#পুষ্পবৃষ্টির_সেই_দিনে💙
#মাইশাতুল_মিহির
#তৃতীয়াংশ_এবং_শেষাংশ
[ছোটগল্প]
মেঘলা আকাশ! মন খারাপের কালো মেঘ আনাগোনা করছে। মৃদু হাওয়া দুলছে চারপাশে। ভেজা মাটির ঘ্রানে মুমু করছে পরিবেশ। ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। তার পাশে কয়েক হাত দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিভ্র।
নিরবতা ভেঙ্গে বলে নিভ্র,
‘ষোড়শী কন্যা, তুমি কি জানো? তোমার এক রাশ মুগ্ধতায় মাতোয়ারা হয়ে গেছে এই অবুঝ মন। আমাকে বিনা অপরাধে কারাদণ্ড দিলে।’
‘একদিন ফিরে আসবো, নীল আকাশে জমে থাকা কালো মেঘের মাঝে প্রেমের ভেলা ভাসিয়ে হাত বারিয়ে দিবো তোমার দিকে। কাছে টেনে আপন করে নিবো হৃদমাঝারে। পারবে না সেই দিনের অপেক্ষা করতে?’
শুভ্রতা কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলে নিভ্র,
‘আবার আসবো ফিরে, ভুলে যেও না যেনো,
ফিরে আসবো এক সুন্দর দিন নিয়ে,
মিল ঘটাবো দুটি অপূর্ণ প্রণয়ের।
ফিরে আসবো তোমায় ভালোবাসি বলে,
অপেক্ষায় থেকো প্রেয়সী, ভুলে যেও না যেনো।’ 🍂
.
ছাদ থেকে নেমে গেলো নিভ্র। বাড়ির সবাইকে বিদায় দিয়ে গেইটের সামনে সিএনজির পাশে দাঁড়ালো। নিভ্র গাড়িতে উঠার আগে চোখ তুলে ছাদে দেখলো। ষোড়শী কন্যা রেলিং ধরে তারই দিকে আছে। বিনিময়ে মুচকি হাসি দিয়ে গাড়িতে উঠলো। চলে গেলো নিভ্র শহরের উদ্দেশ্যে।
.
গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শুভ্রতা। এক মনে তাকিয়ে আছে নিভ্রের যাওয়ার দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। হয়তো এই কয়দিনে মনে এক কোণে জায়গা দখল করে নিয়েছে নিভ্র। শুভ্রতার মাঝেও লুকিয়ে আছে এক অজানা সুপ্ত অনুভূতি। প্রথম দিন থেকেই নিভ্রকে খেয়াল করেছে সে। কবি হুমায়ন আহমেদ ঠিক বলেছে। প্রতিটি নারী তার তৃতীয় চোখ দিয়ে পুরুষ মানুষের মন পড়তে পারে। শুভ্রতাও নিভ্রের মন বুঝতে পেরেছে তবে। নিভ্রের ভালোবাসা প্রকাশে মুগ্ধ হয় শুভ্রতা। অপেক্ষা করবে সে। সেই দিনটির জন্য সে অপেক্ষা করবে যে দিন তার প্রেমিক পুরুষটি এসে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিবে। আর সে? দ্বিধাহীন হৃদয়ে ধরতে সেই হাত। প্রণয়ের প্রেমকাহিনী সমাপ্তে সাহায্য করবে। উজাড় করে ভালোবাসবে নিভ্রকে। শুধু অপেক্ষা সেই দিন টির জন্য।🌺
.
দু-বছর পর গ্রামের মাটিতে পা রাখে নিভ্র। আকাশটা আজ ঠিক আগের মতোই মেঘে ঢাকা। ভেজা মাটির ঘ্রান, বৃষ্টির পানিতে ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে কদম ফুল, কামিনী ফুল আর বিলের ধারে শাপলা। বুক ভরে লম্বা নিশ্বাস নেয় নিভ্র। অপেক্ষার প্রহর তবে শেষ হলো বলে। সেই ষোড়শী মায়াবিনী কন্যা এখন আর ষোড়শী নেই। সে এখন পূর্ন কিশোরী। ইশ কত দিন পর দেখবে সে তার শুভ্রতা কে।
.
