে।”
” তা খুঁজে নিবো দু’জন মিলে। কিন্তু আজ খাবো কি? আমার না হয় দুটো জামা তাই ঘর বন্দী থাকি, আহারের ব্যবস্থা করতে পারি না। তুই তো চেষ্টা করবি! আজ রাহেলা ম্যাডাম এসে সোজা বলেছে আগামীকাল যেন এতিমখানা থেকে আমরা চলে যাই। নতুন জায়গার খোঁজ করি। আর এতিমখানা থেকেও তো এখন আর খাবার পাবো না। কেন রে বড়ো হলাম রে রুপ!”
রুপ খুব মনোযোগ সহকারে রাইসার কথা শুনলো। ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো চারটে সিঙ্গারা বের করে ইশারায় খেতে বলল।
” আজ একটা কান্ড ঘটেছে আমার সাথে।”
রাইসার নজর সিঙ্গারার দিকে নিবদ্ধ। একটা সিঙ্গারা নিয়ে তাতে বড়ো কামড় বসিয়ে ভরাট স্বরে বলল,
” কি কান্ড ঘটেছে?”
রুপ দুপুরে আজাদ সাহেবের সাথে আকস্মিক সাক্ষাতের কথা বলল রাইসাকে। আজাদ সাহেবের ছোট সন্তানের কথা বলার সময় রুপের মুখশ্রীতে এক বিরক্তিভাব ফুটে উঠে। আর সর্বশেষে আজাদ সাহেবের কার্ড দেয়া। সারা দিনের সমস্ত কথা বলে রুপ হতাশার দৃষ্টিতে রাইসার দিকে তাকালো।
রাইসা তৃতীয় নাম্বার সিঙ্গারায় কামড় বসিয়েছে মাত্র। আঁখি পল্লব চঞ্চল। যেন এই মুহুর্তে সিঙ্গারা খাওয়া তাঁর জন্য বেশি জরুরি।
” আমি তোকে কিছু বলেছি।”
ঢকঢক করে পানি পান করে রাইসার প্রত্যুওর,
” আজাদ সাহেবকে ফোন লাগা। আমার মনে হচ্ছে আমাদের উপকার আসবে সে।”
” উপকার না ছাই। আমার কাছে লোকটিকে বদ্ধ উন্মাদ মনে হয়েছে। একটা কথার সাথে অপর কথার কোন মিল নেই।”
রাইসার পেটে যেন আজ ইঁদুরের পরিবর্তে হাতি ঢুকেছে। তিন নাম্বার সিঙ্গারা খেয়েও মনে হচ্ছে এখনও পেটে অবশিষ্ট জায়গা খালি। চতুর্থ সিঙ্গারার দিকে কটু নজরে তাকিয়ে উওর দিলো,
” আমার কাছে রহস্যময় মনে হলো। একবার ফোন দিলে তো আর সমস্যা নেই,তাই না!”
মাথা থেকে পেঁচানো গামছা খুলে রুপ ভীত স্বরে বলে,
” আজাদ সাহেব ঠিক আছে বেশি কথা বলে আর কি। কিন্তু তার ছোট ছেলে আমার পানে এমনভাবে তাকায় যেন আমি তার কোন জন্মের শত্রু।”
রাইসার যেন এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। নিজেই রুপের ব্যাগ থেকে ফোন কার্ড বের করে নিলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো এতগুলো নাম্বার দেখে। পর পর লাইনে চারটে নাম্বারের মধ্যে কোন নাম্বারে ফোন করবে তা নিয়ে গভীর চিন্তিত রাইসা। অবশেষে চার নাম্বারের মধ্যে সবচেয়ে সহজ নাম্বারের ফোন লাগালো রাইসা।
ফোনে রিং হচ্ছে অনবরত কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। এদিকে রাইসির নজর চতুর্থ সিঙ্গারায় যেটা এখনও বিছানার উপর পড়ে আছে। একপ্রকার অধৈর্য হয়ে রাইসা ফোন রুপের হাতে তুলে দিলো। রুপ ভীত চাহনি রাইসার দিকে নিক্ষেপ করে হাতে ফোন নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো।
” হ্যালো।”
ফোনের অপরপাশ থেকে বুড়োদের স্বরের বদলে রাগী, কর্কশ কন্ঠস্বর শুনে ভয় পেয়ে গেলো রুপ। এক মুহূর্তও সময় বিলম্ব না করে ফোন কেঁটে দিলো রুপ।
ফোনের দেয়ালে নাম্বার দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো রুপা। জানালার পাশ থেকে এসে রাইসার সামনে দাঁড়ায়। রাইসা মাত্র চতুর্থ সিঙ্গারায় কামড় বসাবে। রুপকে সামনে দাঁড়ানো দেখে ক্যাবলাকান্তের ন্যায় হেসে সিঙ্গারা আগের স্থানে রেখে দিলো
” রাইসা তুই কোন নাম্বারে ফোন করেছিস?”
