#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

———————–

রাফিদ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা হাতে পানির বোতল নিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ইনশিতা। শীত বেশি না পড়লেও আবহাওয়াটা খুবই ঠান্ডা। রাফিদের ইচ্ছে করছে সিনেমার নায়কদের মতো জ্যাকেট খুলে ইনশিতাকে পরিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস, সে এটা কখনোই পারবে না।

ইনশিতা নিজেকে ধাতস্থ করে ঠিকভাবে উঠে বসে। পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে নেয়। পানি খেতে গিয়ে গলার দিকটাও ভিজে যায়। বোতল হাতেই আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে। রাফিদ নিজেকে এতক্ষণ শান্ত রেখেছিল ইনশিতাকে সামলে ওঠার জন্য। ইনশিতার কান্নায় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেনি। একটু এগিয়ে ইনশিতার মাথায় হাত বুলাতে গিয়েও থেমে যায়। হাত নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-“ইতু, তাকাও আমার দিকে।”

ইনশিতা তাকাল না। মাথা নিচু করে কাঁদতেই থাকল। রাফিদ আবার বলল,

-“ইতু, তুমি যদি না বলো তাহলে কী করে বুঝবো কী হয়েছে? অনেক্ষণ আগে থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি কোনো কারণে প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছ। তাই তোমাকে সময় দিয়েছি নিজেকে সামলে উঠতে। এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যাস্ট রিল্যাক্স।”

ইনশিতা মাথাটা একটু উঁচু করে তাকাল রাফিদের দিকে। রাফিদ তাকিয়ে থাকতে পারল না। সে চোখ বন্ধ করে নিলো। ইনশিতার দুচোখ লাল হয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে আছে, কপালেও আঘাতের চিহ্ন। জামাটারও কিছু কিছু অংশে ছেঁড়া যেটা ইনশিতা ওড়না দিয়ে আপাতত আড়াল করে রেখেছে। কাঁদতে কাঁদতে মুখের অবস্থা বেহাল। এমন অবস্থা দেখে রাফিদের ইচ্ছে করছে ইনশিতাকে বুকে জড়িয়ে নিতে। নিজের ইচ্ছাকে দমন করতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল রাফিদ। এই অবস্থার জন্য যদি জেহের দায়ী হয়ে থাকে তবে রাফিদ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে ইনশিতাকে নিয়ে সোজা চলে যাবে নিজের বাড়ি। জেহের নিতে চাইলে সে নিজেও একটা রক্তারক্তি কান্ড ঘটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

ট্যাক্সির বাতি বন্ধ করে দিতে বলল ড্রাইভারকে। বাতি বন্ধ করার একমাত্র কারণ ইনশিতার যাতে অস্বস্তি না লাগে। ইনশিতা কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলার জন্য তৈরি হয়। পানির বোতলটা হাতে শক্ত করে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তটা চোখের সামনে ভাসলেই তার রাগে, লজ্জায়, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।

তখন ইনশিতাকে তিনজনই জোরাজুরি করে সাত তলায় একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। রুমে এনে জিহাদ ইনশিতাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। যার ফলে কপালে খানিকটা আঘাত পায় ইনশিতা। কয়েকটা ব্যাগ ইনশিতার মুখের ছুঁড়ে মেরে নয়নিকা আর জেবাকে আদেশ দেয় রেডি করিয়ে দিতে। জিহাদ বেরিয়ে গেলে নয়নিকা আর জেবা তৈরি করাতে লাগে ইনশিতাকে। ইনশিতা কিছুই বুঝতে পারছিল না। কান্নার দমকে তার গলা দিয়েও কোনো কথা বের হতে চাইছিল না। যখন দেখল ব্যাগ থেকে বিয়ের বেনারসী আর গয়নাগাটি বের করছে তখনই তার মনে অজানা আতঙ্ক হানা দিতে লাগল বারংবার। আর একটু দূরেই দেখল তিনটা বড় বড় ব্যাগে গোলাপ ফুল। ইনশিতা ভয় পেয়ে জেবা আর নয়নিকার দিকে তাকাল। তারা তখন শাড়ী আর গয়না ঠিক করতে ব্যস্ত।

