#পদ্মফুল – ২য় পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
______________________________
বুকে অসম্ভব সাহস এবং উদ্যম সঞ্চয় করে আমি তাকে কল করলাম। বুকের কাপুনি অসহ্য ঠেকছে। উত্তাল পাত্তাল প্রেমের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে আমার মনের সবকিছু। কেমন যেন অস্থির লাগছে। বোধ হচ্ছে উত্তেজনায় জ্ঞ্যান হারাচ্ছি। আমি কল করার সঙ্গেসঙ্গে সে ধরে ফেলল। মৃদু স্বরে হেসে বলল,
‘ আমি জানতাম তুমি কল করবে। কিন্তু এত দ্রুত করবে বুঝিনি। ‘
আমি বুঝতে পারলাম সে ব্যঙ্গ করছে। আমি ঠোঁট কা’মড়ে বসে থাকলাম ঠায়, নিশ্চুপ। কথা বলছি না। কন্ঠনালী দেবে গেছে বোধ হচ্ছে। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলল,
‘ ঘুমাও নি? ‘
আমি এবারেও কথা বলতে পারলাম না। ফুশফুশ করে নিঃশ্বাস ছাড়ছি। নিঃশ্বাস নিতে নিতে বোধ হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। সে আবারও বলল,
‘ কথা বলছ না কেন? ‘
আমি চুপ। সে আবার বলল,
‘ তুমি কি বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা নিয়ে কল করেছ? ‘
এতক্ষণ কথা বলতে না পারা আমি তাৎক্ষণিক বললাম,
‘ না। ‘
সে হেসে ফেলল। বলল,
‘ তাহলে? কথা বলছ না কেন? ‘
‘ আ-আসলে আমি খুব নার্ভাস। প্রথমবার কোনো ছেলের সাথে কথা বলছি। ‘
‘ এটাই প্রথম আর শেষ ছেলে হবে তোমার। ‘
তার গভীর কথা। ইশ, এত সুন্দর কথা শুনে ডুবে যাচ্ছি যে। সে বলল,
‘ ঘুমাও নি সারারাত?
কথা বলে বেশ সহজ হয়ে এসেছি ততক্ষণে। মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ না। ‘
‘ কেন?
‘ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। ‘
‘ কিসের সিদ্ধান্তহীনতা? ‘
‘ কল করব কি না। ‘
‘ তা এখন কি ভেবে কল করলে? ‘
আমি লজ্জা পেলাম। বললাম,
‘ জানিনা। ‘
‘ জানো না?
‘ না। ‘
‘ কি জানো তাহলে? ‘
‘ কিছুই না। ‘
সে হেসে ফেলল। আমি ফোনের ওপাশে মুগ্ধ হয়ে তার হাসির শব্দ শুনে গেলাম। ঘুমে পাগল হওয়া চোখদুখানা দুবার পলক ঝাপটালো। ঘুমেরা বন্য ঘোড়ার ন্যায় কেমন ছুটে পালাল। সে রাত কেটে গেল প্রেমের ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে।
__________________________________
তারপরের সময়টা বেশ ছিল। দুজনের প্রেম একদম মাখোমাখো। তাকে ছাড়া আমার একমুহুর্ত চলে না। সে আমি ছাড়া কেমন পাগল হয়ে যায়। প্রতি রাতে ফোনে কথা হত আমাদের। আব্বার বালিশের পাশ থেকে ফোন চুরি করা আমার প্রায় অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। একদিন আব্বা সেটা কেমন করে যেন বুঝে গেলেন। তারপর থেকে তার ফোন আর বালিশের পাশে রাখেন না। কোথাও যেন লুকিয়ে রাখেন। আমি আর রাতে কথা বলতে পারিনা তার সাথে। সে অপেক্ষা করে প্রতিরাত। ভাবলে কান্না আসে আমার। কিছু করার থাকে না। ভাই হয়ত কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন। তারপর থেকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে যাওয়া সব ভাই করেন। তার সাথে যে দেখা করব se