প্রহর শেষে
পর্ব-৯
আজ আকাশ ভীষণ মেঘলা। ওয়াসিয়াত বসে আছে তার ঘরের বারান্দায়, তার হাতে চা’য়ের কাপ।
আবহাওয়ার চরিত্রটাই বোধহয় সংক্রামক কারণ আবহাওয়া যখন খারাপ হয় আশেপাশের মানুষগুলোর মন নিয়েই খারাপ হয়।থেকে যায় শুধুই বিষন্নতা।
তাই ওয়াসিয়াতেরও মন খারাপ, ভ্রু জোঁড়া কুচকে বিষন্ন মুখে সে বসে আছে । কিছু একটা নিয়ে সে চিন্তিত।
কিছুদিন ধরেই তার মনে একটা ভাবনা খুব আবছা ভাবে আসছে।গুনগুনের দেখা পাওয়া এখন দায় হয়েছে। কেন যেন মনে হচ্ছে গুনগুন আজকাল তাকে এড়িয়ে চলছে। ও-বাড়ি গেলেও সে গুনগুনের দেখা পায় না। গুঞ্জন এলে তার সাথে কথা হয়, চা’ নিয়ে আসে সেলিনা যে কাজ একসময় গুনগুন একচেটিয়া ভাবে করতো,চা খেয়ে একসময় সে চলে আসে। তবে গুনগুন তার সামনে আসে না। মাঝে মধ্যে হুট-হাট দেখা হয়ে গেলে ‘কেমন আছ?’ ‘ভালো আছি ‘ এইটুকুই কথা হয়।
এমনকি গুনগুন আজকাল তাঁদের বাড়িতেও আসে না। মাঝে মধ্যে হয়তো আসে সেই খবর সে জানতে পারে মায়ের কাছে। তার আসা যাওয়ার সময়ও বদলেছে। সে আসে ভরদুপুরে যখন মা-বাবা আর ভাবি ছাড়া কেউ বাড়ি থাকে না। গুনগুন কি তবে সত্যিই তাকে এড়িয়ে চলছে?
ওয়াসিয়াত নিজের মনেই প্রশ্ন করে, ‘তাকে এড়িয়ে যাবার মতো কোন ঘটনা কি সে ঘটিয়েছে?
আবার সাথে সাথেই তার মনে হয় গুনগুন যদি সত্যিই তাকে এড়িয়ে যায় তবে সেটা তার কোন সমস্যা নয়।তাহলে সে এতো ভাবছে কেন?
ওয়াসিয়াত চা’য়ে চুমুক দিয়ে দেখলো চা’টা পুরো শরবত হয়ে গেছে। ওয়াসিয়াতের ভ্রু কুঞ্চিত হলো,মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো।রেখে সে আবার ভাবনায় ডুব দিল। হঠাৎ মনে হলো গুনগুন তাকে ইগনোর করছে এই ব্যাপার টাই কি তার ইগোতে লাগছে?
নাহ, আর নয়।যথেষ্ট বেহায়াপনা করা হয়েছে। এতোদিন সে নানা ভাবে সকলের কাছে গুনগুনের খবর নিয়েছে।ওয়াসিয়াত ঠিক করলো সে আর কখনোই যেচে গুনগুনের কথা জানতে চাইবে না,নেভার।গুনগুন এমন কোন মেমসাহেব নয় যা কে না দেখলে সে বাচঁতে পারবে না।
ওয়াসিয়াতের দিন গুলো এখন খুবই বাজে কাটছে।কর্মব্যস্ততা হীন একঘেয়ে সময়।অনার্স শেষ করেছে সে বেশ কিছুদিন হলো।ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে জোহরা খানম গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেন।ফলস্বরূপ তার ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দেয়া হলো না।তখন থেকেই সে ভেবে রেখেছিল ঢাবি’তে মাস্টার্স এর জন্য আবেদন করবে। এবার আর কোন ঝামেলা হয়নি।তার স্বপ্ন কিছুটা হলেও সত্যি হতে যাচ্ছে।
ওয়াসিয়াত বিসিএস’এর জন্যও পড়তে চায় সেই সাথে ঢাবি’তে সান্ধ্যকোর্স।তাই আহসানউল্লাহ সাহেবও আর আপত্তি জানান নি।
ঢাকা যাওয়ার সময়ও হয়ে এসেছে। ওয়াসিয়াত মাঝে মাঝে ভাবে, গুনগুন কি তাকে একেবারেই ভুলে গেছে? তার কি একবারও মনে পরে না,নাকি তার জীবনে বিশেষ কেউ এসেছে যার জন্য এই আকস্মিক পরিবর্তন!