ইনশিতা ভয়ে দরজার কাছে দৌড়ে যেতে নিলে জেবা আর নয়নিকা জোর করে ধরে রাখে। ইনশিতার ইচ্ছে করছিল গলায় ঝুলানো ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন দেয়। কিন্তু সেই সুযোগও আর পেল না। জেবা আর নয়নিকা ইনশিতার ওড়না আর জামা খোলার চেষ্টা করে শাড়ি পরানোর জন্য। ইনশিতা সাপের মতো মোচড়ামোচড়ি করার কারণে কেউই ঠিকভাবে কিছুই করতে পারল না। এভাবেই প্রায় পনের মিনিট কাটল তবে ইনশিতাকে ধরে রাখা ছাড়া কেউই কিছু করতে পারল না। ইনশিতা হাতের কাছে একটা গ্লাস পেয়ে নয়নিকার কপালে বারি মারে। নয়নিকা এক মুহুর্তের জন্য ইনশিতাকে ছেড়ে নিজের কপাল চেপে ধরলে ইনশিতা জেবার থেকে ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের থেকে ছাড়া পাওয়াটা বেশি কষ্টের নয়। ইনশিতা জেবার চুলের গোছায় টান মারলে জেবা ককিয়ে উঠে ইনশিতাকে ছেড়ে দেয়। ইনশিতা জেবাকে নয়নিকার উপর সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

রুম থেকে বের হয়েই আরেক যমের মুখোমুখি পড়ে। জিহাদ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, পাহারা দিচ্ছে দরজার কাছে। ইনশিতাকে শাড়ি পরা ছাড়া বের হতে দেখে রেগে যায় সে। ইনশিতা দৌড়ে পালাতে নিলে জিহাদ ইনশিতাকে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ইনশিতা চড়, থাপ্পড়, ঘুষি দিয়েও ছাড়াতে পারে না নিজেকে। মেয়েদের সাথে শক্তি দিয়ে পারলেও জিহাদের সাথে কখনোই পেরে উঠবে না সে।

বলা বাহুল্য, জেহের আর জিহাদের শক্তি খুবই কাছাকাছি। ইনশিতাকে কাঁধে তুলে লিফটের দিকে এগিয়ে যায় জিহাদ। পেছন থেকে নয়নিকা আর জেবা দৌড়ে আসে। নয়নিকার কপাল বেয়ে তখন রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। তার দৃষ্টি এমন যেন সে এক্ষুনি ইনশিতাকে একা পেলে চিবিয়ে খেত। জেবা মাথায় হাত চেপে ধরে বলে,

-“ও’কে তো এখনো রেডিই করাতে পারলাম না। কীভাবে এখন…”

জেবার কথা শেষ হওয়া পূর্বেই জিহাদ থামিয়ে দিয়ে বলে,

-“বিয়ে করার জন্য বর আর কনে থাকলেই যথেষ্ট। বাড়তি কোনো সাজের প্রয়োজন নেই। আর আমার জানের যখন কোনো সাজ ছাড়া বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তখন তাই হবে।”

ইনশিতা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। বিল্ডিংটাতেও বোধহয় বেশি মানুষ নেই। এই মুহুর্তে সে প্রার্থনা করছে জেহের যাতে ছুটে এসে তাকে বাঁচিয়ে নিক। সকলকে মেরে তক্তা করে দিক। তবে ইনশিতা যে নিজেই সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে জেহেরকে বেঁধে। আর এমন ভাবে বেঁধেছে যে কারো সাহায্য ছাড়া সেই বাঁধন খুলবে না। কী আশ্চর্য! যাকে বেঁধে রেখে সে পালিয়ে এসেছে এখন তাকেই বাঁচাতে আসার জন্য প্রার্থনা করছে!

জিহাদ লিফটে উঠে নয়তলার একটা রুমে ঢুকে যায়। রুমে ঢুকেই ইনশিতাকে একটা চেয়ারে জোর করে বসিয়ে নিজে আরেকটা চেয়ারে বসে পড়ে। ইনশিতার দুহাত নিজের একহাতে নিয়ে হাঁটু দিয়ে ইনশিতার পা চেপে ধরে আছে যাতে উঠতে না পারে। তাদের সামনেই চশমা চোখে কাজী বসে আছে। জেবা আর নয়নিকা তাদের পেছনে এসে দাঁড়ায়।

জিহাদ ইনশিতাকে চাপ দিতে থাকে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার জন্য। ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে বলছে সে কিছুতেই সাইন করবে না। তা দেখে কাজী বলে,

-“আমার মনে হয় কনের বিয়েতে মত নেই। এভাবে জোর করে তো…”

