#প্রহেলিকা
#পর্ব_১২
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

———————–

ইনশিতা হাত, মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে গাড়িতে। পরনে বিয়ের সাজ। সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। গাড়িতেও আলো নেই। যার কারনে ইনশিতা গাড়িতে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তবে বুঝতে পারছে ড্রাইভার সীট ছাড়া আর কোথাও কেউ নেই। বিকেলের আগেই তাকে মেকআপ রুম থেকে কয়েকজন বোরকা পরিহিত মহিলা জোর করে হাত মুখ বেঁধে সকলের আড়ালে এই গাড়িতে ধরে বেঁধে উঠিয়ে দিয়েছে। চিৎকার চেঁচামেচির কোনো সুযোগই পেল না সে। এতক্ষণ ধরেই সে গাড়িতে। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না। ওদিকে জেহের কোনো হাঙ্গামা সৃষ্টি করেছে কি না কে জানে?

ইনশিতার হুট করেই ঐ দিন রাতের কথা মনে পড়ল। সেদিন যখন সে ব্যালকনির দরজা খুলছিল তখন কেউ একজন হাত ধরে হেচকা টানে দেয়ালে চেপে ধরে। চিৎকার দিতে গেলে লোকটি মুখ চেপে ধরে। রাস্তার ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেল জেহেরকে। একদম তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে আছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে জেহের। যেন ভয়ানক রেগে আছে। ভয় ঝেঁকে ধরল তাকে। এত রাতে কীজন্য এসেছে জেহের?

-“বিয়েটা একদম করতেই হতো তোমাকে? একবার না করলে না কেন? তুমি জানো এই বিয়েটা করলে তোমার লাইফ হেল হয়ে যাবে?”

জেহেরের রাগী কন্ঠ শুনে ইনশিতা যারপরনাই অবাক হয়। যেখানে জেহের নিজেই বিয়ে করার জন্য পাগল সেখানে সে এই কথা বলছে? তবে জেহেরের ভয়েসটা কিছুটা অন্যরকম লাগছে। ইনশিতা একবার ভালো করে তাকাল। একি! এটাতো জিহাদ! জিহাদ চশমা পড়েনি তাই তখন তাকে জেহের ভেবেছিল। কিন্তু কুচকুচে কালো চোখের মনি দেখে বুঝে গেছে এটা জিহাদ। জিহাদ হঠাৎ এমন আচরণ করছে কেন সেটা ইনশিতার বোধগম্য হচ্ছে না। শুধুমাত্র জেহের নামক এক পাগলকে বিয়ে করার জন্যই না কি?

ইনশিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল।

-“এত রাতে একটা মেয়ের বাড়িতে চলে আসার মানে কি? আর জেহের জানলে কি হবে ভেবে দেখেছেন?”

জিহাদ ইনশিতার হাত চেপে ধরে কার্ণিশের সাথে চেপে ধরল। ইনশিতার হাত জিহাদের দু’হাত দ্বারা এক প্রকার বন্দী করে নিলো।

-“ভাই ঘুমোচ্ছে। আর তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন বিয়েতে রাজি হয়েছ?”

ইনশিতা একবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল জিহাদের দিকে। জিহাদের চোখে রাজ্যের অসহায়ত্ব। চোখ দুটো যেন খুব কষ্টে মেলে রেখেছে। ঘোলাটে চোখে মনে হয় কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগছে দেখতে। ইনশিতা চোখ সরিয়ে নিল।

-“জেহেরকে তো আপনি আমার চেয়েও ভালো চিনেন। উনি যেটা সেটা জোর করে হলেও আদায় করে নেয়। আমি যদি বিয়েতে রাজি হই তাহলে উনি বাবাকে মেরে ফেলবেন বলেছিল। আর এমনিতেও ওনার সাথে বিয়ে হলে তো সব সমস্যা মিটেই যাবে। উনি সুখী থাকবেন আর ঝামেলাও পাকাবেন না, তাতে সকলেই সুখী থাকবে।”

-“তুমি সুখী থাকবে তো?”

