পর্ব ৪০
মিশু মনি
.
হৃদমোহিনী৫৭
অনেক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইলো মিশু। মনটা বড্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ধীরেধীরে চেষ্টা করছে মনকে শান্ত করার। এরপরের পদক্ষেপ কি হবে সেটাই ভাবছে একমনে। এখন কোথায় যাবে আর কি করবে? মাথায় কিছুই আসছে না।

রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখলো। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। বাহ্যিক চেহারায় কোনো সমস্যা কি আছে? হ্যা আছে। নিজেকে দেখতে ভালো লাগছে না আজকে। এমন কিছু করতে হবে যাতে নিজেরই নিজেকে দেখতে ভালো লাগে।
বাথরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে রইলো অনেক্ষণ। ভিজলো প্রায় এক ঘন্টা ধরে। পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করে ছিলো। ধীরেধীরে মনটা শান্ত হয়ে এসেছে।

ফুরফুরে লাগছে অনেক। গা মুছে পোশাক বদলে চুলে তোয়ালে বেঁধে রুমে চলে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এবার মুগ্ধ হয়ে গেলো। বাহ! বেশ পরিচ্ছন্ন লাগছে তো। এটা সত্যি যে প্রতিটা মেয়েকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে সুন্দর দেখায়। গোসলের আগে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছিলো, খাওয়া নেই দুদিন ধরে। খাবারের কথা মনে পড়তেই বুঝতে পারলো খিদে পেয়েছে অনেক। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। আগে খেয়ে নেয়া দরকার।

বাসায় আজকে কেউ নেই। চাচা চাচী দুজনেই বাইরে। চাচাতো বোনটা দরজা খুলে দিয়ে টুকটাক কথা বলে সেও বাইরে চলে গেছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। তবে ফাঁকা বাড়িতেই ভালো লাগছে। একাই টেবিলে বসে খাবার খেয়ে নিলো মিশু। তারপর রুমে চলে এলো। মাথা থেকে তোয়ালে খুলে আয়নার দিকে তাকালো। ভেজা চুল হাত দিয়ে আচড়ে নিলো। মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে স্নিগ্ধ মনেহচ্ছে। আচ্ছা, ওরা বারবার কেন যোগ্যতা নিয়ে কথা বলে? চেহারায় তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা কি তাহলে?

অনেক্ষণ ধরে চিন্তা ভাবনা করার পর আবিষ্কার করলো সমস্যা হচ্ছে আউটলুকিংয়ে। স্মার্টনেসের একটা প্রধান শর্ত হচ্ছে আউটলুক। শুধু মনের দিক থেকে সুন্দর হলেই হয়না। আউটলুক বদলানো প্রয়োজন। বাহ্যিক রূপটাকেও যেন দেখতে মানানসই আর সুন্দর দেখায়। সর্বপ্রথম একটু রেস্ট নেয়া দরকার, তারপর অন্যকিছু। অনেকদিন ধরে যা ধকল গেলো!

বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই ঘুম এসে গেলো। টানা তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো রাত আট টায়। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো চাচাতো বোন মিফতা চা নিয়ে এসেছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিশু সংক্ষিপ্ত করে ঘটনাটা খুলে বললো মিফতাকে।

সব শুনে মিফতা বললো, ‘এখন কি করার চিন্তাভাবনা করছিস?’
– ‘জানিনা। আব্বু আম্মুর সাথে এখনো কথা হয়নি।’
– ‘ওরা নিশ্চয়ই বলবে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে।’
– ‘বলুক। আমি যাবো না। আমি মেঘালয়কে কথা দিয়েছি তার সম্মান উঁচু করে নিজে সম্মানের সাথ ওই বাড়িতে যাবো।’
– ‘তাহলে ভাব এখন কি করবি?’

মিশু নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। পরক্ষণেই মাথায় একটা ব্যাপার ঝিলিক খেলে গেলো। কয়েকদিন আগে শুনেছিলো স্কলারশিপ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এপ্লাই তো করাই আছে, পরীক্ষা দেয়া যায় কিনা?

মিফতা শুনে বললো, ‘লং টাইম পড়াশোনা করিস না। পারবি কি?’

মিশু আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘আমি ইংলিশে অনেক ভালো। বিয়ের আগে অনেক প্রাকটিস করেছি। স্কলারশিপ এক্সামটা দেয়ার জন্য অনেক প্রস্তুতি ও নিয়েছি। আমি একটা সুযোগ নিতে চাই। পরীক্ষা কবে দেখতে হবে।’