জিহাদ ধমকে বলল,

-“সেটা আপনার জানার দরকার নেই। কাজী আছেন, কাজীর মতো থাকবেন। বেশি বুঝতে গেলে আপনাকে জেলের ভাত খাওয়াতেও সময় লাগবে না আমার।”

কাজী সাহেব চুপসে গেলেন। ইনশিতা জিহাদের সাথে ধস্তাধস্তি করে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। ইনশিতা নয়নিকার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-“নয়ন রে, তুই প্লিজ এসব থামা। আমাকে জেহেরের কাছে যেতে দে নয়ন। প্লিজ নয়ন।”

নয়নিকা কটমট করে বলে,

-“তোর নাটক শেষ হলে সাইনটা করে দে। বিয়ে বসতে চলেছিস, কোনো ফাঁসিতে ঝুলছিস না কোনো।”

-“আমার জেহেরের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সব নিয়ম মেনেই বিয়ে হয়েছে। আরেকটা বিয়ে করা যাবে না কোনোমতেই। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি জিহাদকে বিয়ে করতে পারবো না। ওনার মতো নোংরা মন মানসিকতার লোক কখনো কারো স্বামী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।”

এটা শুনে জিহাদ ইনশিতার বাহু চেপে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

-“সেই নোংরা মন মানসিকতার লোকটাই আজ তোমার স্বামী হবে। আর জেহেরের সাথে বিয়ে কেউ মানেই না। সো নিজেকে জেহেরের স্ত্রীর পরিচয় দেওয়া বন্ধ করো। জেহেরকে শুধুমাত্র ভয় পেয়ে বিয়ে করেছো তুমি। ওটা কোনো বিয়েই ছিল না।”

তারপর ইনশিতার হাতে কলম ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“সাইনটা করো আগে।”

জেবাও বলল,
-“ভালোয় ভালোয় সাইনটা করে নাও ইনশিতা।”

ইনশিতা কলম ছুঁড়ে মারল। জিহাদকে ধাক্কা মেরে চলে যেতে নিলে নয়নিকা চেপে ধরে। ইনশিতা মিনতি করে বলে,

-“তুই কেন এমন করছিস নয়ন? তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার বোনের মতো। তাহলে কেন তুই আমাকে এই বিয়ের জন্য জোর করছিস? আমি জেহেরের সাথে ভালো থাকবো। তুই কি চাস না আমি ভালো থাকি? এই নয়ন, প্লিজ আমাকে রেহাই দে। আ-আমাকে যেতে সাহায্য কর রে নয়ন।”

বলতে বলতে ইনশিতা নয়নিকার পা ধরে ফেলল। পা ধরে বারবার মিনতি করতে লাগল এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার। নয়নিকা বিরক্তি নিয়ে ইনশিতাকে টেনে উঠাল। শক্ত গলায় বলল,

-“সাইনটা কর, তারপর নিয়ে যাব।”

ইনশিতা দুহাত জোড় করে রেখেছে। চোখের অশ্রু বাঁধ ভেঙে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। কোনরকমে কষ্টে বলল,

-“আম-আমি স-সাইন করবো না। আমি জেহেরের কাছে যাবো। তুই শত্রুর মতো আচরণ করছিস কেন নয়ন? তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

নয়নিকা তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে,

-“আমার বালের বেস্ট ফ্রেন্ড।”

নয়নিকার এমন আচরণ ইনশিতার বোধগম্য হচ্ছে না। সে নয়নিকার গাল ধরে বলে,

-“এই নয়ন। তুই পাল্টে কেন গেলি নয়ন? এদের হাত থেকে আমাকে বাঁচা না রে নয়ন। আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?”

নয়নিকা রাগ সামলাতে না পেরে সপাটে একটা চড় মেরে দিলো ইনশিতার গালে। নয়নিকার হাতে থাকা কলমের জন্য ইনশিতার ঠোঁট কেটে যায়। চড়টা এতটাই জোরে ছিল যে ইনশিতা পিছিয়ে গিয়ে পড়ল জিহাদের বুকে। ইনশিতা গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ বনে চেয়ে রইল নয়নিকার দিকে। এ কোন নয়ন? এটা কী সেই নয়ন যে ইনশিতার কষ্টে নিজে কষ্টিত হতো? নিশ্চয়ই না। এই নয়ন আর আগের নয়নের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

