নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব -১১
– তুমি আমার সাথে মিথ্যে কেনো বলেছ? তুমি বলেছো ভাবনা আমার তুলনায় কিছুই না! কিন্তু সে তো রীতিমত সুন্দরী। এ থেকে আমি কি বুঝবো, রায়হান ? তুমি এভাবেই প্রতিনিয়ত আমার সাথে মিথ্যে বলছো!
মাসুদ আংকেল তবে মিথ্যে বলেন নি।
– আশা, তুমি কার কথায় আমাকে অবিশ্বাস করছো? উনি নিজেই একটা চোর। কোম্পানীর কত ক্ষতি করেছে। তাও মাফ করে দিয়েছি। পুলিশে দেওয়া উচিত ছিলো। উনাকে সম্মানের সাথে অফিস থেকে বিদায় করাটাই আমার ভুল হয়েছে। চোর অপবাদ দিয়ে বের করাটাই ঠিক ছিল। কত বড় সাহস! আমার সংসার ভাঙার পায়তারা করছে। বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলতে হবে।
– তুমি প্রসঙ্গ চেঞ্জ করছো ,রায়হান! মাসুদ আংকেল কি বললো না বললো সেটা ব্যাপার না! সত্যি কথা হচ্ছে তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো। উনি চোর হোক আর যা হোক উনি তোমার ব্যাপারে যা বলেছে তার মধ্যে কোন মিথ্যে তো কিছুই বলেননি। তুমি ভাবনার সাথে কি করছো আমি মনে করেছো কিছু বুঝতে পারছিনা।
– আশা, মাথা ঠাণ্ডা করো। ভাবনা ম্যারিড, ওর একটা মেয়ে আছে। এসব আজেবাজে কথা বলে মেয়েটার সংসার ভাঙতে চাইছো কেনো? এসব কথা অন্য কারো কানে গেলে আমিও কারো সামনে মুখ দেখাবার উপযুক্ত থাকবোনা।
– আমিও সেটাই চাই। যারা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে তাদেরকেও আমি কষ্ট পেতে দেখতে চাই। আমার কেমন লাগছে এটা তোমাদেরও অনুভব করতে দেখতে চাই।
– আশা, প্লিজ! অযথা সন্দেহ করে নিজেও কষ্ট পেওনা আর আমাকেও এভাবে ঝামেলায় ফেলোনা। কোথায় তুমি আর কোথায় ওই ভাবনা? কার সাথে তুমি নিজেকে মিলাচ্ছো ?
– ভাবনাকে আমার সামনে হেলাফেলা করছো অথচ আমার পেছনে ঠিকই তার সাথে রসিয়ে রসিয়ে প্রেমালাপ কর! লজ্জা করেনা তোমার? আমি সেদিন ইচ্ছে করেই দেরি করে গিয়েছি তোমারা কী করো সেটা দেখতে!
– কি দেখলে? প্রেমালাপ করছিলাম কি?
– তা নয়তো কী? দাঁত বের করে হাঁসতেও দেখেছি দুজনকে। আমি অফিসেও দু একজনের কাছে খোঁজ নিয়েছি। সুযোগ পেলেই তুমি ওকে তোমার কেবিনে ডাকো। ভেবেছো আমি কিছুই টের পাচ্ছিনা ! সামান্য সহকারী হিসাবরক্ষক কী করে সহকারী ব্যবস্থাপক হয়ে যায় সেটা মনে করেছো আমি বুঝিনা? সবই বুঝি! শুধু আমিই না । অফিসের সবাই পেছনে পেছনে তোমাদের নিয়ে গসিপ করে। ছিঃ!