এরপর অনলাইন ঘেঁটে দেখতে পেলো একদিন পরেই পরীক্ষা। পুরো শরীরে ঝংকার খেলে গেলো মিশুর। গতবার যারা পরীক্ষা দিয়েছিলো তাদের কাছে শুনেছে এই পরীক্ষায় শুধুমাত্র ইংলিশ বেসিক রুলস থেকেই প্রশ্ন হয়। খুব একটা কঠিন প্রশ্ন হয়না। কারণ আমাদের দেশেই একমাত্র পরীক্ষাটা হচ্ছে আর এদেশের শিক্ষার্থীরা ইংলিশে ততটা দক্ষ নয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, ‘আইসিসি আর’ স্কলারশিপের কথা আমাদের দেশের বেশিরভাগ ছাত্র ই জানেনা। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় খুব কম সংখ্যক ছাত্র। একটু ভালো করলেই টপকে যায়। ছোটবেলা থেকেই মিশু ইংলিশে অনেক ভালো। প্রতিটা ইংরেজি পরীক্ষায় ওর ‘এ প্লাস’ থাকবেই। আর ইংলিশে কথা বলতেও অনেক পটু। প্রতিদিন ই অন্তত ২০০ টা ট্রান্সফরমেশন অব সেন্টেন্স করতো। আশা করা যায় পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব।

অনেক উত্তেজনা বোধ করছে মিশু। অনেকদিনের ধকলে মনটা মরে গিয়েছিলো যেন। পরীক্ষার কথা ভেবে আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ইংরেজি ওর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। এত বছর ধরে ইংরেজিতে ভালো ফলাফল করে এসেছে ও। এবার এই পরীক্ষায় নিজের সবটুকু ঢেলে চেষ্টা করতে হবে। পাশ করতে পারলেই আর বাবা মায়ের কাছেও বোঝা হয়ে থাকতে হবেনা। ভার্সিটিতে ভর্তি থেকে শুরু করে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা পর্যন্ত সমস্ত খরচ সরকার বহন করবে। উফফ! খুব উত্তেজনা কাজ করছে।

৫৮
বাবা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর কিছুক্ষণ মেডিটেশন করলো মিশু। বারবার মেঘালয়কে মনে পড়ে যাচ্ছিলো। মেডিটেশন করার ফলে মেঘালয়ের ভূতটা মাথা থেকে নেমে গেছে। রাতের খাবার শেষ করে একেবারে শান্ত হয়ে পড়তে বসে গেলো।

ঘুমানোর ফলে শরীরটা ফুরফুরে হয়ে গেছে। আজ আর ঘুমাতে হবেনা, আজকে শুধুই পড়াশোনা। কিছুক্ষণ বেসিক রুলস নিয়ে ঘাটাঘাটি করে অনলাইনে ঢুকে গেলো। টেন মিনিট স্কুলে ঢুকে সরাসরি পরীক্ষা দিতে লাগলো। একেকটা পরীক্ষা দেয়ার পর উত্তর নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে শুরু করলো। এভাবে রাত দুইটা পর্যন্ত শুধু অনলাইনেই ইংলিশ পরীক্ষা দিয়ে গেলো। অনেক দিন পর প্রাক্টিস করতে বসে মগজ ঝালাই হয়ে যাচ্ছে।

পড়তে পড়তে বোর লাগছিলো। উঠে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইংলিশে কথা বললো একা একা। বারবার আটকে যাচ্ছে, জড়তা কাজ করছে।দীর্ঘদিন ইংরেজিতে কথা বলা হয়নি। কিছুতেই পারছে না কথা বলতে। মিনিট পনেরো চেষ্টা করার পর এক কাপ চা খেয়ে আবারো পড়তে বসলো। এবার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির এডমিশন টেস্টের প্রশ্নপত্র ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। সবই ইংরেজিতে হওয়ায় খুব মজা লাগছে মিশুর। কারণ ইংলিশ পড়তে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

স্কিল ডেভেলপমেন্ট সলভ করতে করতে ফজরের আযান হয়ে গেলো। মিশু একটা জিনিস ভালোভাবেই জানে, যে ধর্মেরই ব্যক্তি হোক না কেন, প্রার্থনা অত্যন্ত জরুরি। এখন থেকে নিয়মিত প্রার্থনায় মনোযোগী হতে হবে। ওযু করে এসে নামাজে বসে গেলো। নামাজ শেষ করে উঠে আবারো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ইংলিশ লেটারেচার পড়তে আরম্ভ করলো। পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুম এসে গেলো চোখে। বিছানায় এসে শোয়ামাত্রই ঘুমে ঢলে পড়ল।

পরেরদিন টাও পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে রইল। নিজের সবটুকু ঢেলে দিতে হবে এই পরীক্ষায়। এতদিনের অর্জিত সমস্ত মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রস্তুতি আগে থেকেই নেয়া ছিলো, মাঝখানে কয়েকটা দিন বিরতি দেয়ায় জড়তা এসে গেছে। টানা চব্বিশ ঘন্টা আবারো চর্চা করার ফলে জড়তা কেটে গেলো। বেশ মজা পাচ্ছে পড়াশোনা করতে।

রাত্রিবেলা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো। রাত পোহালেই পরীক্ষা। এমন সময় মিফতা এসে ওর ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আন্টি ফোন দিয়েছে।’