ইনশিতাকে মারতে দেখে জিহাদ নয়নিকাকে শাসালো,

-“লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছ না কি? ইনশিতাকে চড় মারার সাহস কোথায় পেলে হু? নিজের লিমিটের মধ্যে থাকো। নইলে ভালো হবে না তোমার জন্য।”

নয়নিকা ঘৃণার দৃষ্টিতে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্যতম বস্তুটি এখন তার সামনে। জিহাদ ইনশিতার বাহু ধরে নিয়ে আবার চেয়ারে বসাতে চাইল। ইনশিতা এখনো নিস্তব্ধ। আচমকা সে জিহাদের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে এক দলা থুথু ছুঁড়ে মারল নয়নিকার মুখে। রাগে ইনশিতার হাত পা কাঁপছে। চিল্লিয়ে বলল,

-“তোর মতো বেস্ট ফ্রেন্ড যেন আমার শত্রুরও না হয় এই দোয়া করি। মরিস না কেন রে তুই? তোর মতো বন্ধু তো কোবরার থেকেও বিষাক্ত। থুউউ…”

আরেক দলা থুথু ছুঁড়ল নয়নিকাকে। ইনশিতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে রাগে। নয়নিকা রেগেমেগে ইনশিতার দিকে তেড়ে গেলে জিহাদ এসে আটকায় নয়নিকাকে। আঙ্গুল তুলে নয়নিকাকে হুমকি ধামকি দিলেও নয়নিকা ইনশিতার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসে। জেবা এসে নয়নিকাকে নিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেল। জিহাদ এগিয়ে আসে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা তখনও ভাবছে তার বোনের মতো ফ্রেন্ডের আচরণের কারণ। জিহাদ ইনশিতাকে নিয়ে আবারও চেয়ারে বসালে ইনশিতা উঠে পড়ে। জিহাদের রাগটাও ধীরে ধীরে লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্টে সামলাচ্ছে নিজের রাগ। শান্ত কন্ঠে বলে,

-“সাইনটা করে দাও জান। প্রমিস, জেহেরের থেকেও বেশি সুখে রাখবো আমি।”

ইনশিতা রাগে দিশেহারা হয়ে গেল। জিহাদকে আচমকা থাপ্পড় মেরে বলে,

-“তোর মতো কু***বা*র সাথে সুখে থাকতে চাই না আমি।”

এমন আরও কয়েকটা কথা বলছিল সে। জিহাদ স্তম্ভিত হয়ে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকল ইনশিতার দিকে। পরমুহুর্তে রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। পা দিয়ে চেয়ার উল্টে ফেলে ইনশিতাকে আগের ন্যায় কোলে তুলে নেয়। যেতে যেতে বলে,

-“এই কু***বা*র হিংস্রতাও আজ তোকে দেখাব। চল তুই।”

ইনশিতাকে নিয়ে সেই সাত তলার রুমে নিয়ে আসে। খাটের মাঝে চেপে ধরে ফুলের ব্যাগ থেকে ফুল ছড়াতে লাগে খাটে। জেবা আর নয়নিকা পেছন পেছন আসে। জেবা বলে,

-“বিয়েটা হয়েছে?”

জিহাদ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

-“হয়নি, তবে এখন আমি যা করব তাতে বিয়ে না করে আর উপায় নেই।”

সকলেই বুঝে গেছে ইনশিতার সাথে এখন কী ঘটবে। জেবা খানিকটা চিন্তিত মুখে বলে,

-“বাট ভাই, বিয়ে না করে এখন এসব করার কী দরকার। বিয়েটা করে নে আগে। তারপর না হয়…”

জিহাদ বিরক্তি নিয়ে বলে,

-“একই তো। বিয়ের পর যা করব, তা বিয়ের আগেই করে ফেলি। বিয়েটা তো হচ্ছেই আমাদের।”

-“কিন্তু…”

-“তুই প্লিজ, এখন রুম থেকে বের হ। যা।”

নয়নিকা জেবাকে টেনে বেরিয়ে নিয়ে আসে। বেরিয়ে আসার সময়ও ইনশিতা ব্যাকুল দৃষ্টিতে ওদের থেকে সাহায্য চাইছিল। কিন্তু কেউই ফিরে তাকায়নি। নয়নিকা তো চায়ই ইনশিতাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিক জিহাদ।

