প্রহর শেষে
পর্বঃ২
আহসানউল্লাহ সাহেবের তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলের নাম হলো শাহাদাত ,মেঝো ছেলে ইরশাদ আর সবচেয়ে ছোট ছেলে হলো ওয়াসিয়াত।
বড় ছেলে শাহাদাত খুবই গম্ভীর আর সৌখিন প্রকৃতির।টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ,আকর্ষণীয় চেহারা। চোখে সর্বদা কালো ফ্রেমের চশমা থাকে।দ্বিতীয় জন অর্থাৎ ইরশাদ হলো অতন্ত্য ভালোমানুষ। তার মুখে সর্বদাই হাসি লেগে আছে। তার রাগি চেহারাটা বোধহয় আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। সে চাইলেও কখনো কারো ওপর রাগ করতে পারে না।আর সর্বশেষ অর্থাৎ আহসানউল্লাহ সাহেবের তৃতীয় পুত্র হলো এদের দুজনের সম্পুর্ন বিপরীত। গুনগুনের মতে সে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অলস মানুষ। একগ্লাস পানি তুলে খেতেও যার কাউকে ডাকা চাই।বিছানা তার সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী। যতক্ষণ সে বাড়িতে থাকে বিছানায় বসেই সে সব কাজকর্ম করে।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে। বাড়িটার সামনে নানা রকম গাছ- গাছালি থাকায় জায়গাটা পোকামাকড়ে ভরপুর। কি একটা পোকা যেন অনবরত ডেকে চলেছে। গুনগুন মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে একবার তাকালো।আবছা আলোয় মহীরুহ গুলোকে কেমন ভৌতিক লাগছে। সে জলদি হেটে সদর দরজার কাছে এসে কলিংবেল চাপলো।
অনেকক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরও কেউ দরজা খুললো না।গুনগুনের কিছুটা রাগ হলো। এই ভর সন্ধ্যায় এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? তার ওপর বাইরের বাতিটা এখনো অবধি জ্বলে নি।
বাগানের ওদিকটায় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। গুনগুন ফের একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতেই দরজাটা খুলে গেল। দরজার ওপাশে ইরশাদ দাঁড়িয়ে আছে।
গুনগুনকে দেখেই সে ভ্রু নাচিয়ে বললো -“আরে গুনগুন, কি খবর?”
গুনগুন কিছুটা বিব্রত বোধ করলো। -“আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া ” বলেই সে মুচকি হাসলো। ভেতরে এসে সে চারিদিকে একবার চোখ বুলালো। নাহ কোথাও কেউ নেই। সব গেল কোথায়?
প্রথমে সে গেল বড়মার ঘরে। সেখানে কাউকে না পেয়ে সিড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠে গেল।ওপরে আসতেই হাসির শব্দ এলো তার কানে।
-‘গুনগুন’ বলেই মেয়েটি জড়িয়ে ধরলো। খানিক পরে তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো -“কেমন আছ গুনগুন? ”
গুনগুন মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো -“ভালো “।
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হিয়া তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো -” তুমি একেবারে ঠিক সময় এসেছ”।
গোল-গাল চেহারার মায়া ভরা মুখের মেয়েটিকে দেখেই জোহরা খানমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি জলদি কাজের মেয়েটিকে ডেকে নাস্তা দিতে বললেন। আদেশ পাওয়া মাত্রই মিনা দৌড় লাগালো।
সেদিকে তাকিয়ে গুনগুন খাবে না বলে আপত্তি জানাতেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো
-“থাক আর ঢং করে কাজ নেই, খেতে চাইছো কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছো না তা বুঝতে পারছি। খেয়ে ফেল নইলে আবার আমাদের নজর লেগে যেতে পারে। “তার কথা শুনে সকলেই মুচকি মুচকি হাসছে।গুনগুন রাগি দৃষ্টিতে একবার পেছন ফিরে তাকালো।এখানে গুরুজনেরা আছে তাই সে কিছু বলতে পারলো না শুধু মুখ ভেংচালো।
জোহরা খানম বিরক্তির স্বরে বললেন -” আহ ওয়াসি, ও আসতে না আসতেই তুই পেছনে লাগা শুরু করে দিলি?”
