প্রহর শেষে
পর্ব-১১
তারপর ছোট্ট গুনগুন একটু বড় হলো। দুই কাঁধে দুই বেনি ঝুলিয়ে সে সারাদিন ঘুরে বেরায়।তখন তার খেলার অন্যতম সঙ্গী ছিল দীপু।আর তাই দীপুর যন্ত্রণারও শেষ ছিল না। রোজ বিকেলে খেলতে যাবার সময় ওয়াসিয়াত গুনগুনকে তাদের খেলার জায়গাটায় রেখে আসত।সেখানে খেলার সাথিরা গুনগুনের জন্য অপেক্ষা করতো।বন্ধুদের দেখামাত্রই গুনগুন ওয়াসিয়াতের হাত ছেড়ে দৌড়ে তাদের কাছে চলে যেত। ফেরার আগে দীপুকে কাছে ডেকে ওয়াসিয়াত রোজ একবার করে বলে আসতো সে যেন গুনগুনের খেয়াল রাখে। তাকে খানিক শাসিয়ে তারপর নিজে খেলতে যেত।
এমনই একদিন বিকেলে গুনগুন বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। সে এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে তবুও শত বাড়নের পর বিকেল হলেই সে বেড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে । দূর থেকে আযান ভেসে আসছে।ওয়াসিয়াত ফুটবল হাতে বাড়ি ফিরছিল।মাঠের কাছাকাছি আসতেই দেখলো গাছের আড়ালে গুনগুন দাঁড়িয়ে আছে। মূহুর্তেই সে সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, গলা উঁচিয়ে গুনগুনকে ডাকলো।গুনগুন সামনে এসে দাড়াঁতেই বিরক্ত গলায় বলল, ‘এখনো তুমি এখানে কি করছো?’
গুনগুন গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা লুকোচুরি খেলছি।আমি যে এখানে লুকিয়েছি তুমি কাউকে বল না, কেমন? ‘
কিছু বলতে গিয়েও ওয়াসিয়াত দাঁতে দাঁত চেপে থেমে গেল, আশেপাশে একবার তাকিয়ে দ্রুত নিজের টি-শার্ট খুলে গুনগুনকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’এটা কোমড়ে বাঁধো।’
-‘কেন?’
-‘আমি বলেছি তাই।এরপর এক দৌড়ে বাড়ি যাবে।কোথাও দাঁড়াতে পারবে না। ‘
ওয়াসিয়াত রেগে আছে তা দেখেও গুনগুন মিনমিন করে বলল, ‘কিন্তু আমাদের খেলা তো এখনো……..। ‘
প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে ওয়াসিয়াত বলল,’যাও….এক্ষুনি বাড়ি যাও।’
কয়েক পা এগোতেই সে আবার বলল,’শোনো,চাচি যদি জানতে চায় জামাটা কার,বলবে জানো না।মাঠের পেছনের দোতলা বাড়িটার সামনে পড়েছিল।’
সেদিনের পর গুনগুন দীর্ঘদিন ওয়াসিয়াতের সামনে এলো না।তার বাইরে খেলাও চিরজীবনের মতো বন্ধ হলো।
____________
ইরশাদ আর গুনগুনের বিয়েটা হবে খুব সাদামাটা ভাবে। কিছুদিন আগেই জোহরা খানমের হার্ট সার্জারি হয়েছে। তাছাড়া ইরশাদ এসব পছন্দ করে না। তাই ঝামেলা এড়াতে ছোট করে অনুষ্ঠান হবে।
জোহরা খানমকে কেউ বোধহয় এতো খুশি হতে কখনো দেখেনি। আজকাল সারাক্ষনই তার মুখে হাসি লেগে থাকে। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি সব কাজের তদারকি করছেন। বহু বছর ধরে একটা স্বপ্ন তিনি বুকে লালন করে এসেছেন,এখন সেই স্বপ্ন সত্যি করার সময় হয়েছে !সেই ছোট্ট মেয়েটা যাকে ছেলেবেলা থেকে বুকে আগলে বড় করেছেন সে এখন বাড়ির বউ হতে যাচ্ছে। সারাজীবনের জন্য আসতে চলেছে এ’বাড়িতে!
জোহরা খানম বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিলেন। শরীর জুড়ে যত অসুস্থতাই থাক, মনের প্রশান্তির থেকে তা অধিক নয়।আর তার মন এখন প্রশান্ত!
