#ধারাবাহিকগল্প
#প্রবাসীর বউ
পর্ব–দুই
মাহাবুবা বিথী
প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে মানুষ পৃথিবীতে আসে।আবার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।প্রিয়জন হারানোর কষ্ট মানুষ একসময় ভূলে যায়।তবুও কিছু কিছু মৃত্যু কিছু কিছু বেদনার অভিঘাত মানুষ সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।প্রিয়জন হারানোর বেদনায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয় তার উপলব্ধি কেবল তারাই বোঝে যারা অকালে তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে।
রহিমার শ্বশুর বাড়ি ফেনী জেলার সদর থানার মহিপাল এলাকায়।আর ওর বাপের বাড়ি চাঁদপুর জেলায় মতলব থানায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নামলো।সারাদিন রহিমার কিছু খাওয়া হয়নি।পোয়াতি মানুষ।রহিমার মা সখিনা বেগম রহিমাকে বললো,
—-মারে গোসল করে সাদা শাড়ি পড়।তা না হলে এটা নিয়ে তোর শ্বশুর বাড়িতে নানা কথার সৃষ্টি হবে।
রহিমা শোকের শরীরে কোনো রকমে গোসলটা সেরে সাদা শাড়ি পড়ে নিলো।সখিনা রহিমার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো।মনে মনে সখিনা ভাবলো,বাচ্চাটা হয়ে যাক রহিমারে আবার বিয়া দিমু।ওর সারাজীবনটা পড়ে আছে।সখিনা রহিমার জা জরিনার কাছে গিয়ে বললো,
—-জরিনা,রহিমা তো পোয়াতি মানুষ।সারাদিন না খাইয়া রইছে।ওরে একটু ভাত দাও।
সখিনা ভাত নিয়ে এসে রহিমারে খাইয়ে দিলো।রহিমা কাঁদতে কাঁদতে ওর মাকে বললো
—মা,ওর সাথে সংসার করে আমার মনতো ভরলো না।সাত বছরে ও আমার কাছে সাত মাসও থাকে নাই।ও ছিলো আমার জীবনের সেরা পাওয়া।আল্লাহ পাকের সেরা উপহার।এ অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে এক বুক হাহাকার নিয়ে রহিমার গলা ভারী হয়ে আসে।কণ্ঠ রোধ হয়ে যায়।এ বেদনার কোনো সান্তনা নাই।
রহিমার মা ভাবে ও ওর কষ্টের কথাগুলো বলে হালকা হোক।ওকে তো স্বাভাবিক হতে হবে।পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে।বাচ্চা একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত রহিমাকে বিয়ে দেওয়া যাবে না।নিকটজন হারানোর শোকের যেমন শেষ নেই তেমনি এর সান্তনা দেওয়ার ভাষাও কারো জানা নেই।সময়ের সাথে সাথে আল্লাহপাক মানুষকে ভূলিয়ে দেন।সামলে উঠার শক্তি দেন।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।মাঝে মাঝে সালেহা বেগমের বিলাপ শোনা যায়।আর একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রহিমার অন্তর হাহাকার করে উঠে।কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বুকের ভিতর থেকে উঠে আসতে চায়।রহিমা নামাজ পড়ে হেলালের জন্য অনেকক্ষণ ধরে মােনাজাত করার পর ওর বুকের ভিতরটা হালকা হয়।হেলালের সাথে কাটানো সুখের স্মৃতি গুলো মনে পড়ে যায়।
শেষবার হেলালে যাইতে চায় নাই।ব্যাংকে কোনো টাকা ছিলো না। সুতরাং না গিয়ে উপায় ছিলো না।সারারাত রহিমারে হেলাল বুকে জড়িয়ে রাখলো।কারো মুখে কোন কথা ছিলো না।হেলাল যেন রহিমার বুকের ভিতরের কষ্টগুলো বয়ে নিতে চাইলো।দুটো হৃদয়ের গভীর বেদনার ক্ষত এ বাড়ির মানুষগুলো বুঝতে পারলো না।
কিছুদিন পর রহিমার মা ও ভাই চলে গেলো।রহিমার বাচ্চা প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসলো।রহিমার ভাসুর আর জা জরিনা ওকে চাপের উপর রাখে।রহিমার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষগুলো সময়মতো ও পায় না।রহিমা ওর তেল সাবান ওষুধপত্রের কথা বললে, জরিনা বলে,
—-এতো খরচ চালাতে গিয়ে আমার স্বামীতো রাস্তার ফকির হয়ে যাবে।হেলালতো মরে বেঁচেছে।আর আমাদের উপর হাতির খোরাক চাপিয়ে দিয়েছে।
রহিমা কিছু বলে না। সয়ে নেয়।কথায় কথা বাড়ে।
সেদিন রান্না করতে গিয়ে দেখে সয়াবিন তেল ফুরিয়ে গেছে।ও শাশুড়ীকে গিয়ে বললো,
—-মা তেল তো ফুরিয়ে গেছে।কি দিয়ে রান্না করবো?