– অফিসের কে কি বলে সে নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। তুমি কি করে এমন ভাবছো সেটা ভেবে অবাক হই। হ্যা, ভাবনাকে আমি কেবিনে ডাকি তবে অফিসিয়াল কাজের জন্য; প্রেমালাপের জন্য না। উনি কাজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। এসব বাজে চিন্তা আমার মত তারও নেই। কাজকর্মে সিরিয়াস বলেই তার যোগ্যতা বলে সে আজ এসিসট্যান্ট ম্যানেজার। আমি তাকে একবিন্দুও ফেভার করিনি।
রায়হান এগিয়ে এসে আশাকে পাশে বসিয়ে আস্তে করে বলল, আশা, প্লিজ! এই ব্যাপারে আর কথা বাড়িওনা। তুমি ভাবনাকে দেখতে চেয়েছো আমি তোমাকে দেখিয়েছি। তোমার কেন মনে হয় আমি ভাবনার প্রতি দুর্বল। উনার সাথে অফিসিয়াল কথার বাইরে কোনো কথাবার্তা হয়না আমার। আমার সাথে ওখানে খুব হেজিটেশান ফিল করছিল উনি। তাই টুকটাক পারিবারিক কথাবার্তা হয়েছে; এই যেমন উনার মেয়ে কিসে পড়ে , হাসবেন্ড কী করে এসব নিয়ে । এছাড়া কোন কথাই হয়নি।
– হলেও নিশ্চয়ই আমার কাছে বলবেনা।
– আশা, প্লিজ! তুমি এসব কবে বন্ধ করবে? কথায় কথায় এভাবে আমাকে সন্দেহ করাটা আমি আর নিতে পারছিনা। যার কাছে তোমার মত স্ত্রী আছে তার কেনো বাইরে কারো কাছে যেতে হবে?
– রিমির সাথে যখন অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছিলে তখনও কি একথা মনে ছিল তোমার?
– আশা! তুমি এই ব্যাপারটা আর কতবার মনে করিয়ে দিবে? যতবার ভুলতে চাই ততবারই তুমি মনে করিয়ে দাও।
– কারণ একথা কিছুতেই ভোলার নয় , রায়হান! যাকে পাগলের মত ভালোবেসে আমি বিয়ে করেছিলাম, সেই মানুষ আমার সাথে এমন কী করে করেছে ? আমি এটা আমৃত্যু মনে রাখবো ,রায়হান।
– যা হয়েছিলো তুমিও তার জন্য কম দায়ী না। তুমি যদি তখন আমাকে রেখে ওভাবে মাসের পর মাস দূরে চলে না যেতে তাহলে আমিও তোমার শূণ্যতায় বিধ্বস্ত হয়ে এমন ভুল পথে বা বাড়াতাম না। আমিও মানুষ! মানুষ মাত্রই ভুল করে । আমিও ভুল করেছি। সেই ভুলের মাশুল আমি এই তিন বছর ধরে দিয়ে যাচ্ছি। পাগলের মত তোমার সান্নিধ্যে আসার জন্য চেষ্টা করছি। তোমার মন জয় করার জন্য আমি সবকিছু করার চেষ্টা করি যা তুমি পছন্দ করো। কিন্তু তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটল। তুমি আমার সংসারে ফিরে এসেছো ঠিকই। কিন্তু, আমার জীবনে ফিরে আসোনি। আমি কী এত বড় অন্যায় করে ফেলেছি যে তুমি কোনোভাবেই তোমার যোগ্য ভাবতে পারছোনা আমাকে?
– আমি কি করে একটা বিশ্বাসঘাতককে বিশ্বাস করবো ,বল! জীবন থাকতেও ভুলতে পারবেনা।
– কারণ তুমি সাইকোতে পরিণত হয়ে যাচ্ছো দিনদিন! পাগলের মত তোমাকে আমি ভালোবাসি আর সেই আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারছোনা। সম্পর্কটাকে যতই চেষ্টা করি স্বাভাবিক করতে তুমিই ততই জটিল করে তুলছো। আর অযথা আমাকে সন্দেহ করে করে দূরে ঠেলে দিচ্ছো । এটা জীবন , আশা। এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারেনা। হয় তুমি পাগল হয়ে যাবে নয়তো আমি। কতবার বলেছি আমি ভুল করেছি , আমি শুধরে গেছি কিন্তু তোমাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই।
– – এটাই বাকী ছিলো বলতে! আমি সাইকো ! বাহ! এতদিন তো খুন করার প্লান করতে এখন আবার পাগল সাব্যস্ত করার ধান্ধায় আছো।
– আশা! চিৎকার করে উঠলো রায়হান!
– চিৎকার করছো কেনো? অস্বীকার করতে পারবে বাসার কাজের মেয়ের সাথেও তোমার ফষ্টিনষ্টি ছিলোনা। ওকে দিয়ে আমাকে মারানোর চেষ্টা করোনি?
– আল্লাহ! আমি পাগল হয়ে যাবো। একটার পর একটা এমন মিথ্যা অভিযোগ ! আর হজম করতে পারছিনা। সারাদিন অফিসের নানান ঝামেলা পোহানোর পরে তোমার এই অত্যাচার আর নিতে পারছিনা। জানিনা এখান থেকে আমার আদৌ মুক্তি মিলবে কিনা!