প্রায় সকলেই উঠে গেছে। গুনগুন আর হিয়া ডিভানে বসে কথা বলছে। কিছুটা দূরে বিছানায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে ওয়াসিয়াত এখনো তার খাওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তার চোখ বন্ধ।চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে সে ডাকলো-“গুনগুন “। ভ্রু জোড়া কুচকে গুনগুন তার দিকে ঘুরে তাকালো শুধু। ওয়াসিয়াত হাই তুলতে তুলতে বললো -” খাবো না খাবো না করেও তো সবই খেলে, যাও এখন কফি করে নিয়ে এসো, কুইক!
চোখ বড় বড় করে গুনগুন বললো -“তুমি তো চা খাচ্ছ।আবার কফিও খাবে!!”
-“তুমি আনবে কি না?”
গুনগুন বিরক্তি নিয়ে উঠে এগোতেই ওয়াসিয়াত আবার পিছু ডাকলো।-“শোন শুধু আমার জন্য এনো না। তারপর হিয়ার দিকে ইশারা করে বললো -“এই নিউ কামারের জন্যও এনো।আর তারপরও যদি থেকে যায় তাহলে তোমার জন্য এনো।”বলে সে মুচকি হাসলো।
গুনগুন রাগে ফুসতে ফুসতে চলে গেল।
এই ছেলেটাকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। দেখলেই মাথায় আগুন ধরে যায়। top to bottom একটা শয়তানের ধারি।তাকে খাটিয়ে ওয়াসিয়াত যে পৈশাচিক আনন্দ পায় তা সে জানে।গুনগুনকে দেখলেই তার বিচিত্র সব খাবার বানানোর কথা মনে পরে।কখনো মালাই দিয়ে কফি আবার কখনো মাছের শিক কাবাব। মাছের শিক কাবাবের কথা মনে পরলেই গুনগুনের গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। সেবার কি বিচ্ছিড়িই না হয়েছিলো খেতে।উফফ!!
কিন্তু কিছুই করার নেই। যতই হোক সে বাড়ির সকলের আদরের ছোট পুত্র।
সন্ধ্যা বেলা সকলের সামনে বলা কথার প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করেই ওয়াসিয়াতের কফিতে বেশি কফি পাউডার মেশালো।তারপর কফি নিয়ে ওপরে চলে গেল।
হিয়া আর ওয়াসিয়াত কিছু একটা নিয়ে খুব হাসা-হাসি করছে। কফি সহ ট্রে টা বিছানায় রেখে হিয়া কে একটা মগ এগিয়ে দিয়ে সে নিজেও একটা মগ নিয়ে বসলো।
-“কি আশ্চর্য গুনগুন! কফিটা হাতে দাও।কবে যে এগুলো শিখবে। একদম মেনার্স জানো না।কফিটা এনেছো,অথচ আমাকে না দিয়ে নিজেই খাওয়া শুরু করে দিলে।”।
গুনগুন আড় চোখে তাকিয়ে বললো।
-“কেন,তুমি একটু কষ্ট করে নিয়ে নাও।”
ওয়াসিয়াত কপাল কুচকে বললো -“আহ! কি যে বলো।এত আরাম করে বসেছি।এখন যদি একটু নড়ি তাহলে কি আর এভাবে বসতে পারবো? তার থেকে তুমিই বরং দাও।”
হিয়া এতক্ষণ হা করে তাদের কথা শুনছিলো। এবার সে হো হো করে হেসে ফেললো।
গুনগুন কফি ওয়াসিয়াতের হাতে দিলো না।উল্টো হিয়া কে নিয়ে উঠে চলে গেল। এদিকে কফিতে চুমুক দিয়েই ওয়াসিয়াতের চেহারা পাল্টে গেছে।
__________
ঝালমুড়ি চিবোতে চিবোতে গুনগুন বাড়ি ফিরছিল।হটাৎ মোড়ের স্কুলের গেইটের সামনে দীপুকে দেখে সে ঘুরে দাড়ালো, চেচিয়ে বললো -“এই আবুল দাড়া”।
হাতের ইশারায় দীপুকে দাড়াতে বলে সে রাস্তা পাড় হয়ে সেদিকে এগোলো।স্কুল টা তাদের গলির মোড়েই।সেখানে গিয়ে দীপুকে দেখে একটু হেসে বললো -“কিরে আবুল কি খবর? ”
-“খবর ভালোই,দাড়া তুই আমাকে মাঝরাস্তায় এভাবে আবুল বলে ডাকলি কেন?”