নয়নিকা আর জেবা বেরিয়ে আসলে জিহাদ রুমের দরজা আটকে দেয়। জিহাদ ইনশিতাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে ইনশিতা ব্যথা পেয়ে পেট হাত দিয়ে আছে। সাহায্যের জন্য একমাত্র আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। জিহাদ ইনশিতাকে খাট থেকে উঠিয়ে নিজের একহাতে পেঁচিয়ে ধরে আরেকহাতে ফুলের পাপড়ি ছড়ায় শুভ্র বিছানায়। মুখে তার বিদঘুটে হাসি। ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে জিহাদের হাত জড়িয়ে বসে পড়ল।

-“আ-আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন জিহাদ। আমার এ-এত বড় সর্বনাশ করবেন না প্লিজ।”

জিহাদের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে পা জড়িয়ে ধরে ইনশিতা। ইনশিতার চুলের মুঠি ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে দেয় জিহাদ।

-“তখন বলেছিলাম সাইন করে দিতি, দেসনি। আর এখন যা করব তাতে নেচে নেচে তুই সাইন করবি। আমাকে কু**বা* বলা তাই না? দেখ আজ এই কু**বা* তোর কী অবস্থা করে।”

ইনশিতাকে ধাক্কা মেরে খাটে ছুঁড়ে দেয় জিহাদ। নিজের শার্ট খুলে মেঝেতে ফেলে ইনশিতার পা ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। ওড়না খোলার চেষ্টা করে সে। ইনশিতা বাকশূন্য হয়ে গিয়েছিল সেই মুহুর্তে। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক কী করতে হয় এই মুহুর্তে তার মাথায় আসছে না। এদিকে ইনশিতার উপর প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়েছে জিহাদ। জামার কিছু অংশও ছিঁড়ে ফেলল সে। ইনশিতা বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আগে নিজের মাথা ঠান্ডা করে নেয়। এই মুহুর্তে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। ইনশিতা ধস্তাধস্তি না করে শান্ত হয়ে যায়। ইনশিতাকে শান্ত হতে দেখে জিহাদ নিজেও খানিকটা আলগা করে ধরে রাখে ইনশিতাকে। ওড়না ছুঁড়ে যেই জামায় হাত দিবে অমনি মেইন পয়েন্টে লাথি মেরে দেয় ইনশিতা। খুব জোরে না লাগলেও ততটাও আস্তে লাগেনি। ব্যথা পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার মতোই লেগেছে। জিহাদ ইনশিতাকে ছেড়ে ব্যথা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে সরে যায়। তখনই ইনশিতা উঠে সর্বশক্তি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দেয়। দৌড়ে দরজার কাছে আসতে গিয়ে কিছু একটার সাথে লেগে আর পা কেটে যায়।

তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে লিফটের দিকে দৌড় মারে ইনশিতা। ঘটনাটা এত দ্রুতই ঘটেছিল যে নয়নিকা আর জেবা ইনশিতাকে ধরার সময়ও পায়নি। সিঁড়ি দিয়ে নামলে দেরি হবে তাই ইনশিতা লিফটাই বেছে নিলো। লিফটটা বন্ধ হতেও যেন দেরি লাগছে। বিপদের সময় সবকিছুতেই কেন যে দেরি হয়? উফ! ততক্ষণে জিহাদ নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। তিনজনেই দৌড়ে লিফটের দিকে আসছে ইনশিতাকে ধরার জন্য। ইনশিতা ভাবছে কোনোরকমে যদি কেউ তাকে আজ ধরে নেয় তাহলে তার আর নিস্তার নেই। জিহাদ প্রায় লিফটের কাছাকাছি এসে গেছে। ইনশিতা তখন দোয়া করছে লিফটা বন্ধ হওয়ার। জিহাদ যেই লিফটে ঢুকতে নিবে সেই মুহুর্তেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইনশিতা লিফট ঘেঁষে বসে পড়ে। যেন সে এই মুহুর্তে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে।

নিচে নেমে কোনদিক যাবে ভেবে পায় না সে। এই রাস্তাটা সম্পূর্ণ অচেনা। তার উপর সন্ধ্যা নেমে গেছে। নিয়নের আলোতে ইনশিতা খানিকটা এগিয়ে এলে নয়নিকা জেবা আর জিহাদের আওয়াজ শুনতে পায়। তার মানে তারা চলে এসেছে। এইখানে গাছগাছালিও নেই যে লুকাবে। রাস্তায় দৌড়ালেও জিহাদ ধরে ফেলবে। গাড়ি থামানোর চেষ্টা করলো সে। তবে একটাও থামল না। তার গলা আর কোমর মিলে ঝুলছে ছোট্ট ব্যাগটা। এইমুহুর্তে যে কাউকে ফোন করলেও পাবে না সেটা সে বুঝতে পারছে। অদূরে কিছু গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে পা ছুটালো সেদিকটায়।