– হাহাহা! এজন্যই কি ভাবনাকে গুছিয়েছো? আমার থেকে মুক্তির আশায়? এটা পসিবল নাহ, মি রায়হান! আমি যতদিন জীবিত আছি অন্ততপক্ষে ততদিন না! ওই ভাবনার কী করতে হবে সে আমি দেখছি। ওকে সাইজ করা আমার ওয়ান টুর ব্যাপার!
তুমি কিছুই করবেনা ওর জানি।
– কতবার বলবো, ভাবনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ভাবনার সাথেই কেনো কারো সাথেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
রায়হান খানিকটা নরম হয়ে আশাকে কাছে টেনে নিয়ে বসিয়ে বলল,
– আশা , তুমি আমার স্ত্রী। তোমার স্থান আমার জীবনে কোথায় কেনো বোঝনা? আমি তোমাকে চাইলেই জোর করতে পারতাম, কিন্তু তা না করে তোমাকে পাবার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছি ।তোমার মন জয় করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তুমি কিছুতেই আমার মন পড়তে পারছনা। ম্যারিটাল লাইফ সুখময় হয়ে উঠে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান , ভালবাসা ও সহমর্মিতার উপর ।একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, ভালবাসা ও সহানুভূতি যত গভীর হয়, দুজনের বন্ধনটাও তত দৃঢ় হতে থাকে। আর যখনই এই বিশ্বাস ও ভালবাসার বদলে সম্পর্কের মাঝে অনুপ্রবেশ করে অবিশ্বাস আর সন্দেহ তখনই দুজনের মধ্যে বাড়তে থাকে দুরত্ব। যার ফলাফল আমরা টের পাচ্ছি দিনের পর দিন। আমাদের এতদিনের তিল তিল করে গড়ে ওঠা সুখ নিঃশেষ করার জন্যে এই সন্দেহই দায়ী। সন্দেহ নানারূপে আমাদের সম্পর্কে প্রবেশ করেছে। এটা যে হারে দিন দিন বেড়েই চলছে তাতে আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ। তুমি প্লিজ ,আমার কথা শোন! ডঃ ফারুকের কাছে চল। একবার দেখাতে অসুবিধা কি! তুমি বিশ্বাস করো তোমার ভালো না লাগলে আমি তোমাকে দ্বিতীয়বার জোর করবোনা।
– অসম্ভব! আমি কেনো পাগলের ডাক্তারের কাছে যাবো? আমি পাগল না!
– তুমি পাগল হতে যাবে কেনো? উনি পাগলের ডাক্তার না। তুমি চল! মাত্র একবার! বললাম তো এরপর ভালো না লাগলে আমি আর কখনো বলবোনা। আমাদের ছেলেমেয়ের ফিউচারের কথা ভেবে হলেও অন্ততপক্ষে রাজী হও। অফিস শেষে আমি আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। তুমি তৈরী থেকো।
– নেভার! নিজের দোষ ঢাকতে তুমি এভাবে আমাকে পাগল ব্লেম করতে পারোনা। তোমাকে আমি বিশ্বাস করিনা। কি জানি নতুন কোন পায়তারা করছো?
– কি করলে বিশ্বাস করবে?
– তুমি ওই ভাবনাকে বের করে দিবে। তবে বুঝবো তুমি সত্যি বলছো। আমি বুঝতে পারবো ওর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।
– আশা! একটা নির্দোষ মানুষকে বারবার কেনো টানছো?
– দেখলে তো !
– কী দেখবো! উনি আমাদের কোম্পানীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া উনি নিজ যোগ্যতায় এই পজিশানে। উনাকে আমি কি বলে বের করবো?
– টাকা হলে এমন হাজারটা ভাবনা মিলবে। তুমি মালিক! চাইলেই যে কোনো বাহানা বের করে ওকে বের করে দিতে পারো।
– একজন নিরপরাধকে বিনা কারণে আমি শাস্তি দিতে পারবোনা , সরি! তোমাকে আমি যতই বোঝাই লাভ নেই। একজন বাইরের মানুষ তার স্বার্থসিদ্ধি করতে তোমাকে আমার নামে উসকে দিয়ে গেলো অমনি তুমি সত্যি মিথ্যা কিছু না জেনে নাচতে শুরু করেছ। ডিসগাস্টিং!