-“তো কি বলে ডাকবো? ”
-“আমার নাম ধরে ডাকবি”।
-“চুপ কর।আমি আবুল বলেই ডাকবো। নে ঝালমুড়ি খা।বলে সে নিজেই মুখে ঝালমুড়ি পুড়ে বললো -“নেহার কি খবর? ”
দীপু ঝালমুড়ি খেতে খেতে বলল -“নেহার সাথে ব্রেকাপ”।
গুনগুন মুচকি হেসে বললো-“শ্রাবন্তীর পর এবার নেহাও আউট? ”
দীপু মুখ গোমড়া করে বললো -“হুম”।কথা বলতে বলতে পাশ ফিরে তাকাতেই জলদি দীপুর মুখভঙ্গি পাল্টে গেল। সে বললো -“দোস্ত আমি যাই রে।”
গুনগুন অবাক হয়ে বললো “-কেন? ”
-“এলাকার বড় ভাই আসছে।এভাবে রাস্তায় কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলে ঝামেলা হবে। ”
গুনগুন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওয়াসিয়াত আর একটা ছেলে এদিকেই হেটে আসছে।কিছু বলার জন্য সামনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো দীপু হেটে প্রায় স্কুলের মাঠের কাছাকাছি চলে গেছে। -“আরে আবুল আমার ঝালমুড়ি টা তো দিয়ে যা।” দীপু ততক্ষণে দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেছে। -“ধুরর,যাবি যা আমার ঝালমুড়ি টা কেন নিয়ে গেলি?”
গুনগুন ওয়াসিয়াত কে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। সাথে বন্ধু থাকায় ওয়াসিয়াতও কথা বললো না। আড় চোখে একবার তাকালো শুধু।
-“ওয়াসি, এটা গুঞ্জনের বোন না?”
ওয়াসিয়াত গম্ভির হয়ে জবাব দিলো -“হুম ”
রাফি মৃদু হেসে বললো -“মেয়েটা খুব সুন্দর, ওর নাম যেন কি? অনেকদিন আগে দেখা হয়েছিল তো, নাম টা ভুলে গেছি। ”
ওয়াসিয়াতের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। সে জানতে চাইল -“নাম দিয়ে কি করবি? আর মেয়েটা সুন্দর তাই না?তুই সুন্দরের বুঝিস টা কি?”
-“তুই এগুলো কি বলিস,এতো মিষ্টি একটা মেয়ে। যাইহোক ওর সাথে তোর সম্পর্ক কেমন দোস্ত? ”
-“মানে?”
-“না,মানে তোর সাথে কি কথাবার্তা বলে? ”
ওয়াসিয়াত সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইলো।বললো -“কেন?”
রাফি একটু থতমত খেয়ে গেল।-“দোস্ত…. ”
-“চুপ,আরেকবার কিছু বললে তোর পিঠে আমি এই ব্যাট ভাঙবো।”
আকাশ টা মেঘলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় বৃষ্টি নামবে। ধূসর মেঘগুলো পেজা তুলার মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। গুনগুন গাছে পানি দিচ্ছে।ওয়াসিয়াতদের বাড়ির ছাদের এই বাগানটায় বাহারি ফুলের গাছ আছে। এখানে এলেই গুনগুনের মন ভালো হয়ে যায়। আজক স্কুলে হাফ ক্লাস থাকায় বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ পরই সে এখানে চলে এসেছে।
গুনগুনের বাগানের খুব শখ।তবে তাদের বাড়িতে বাগান করার মতো যথেষ্ট জায়গা না থাকায় সুযোগ পেলেই সে এখানে চলে আসে। তাছাড়াও বাগান পরিচর্যার দায়িত্ব টা চাচা তাকেই দিয়েছেন। কারন তার ছেলেরা ভুল করেও কখনো এদিকে উঁকি দেয় না।
গুনগুন ডালিয়া গাছটায় পানি দিচ্ছিলো। আহসানউল্লাহ সাহেব যেতে যেতে বললেন -” তুমি এইদিকটা দেখো।আমি নিচের বাগানে যাচ্ছি। আগাছা গুলো পরিষ্কার করতে হবে। ”
মাথা নেড়ে গুনগুন সামনে ফিরতেই আবার কেউ তাকে ডাকলো।সে পেছন ফিরে তাকালো। ওয়াসিয়াত কখন ছাদে এসেছে তা সে একদমই টের পায় নি।
চলবে….…………
লেখিকাঃঅদ্রিজা আহসান