প্রহর শেষে :১
লেখিকাঃ অদ্রিজা আহসান

বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়িটার সামনে এসে ছেলেটি থমকে দাঁড়ালো। উঁচু লোহার গেইট পেরিয়ে তার নজর গিয়ে পরলো সাদা বাড়িটির দিকে। মনের মধ্যে এখনো ক্ষীণ আশা হয়তো এক্ষুনি কেউ এসে বলবে সব মিথ্যা। সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। কিন্তু ছেলেটির ক্ষীণ আশা সত্যি করে কেউ এগিয়ে এলো না।গেইট পেরিয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়ির সামনের বিশাল খোলা জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। সকলেই খুব ব্যস্ত।
মনের ভিতর যে দৃঢ়তাহীন আশাটা ছিল ধীরে ধীরে সেটাও নিভে যেতে লাগলো।

সদর দরজার কাছে যাওয়া মাত্রই বিধস্ত চেহারার একজন মধ্য বয়সী এসে ছেলেটির বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।
মহিলাটি তাকে জাপ্টে ধরে গগন বিদারি চিৎকার দিয়ে কেঁদে যেতে লাগলেন। ছেলেটি কেবল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল। তার জানা নেই কিভাবে একজন মাকে তার ছেলের মৃত্যুতে শান্তনা দিতে হয়।শান্তনা দেওয়ার মতো ভয়ংকর কাজটি সে করতে পারবে না। সে এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো উষ্ণ স্রোতের ধারা।

অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলে মধ্য বয়সী মহিলাটি তাকে ছাড়লেন। পাশের সোফায় ধপ করে বসে পরলেন। একজন ছুটে এলো তাকে সামলানোর জন্য।

এর কিছুটা দূরে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। বয়স ৬০ থেকে ৬৫ এর মধ্যে। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। ছেলেটি এগিয়ে যেতেই তিনি মাথা তুলে তাকালেন, তাকে পাশে বসতে ইশারা করলেন।কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন -“নিজেকে শক্ত করো”।

তারপর চোখের ইশারায় দূরে বসে থাকা সেই মধ্য বয়সী মহিলা টিকে দেখিয়ে বললেন -“ও খুব ভেঙে পরেছে। একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছে। তোমাদের কেই সব সামাল দিতে হবে।দাফন -কাফনের ব্যবস্থা কর, কিছুক্ষণের মধ্যেই বডিটা আনা হবে।” বলতে গিয়ে লোকটির কণ্ঠস্বর কেমন কেঁপে উঠল।

বাদ আসর জানাযার পর বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে এলো। সন্ধ্যের আবছা অন্ধকারে বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখে মনে হলো যেন প্রেতপুরী । আর বাড়ির সামনে সাদা পোশাকে ঘুরতে থাকা মানুষ গুলোকে মনে হলো প্রেতাত্মা। সে ধীর পায়ে হেটে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাথায় টুপিটা খুলে পকেটে পুরলো।বসার ঘরের লোক সমাগম এড়িয়ে সে ভেতরের দিকে পা বাড়ালো।কিছুটা এগিয়ে যেতেই তাকে থমকে দাঁড়াতে হলো।

চেনা পরিবেশটা হঠাৎ করে অচেনা ঠেকছে। বহুদিন হলো বাড়ির এই দিকটায় তার আসা হয়ে ওঠে নি।এই ঘরে যার বাস তাকে সে সর্বদাই এড়িয়ে চলে। তবে আজ আর এড়িয়ে যেতে পারলো না।এড়িয়ে যেতে বোধহয় তার বাধবে ।সে নিশ্চয়ই খুব কষ্টে আছে?