– হাউ ফানি! আমি ডিসগাস্টিং? কে ডিসগাস্টিং নিজের কাছে জিজ্ঞেস করো। উত্তর পেয়ে যাবে। তাহলে এ ব্যাপারে তোমার সাথে আর কোনো কথা নেই। যা করার আমিই করবো। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। তুমি থাকো তোমার ভাবনার ভাবনায় ডুবে। তোমাকে শায়েস্তা আমিই করবো। আগে যেমন করেছি।
– উহ! ঘুরে ফিরে সেই এক জায়গায়। এতক্ষণ বকবক করাটাই বৃথা!
আবিরের সাথে ভাবনার আজকাল বেশ ভালো যাচ্ছে। ভাবনার সাথে প্রাণখুলে গল্প করে সে। ঠিক যেন সেই আগের দিনগুলির মত! ভাবনার খুব ভালো লাগছে । আবির অফিস থেকে ফিরে ভাবনার পাশে বসে। সারাদিন অফিসে কী করল কী না করল জিজ্ঞেস করে। নিজেও আগ বাড়িয়ে অনেক কথা বলে। ভাবনা যেনো স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক, অবশেষে আবির ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে। এমনটাই তো চেয়েছিলো সে। এতদিন আবিরের এমন আচরণে তার দম বন্ধ হয়ে আসতো।
আজ ছুটির দিন। আবির ভাবনা আর তাদের মেয়ে জারাকে নিয়ে হাতিরঝিলের ওইদিকে ঘুরতে বেরিয়েছে। অনেকদিন পরে বিকেলটা স্বপ্নের মত কাটলো যেন তাদের। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। আবিরের হাত চেপে ধরে ভাবনা বলল, এমন দিনের প্রতীক্ষা সেই কবে থেকে করছি। ভেবেছিলাম আর বুঝি জীবনে এই রঙ্গিন দিন আমাদের আসবেনা। আল্লাহর অসীম রহমত! তুমি আবার বদলে যাবেনা তো আবির?
– একদমই না। আমিও এই সময়গুলিকে খুব মিস করেছি ভাবনা। আমি নিজের ভুলগুলিকে ধরতে পেরেছি। আমি তোমার এই হাসিমুখখানি যেকোন মূল্যে সারাজীবন ধরে দেখতে চাই।
– আমিও চাই আবির!
রাতে ডিনারের উদ্দ্যেশ্যে পাশেই একটা বেশ ভালো মানের রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। খাবারের অর্ডার দিয়ে ভাবনা আর আবির মুখোমুখি টেবিলে বসে আছে । জারা প্লে জোনে ওর সমবয়সী আরো কয়েকটি বাচ্চার সাথে খেলা করছে। জারাও আজ খুব খুশি। অনেক দিন পরে বাবা মায়ের সাথে বাইরে এসেছে সে। মা মেয়ে প্রায়ই এমন রেস্টুরেন্টে যায়। মেয়েকে খুশি করতে ভাবনা এমন বাইরে নিয়ে এলেও আবিরের অভাবটা যে তার মত জারাও খুব বোধ করতো এটা ভাবনা বুঝতো। আজ মেয়ের উচ্ছলতা দেখে সে খুব বুঝতে পারছে কেমন লাগছে জারার । মনে মনে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে মহান রবকে আবিরের মাথায় এমন সুবুদ্ধি দেবার জন্য।
জারার দিকে তাকিয়ে আবির বলল, দেখেছো! আজ জারা কত খুশি! বাইরে এসে ওর সমবয়সী বাচ্চাদের পেয়ে ওর পুরো চেহারাই চেঞ্জ! ও একা একা বাসায় থাকতে থাকতে দিনদিন কেমন মন মরা হয়ে যাচ্ছে। ওর একজন সঙ্গী দরকার , তাইনা! মেয়েটা সারাদিন বাবা মা কাউকেই পায়না। ওর কেমন লাগে সেটা বুঝি। আমরা আমাদের শৈশব কৈশোর মায়ের আঁচলে কাটিয়েছি। কত আবদার , কত আদর ,শাসনে খোলা মাঠে ,প্রান্তরে হেসেখেলে মানুষ হয়েছি। অথচ আমাদের মেয়ে বন্দীর মত নিঃসঙ্গ ভাবে বড় হচ্ছে। মাঝেমাঝে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হয়।
– সবার জীবন এক রকম হয়না, আবির! যে পরিবেশে যার জন্ম সে সেখানেই মানিয়ে যায়। জারা শিখে যাচ্ছে। তুমি অযথা চিন্তা করোনা। পারলে বাসার পরিবেশ স্বাভাবিক রেখো। দেখবে সব ঠিক আছে।
– আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, হুম! এটা ঠিক বলেছো ! খাঁচায় বন্দী পাখি মুক্ত হাওয়ার মর্ম কী করে বুঝবে? জন্ম থেকেই জারা অভ্যস্ত এমন করে থাকতে। অযথাই চিন্তা করছি হয়তো!