উপায় নেই। আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। সে ছাড়া চোখে অন্ধকা দেখতে লাগলাম। বড় হয়েছি বিধায় মা ছাড়া বাড়ির বাইরেও যেতে পারিনা। অথচ তার বাড়ি আর আমার বাড়ি হাটা দূরত্ব পাঁচ মিনিট। কিন্তু আমি যেতে পারিনা তাকে দেখতে। সে কি ভয়ংকর দিন যাপন করেছিলাম। মনেমনে বড্ড ভেঙে পড়েছিলাম। প্রায় এক মাস কেটে যায়। তার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন আমার। এক মাস পরে স্কুলে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। পরীক্ষায় মন বসে না। বারবার জানালার বাইরে তাকে দেখার জন্যে উৎ পেতে থাকি। সে আসে না। আমার আর তাকে দেখা হয়না। তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় আমি তার পথ চেয়ে থাকি।
অথচ সেদিন সে এল। পরীক্ষার সময় আমি তাকে দেখলাম জানলার বাইরে সে পায়চারি করছে। হয়ত আমাকে দেখবে বলে অপেক্ষা করছে। আমি তাকে দেখে অস্থির হয়ে গেলাম। দু ঘণ্টার পরীক্ষা এক ঘণ্টায় দিয়ে শেষ করলাম। দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম হল ছেড়ে।
ভাই আসেন নি এখনো। আমি সব রাস্তা পরিষ্কার দেখে দৌঁড়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে সে মাথা কাত করে অপলক আমাকে পরখ করল। আমার চোখে জল। সে বলল,
‘ অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। কোথায় ছিলে? ‘
আমি কেঁদে উঠলাম। সে আমার কান্না দেখে অস্থির হল ভীষন। আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,
‘ এই মৌরি, কেঁদো না। বাইকে উঠো। নদীর পাড়ে গিয়ে শুনব সব। দ্রুত উঠো। কেউ দেখে নিবে। ‘
আমি কাদতে কাদতে তার বাইকে পেছনে উঠে বসলাম। সে বাইক নিয়ে শো করে স্কুলের সামনে থেকে চলে এল। সারা রাস্তা বাইকের লুকিং গ্লাসের দিকে চেয়ে তাকে দেখলাম আমি। কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেললাম। সেও বড্ড উষ্ষকুশ্ক। আমায় নিয়ে নদীর পাড়ে এল।
বাইক থেকে নেমে বলল,
‘ ব্যাগ দিয়ে দাও আমার কাছে। ‘
আমি আমার কাঁধের স্কুল ব্যাগ তাকে দিলাম। সে বাইকের হাতলে ব্যাগ রেখে দিল। আমাদের দেখে তার একজন বন্ধু এগিয়ে এল। সে বন্ধুকে বলল,
‘ কামাল, পাহারা দিস। মৌরির কোনো আত্মীয় এলে ইশারা করবি। ‘
কামাল কেমন করে যেন আমাকে দেখল। মহসিনের দিকে চেয়ে বলল,
‘ আচ্ছা। তোরা যা। ‘
সে আমাকে নিয়ে একটা গাছের নিচে বসল। আমার দিকে চেয়ে বলল,
‘ এখন বলো কি হয়েছিল? ‘
আমি একে একে সব কথা তাকে খুলে বললাম। তাকে চিন্তিত দেখাল। নিচের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে আমাকে বলল,
‘ রাতে কথা বলার জন্যে একটা ফোন দরকার। আমার কাছে জমানো কিছু টাকা আছে। সেটা দিয়ে তোমায় কাল ফোন কিনে দেব। ‘
‘ না, না। ফোন কিনে দিলে ঘরে বিপদ হবে।
‘ লুকিয়ে রাখবে। ‘
‘ কোথায় লুকাব? আম্মা দেখে ফেলবে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। কেউ দেখলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। ‘
মহসিন চিন্তায় পড়ে গেল। আমি তার কাধে হাত রাখলাম। বললাম,