বিছানায় আলুথালু বেসে মেয়েটি বসে আছে। তাকে ঘিরে বসে থাকা সকলের মুখে চিন্তার ছাপ। মৃত্যুর খবর টা শোনার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে একবারও কাদেনি।এমন কি কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি।সে যেন এক অনুভুতি শূন্য মানুষ। তার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে প্রথমে কেউ তাকে খবর টা দিতে চায় নি। কিন্তু সে খুব জলদিই জেনে গেল। আর তারপর থেকে এভাবেই বসে আছে।

খুব ভোরে যখন আহসানউল্লাহ সাহেব নামাজ পরার জন্য উঠেছেন মাত্র এমন সময় ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল। এত ভোরে কে ফোন করতে পারে তিনি ভেবে উঠতে পারলেন না।কল টা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

-“হ্যালো আপনি কি আহসানউল্লাহ মীর্জা? ”

-“জি বলুন”।
ওপাশে খানিকটা নিরবতা। তারপর সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বর বললো –
“আহসানউল্লাহ সাহেব আমি মুক্তাগাছা থানার ওসি বলছি। আপনার নাম্বার আমরা পেয়েছি আপনার ছেলের ফোন থেকে। বাইক দূর্ঘটনায় ওনি গুরুতর ভাবে আহত হয়েছেন। অবস্থা আশংকাজনক।ওনাকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। আপনারা জলদি আসুন।”

কল কেটে গেল।কিন্তু আহসানউল্লাহ সাহেব কান থেকে ফোন সরালেন না।থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন।আধ ঘন্টার মধ্যে প্রায় সকলে হাস্পাতালের দিকে ছুট লাগালো।

এই কাক ভোরে এতো হইচই শুনে মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।ওপর থেকেই সে দেখতে পেল তার জা আর শাশুড়ী মা ক্রন্দনরত অবস্থায় সোফায় বসে আছেন।সে ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। চার মাস চলছে। ডক্টর বলেছেন এই প্রথম কয়েকটা মাস একটু বেশি সাবধান থাকতে।

-“ভাবি, কিছু কি হয়েছে? ”
জিজ্ঞেস করে সে তাদের কাছে এগিয়ে দাড়ালো। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে স্পষ্টতই বুঝতে পারলো তাকে দেখে বাকি দুজনের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। কোনো এক অজানা কারণে তার অসস্থি শুরু হলো।ফের কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই হুট করে ল্যান্ড ফোন টা বেজে উঠল। সেই এগিয়ে গেল রিসিভ করতে। বাকি দুজন স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে টেলিফোন ধরা অবস্থাতেই মেয়েটি টলতে টলতে মেঝেতে বসে পরলো।

তারপর থেকে সে এভাবে স্তব্ধ হয়েই আছে। লক্ষ্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

“তুই এখানেই দাড়িয়ে আছিস? ” মধ্যবয়সী মহিলাটি দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে তিনি ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেললেন।
আদ্র গলায় বললেন -“দেখ না বাবা মেয়েটা সকাল থেকে এভাবেই বসে আছে। কেউ তাকে কথা বলাতে পারছে না। মেয়েটা এখন পর্যন্ত একবারও কাদে নি।শরীরের এই হাল,না কাদঁতে পারলে যে ও মরে যাবে।” কিছুটা থেমে তিনি আবার বললেন
-” ওকে দেখলেই আমার ইবুর কথা মনে পরে যাচ্ছে। ওর কিছু হলে আমার ইবু কষ্ট পাবে। ওর কাছে যে আমার ইবুর শেষ সৃতি । ”
আর কোন কথা বোঝা গেল না।তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন।

ছেলেটি এক দৃষ্টিতে দূরে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল।কিছু সময়ের মধ্যেই মেয়েটির বয়স যেন কয়েক বছর বেড়ে গেছে। সেই প্রানবন্ত হাসি খুশি মেয়েটি আর নেই।গায়ে বেখেয়ালি ভাবে ওড়নাটা জড়ানো ফলে তার হালকা উঁচু পেটটা বোঝা যাচ্ছে।সেদিকে তার কোনো হুশ নেই।
সে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। যে মেয়েটির ওপর অভিমান করে দিনের পর দিন সে এ বাড়িতে আসে নি আজ তাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আজ যে চলে গেছে আর এইখানে যে বসে আছে তাদের দুজনকেই সে খুব ভালোবাসতো,না ভালোবাসতো নয় এখনো বাসে।তবে দু’জনকে ভালোবাসার ধরন টা ছিল দুরকম । তবুও সে তো কখনোই এমনটা চায়নি। সে তো নিজের ভেতর তো সব মাটি চাপা দিয়ে ফেলেছিল। তবে আজ কেন তাকে এইদিন দেখতে হলো।আজ আবার সেই পুরোনো ঘা টা সতেজ হয়েছে।যেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে খুব।