ইনশিতা গিয়ে একটা গাড়ির পেছনে লুকালো। ইতিমধ্যে জিহাদ জেবা আর নয়নিকা রাস্তায় এসে পড়েছে। জিহাদ খালি গায়েই দৌড়ে এসেছে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ইনশিতাকে খুঁজতে লাগে। এখন যদি ইনশিতাকে পেয়ে যায় সে তাহলে পৃথিবী উল্টে গেলেও কোনোভাবেই ছাড়বে না। এমন অবস্থা করবে যে মানুষকে নিজের চেহারাও দেখাতে লজ্জা পাবে ইনশিতা। চারিদিক তাকিয়ে খুঁজছে তারা ইনশিতাকে। ইনশিতার লুকানো গাড়ির কাছেই জিহাদ দাঁড়ানো। একটু পেছন ফিরলেই ইনশিতাকে দেখতে পাবে সে। ইনশিতা দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল যাতে কান্নার আওয়াজ জিহাদ না পায়। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জিহাদ তখন হুমকি দিচ্ছিল ইনশিতাকে। কারণ সে জানে ইনশিতা আশেপাশেই লুকিয়ে আছে।

তখনই একটা ট্যাক্সি ঐ রাস্তা দিয়ে যায়। জিহাদ তখন আশেপাশে খুঁজতে ব্যস্ত। আর নয়নিকা আর জেবা বিল্ডিংয়ের আশেপাশে খুঁজতে লাগে। ট্যাক্সির মধ্যে বসা রাফিদ দেখতে পেল নয়নিকাকে। সে তার বাবার সাথে একটু আগে হসপিটাল থেকে চেকাপ করে ফিরল। বাবা একটা কাজে গিয়ে তাকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিলেন। নয়নিকাকে এই ভরসন্ধ্যায় হঠাৎ দেখে রাফিদ গাড়ি থামাতে বলে। তার পা এখনো ঠিক হয়নি। তবুও একটু একটু হাঁটতে পারে।

নয়নিকাকে যেই ডাক দিবে তখন তার চোখ পড়ে একটা কালো গাড়ির পেছনে হলুদ জামা পরিহিত চেনা কাউকে। যে কিনা মুখ চেপে বসে আছে। ড্রাইভারকে সেই কালো গাড়ির কাছে এগিয়ে যেতে বলে। সেখানে গিয়ে থামলে রাফিদ দরজা খুলে দেয়। ইনশিতার চোখ পড়ে তখন রাফিদের উপর। প্রাণ ফিরে পায় যেন সে। হুড়মুড় করে ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকে পড়ে। ইনশিতার বিধ্বস্ত অবস্থা দেগে রাফিদ কিছু বলতে যাবে ইনশিতা ইশারায় চুপ করতে বলে আর ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে।

আশেপাশে এমন অনেক গাড়িই যাতায়াত করছে তাই তাদের তিজনের কেউই বিশেষ খেয়াল করেনি ট্যাক্সিটাকে। গাড়ি চলতে শুরু করলে রাফিদ লাইট অন করতে বলে। বিস্মিত চোখে বলে,

-“তোমার এই অবস্থা কেন ইতু? আর নয়নিকাকে দেখলাম। ও’কে নিয়ে আসলে না কেন? কী হয়েছে?”

ইনশিতা তখন থেকেই কাঁদতে লাগে। রাফিদ পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলানোর সময় দেয় ইনশিতাকে।

.

.

সব শুনে রাফিদের ইচ্ছে করছে নয়নিকাকে টুকরো করে রাস্তার কুকুরকে খাওয়াতে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। ছিঃ! ইনশিতা নয়নিকাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করত। আর সেই নয়নিকাই যে ইনশিতার পিঠে ছুরি মারবে সেটা কে জানতো? রাফিদের হাত পা আজ ঠিক থাকলে সে নিশ্চিত নয়নিকাকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিত।

ইনশিতা তখনও সেই মুহুর্তের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। তার হাত পা মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে ভয়ে। গলা ব্যথা হয়ে গেছে তার। রাফিদ ইনশিতাকে আর এই পরিস্থিতি নিয়ে একটাও প্রশ্ন করল না। কথা ঘুরানোর জন্য বলে,

-“তুমি কী সত্যিই জেহেরকে ভালোবাসো?”