রুপের রাগান্বিত কন্ঠস্বরে রাইসা শুকনো ঢুক গিলে। মিনমিন কন্ঠস্বরে বলে,
” সবচেয়ে সহজ নাম্বার যেই নাম্বার, সেই নাম্বারে ফোন করেছি। ঐ যে শেষের নাম্বারটা।”
রাইসার কথা শুনে রুপ ললাটে হাত দ্বারা আঘাত করে। রাইসাকে আর কাছু বলতে না দিয়ে চতুর্থ সিঙ্গারা নিজে নিয়ে নেয়। রাইসাকে চোখ দ্বারা শাসিয়ে যায় যে,” এই সিঙ্গারা তুই পাবি না, অকাজ করার সময় ধ্যান কোথায় ছিলো! সব দোষ এই সিঙ্গারার।”
রুপ এবার সঠিক নাম্বার উঠালো। আজাদ সাহেবের নাম্বার। রুপের জানতে হবে কি এমন কারণে আজাদ সাহেব মিথ্যা বলল।
———-
প্রেম নীড়ে,
” ও ললিতা ও ললিতা তুমি কোথায়?
আমার চোখ দুটো যে খুঁজে তোমায়!”
প্রেম নীড়ে প্রেম প্রেম ভাব থাকবে না এই বিষয়টি মানা খুব’ই কষ্টকর। রান্নাঘরে কাজ করছে আয়েশা আজাদ এবং তাঁর বড়ো ছেলের স্ত্রী ফাহিমা। শ্বশুর বাবার রসিকতার বিষয়ে ফাহিমা অবগত। যেকোন সময়’ই আজাদ সাহেব রোমান্টিক মুডে চলে আসেন আর শাশুড়ি আয়েশা আজাদকে লজ্জায় ফেলেন। এই যে এই মুহূর্তে, আয়েশা আজাদ লজ্জায় লাল হয়ে কাজ করছেন। ফাহিমা শাশুড়ির লজ্জা দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছেন।
” ও মা, বাবা ডাকছে তো। সাড়া দিলে’ই তো হয়। তাহলে আর লজ্জা পেতে হবে না।”
আয়েশা আজাদ যেন আরো বেশি লজ্জায় নুয়ে গেলেন। সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে মুখে গাম্ভীর্যভাব নিয়ে আসলেন।
” বেশি কথা বলা শিখে গিয়েছো ফাহিমা। নিজের ঘরে যাও আর কাজ করতে হবে না।”
শাশুড়ির শক্ত কথা শুনে ফাহিমা জোরে হেসে দেয়।
ফাহিমার হাসির আওয়াজে আয়েশা আজাদ চোখ রাঙায়। ফাহিমা চলে যায়। যাওয়ার আগে আয়েশা আজাদের উদ্দেশ্যে বলে,
” মাগো তোমার কপাল কত ভালো গো! এমন একটা জামাই পেয়েও রাগ করে থাকো। মুখে হাসি টেনে আনো দেখবে বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসবে।”
” তুই যাবি ফাহিমা?”