এই একটা প্রশ্ন যেন ইনশিতার ভেতরতা নাড়া দিলো। চোখে টলমল করে উঠল জল। সে কি আসলেই সুখী থাকবে? হয়ত না। মেকি হাসি দিয়ে বলল,

-“সুখী না থাকার কি আছে? সবাই সুখী তো আমিও সুখী।”

জিহাদ কিছুই বলছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতার কেমন যেন লাগল। সে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু জিহাদ এত শক্ত করে ধরে আছে যে চাইলেও সরাতে পারছে না। ইনশিতা অস্বস্তি ভরা কন্ঠে বলল,

-“আপনি দূরে সরে দাঁড়ান। ভালো লাগছে না?”

-“জেহের কাছে আসলে খুব ভালো লাগে বুঝি? ওর ছোঁয়া খুব উপভোগ করো তাই না?”

জিহাদের এমন কথায় ইনশিতার মনে ঘৃণার সৃষ্টি হলো। ছিঃ! জিহাদ এই ধরনের কথা বলছে কেন? ঝাঁঝাল গলায় বলল,

-“মুখ সামলে কথা বলুন।”

-“আরে আরে, সুইটহার্ট দেখছি রেগে যাচ্ছে। ওর ছোঁয়া আর আমার ছোঁয়ায় পার্থক্য আছে? আমি ছুঁয়ে দিলেও তোমার ভালো লাগবে। দেখো,”

বলেই নিজের নাকটা ইনশিতার গালের কাছে নিয়ে গেল। ইনশিতা মুখ ফিরিয়ে নিলো। গা ঘিনঘিন করে উঠছে তার। এটা বুঝতে পারল যে জিহাদও তাকে কোনো না কোনো ভাবে পছন্দ করে। দুই ভাইই এক। যখন তখন সুযোগ খুঁজে কাছে আসার। এখানে থাকাও ঠিক হবে না। ইনশিতা জোরে পা দিয়ে জিহাদের পায়ে লাথি দিলো। হাত আলগা হতেই ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল জিহাদকে। জিহাদ টাল সামলাতে না পেরে পিছু হটল। সেই ফাঁকে ইনশিতা ভিতরে ঢুকে ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দিলো। আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় খারাপ কিছু হয়ে যেত। জিহাদ দরজায় ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। ইনশিতার ভয় হলো, যদি বাবা মা শুনে নেয়! তবে আওয়াজ আর শোনা গেল না। জিহাদ রুম আর ব্যালকনির জানালায় হাত রেখে চোখ লাল করে শাসালো,

-“তোমাকে আমি আমার করেই ছাড়বো। বিয়ে হলেও তুলে আনবো। এমনকি দশ বাচ্চার মা হলেও।”

জিহাদ কিছুক্ষন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ইনশিতার দিকে। ইনশিতা তখন বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল এমন দৃষ্টি হতে বাঁচার জন্য। আধ ঘন্টা পর দেখল জিহাদ আর নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সে ব্যালকনির দরজা খুলে বসে রইল। শিরশির করা বাতাস গায়ে লাগিয়ে সেখানে ঘুমিয়ে গেল।

.

.

ইনশিতার ভাবনার জাল ছিঁড়ল যখন দেখল কেউ একজন তাকে কাঁধে করে তুলে নিচ্ছে। তবে তার আগে ইনশিতার চোখ বেঁধে দিলো লোকটি। ইনশিতা নিশ্চিত হলো এটা জিহাদ। কারণ জিহাদ সেদিন তাকে হুমকি গিয়েছিল। আর এরকমটা একমাত্র জিহাদই করতে পারে। জিহাদ কি করতে যাচ্ছে আর কি করবে সেটা ভাবতে পারে না ইনশিতা। এখন জেহের-জিহাদ দুই ভাই-ই তার চোখের বিষ। দুই ভাইকেই দেখতে পারে না সে। একজন পাগল তো আরেকজন ছাগল।

ইনশিতা অনুভব করল তাকে কোথাও বসানো হয়েছে। কিছু দিয়ে তাকে সেই বসার জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে। আর একটু বাদেই অদ্ভুত শব্দ কানে আসল। তার মনে হয় সে দুলছে। সে কি উড়ছে না কি?

