প্রহর শেষে

পর্ব :-১৭
চিবুকের তিলটা আরও কালো দেখাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় সে স্বাভাবিক হচ্ছে।চেহারায় হয়তো তারই ছায়া পড়েছে। অথচ তিনি জানেন মেয়েটা কি দুর্বিষহ দিন পার করছে।
সেলিনা হক অপলক তাকিয়ে রইলেন।তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মনে মনে লজ্জিত হলেন , ‘ ছিঃ! এভাবে কেউ নিজের মেয়ের দিকে তাকায়! মেয়েটার যদি নজর লেগে যায়? ‘
তিনি অস্থির হয়ে মনে মনে কিসব বিরবির করে মেয়ের গায়ে ফু দিতে লাগলেন।

গুনগুন অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো।
-‘কি হয়েছে , এসব কি করছ মা?’

-‘না না, মানে.. তেমন কিছু না। তাড়াতাড়ি নিচে চল।সন্ধে হয়ে এলো বলে।খারাপ হওয়া-বাতাস লাগবে। ‘

গুনগুনের মুখের কঠিনতা কিছুটা কমে সেখানের হাসির আভাস দেখা গেল। সে বলল,’হাওয়া-বাতাস আমার এতো সহজে লাগবে না মা।চল নিচে চল।’

ওয়াসিয়াত জোহরা খানমকে অনবরত কল করে যাচ্ছে। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না।সে ফের একবার কল করলো।জোহরা ফোন রিসিভ করেছেন।
ওয়াসিয়াত সালাম দিয়ে বলল,’ কেমন আছ মা?’

-‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভালো আছি।’জোহরা অতন্ত্য নির্জীব কণ্ঠে বললেন।

ওয়াসিয়াতের মন খারাপ হলো। সে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,’তুমি কি আমার ওপর রেগে আছ মা?’

জোহরা খানম বহু কষ্টে নিজের কান্না চাপলেন।আদ্র গলায় বললেন ‘কিভাবে রেগে থাকব ওয়াসি, তুই আর শাহাদাত ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই। ইবু তো আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। একবারও ভাবলো না তাকে ছাড়া তার অসুস্থ মা কিভাবে বাঁচবে।
কিছুটা থেমে বললেন,’আমি রাগ করিনি ওয়াসি, তুই ভালো থাক।মাঝে মাঝে শুধু একটু কথা বলিস।’

খানিক নিরবতার পর ওয়াসিয়াত বলল-‘ আসলে মা, নতুন চাকরি তো, সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে।তাই ঠিকভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে না।’

ওয়াসিয়াত মিথ্যে বাহানা দিল।যদিও সে জানে এটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সে অপারগ। ওবাড়ি এখন আর তার ভালো লাগে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।খোঁজ খবর নিতেও মন চায় না। কি হবে জেনে? মন ভালো করার মতো কোন কিছুই সেখানে অবশিষ্ট নেই।ফোন করলেই মায়ের অসুস্থতা, ফেচফেচ কান্না,বাবার ব্যাবসার ভরাডুবির খবর আর…।
বাড়িটা যেন ক্রমশই একটা অন্ধকার পুরীতে পরিণত হচ্ছে।

-‘ও,সে তো ঠিকই।ওয়াসি…’

-‘ হ্যাঁ মা।’

একটু নিরব থেকে জোহরা বললেন -‘তুই কবে বাড়ি আসবি?’

ওয়াসিয়াত নিশ্চুপ হয়ে রইল।একজন মায়ের সন্তানের জন্য এই তীব্র অনুরাগের বিপরীতে বলার মতো কোন না বোধক শব্দই তার জানা নেই।

-‘আচ্ছা ওয়াসি, ভালো থাকিস।শরীর টা খারাপ লাগছে।আমি রাখি।’

-‘হুম রাখো।’

ফোন রেখে ওয়াসিয়াত কাজে মন দিল।কিন্তু মনকে পুরোপুরি কাজে নিরত করতে কি পারলো?
ক্রমশই মনে হতে লাগলো সে বদলে যাচ্ছে।কাছের মানুষ গুলোর সাথে তার অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি হচ্ছে।ওই বাড়ি আর বাড়ির মানুষ গুলোর জন্য আজকাল সে আগের মতো প্রগাঢ় আসক্তি অনুভব করছে না।অথচ এর জন্য তার মনে কোন অপরাধ বোধ নেই। সময়ের সাথে মানুষের মন,ভালোলাগা আর ভালবাসা গুলো কি এভাবেই বদলায় !