‘ চিন্তা করবেন না। আমাদের কপালে যা আছে তাই হবে। ‘
সে অস্থির হল। বলল,
‘ তাই বলে তোমার সাথে একবারও যোগাযোগ রাখব না? তোমার ভাই সবসময় পাহারা দেয় তোমাকে। দেখা করার উপায় নেই। কথা বলার উপায় নেই। কি করব? ‘
আমিও চিন্তিত হলাম। চিন্তা করতে করতে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। অথচ সমাধান বের হচ্ছে না। আমি হাল ছেড়ে বললাম,
‘ যা হবার হবে। এখন আমি কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। একবার ধরা পড়ে গেলে সোজা বিয়ে দিয়ে দেবে আমায়। ‘
‘ বিয়ে করলে আমাকে করবে। আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। ‘
‘ আপনি সবে কলেজে পড়েন। আপনার অনেক বড় ভাই বিয়ে করেনি। ওদের বিয়ে না দিয়ে কে আপনাকে বিয়ে করাবে? ‘
‘ খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেব। ‘
‘ এসব করে কিছুই হবে না। শুধুশুধু শরীর খারাপ করবে। তার থেকে বরং আমাদের ব্যাপারটা এভাবেই চলুক। কপালে যেদিন কথা বলা থাকবে কথা বলব। যেদিন দেখা করার থাকবে, দেখা করব। এর বেশি কিছু করলে আমাদের দুজনেরই বিপদ। ‘
মহসিন হয়ত আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছে। সেদিনের মত আমরা উঠে গেলাম। মহসিন বাইকে করে আমাকে স্কুলের সামনে দিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভাইয়ের সাথে বাড়ি চলে এলাম।
তারপরের দিন ভাই কেমন উ’গ্র হয়ে আমার ঘরে এলেন। আমি পড়ছিলাম তখন। ভাই এসেই আমার গালে চপাট করে থা’প্পড় বসিয়ে দিলেন। আমি হতবম্ব হয়ে গেলাম। গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে ভাইকে দেখলাম। আম্মা, উর্মি, বাড়ির কাজের লোক সবাই আমার কক্ষে জড়ো হয়ে গেল। ভাই রেগে আছেন। রাগে তার গা কাপছে। তিনি আমাকে আরো একবার থা’প্পড় দিলেন। আমি মাটিতে ছিটকে পড়লাম। এতক্ষণের কান্না চেপে রাখলেও এখন চোখ উপচে জল পড়ছে। আমি চিৎকার করে বললাম,
‘ আমাকে মারছ কেন তুমি? কি করেছি আমি? ‘
ভাই আবারও আমাকে মারার জন্যে এগিয়ে আসতে চাইলেন। মা, ঊর্মি আটকে দিল তাকে। ভাই চিৎকার করে বললেন,
‘ চেয়ারম্যান বাড়ির মহসিনের সাথে তোর কিসের সম্পর্ক? তোরে আর ওই ছেলেরে নদীর পাড়ে দেখছে একজন। আমার বাড়ির সম্মান ন’ষ্ট করার আগে বুক কাপল না? শ’য়’তানের বা’চ্চা। ‘
আম্মা ঠোঁট হা করে আমার দিকে তাকালেন। ঊর্মিও অবাক হয়েছে। আম্মা ভাইকে বললেন,
‘ এসব সত্যি কথা তোকে কে বলল? আমার মেয়ে এমন করবে না। ‘
ভাই আম্মার দিকে চেয়ে হুংকার ছাড়েন,
‘ তোমার মেয়ে! ওই তোমার মেয়ে হওয়ার যোগ্যই না। হা’রাম’খোর একটা। ন’ষ্টা’মি করে বাইরে। আজ আব্বা আসুক বাড়ি। ওর খবর করতাসি আমি। ‘
ভাই রাগে গ’জরাতে গ”জরাতে চলে গেলাম সেখান থেকে। আম্মাও আমারে কয়েক দফা মে’রে ক্ষান্ত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আমি কাদতে কাদতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। চোখ লাল মরিচের ন্যায় জ্বলতে লাগল। এমন দুঃখও আল্লাহ আমার কপালে রেখেছে।