ঘরে যাওয়ার পথে মায়ের ঘরে নজর পরা মাত্র প্রায় দৌড়ে ওয়াসিয়াত জোহরা খানমের কাছে এলো। মা’কে এভাবে বসে থাকতে দেখে সে ভাবছিল মা’র অসুখ টা বুঝি আজ আবার বেড়েছে। এসেই মায়ের মাথায় আর মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে সে সন্দিগ্ধ হয়ে বলল,’মা,কি হয়েছে তোমার, খারাপ লাগছে? ‘
ওয়াসিয়াতের এতো অস্থিরতা দেখে জোহরা খানম হাসলেন। বললেন, ‘কিছু হয়নি আব্বা, এমনই বসে আছি। ‘
ওয়াসিয়াত পিতামাতার শেষ বয়সের সন্তান। বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কও অন্যদের তুলনায় একটু আলাদা।বয়স বাড়লেও বাবা-মায়ের কাছে সে এখনো অপরিণত। এখনো সে মাঝরাতে উঠে এসে বাবা-মায়ের মাঝখানে শুয়ে পরে। আহসানউল্লাহ সাহেব আর জোহড়া খানমও অন্যছেলেদের তুলনায় তাকে একটু বেশি স্নেহ করেন। তার ছেলেমানুষী আচরণ দেখে মজা পান। মায়ের অসুস্থতার পর থেকে মায়ের প্রতি তার দূর্বলতা আরও বেড়েছে,সম্পর্ক হয়েছে আরও গভীর।
ওয়াসিয়াত কিছু না বলে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বুকে যে ঝড় উঠেছে তার জন্য মজবুত আশ্রয় দরকার।
জোহরা খানম ছেলের মাথায় হাত রেখে স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলেন।কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই বললেন, ‘জানিস ওয়াসি,অনেকদিন আগে থেকেই আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল!তুই জন্মানোর সময় ভেবেছিলাম মেয়ে হবে কিন্তু তুই হলি। আমার একটু মন খারাপ হলো।কিন্তু তারপর তোর মুখ দেখে সব দুঃখ ভুলে গেলাম।
আমার সেই দুঃখটা আবার প্রাণ পেল যখন গুনগুন হলো। ওকে দেখে ভীষণ মন খারাপ হলো। এতোটাই মন খারাপ হলো যে একবার তো ঠিক করে ফেললাম সেলিনাকে বলবো তোকে নিয়ে সে যেন গুনগুনকে আমায় দিয়ে দেয়।’
বলে জোহরা খানম হাসলেন। বললেন, ‘একথা শুনে রাগ করিস নি তো আব্বা?’
ওয়াসিয়াত কিছু বললো না।একটু নড়েচড়ে আবার স্থির হয়ে গেল। জোহরা খানম আবার বলতে শুরু করলেন, ‘যদিও ভাবলাম সেলিনা কে এসব বলবো কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই আমার মনের দুর্বলতা সে টের পেল।বলল,’আপা আপনি আমার বড় বোনের মতো। গুনগুন যেমন আমার মেয়ে তেমনি ও আপনারও মেয়ে।ওর ওপর আপনার সম্পুর্ন অধিকার আছে। আপনার যখন মন চাইবে ওকে নেবেন,আদর করবেন, মারবেন, বকবেন।আমি কিছুই বলবো না আর আজ থেকে আপনি ওর বড়মা।’
জানিস,একথা শুনে আমি সেদিন খুশিতে কেঁদে ফেললাম। আর ঠিক করলাম ওকে সারাজীবনের জন্য এ’বাড়িতে আনবো।ও সবসময় আমার সামনে থাকবে। আর দেখ,আজ আমার এই ইচ্ছেটা সত্যি হতে যাচ্ছে! ‘
জোহরা খানম জোরে শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘এখন শুধু আমার একটাই ভয়, সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হবে তো?’
ওয়াসিয়াতের চোখ বেয়ে উষ্ণ একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।খুব সন্তর্পণে তা মুছে ফেলে জোহরা খানমের হাত ধরে সে বলল,’তোমার ইচ্ছে অপুর্ণ থাকবে না মা,পূরণ হবে ইন শা আল্লাহ, তুমি ভেবো না।’
ওয়াসিয়াত উঠে এলো। তার আর বসে থাকা চলে না।মায়ের ইচ্ছে যেন কোন ভাবেই অপূর্ণ না থাকে সে খেয়াল তো তাকেই রাখতে হবে!
_____________
ওয়াসিয়াত আর গুনগুন দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক মাঠের মাঝখানে। চারপাশের বৃহদাকার মহীরুহ গুলো ভীষণ ভাবে মাঠের ওপর ঝুঁকে আছে।সেগুলোর একটাতে বসে একটি কাক অনবরত কাঁ কাঁ করে যাচ্ছে। ওয়াসিয়াত গুনগুনকে জিজ্ঞেস করলো,’তোমার বিয়ে হয়ে যাবে? ‘
গুনগুন তেজী গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। ‘
-‘তোমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে?’