ফাহিমা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। জিহ্বায় কামড় কেঁ’টে চলে গেলো নিজের ঘরে।
” ও ললনা, আজ বলো না,
বাসবে ভালো কি!
ও রূপসী, আমিও আজি,
হৃদয় এনেছি।
বলো না ললনা ললনা !”
সোফায় বসে টেলিভিশনে গান শুনছেন আর চিল্লিয়ে গাইছেন আজাদ সাহেব। রান্না ঘর থেকে হাতে ঢাকনা যুক্ত বাটি নিয়ে আজাদ সাহেবের সম্মুখে এসে দাড়ায়।
” বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে নাকি? এমন জোয়ান ছেলে পেলেদের গান শুনছো যে? আর বলি লাজ শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছো নাকি? বাড়িতে ছেলে, ছেলের বউ আছে। একটু দেখে শুনে আওয়াজ দিবে তো!”
আজাদ সাহেবের মন আছ বেজায় খুশি। আজ শত বকাঝকা করলেও মন খারাপ হবে না। স্ত্রীর কথা শুনেও হাসছে বলে আয়েশা আজাদ ভীষণ তেতে গেলেন। মুখ খুলে কিছু বলবেন তার আগেই ছোট ছেলে নাদিফের আগমন ঘটে,
” মা! বাবাকে নিজের আঁচলে বেঁধে রেখো। আজ দেখলাম কচি মেয়ের পিছনে দৌঁড়াচ্ছে।”
স্বামীর মুখের হাসির রহস্য এবার বুঝতে পারলেন আয়েশা আজাদ। এদিকে আজাদ সাহেব এই মুহূর্তে নাদিফের আগমনের জন্য তৈরি ছিলেন না। আর নাদিফের বোম ফাটানোতে যেন আজাদ সাহেবের ডায়রিয়া, জ্বর হয়ে গিয়েছে। সোফায় বসে কাঁচুমাচু করে যেই না উঠতে যাবে ঠিক তখনই আয়েশা আজাদ পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়।
” কোথায় যাচ্ছো? বসো! তোমার সাথে প্রেমের রাগারাগি করবো।”
আজাদ সাহেব বুঝতে পেরেছেন আয়েশা আজাদের এই প্রেমের মানে কি। মনে মনে নিজের ছেলেকে শ’খানিক বকা দিয়ে স্ত্রীর মান ভাঙাতে মনোনিবেশ করলেন।
” আরে রাখো তো তোমার প্রেমের রাগারাগি! কথা আছে, পাশে বসে শুনো।”
আয়েশা আজাদ ক্ষান্ত হলেন না। স্বামীর কর্মের কথা আয়েশা আজাদের জানা আছে। এই তো সেদিন! পাশের বাসার কাজের মেয়ে জরিনা বলল যে, ” খালুকে দেখলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাঁটুর বয়সী মেয়ের সাথে কথা বলছে। ও চাচীগোও সেই কি হাসি গোওও! মেয়েটা তো পারে না চাচার হাত ধরে হাসতে।”
সেদিন আয়েশা আজাদ পাত্তা দেয়নি জরিনার কথায়। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এর একটা বিহিত করতে’ই হবে।
আয়েশা আজাদ চোখ রাঙিয়ে স্বামীর পাশে বসলেন। ঢাকনা যুক্ত বাটির ঢাকনা সরিয়ে স্বামীর হাতে গচ্ছে দিলেন। যার মধ্যে রয়েছে পাট শাক আর শুঁটকি।
শুটকির গন্ধ নাকে আসতে’ই সন্ধ্যায় নাস্তা করা চমচম মিষ্টি গলা দিয়ে যেন প্রতিযোগিতা করে বের হয়ে আসছে।
” ও ললনা গো! এই পঁচা শুঁটকি সামনে থেকে হাটাও। ভেতরের নাড়ি ভুঁড়ি সব বের হয়ে আসছে”
আয়েশা আজাদ চুপ করে বসে রইলেন না। পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা একসাথে মেখে ঢুকিয়ে দিলেন আজাদ সাহেবের মুখের গহ্বরে।
ওয়াক ওয়াক করে দুই তিন বার ঢুক গিলে খেয়ে নিলেন আজাদ সাহেব।
” এবার বলো! এই বয়সে আরো ঘুরবে মেয়েদের পিছনে?”