শত কষ্টের মধ্যেও ইনশিতার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। যা দেখে উত্তর পেয়ে যায় রাফিদ। তার কষ্ট হতে লাগে, কিন্তু সেটা অপ্রকাশিতই রাখে। ইনশিতা আপনমনে বলে,

-“কখন কীভাবে জেহেরকে যে ভালোবেসে ফেললাম নিজেই জানি না। ভালোবাসা কখনোই বলেকয়ে হয় না। হুট করে হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রেও বোধহয় তাই হয়েছে।”

রাফিদ ঢোক গিলে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজের কষ্ট দমন করে। নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে তার ভালোবাসার মানুষটির কথা শোনা বোধহয় সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয়। রাফিদ আড়চোখে তাকাল ইনশিতার দিকে। সে পারলে জেহেরের নামে সেদিন কেসটা করতে পারত। তবে জেহের তাকে হুমকি দিয়েছিল তার পরিবারের ক্ষতি করার। তাই রাফিদ সেদিন পুলিশকে মিথ্যে বলেছিল যে ঝামেলায় জড়িয়ে তার এই অবস্থা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাফিদ। তবে তার এটা ভেবেই বেশি রাগ লাগছে জিহাদ কীভাবে এমন একটা নোংরা কাজ করতে পারল? নিজের বোন আর ইনশিতার ফ্রেন্ডের সাহায্যে এত বড় একটা অন্যায় করতে একবারও বিবেকে বাঁধলো না! জেবার সম্পর্কে এবার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই জন্মালো না রাফিদের মনে। মনুষ্যত্বহীন মানুষ সবগুলো। রাফিদ সুযোগ পেলেও এখন আর এমনটা করবে না। সে চায় ইনশিতা খুশি থাকুক। ভালোবাসার মানুষটি ভালো থাকলে সেও ভালো থাকবে। সবসময় যে কাছে থেকেও ভালোবাসা যায় কে বলল? দূর থেকেই ভালোবেসে যাবে নিজের ভালোবাসাকে।

জঙ্গলের রাস্তায় পৌঁছাতেই ইনশিতা ট্যাক্সিটা এখানে থামাতে বলল। এখান থেকে হেঁটে গেলে দশমিনিটে পৌঁছে যাবে সে। কিন্তু রাফিদ তাকে একা ছাড়তে নারাজ। পথিমধ্যে আবার কোনো বিপদ হোক সেটা সে চায় না। ইনশিতা রাফিদকে বোঝাতে চাইল, জেহের যদি কোনোভাবে জানে যে রাফিদ তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাহলে রাফিদকে আর ছাড়বে না। রাফিদ চাইল সে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তারপরই আসবে। রাফিদের হাত পায়ের অবস্থা ভেবে ইনশিতা বাঁধা দিতে চাইল। তবে রাফিদ শুনল না কোনো কথা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইনশিতাকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। পুরো বাড়িটায় এখন অন্ধকার ঘিরে রয়েছে। সামনে যে একটা ঘর আছে সেটাও বোঝবার উপায় নেই। রাফিদকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয় ইনশিতা। বিদায় দিয়ে ইনশিতা ফ্ল্যাশ অন করে গেইট বন্ধ করে ধীর পায়ে এগোলো ঘরের দিকে। খুশি আর ভয়ের সংমিশ্রণে হাবুডুবু খাচ্ছে ইনশিতা। জেহেরকে আজ তার ভালোবাসার কথা বলবে সেই খুশি। আর আজকে জেহের ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেই ভয়। জেহের নিশ্চয় ছেড়ে দেবে না আজ! এটা সত্যি যে ইনশিতার মনে খুশির থেকে ভয়টাই বেশি ঝেঁকে ধরেছে। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে দরজা খুললো সে।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে মনে হচ্ছে এটা ভুতের বাড়ি। এই এতটা ক্ষণ জেহের কীভাবে যে ছিল ভাবতেই ইনশিতার শরীরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায়। দরজা আটকে রুমের দিকটায় পা বাড়ালে সে শুনতে পায় ভয়ঙ্কর সেই হাড় হিম করা সুর। যেটা একবার নয়নিকাদের পুরোনো বাড়িতে জেহের বাজিয়েছিল। যেই ভয়ানক সুরে ইনশিতা প্যানিক হয়ে গিয়েছিল। হারমোনিকার অদ্ভুত ভয়ানক সুর। ইনশিতা কান চেপে ধরল। সে এমনিতেই এমন সুর শুনতে পারে না। তার উপর মোবাইলটা পড়ে বন্ধ হয়ে ফ্ল্যাশ অফ হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার ছাড়া চোখে আর কিছুই দেখছে না সে। ভয়ে ইনশিতার শ্বাস উঠে গেল যেন। হরর মুভিগুলার হাড় হিম করা সুরের থেকেও বোধহয় জেহেরের এই সুরটা অত্যাধিক ভয়ানক।