সেলিনা হক রান্নার আয়োজন করছিলেন।বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ রান্নাবান্না কিছুই এখনো হয়নি। গুনগুন বসার ঘর সোফায় বসে আছে। তিনি মাত্রই তাকে চা করে দিয়ে এসেছেন।

দরজায় কেউ অস্থির ভাবে কড়া নাড়ছে। সেলিনা রান্না রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। বাইরে জোহরা দাঁড়িয়ে।তিনি চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।সেলিনা ভারি অবাক হলেন।ব্যাস্ত হয়ে ভেতরে আসার জন্য বললেন। জোহরা উদ্ভ্রান্তের মতো হেসে অস্থির হয়ে বললেন,’গুনি কোথায়?’

সেলিনা তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসতে আসতে বললেন।-‘গুনি এইতো এখানেই আছে আপা।আপনাকে তো ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে। আপনি কি একা এসেছেন ?’

মাথা নেড়ে জোহরা দ্রুত সামনে এগিয়ে গেলেন। বসার ঘরে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গরাদ দেয়া বড় জানালা গেলে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে গুনগুনের গায়ে।সে নিস্তেজ হয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে।ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। মুখের বর্ণ ফ্যাকাস। জোহরা অস্থির হয়ে তার কাছে গিয়ে বসলেন। তৎক্ষনাৎ তার চোখে পানি এসে গেল।করুন মুখে তিনি বললেন
-‘গুনি তুই এতো নিষ্ঠুর হতে পারলি?একবারও আমার খোঁজ নিলি না।এবাড়ি এসে অবধি একবারও আমাকে ফোন করলি না, ভাবলি না এই বুড়ো মা টা কি অবস্থায় আছে ? ‘

জোহরা খানমের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গুনগুন ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসলো। বলল,’ভুল হয়ে গেছে বড়মা,আমাকে মাফ করে দাও।করবে না মাফ ?’

জোহরা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললেন, ‘আমার গুনি কোনো ভুল করতেই পারে না। আমি মাফ করবো কিভাবে?
তুই আমার খোঁজ নিস নি,নিশ্চয়ই এর কোনো কারন আছে?’
কিছুটা থেমে গুনগুনের দিকে তাকিয়ে আতংকের সুরে বললেন, ‘হ্যাঁ রে গুনি,তোর মুখটা ওমন দেখাচ্ছে কেন? তোর শরীর কি খুব খারাপ নাকি ? ‘

গুনগুন কিছু বলার আগেই সেলিনা দ্রুত বলে উঠলেন, ‘না না আপা তেমন কিছু না।ওই একটু আরকি। ঘুম টা ঠিক মতো হচ্ছে না তো তাই ওমন দেখাচ্ছে। ‘

জোহরা ভীত হয়ে বললেন ,’গুনি চল তোকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি।আমার একদম কিচ্ছু ঠিক লাগছে না। ‘

গুনগুন শুধু হাসলো কিছু বলতে পারলো না। তার দিকে একবার আঢ় চোখে তাকিয়ে সেলিনা একপ্রকার জোর করেই বিশ্রামের কথা বলে জোহরা কে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

গুনগুন সেখানেই স্থির হয়ে বসে রইল। শরীর ভয়ংকর খারাপ লাগছে। সকাল থেকেই হালকা শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। সেটা ব্যাপার না।সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার টা হল আজকাল তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। খারাপ রকমের হ্যালুসিনেশন!
রাতে একা ঘরে থাকাই দায় হয়েছে। একা থাকলেই মনে হচ্ছে ঘরে আরও কেউ আছে।সে মারা যাবে,এক্ষুনি মারা যাবে।তারপর হাত পা শিরশির কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়।এর প্রভাব শরীরেও পড়ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই শরীর ভেঙে গেছে। মুখে সর্বদা একটা আতংকিত ভাব লেগে আছে।গুনগুন মাথা নিচু করে চোখ বুজে বসে রইল। সে তাকাবে না।তাকালেই দেখা যাবে অপ্রাকৃত কিছু চোখে পরছে।