-‘বাঃ, কেন করবে না?’
-‘তোমার পড়তে ইচ্ছে করে না?’
_’পড়াশোনা করেও তো বিয়ে করতেই হবে। তার চেয়ে আগে বিয়ে হয়ে যাওয়াই ভালো। ‘
-‘তুমি নিষ্ঠুর, গুনগুন। ‘
-‘আমি নিষ্ঠুর না,ওয়াসি ভাই। পড়াশোনা করেও যখন রান্না-বান্না করতে হবে তাহলে কষ্ট করে পড়ে কি লাভ?
কিন্তু তুমি এসব কেন বলছো ওয়াসি ভাই? তুমি কি আমাকে……………।’
-‘আমি কি?’
গুনগুন খিলখিল করে হেসে উঠলো।বলল-‘উহু, বাকিটা আর বলবো না।’
বলে সে ওয়াসিয়াতের কাছাকাছি এসে দাড়াঁলো। চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল-‘আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন , তোমার মনের খবর তুমি জানো না?’
-‘আমি, আমি……….’
গুনগুনের মুখটা ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসছে। ওয়াসিয়াত কথা থামিয়ে গুনগুনকে ডাকলে লাগলো।
হুট করে ওয়াসিয়াতের ঘুম ভেঙে গেল । সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো।বেডসাইড টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে দ্রুত পানি খেলো।হঠাৎ করে বুকের ভেতর টা ফাঁপা লাগছে।এসব তো সে আর ভাবতে চায় না। তাহলে কেন দুঃস্বপ্নরা তার পিছু ছাড়ে না?
দু’হাতে নিজের চুল খামছে ধরে সে বলল,’কেন গুনগুন,কেন?আমি কি এতটাই অযোগ্য?
কোনো উত্তর এলো না। ওয়াসিয়াতের ভাবনার মোড় আবার ঘুরে গেল।নানা এলোমেলো চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠল।
গভীর রাত,সবাই ঘুমে মগ্ন।ঘুম নেই শুধু গুনগুনের চোখে।আজকাল রাত গুলো তার জেগেই কাটে।তার মধ্যে যেন নিশাচর প্রাণীর স্বভাব প্রবল ভাবে জেগে উঠছে।জানালার পাশে বসে সে ভাবে, সে ভাবনা গুলো বড়ই এলোমেলো আর অগোছালো।ভেবে ভেবে যখন কোন থৈ পায় না। তখন সে কাঁদতে শুরু করে। কান্নাগুলো যখন দেয়ালে বারি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয় তখন তা বড়ই করুন শোনায়।
কৃষ্ণপক্ষ,বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।আকাশে কালো মেঘের পেছনে কালো মেঘ ছুটছে, তার পেছনে আরও কালো মেঘ ছুটছে, এবং তার পেছনে আরও কালো মেঘ…..।প্রকৃতির এই ভয়ংকর সৌন্দর্যের খেলা দেখার ইচ্ছে গুনগুনের নেই, তাই জানালার পাশে বসেও তার নজর সামনের দেয়ালে।অথচ একবার যদি সে বাইরে তাকাতো তাহলে হয়তো দেখতে পেত বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় সে একাই কাতর নয়।আরও কেউ একজন আছে!
এই নিকষকালো অন্ধকারে কেউ একজন দাড়িঁয়ে আছে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে।যদিও ল্যাম্পপোস্ট আলোহীন,বিদ্যুৎ নেই।সে স্থির দাঁড়িয়ে অথচ বুকে কি ভীষণ তোলপাড়! কতশত জিজ্ঞাসা আর উত্তরের খোঁজ সেখানে! সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওয়াসিয়াত নিজেকে জিজ্ঞেস করে ‘গুনগুন কি কোনোদিন আমার পায়ের শব্দের জন্য কান পেতে থাকে নি?’
উত্তরে শুধু একটি মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যায়।ওয়াসিয়াত ঘুরে দাঁড়ায়।মাথায় মেঘ নিয়ে অজানায় হাটতে থাকে।
গুনগুন জানালার পর্দা ফাঁক করে তাকায়। তার মুখ বিষন্ন। চোখ গাঢ় বিষাদের ছায়া! এই বিষাদের উৎস কি, কে জানে!
চলবে……..
অদ্রিজা আহসান