___________

চৈত্রের বিকেল।রাস্তাঘাট প্রচন্ড গরমে তেঁতে আছে। গুনগুন পা চালিয়ে হাটছে। তার কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ।আজ কপালে নির্ঘাত একচোট বকা আছে। ভাগ্য বেশি খারাপ থাকলে দু-একটা কিলও পিঠে পড়তে পারে। স্কুল ছুটি হয়েছে বিকাল চারটায় আর এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু তারই বা কি দোষ। বান্ধবী গুলো ফুচকা খাওয়ার জন্য এমন ভাবে ধরলো যে সে আর না করতে পারলো না। আর আজও বন্ধু গুলো ফুচকা খাওয়ার পাশাপাশি গল্পের ঝুলি খুলে বসলো।ফলাফল তাকে এখন এতটা পথ হেটে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। কারণ ব্যাগে আর একটি পয়সাও অবশিষ্ট নেই।

বাড়ি ফিরে গুনগুন চোরের মতো নিজের ঘরে পা রাখতেই পেছন থেকে সেলিনা হক বলে উঠলেন -“কি রাজকার্য করে ফিরলি তুই, কটা বাজে সে খেয়াল আছে?”

গুনগুনের উত্তর তৈরিই ছিল। সে দ্বিধাহীন ভাবে বলতে লাগলো -” মা, আসলে আজ লাস্ট পিরিয়ডে ম্যাথ ক্লাস ছিল তো। স্যার একটা অংক শুরু করলেন।কিন্তু কিছুতেই তার উত্তর মিলে না,আর সেটা মিলাতে মিলাতেই……..
-“হয়েছে আর মিথ্যা বলে কাজ নেই। জলদি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পরে নে। “গুনগুন বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো।

-“বেগুনি “।
খাওয়া থামিয়ে গুনগুন পেছন ফিরে তাকালো।ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে গুঞ্জন হাসছে।সে হাসে খুব কম।গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, তাই বোধহয় তার হাসিটা এত সুন্দর।গুনগুন মুখ ঘুরিয়ে খাওয়ায় মন দিল।সে সাড়া দেবে না।কারণ এই বেগুনি ডাক টা তার খুবই অপছন্দের। দ্বিতীয় বার আর এই নামে ডাকলো না গুঞ্জন।
বললো- ” গুনগুন তোর সই এসেছে, চাচী বলেছে দেখা করে আসতে। ”
গুনগুনের কান খাড়া ছিল। কথাটা শুনে তার মন খুশিতে নেচে উঠল।তারমানে আজ আর তাকে পড়তে বসতে হবে না। কোনো রকম ভাতটা শেষ করে সে মায়ের কাছে গেল।মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সে আর অপেক্ষা করলো না।চাচার বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো।সে বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়।

মোড়ের দোকানের ডান পাশের রাস্তা টা ধরে গিয়ে গলিটার মাঝ বরাবর যে একতলা বাড়িটা আছে সেটা গুনগুনদের। তারপর খানিকটা সামনে এগিয়ে গলির শেষ মাথায় প্রাচীর ঘেরা সাদা দোতলা বাড়িটাই বড় চাচার বাড়ি । গুনগুনের চাচা আহসানউল্লাহ মীর্জা ধনী মানুষ। ভাইদের মধ্যে সর্বদা যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতেই তিনি এখানে বাড়ি করেছেন। তিন ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সুখী পরিবার।

চলবে…………..

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here