টেবিলের উপর রাখা পানির পাত্র থেকে একের পর এক গ্লাস পানি পান করে যাচ্ছেন আজাদ সাহেব। শেষ গ্লাস পানি পান করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোমার মনে দয়া মায়া বলতে কিছুই নেই? তোমাকে আমি কত ভালোবাসি তা তুমি বুঝো না?”
” ভালোবাসা না পাটের বস্তা। ভালোবাসলে কি আর হাঁটুর বয়সী বাচ্চার পিছনে ঘুরো?”
আজাদ সাহেব এবার স্ত্রীর দিকে কঠোর দৃষ্টিপাত করলেন। স্ত্রীর নিকট অবিশ্বাসের খেতাব পেয়ে খুবই মর্মাহত হলেন।
” পারো তো শুধু আমাকে অবিশ্বাস করতে। এদিকে ঘরে যে ছেলের বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে তার দিকে তোমার কোন খেয়াল আছে নাকি? আমি পড়েছি মহা ঝামেলায়, যেখানে মায়ের ছেলের পাত্রীর খোঁজ করার কথা সেখানে আমি পথে, ঘরে হেঁটে হেঁটে পাত্রী খুঁজে চলেছি।”
স্বামীর দুঃখভরা কথা শুনে আয়েশা আজাদের রাগ, ক্ষোভ কোথায় যেন চলে গেলো। হাতের বাটি টেবিলের উপর রেখে স্বামীর পাশে এসে বসলো। এদিকে আজাদ সাহেব মনে মনে বেজায় খুশি আজকের জন্য আর পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা গিলতে হবে না।
” কি বলছো কি তুমি নাদিফের আব্বু। আমার নাদিফের জন্য তুমি এভাবে পাত্রী খোঁজ করো? আহারে! আর আমি কি ভাবলাম!”
আজাদ সাহেবের যেন এবার অভিমান হলো। বউ আদর সোহাগ না করলে এই অভিমান ভাঙবে না। আয়েশা আজাদ স্বামীর অভিমান বুঝতে পেরে আহ্লাদ স্বরে ফলে,
” ওগো শুনছো! রাগ করে না। তোমাকে আমিও খুব ভালোবাসি। তাইতো একটু বেশি বেশি করি।”
ব্যস বুড়ো-বুড়ির রাগ, অভিমান শেষ! আজাদ সাহেব এবার স্ত্রীর দিকে ফিরে দুপুরের মেয়েটির কথা বললেন। আয়েশা আজাদ স্বামীর পছন্দের উপর বিশ্বাসী। তাইতো আয়েশা আজ আজাদের।
” তোমার কি মনে হয়! মেয়েটি তোমাকে ফোন করবে!”
” আলবাত করবে।”
” এমন মনে হবার কারণ?”
” আমি যে মিথ্যা বলেছি তা মেয়েটি নিশ্চয়ই বুঝেছে।”
আজাদ সাহেবের ফোন বাজছে অনবরত। সময় নিয়ে আজাদ সাহেব ফোন রিসিভ করলেন। সামনে আয়েশা আজাদ উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে ফোনের ঐপাশে কে আছে তা জানার জন্য।
” হ্যালো।”
আজাদ সাহেব একটু ভাব নিয়ে বলল। ঐপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠস্বরে কেউ সালাম জানালো,
” আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি রুপ, আজ যে আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে সাহায্য করেছে।”
রুপের কথা শুনে আজাদ সাহেব এতোটাই খুশি হয়েছেন যে খুব কঠিন পাল্টা প্রত্যুওর দিলেন রুপকে,
” আরে আমার বউমা যে, আমি জানতাম তুমি আমাকে ফোন করবে।”
চলবে……….