.
ইনশিতার বাবা মা বসে আছে জেহেরের সামনের সোফায়। জেহের পায়ের উপর পা তুলে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে আর বিড়বিড় করছে। বিয়ের জন্য যখন ইনশিতাকে সাজাতে নেওয়া হয় তখন থেকেই ইনশিতাকে পাওয়া যাচ্ছে না। জেহের অনেক খুঁজেও ইনশিতাকে পায়নি। ইনশিতাকে না পেয়ে জেহের পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়। বিয়ের ডেকোরেশন পুরো তছনছ করে দিয়েছিল। চেয়ার টেবিল, খাওয়া দাওয়ার জিনিস সব উল্টে পাল্টে ভেঙে দিয়েছিল। কয়েকজন থামাতে এলে তাদেরকেও রক্তাক্ত করতে বাদ রাখেনি। জেহেরের হিংস্রতা প্রায় সবাই দেখে নিয়েছিল তখন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সবাই এক কোণে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। জেহেরের তখন চোখ যায় ইনশিতার বাবার দিকে। তার মনে হয় ইনশিতার বাবা-ই তার রোজকে পালাতে সাহায্য করেছে। কারণ ইনশিতার বাবা শেষ মুহূর্তে বিয়েটা ভাঙতে বলেছিল। তাই ইনশিতার বাবাকে ধরে এনে সামনে বসিয়ে রেখেছে। ইনশিতার বাবা নিজেই তো জানে না তার মেয়ে কোথায়। তিনি নিজেও চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার উপর জেহেরের সন্দেহের শিকার হয়েছেন। জেহের যে তাকে সহজে ছেড়ে দেবে না সেটা তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন। জেহের চোখ বন্ধ রেখেই গম্ভীর গলায় বলে,

-“রোজ কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ও কে?”

ইনশিতার বাবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলেন,
-“আমি নিজেও জানি না বাবা ইতু কোথায় আছে।”

জেহের এবার চোখ খুলে তাকাল। চিৎকার করে বলে উঠে,

-“নিজে পালাতে সাহায্য করে এখন নিজেই বলছেন জানেন না? আমাকে বোকা পেয়েছেন আপনি?”

বলেই পাশে থাকা গ্লাস ছুঁড়ে মারে একদম ইনশিতার বাবার কপাল বরাবর। ইনশিতার বাবা কপালে হাত চেপে বসে পড়েন। হাতের আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ইনশিতার মা আঁতকে উঠে ইনশিতার বাবাকে ধরেন। জেসমিন চৌধুরী আর আফজাল সাহেবও এগিয়ে আসেন।

জেহের সবাইকে সরিয়ে ইনশিতার বাবার পাঞ্জাবির কলার তুলে টেনে ধরেন। চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে তার। ঘাড়, হাত আর কপালের রগ ফুলে উঠেছে। গলা আর পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। জেহের আর কিছু করবে তার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠে। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বলল। তা শুনে জেহেরের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। ঘাড় কাত করে ইনশিতার বাবার দিকে তাকিয়ে ইনশিতার বাবার কলার ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

-“ডিয়ার ফাদার-ইন-ল। আমি আর একটু পরই আসছি। আসল ঘটনাটা শুনে তো আসি আগে। যদি শুনি রোজের পালানোর ব্যাপারে আপনার হাত আছে তাহলে আজকের দিনটা আপনার জন্য শেষ দিন হবে। আমি না আসা পর্যন্ত যা করার করে নিন।”

বলেই জেহের একবার ইনশিতার বাবার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল। ইনশিতার বাবা বসে পড়লেন। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

.

.

ইনশিতাকে কেউ কোলে করে নিয়ে হেঁটে চলছে। তারপর ইনশিতাকে তার কোলেই বসিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। চারিদিক রাতের অন্ধকারে ছেয়ে আছে। ইনশিতার কেমন ঘুমঘুম লাগছে। তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে গেছে। মুখ বাঁধা থাকায় কিছুই বলতে পারল না। কিছু না খেয়ে থাকায় শরীরটাও ছেড়ে দিচ্ছে কেমন। কোলে রাখা ব্যক্তির বুকেই মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। আর ব্যক্তিটি একধ্যানে ইনশিতার দিকে তাকিয়ে ইনশিতার চুল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে কপালে চুমু দিলো। ইনশিতার শীত লাগায় লোকটির কোলে আরো গুটিশুটি মেরে ঘুমালো। লোকটি হালকা হেসে গাড়ির জানালা তুলে দিল। একটি চাদর বের করে ইনশিতার গায়ে জড়িয়ে দিলো। নিজেও ইনশিতাকে শক্ত করে চেপে ধরল। উষ্ণতায় ইনশিতা আরো গভীর ঘুমে চলে গেল।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here