সেলিনা হক নিজের ঘরে বসে কাঁদছেন।পাশের ঘরে জোহরা খানম ঘুমিয়ে আছেন। এই মাত্রই তিনি ফোনে ছেলের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছেন। বলেছেন সে যেন আর কখনোই এ বাড়িতে না আসে। এখন মনে হচ্ছে এতটা বলা ঠিক হয়নি।সে তো আর এমনি বাইরে গিয়ে বসে নেই।ট্রেনিংয়ের জন্য জাপান গেছে।ছয় মাসের ট্রেনিং শেষে চাকরিতে জয়েনিং ।সেও নিশ্চয়ই আসার জন্য অস্থির হয়ে আছে?
গুঞ্জন প্রতিনিয়ত ফোন করে বলছে,-‘আর কয়েকটা দিন মা,প্লিজ একটু মানিয়ে নাও।গুনির ডেলিভারি ডেটের আগেই আমি চলে আসব।’

গুঞ্জন আর কিছুদিন পরই চলে আসবে সে ঠিক আছে, কিন্তু এখন যেসব ঝামেলা চলছে সেসব কে সামলাবে?
সারাদিন এই অসুস্থ মেয়ের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।তার ওপর মেয়েটা আজকাল অদ্ভুত আচরণ করছে।একা থাকলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে একাকার করছে।সেলিনার দুশ্চিন্তা ক্রমশই বাড়ছে। তিনি বুঝতে পারছেন সামনে কিছু ভয়াবহ দিন তার জন্য অপেক্ষা করছে!

____________
ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। ওয়াসিয়াত স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কল রিসিভ করার সাহস সে পাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে কল রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে একটা খারাপ খবর আসবে।আজকাল প্রায়শই এমন হয়। ফোন বেজে ওঠা মাত্রই আতংক তাকে গ্রাস করে।ফোন এলেই মনে হয় নিশ্চয়ই কেউ কোন দুঃসংবাদ দেওয়ার জন্যেই ফোন করেছে।এর পেছনেও লজিক আছে।
ওয়াসিয়াত তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ খবর টা পেয়েছিল এই ফোনের মাধ্যমেই।ফলাফল ফোন বিষয়ে তার মধ্যে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।

দুবার ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল।এবার ওয়াসিয়াত উঠে এসে ফোনটা হাতে নিল।আহসানউল্লাহ সাহেবের কল।ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখাচ্ছে বারটা দশ।এই মাঝরাতে বাবা কেন কল করেছে ওয়াসিয়াত বুঝে উঠতে পাড়লো না।সে ফোন নিয়ে বারান্দায় এলো।আহসানউল্লাহ সাহেবের নাম্বারে কল করে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো।
ফোন রিসিভ হতেই কান্নার শব্দ শোনা গেল। ওয়াসিয়াত স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো।জোহরা খানম কাঁদছেন। নিশ্চয়ই এই মাঝরাতে তার ওয়াসিয়াতের কথা মনে পড়েছে, ফলাফল কোনো কিছু না ভেবেই কল করেছেন।তিনি প্রায়শই এমনটা করে থাকেন।ওয়াসিয়াত মৃদু হেসে বলল ,’কাঁদতেই থাকবে, নাকি কান্না থামিয়ে কথাও বলবে। ‘

জোহরা খানম থামলেন না কাঁদতেই থাকলেন।অথবা কিছু বোধহয় বলছেন,কান্নার জন্য কথা টা বোঝা যাচ্ছে না।

-‘উফফ! আম্মা থামো প্লিজ। ‘
রেগে গেলে ওয়াসিয়াত মাকে সবসময় আম্মা ডাকে।
কিন্তু জোহরা খানমের কান্না থামল না। তিনি অতন্ত্য নিচু গলায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’ওয়াসি,আমার সব শেষ। ‘

চলবে…………।
অদ্রিজা আহসান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here