মোস্তফা কামাল’ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাক ছাড়ে নিরা, ‘চাচিমা, নিলু আপু, নিলা, শুভ্রতা আপু। কোথায় তোমরা?’
পুরো বাড়ি মাথায় উঠে গেলো। বাড়ির মেজো ছেলে তার পরিবার নিয়ে বাড়িতে হাজির। ব্যস্ত হয়ে পরলো সবাই। সোফার ঘরে বসিয়ে আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করছে তাদের। মোস্তফা কামাল আজ শয্যাশায়ী। তাই সবাই এসেই উনার ঘরে গিয়ে দেখা করে এসেছে প্রথমে। সবাই ব্যস্ততার সাথে দেখভাল করছে তাদের। ভীরের মাঝে নিভ্রের চোখ খুজছে তার সেই ষোড়শী কে। শুভ্রতা নিচে আসেনি কেনো? তবে কি শুভ্রতা আমাকে ভুলে গেছে?
নিভ্র তার ঘরে গিয়ে কাপড় বদলে নিলো। ভালো লাগছে না কিছু। তৃষ্ণার্ত পাখির মতো কৃষ্ণকন্যার মুখশ্রী দেখতে ভিতর হাহাকার করছে তার।
‘ভুলে গেলে আমায় ষোড়শী কন্যা? এতোটাই সহজ? আমি যে ক্ষণে ক্ষণে তোমাতেই ডুবে ছিলাম। সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে ছিলাম। পারলে না অপেক্ষার প্রহর সইতে?’
.
বিকেলে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিভ্র। আকাশে তাকিয়ে অভিযোগের তালিকা তুলছে। ভাবছে দু বছর আগের কথা। ঠিক এমন মেঘলা দিনেই পুকুর পাড়ে ষোড়শীর মোহে পরেছিলো সে। ভেবেই মনে মনে হাসছে সে।
শুভ্রতা নিশব্দে নিভ্রের পাশে এসে দাঁড়ায়। একরাশ ভয়, জড়তা কাটিয়ে মনে সাহস জুটিয়ে এসেছে তার প্রেমিক পুরুষটির পাশে। শুভ্রতা কে দেখে বিস্মিত হয় নিভ্র। আগের সেই ষোড়শী কন্যা এখন কিশোরী। বেশ পরিবর্তন এসে বাহ্।
পুকুরের ভাসা পানকৌড়ির দিকে তাকিয়ে বলে শুভ্রতা,
‘অপেক্ষার প্রহর সুদীর্ঘ ছিলো তবুও বুকে এক সিন্ধু পরিমান আশা নিয়ে পথ চেয়ে ছিলাম সেই শহুরে ছেলেটির জন্য। আজ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটলো।’
নিভ্র এগিয়ে শুভ্রতার কপালে লেপ্টে থাকা অবাধ্য চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,
‘কথা যখন দিয়েছি তখন তো পালন করতেই হবে। এবার আর অপেক্ষা করবো না কৃষ্ণকন্যা। এই বক্ষস্থলের মাঝে জড়িয়ে রাখবো সারাজীবন।’
বিনিময়ে শুভ্রতা লাজুক হাসে। নিভ্র হেসে বলে, ‘অনেক বদলে গেছো শুভ্রতা।’
লজ্জার রক্তিম আভা শুভ্রতার মুখশ্রীতে হানা দেয়। নুইয়ে ফেলে মাথা। অতঃপর বলে উঠে, ‘কেমন আছেন?’
প্রফুল্লিত কন্ঠে বলে নিভ্র, ‘ভালো আছি বিধায় কৃষ্ণবতী কে নিতে এলাম।’
.