কিন্তু গুনগুনের জীবনে যে ‘বিশেষ কেউ ‘ এর বদলে ‘বিশেষ কিছু’ এসেছে তা যদি ওয়াসিয়াত জানতো…।
ওয়াসিয়াত চলে যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে গুনগুন জানতে পারলো তার চলে যাওয়ার খবর। নিজেকে পর্দার আড়ালে টেনে নেয়ার পর এসব বিষয়ে সে এতোটাই উদাসীন ছিল যে কোন খবরই তার কানে আসে নি। সে শুধুই লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাগ্যে কি আছে তা কেউই জানে না তবে আল্লাহর ফয়সালাই সে মেনে নেবে। মনের গভীরে ওয়াসিয়াতের জন্য অস্পষ্ট অথচ তীব্র যে অনুভূতির দ্বার টা ছিল তা সে অনির্দিষ্টকালের জন্য তালা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও মাঝে মাঝে সে দরজার ফাঁক ফোকর দিয়ে দু-একটা সৃতি গেলে বেরিয়ে আসে।তখন সে খুব সন্তর্পণে নিজেকে সামলে নেয়।আর ভাবে নিয়তিতে থাকলে হয়তো পবিত্র ভাবেই তাকে পাওয়া যাবে।
ওয়াসিয়াতের দিনগুলো এখন খুব ভালো কাটছে। স্কুল জীবনের বন্ধু ‘রাফান’ কলেজে ওঠার পর পরই ঢাকা চলে এসেছিল। এখন সে রাফানের ওখানেই উঠেছে।এখানে তারা চার জন সাবলেট এ থাকে। বিশাল খোলামেলা দোতলা বাড়ি, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত বারান্দা,জায়গাটা খুব নির্জন।চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা। আশেপাশে বাড়ি গুলোও কিছুটা দূরে দূরে।
সারাদিন সে বিসিএস এর জন্য পপড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে, সন্ধ্যে নামতেই ফের ক্লাসের জন্য বেরিয়ে পরে।এছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘুরাঘুরি তো আছেই।তাই আজকাল তার খুব একটা বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না।
রিকশায় বসে সে বাড়ির কথাই ভাবছিল। অনেকক্ষণ ধরেই রিকশাটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা শহরের বিখ্যাত জ্যাম বলে কথা!
প্রচন্ড গরমে রাস্তাঘাট তেঁতে উঠেছে। এই ভ্যাপসা গরমে এভাবে স্থির বসে থাকতে ওয়াসিয়াতের ভীষণ অসহ্য লাগছে। মুখে ফুটে উঠেছে বিরক্তি । শার্টের কলারটা ঝাকিয়ে সে আশেপাশে তাকালো।তখনই রাস্তার বা-দিকে ফুটপাতে তার চোখ গেল। ওয়াসিয়াত নড়েচড়ে বসলো। তার দৃষ্টি ফুটপাতের দিকে স্থির। সে বুঝতে পারলো না এটা চোখের ভ্রম কিনা।
গুনগুন সেখানে দাঁড়িয়ে ফুল কিনছে! তার পাশে খুব সুদর্শন একটি যুবক দাঁড়িয়ে। যে তার হাত শক্ত করে ধরে আছে। ওয়াসিয়াতের চোখ বুজে এলো।মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলো এটা ভ্রম।তবুও সে আবার তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে।তার চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো,রিকশা থেকে নামার জন্য পা বাড়াতেই ছেলেমেয়ে দুটি হেটে অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো। ওয়াসিয়াত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এটা গুনগুন নয়।দেখতে গুনগুনের মতো হলেও গুনগুনের মুখের সেই মায়া মায়া ভাবটা এর চেহারায় নেই।
রাত গভীর হলো, ওয়াসিয়াতের চোখে ঘুম নেই। কি একটা ভাবনা যেন তাকে স্থির হতে দিচ্ছে না।বিকেলের সেই ঘটনা শুধু মনে পরছে।কতদিন হলো গুনগুন কে সে দেখেনি। তাই বুঝি আজ ভ্রম হচ্ছে! ওয়াসিয়াতের নিজের মনেই ভাবলো ,’ গুনগুনের হাত ধরার অধিকার সে ছেলেটার নেই তাই তার রাগ হচ্ছিল অথচ সে অধিকার তো তার-ও নেই।তবে সে যে ছোটবেলা থেকেই গুনগুনের পাশে থেকেছে, তার খেয়াল রেখেছে তার কি হবে? ‘
ওয়াসিয়াত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। এবার আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকালো। আকাশ ক্রমেই কালিবর্ণ হচ্ছে। বাতাস বইতে শুরু করেছে। বাতাস কি তবে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে?
সারাদিনের তাপদাহের পর এই বৃষ্টির যে খুব প্রয়োজন!
ওয়াসিয়াত চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে রইল। মাথা কাজ করছে না,এতো এলোমেলো ভাবনা ভাবতে গিয়ে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। গুনগুন আর অন্যকেউ,সে ভাবতে পারে না। কোথাও যেন একটু খারাপ লাগে।কিন্তু এই তো স্বাভাবিক। তাহলে, সে ভাবতে পারে না কেন!