মিশু ফোন কানে ধরে বললো, ‘হ্যালো।’
– ‘আপু আমি মিতু। কেমন আছিস আপু?’
– ‘ভালো আছি। তুই?’
– ‘আমিও ভালো আছি। রাতে খেয়েছিস আপু?’
– ‘হ্যা। তুই?’
– ‘হুম। আপু একটা কথা বলবো রাগ করবি না তো?’
– ‘না রে। আমি কি তোর উপর রাগ করি কখনো? বল কি কথা?’
– ‘আগে প্রমিস কর কল কাটবি না?’
– ‘আচ্ছা বাবা প্রমিস। এবার বল কি কথা?’
– ‘কনফারেন্সে মেঘ ভাইয়া আছে। একটু কথা বলবি ভাইয়ার সাথে?’

চমকে উঠলো মিশু। বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠলো। প্রথমে ভাবলো কথা বলবে না, পরক্ষণেই বললো, ‘ঠিকাছে। ওকে কলটা কেটে এই নাম্বারে কল দিতে বল।’

এরপর কলটা টুক করেই কেটে গেলো। মিশু ফোন হাতে বইয়ের দিকে তাকালো। বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছে। এরকম কেন হচ্ছে! মেঘালয়ের কথা শুনেই হার্টবিট বেড়ে গেলো ধুপ করেই।

মেঘালয়ের নাম্বার থেকে কল এলে মিশু রিসিভ করে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। মেঘালয় বললো, ‘কেমন আছো মিশু?’
– ‘ভালো আছি। আপনি?’
– ‘জানোনা?’

মিশু নিশ্চুপ। মেঘালয়ের গলা শুনে এমনিতেই ছটফট লাগছে তার উপর ‘জানোনা’ শব্দটা আরো বেশি ধুকধুকি বাড়িয়ে দিলো। মিশু বললো, ‘খেয়েছেন রাতে?’
– ‘না।’
– ‘খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি। নয়তো কথা বলবো না।’

মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, ‘বাহ! অনেক স্বাভাবিক আছো দেখছি।’
– ‘একদম। জানেন আমি একটা গুড গার্ল হয়ে গেছি?’
– ‘ওমা তাই! কিরকম?’
– ‘আমি আজকে নামাজ পড়েছি। গত রাত সারারাত পড়াশোনা করেছি, আজকে দিনে পড়াশোনা করেছি। এখনো পড়ছি।’
– ‘বাহ! কি পড়াশোনা করছো?’
– ‘যা যা পড়তে ভালো লাগছে সব পড়ে ফেলছি। আমি একটা গুড গার্ল হয়ে গেছি না?’

মেঘালয় হেসে বললো, ‘পাগলী।’
– ‘পাগলী না তো, গুড গার্ল।’
– ‘আমার পাগলী টা। ভেবেছিলাম তুমি কান্নাকাটি করে নিশ্চয়ই এখন বিছানায় মরার মত পড়ে আছো। তুমি দেখছি একদিনেই চেঞ্জ হয়ে গেছো!’
– ‘মিশু বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আপনার বউ তো। হা হা হা।’

মিশুর হাসি শুনে আরো অবাক হলো মেঘালয়। মুগ্ধ হয়ে গেলো একেবারে। মুগ্ধতার কারণে কথাই বলতে পারছিলো না। মিশু বললো, ‘আচ্ছা আপনি গত রাতে ঘুমান নি তাইনা?’
– ‘ঘুম আসেনা রে তোমাকে ছাড়া।’
– ‘জানি জানি। ঘুম আসার জন্য উলটা পালটা কাজ করতে হয়। এখন আপনি উলটা পালটা কাজ করুন, আমি একটু পড়াশোনা করি। আমি কাল সারারাত আপনার সাথে কথা বলবো। আচ্ছা?’

মেঘালয় হেসে বললো, ‘আচ্ছা। কিন্তু উলটা পালটা কাজ বলতে?’
– ‘কি আবার? কোলবালিশের সাথে লটর পটর করুন।’

হো হো করে হেসে উঠলো মেঘালয়। হাসি থামতেই চাইছিলো না। মিশু আবারো বললো, ‘হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন? এখন কোলবালিশের সাথে লটর পটর করুন। আমি পড়ছি বললাম তো। কাল রাতে ফোন দিবো।’
– ‘দিনে দেয়া যায়না?’
– ‘না। দিনে আমার কাজ আছে। এখন রাখবো, পড়তে বসেছি। আজকে খেয়েদেয়ে গুড বয় এর মত ঘুমিয়ে যান। নয়তো কথা বলা বন্ধ করে দিবো।’
– ‘ওকে বাবা। শাসন করতেও জানো দেখছি। ঠিকাছে, গুড নাইট।’

মিশু ফোন কেটে দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। বইয়ে মুখ গুঁজে আবারো পড়াশোনা শুরু করলো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here