বসার ঘরে পারিবারিক বৈঠক বসেছে। নিভ্রের বাবা তার ছেলের জন্য শুভ্রতাকে চেয়ে তার আপন ছোট ভাইয়ের কাছে। শুভ্রতার বাবা বড় ভাইজানের কথা ফেলতে পারে নি। তাই আজ তাদের আংটি বদল হয়ে এক সাপ্তাহ পর বিয়ে। শুভ্রতা কে লাল শাড়ি পরিয়ে বসার ঘরে সবার সামনে আনা হয়েছে। নিভ্রের পাশে বসানো হয় তাকে। আংটি বদল হয় তাদের। মিষ্টি মুখ করে সবাই। ঘোমটার আড়ালে শুভ্রতা তার লজ্জা মাখা মুখ খানা লুকিয়ে রেখেছে যেনো।
.
চাঁদনী রাতে আকাশের নিচে ছাদের উপর পাশাপাশি বসে আছে নিভ্র শুভ্রতা। শুভ্রতা আপন মনে জ্যোৎস্না বিলাস করতে ব্যস্ত আর নিভ্র? সে তো তার সেই ষোড়শী কে দেখায় মগ্ন।
‘শুভ্রতা?’
‘হুম’
‘তুমি কি জানো আকাশের ওই চাঁদের চেয়ে আমার পাশে বসে থাকা চাঁদটি সব চেয়ে সুন্দর?’
‘উহুম! মাত্র জানলাম আপনার থেকে।’ মিনমিনে গলায় বলে শুভ্রতা। বিনিময়ে নিভ্র মুচকি হাসে।
.
শুভ্রতার গায়ের হলুদ আজ! চারদিকে কাচা হলুদের ঘ্রান ভাসছে। কলপাড়ে তাকে বসিয়ে গায়ে হলুদ লাগাচ্ছে মহিলারা। নিভ্রকে প্রথম হলুদ লাগিয়ে সেই হলুদ শুভ্রতা কে দেওয়া হচ্ছে। সবাই একজন আরেকজন কে হলুদে মাখিয়ে দিচ্ছে। হাসি, আনন্দ করছে সবাই। হলুদ দেওয়ার পর এক এক করে কলসি দিয়ে পানি ঢালছে শুভ্রতার মাথায়। কাচা হলুদ রঙ্গের শাড়ি পরিয়ে শুভ্রতা কে তার ঘরে নিয়ে যায় বোনরা। মেহেদী দেওয়ার আসর বসে এখন। গাছের মেহেদি পাতা বেটে রাখা হয়েছিলো। বাটা মেহেদি হাতে সুন্দর করে দিয়ে দিলো নিলু। তারা নিজেরাও দিয়েছে। মাঝে মাঝে সবাই কথা শুনিয়ে শুভ্রতা কে লজ্জায় ফেলছে।
.
বিয়ের দিন মানুষের আগমনে চারপাশ হৈচৈ হচ্ছে। মোস্তফা কামালের বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা। কোনো দিকে যেনো কোনো কমতি নেই। মেহমান দের খুব যত্ন সহকারে খাওয়ানো হলো। এবার বিয়ে পরানোর পালা।
কাজি নিভ্র আর শুভ্রতার কাছ থেকে কাবিননামায় সই নিলো। দুজন ‘কবুল’ বলে আবদ্ধ হলো বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে।
.
ঘরের জানালার কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। একমনে দেখে যাচ্ছে প্রতি টি বৃষ্টির ফোটা। নিভ্র এসে শুভ্রতার পাশে দাঁড়ালো। পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে কাধে চিবুক রেখে বলে,
#পুষ্পবৃষ্টির_সেই_দিনে
এক ষোড়শী নজর কেড়েছিলো,
ঘায়েল হয়েছিলাম তার মুগ্ধকর হাসিতে,
মাতোয়ারা হয়েছিলাম তার প্রেমে।
আর আজ?
আজ সেই ষোড়শী আমার অর্ধাঙ্গিনী,
বুকের বা-পাশের অধিকারিণী।
ভালোবাসি প্রেয়সী, ভালোবাসি কৃষ্ণবতী। 🌼
সমাপ্ত… 🍂