আহমেদ চাচা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে গুনগুনকে দেখেছে, খুব কাছ থেকে দেখেছে। গুনগুন তাদের সারা বাড়ি জুড়ে ছুটছুটি করতো।গুনগুনকে সে কারো সাথেই মিশতে দিত না, তা নিয়ে দুজনের মাঝে ঝগড়াও হতো খুব ।সে গুনগুনকে বোঝাতো,
‘শোনো গুনি,তুমি শুধু আমার সাথে খেলবে আর আমার সাথেই কথা বলবে।আর কোন ছেলের সাথে মিশবে না।মনে থাকবে তো? ‘
উত্তরে গুনগুন শুধু মাথা নাড়তো।সেই সাথে তাল মিলিয়ে তার দুই কাঁধের দুই বেনি দুলে উঠতো।
পুরনো কথা ভেবে ওয়াসিয়াতের বুকে তীব্র যন্ত্রণা হলো। সেই দিন গুলি আজ আর নেই কেন? দুজনের মাঝে এতো দূরত্ব কিভাবে এলো?সেইদিন গুলো কি আর কোনো ভাবেই ফেরানো যায় না?
ভাবতে ভাবতে তার মনে হলো যেখানে গুনগুন থাকবে না, আর তার ওপর অধিকারও থাকবে না তখন সে কি করবে? বুকের ভেতরে কেমন হাহাকার হচ্ছে।নাহ!গুনগুনের ওপর অন্যের অধিকার সে সহ্য করতে পারবে না। গুনগুন কে ছাড়া থাকতেও পারবে না।গুনগুনকে ছাড়া কি তার চলবে কোনদিন ? এতো তিক্ততা আর অস্পষ্টতার আড়ালে যে গভীর অনুভূতি গুলো সে ভীষণ যত্নে লুকিয়ে রেখেছে তার কি হবে?
এখন তাহলে কি উপায়!তারমানে, গুনগুনকে কি সে…………
বাকিটা আর সে ভাবতে করতে পারলো না। ভীষণ অস্বস্তি লাগতে লাগলো।
রাত প্রায় শেষ, ভোর হয়ে আসছে।ঘুমন্ত শহর জুড়ে কি ভীষণ নিরবতা! সেদিকে তাকিয়ে ওয়াসিয়াত বুকভরে নিশ্বাস নিল। ভালোবাসার মানুষটা যে এতো কাছেই ছিল তবুও সে খেয়াল করে নি। হয়তো কাছে ছিল বলেই!
অবশেষে বুঝতে পারলো আজ। তাই আজকের দিনটা তার জীবনের বিশেষ দিন, প্রিয় মানুষ খুঁজে পাওয়ার দিন।
চোখ জোড়া বুজে সে বলল,’আমি আসছি গুনগুন,
আমি তো শুরু থেকেই ভালোবাসি।শুধু বুঝে উঠতেই যা একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি রাগ কর নি তো?’
ভর দুপুর,সময়ের মতো পরিবেশ টাও থমকে আছে।ওপরে সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি মেলে ওয়াসিয়াত শুয়ে আছে। কাল সারারাত জেগে থাকার পরও এখন চোখে একফোঁটা ঘুম নেই, না হয়েছে পড়াশোনা।প্রতিবার ময়মনসিংহ যাওয়ার সময়ই তার এমন হয়।বাড়ি যাবে তা ঠিক করার পর আর কোনো কিছুই ঠিক-ঠাক ভাবে হয় না।শুধুই অস্থিরতা।
সে সকালেই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে।সন্ধ্যায় ক্লাস শেষে রওনা দেবে। মা কে এখনো কিছু জানানো হয়নি।ওয়াসিয়াত যখন এসব ভাবছিল ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। জোহরা খানম কল করেছেন।
জোহরা খানম তার খোঁজ খবর নিয়ে নানান কথার পর বললেন, ‘ওয়াসি, তুই কি কিছুদিনের জন্য আসতে পারবি?’
ওয়াসিয়াত হেসে ফেললো বলল,’উমম্…. তুমি যদি বল তবে এক্ষুনি চলে আসি?’
‘সব সময় ঢং করিস না ওয়াসি,যেভাবেই হোক কিছুদিনের মধ্যে ম্যানেজ করে চলে আয়।আর শোন…..থাক…।’
-‘কি হলো? কি বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলে? ‘
-‘কিছুনা। আগে তুই আয়,তারপর বলব।’
-‘সে যাই-হোক,আগে বল তুমি এতো খুশি কেন?অল্পতে খুশি হওয়ার পাবলিক তো তুমি নও।’
জোহরা আনন্দে আটখানা হয়ে বললেন, ‘হুম, কারণ তো আছেই।তবে এভাবে বলবো না। তুই বাড়ি আয়।’
-‘বাহ,আমার সাথে চালবাজি!বাড়ি না এলে বলা যাবে না এ কেমন কথা? ‘
-‘এসব তো তোর কাছেই শেখা। আমার ছেলে যখন এতো চালবাজ, মা হিসেবে তো আমি এটুকু করতেই পারি।’
-‘কি!আমি চালবাজ। ‘ওয়াসিয়াত মিথ্যে অভিমান করে বলল।
জোহরা বললেন ‘ভালই তো,খারাপ কি দেখলি?’
চলবে…………
অদ্রিজা আহসান