শাশুড়ী কিছু বলার আগেই জা জরিনা বলে উঠে
—-তেল তো তুমি পানির মতো ব্যবহার করো যে এতো তাড়াতাড়ি শেষ হইয়া যায়।তোমার হাতে কোনো বরকত নাই।অপয়া অলক্ষী মেয়ে মানুষ।
শাশুড়ী আর ভাসুর আলাল চুপ করে থাকে। রহিমা শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আমাকে যা বলার মা আপনি বলেন।ভাবি কেন সবসময় আমাকে গালাগাল করে।আর টাকা পয়সা খরচের খোটা দেয়।মা আমি যতটুকু জানি আপনার ছেলে বিদেশে থেকে এই বাড়ির সব খরচই উনি দিয়েছেন।এমনকি রিতা ভাইয়ার মেয়ে হলে কি হবে ওর লেখাপড়ার খরচ আপনার ছেলে দিয়েছে।
জরিনা চিৎকার দিয়ে বলে,
—মা দেখছেন,এই কদিনেই ও হেলাল ভাইয়ের টাকাপয়সার খোটা দেয়।আমি বলে দিচ্ছি ও একদিন হেলাল ভাইয়ের সম্পত্তি দাবি করবে।
সালেহা দুজনকেই বলে ,
—-আমার পোলাডা মরলো দুদিনও হয় নাই।তোরা টাকা পয়সা নিয়া কামড়াকামড়ি করতাছস।সালেহা রহিমাকে একটু তেল বোতলে ঢেলে দিয়ে বলে যাও রান্নাটা সেরে নাও।আর হিসাব করে খরচ করতে শেখো।
রহিমা মনে মনে ভাবে, বাচ্চাটা হওয়ার পর ও ওর সম্পত্তির ভাগ চাইবে।
হেলাল মারা যাওয়ার পর অযত্ন আর অবহেলায় রহিমার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়।ও বেঁচে থাকা অবস্থায় দেশে আসলে রহিমার হাতে কিছু টাকা দিতো। রহিমা সেই টাকাগুলো খরচ করেনি।জমিয়ে রেখেছে।শাশুড়ীকে বলে,
—-মা আমি ডাক্তার দেখাবো।
শাশুড়ী বলে
—ডাক্তার দেখানোর টাকা আমার কাছে নাই।তোমার মাকে টাকা দিতে বলো।
রহিমা বলে,
—আপনাকে টাকা দিতে হবে না মা
এই কথা বলে রহিমা
জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডাক্তার দেখায়।ডাক্তার ওকে দুধ আর ডিম বেশী খেতে বলে।কারণ ওর পেটের বাচ্চার ওজন খুব একটা বাড়েনি।ও বাড়ি ফেরার পথে ডিম কিনে বাড়ি আসে।তারপর রোজ রাত্রে একটা করে ডিম সিদ্ধ করে খায়।
জরিনা ওর শাশুড়ীকে বলে,
—মা মুরগীগুলো যে ডিম পাড়ে ডিমগুলো কোথায় যায় আপনি জানেন?
শাশুড়ী বলে,
—-আমি তো জানি ডিমগুলো তোমার হেফাজতে থাকে।
জরিনা বলে,
আজকে এক সপ্তাহ ধরে কোনো ডিম হাতে পাই না। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি বলতে পারি ডিম কে খায়।
শাশুড়ী বলে
—-ডিম কে খায়?
জরিনা বলে,
—আমি প্রতিদিন ডিম রহিমাকে খেতে দেখি।ওই ডিমগুলো চুরি করে খায়।
শাশুড়ী রহিমাকে ডেকে বলে,
—তুমি নাকি ডিম চুরি করে খাও।বাড়ির মুরগীর ডিম গুলো এখন খুঁজে পাওয়া যায় না
রহিমা বলে,
—-মা আপনার বাড়ির মুরগীর ডিমগুলো সাদা
আর আমি ফার্মের লাল ডিম খাই।সেদিন ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে ডিম কিনে বাড়ি আসি।ডাক্তার বলেছে বাচ্চার ওজন বেশী বাড়েনি।দুধ আর ডিম খেতে।
নিজের ঘরে এসে রহিমার বুক ফেটে কান্না আসে।আজ ওকে ডিম চুরির অপবাদ পেতে হলো।এইটুকুন জীবনের বয়সে আর কতো কি দেখার বাকি আছে।ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হয়তো হারিয়ে যেতো।হেলালের শেষ চিহ্নটুকু আগলে রাখার জন্যই ও হয়তো আজও বেঁচে আছে।হেলালের শেষ কথাটাই ছিলো,”আমাগো সন্তানটারে মানুষের মতো মানুষ করিস”
চলবে