আন্দাজ করে হাতড়ে হাতড়ে ইনশিতা রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। সুরটা আরো গাঢ় হয়ে এলো ততক্ষণে। ইনশিতা বলতে চাইল জেহেরকে এই আওয়াজ বন্ধ করতে। কিন্তু বলতে পারল না। ইনশিতা দরজা ধরে বসে পড়ল। ভেতর বাহির কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে সে সিওর সে জেহেরের রুমের সামনেই। কান চেপে চিৎকার করতে চাইল ইনশিতা। সুরটা যেন কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। ইনশিতার চাপা কন্ঠ শোনা গেল শুধু।

-“জেহের, বন্ধ করুন। আমি আর নিতে পারছি না এই সুর।”

তবে সেই ক্ষীণ কন্ঠ হারমোনিকার আওয়াজে চাপা পড়ে গেল। প্রায় মিনিট খানিকক্ষণ পরে সুরটা আচানক থেমে গেল। থামতেই ইনশিতার কান্না শোনা গেল। নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে ইনশিতার ক্ষীণ কন্ঠের কান্নাকেও বিশাল আওয়াজ মনে হয় যেন। ইনশিতা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। এখন শুধু সাপের মতো ফোঁস ফোঁস আওয়াজ আসছে।

ইনশিতা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ভেতরে। হাত দিয়ে ধরে ধরে সুইচ খুঁজতে থাকে। কোথায় সুইচ সে নিজেও এখন ঠাওর করতে পারছে না। আচমকা তার হাত টেনে ধরে নিজের বুকের উপর ফেলে জেহের। ইনশিতা ভয় পেয়ে জেহেরকে জড়িয়ে ধরে। জেহেরের বড় বড় নিঃশ্বাসের উষ্ণ বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে ইনশিতার সারা মুখে। ইনশিতা জেহেরকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখন সেই সুর আবারও ভেসে আসে। একদম কানের কাছে এবার। দু’হাত দিয়ে কান চেপেও যেন আওয়াজ থামাতে পারছে না ইনশিতা। এদিকে উঠেও দাঁড়াতে পারছে না কারণ জেহের নিজের দু’পা দিয়ে শক্ত করে ইনশিতার পা চেপে আছে। ইনশিতার মাথা ধরে যাচ্ছে সেই সুরে। জেহেরের বুকে শক্ত করে মুখ গুঁজে কাঁদছে সে। আজ সারাদিন তার উপর এত ধকল গিয়েছে যে শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সেই ভয়ানক সুর আর কানে বাজলো না তার। জেহের হারমোনিকাটা ছিটকে ফেলে ইনশিতার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। অস্ফুটে কিছু বলল সে। তবে ইনশিতা বুঝতে পারল না।

টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো জেহের। ইনশিতা দেখল শান্ত অথচ লাল চোখ নিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেহের তার দিকে। জেহেরের বাহু ধরে উঠে হাতের বাঁধন খুলে দিতে লাগল ইনশিতা। দেখল জেহেরের হাতের কব্জি পর্যন্ত রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে। নিজেকে নিজে ধিক্কার জানালো ইনশিতা।

জেহের এখনো একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ইনশিতা তোয়াক্কা করলো না। তার মনে হলো সে এক্ষুনি হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তাই দ্রুত উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। আপাতত একটা লম্বা শাওয়ার নিলে নিজেকে বড্ড ফ্রেশ লাগবে। তারপর জেহেরের হিংস্রতামি সহ্য করা যাবে।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here