ভাবনা আবিরের এমন কথাবার্তার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছেনা। কী বোঝাতে চাচ্ছে সে? এই হঠাৎ পরিবর্তনের কোনো মানে নেই তো!
– আচ্ছা, ভাবনা !
– হুম, বল!
– আমরা একটা কাজ করতে পারিনা! জারার জন্য একজন সঙ্গী নিয়ে আসতে পারি। ওর তো ছয় পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনই উপযুক্ত সময়। আমরা আরেকটা বাচ্চা নেই, কি বল!
ভাবনা এতক্ষণে আবিরের এমন ভোল পাল্টানোর কাহিনী ধরতে পারলো। সে নিজে থেকেও মনে মনে প্লান করে রেখেছে আরেকটা বাচ্চা নেবার জন্য। কিন্তু আবিরের ব্যবহার দেখে এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলার সাহস পায়নি। তার এতক্ষণের সব খুশি এক মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেলো। আবির বাচ্চা নেবার কথা বলতেই পারে। কিন্তু এত নাটক সাজিয়ে বলার কী দরকার! ভাবনার সাথে সহজ করে কথা বলা কী আবির ভুলে গেছে? এই কদিনের ভালোবাসা তবে সবই তাকে দেখানো কী? আবিরের মূল উদ্দেশ্যই হলো ভাবনাকে ঘরবন্দী করা। ভাবনার চোখ ভিজে এলো। আবির কি তবে সত্যিই আর আগের মত হবেনা?
– কি ব্যাপার! কথা বলছোনা যে? আমি কি অন্যায় আবদার করে ফেলেছি?
– আবির, এটা রেস্টুরেন্ট! আশেপাশে নানান জনে আমাদের ফলো করছে। কী বলছি না বলছি শুনছে। মুখ টিপে হাসছেও হয়তো কেউ। ভাবছে রেস্টুরেন্টকে বেডরুম করে ফেলেছি । তাই এসব কথা বাসায় যেয়েও আলাপ করা যাবে। এটা বলার জন্য উপযুক্ত স্থান না। খাবার চলে এসেছে । তুমি জারাকে নিয়ে এসো। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। দ্রুত বাসায় যেতে চাই। তাছাড়া জ্যামের ব্যাপারটা ভুলে যেওনা। জারা বমি করে কিন্তু।
আবির খানিকক্ষণ চুপ মেরে থেকে হয়তো ভাবনার মন পড়ার চেষ্টা করছে। জারাকে আনার জন্য উঠে পড়লো।
পরেরদিন হাজার চেষ্টা করেও আশাকে ডঃ ফারুকের কাছে নিতে পারলোনা রায়হান। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে একাই তার চেম্বারে গেলেন।
কিছু সময় বাদেই আশার সিরিয়াল এলো। রায়হান ভেতরে প্রবেশ করেই তাকে জানালো পেশেন্টকে আনতে পারেনি। এজন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করছে সে। ডাক্তার সাহেব মৃদু হেসে বললেন, এমন কেস আমার জন্য নতুন না। আপনি বসুন প্লিজ! সাইকাট্রিস্ট নাম শুনলেই পেশেন্ট মনে করে তাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। মানুষের এই মন বড় বিচিত্র! সেটাও ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। তারও যে একটু সেবা শুশ্রূষার প্রয়োজন এটা কেউ সহজে মানতে চায়না। যুগ পাল্টেছে, মানুষ আধুনিক হচ্ছে কিন্তু নিজেদের মধ্যের কিছু ভ্রান্ত ধারণা কিছুতেই ছাড়তে পারেনা।
– ইয়েস , সেম ঘটনাই ঘটেছে আমার সাথেও। আমার ওয়াইফকে কিছুতেই কনভিন্স করতে পারলাম না। অবশেষে একাই চলে এসেছি। এত ব্যস্ততার মাঝেও আপনার মূল্যবান সময় আমাদের জন্য বরাদ্দ করেছেন। না এলে কেমন হয়!
– ব্যাপার না। আপনি এসেছেন তাতেই অনেক। পেশেন্টের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবো আপনার থেকে। উনার হিস্ট্রি আমি এতক্ষণ দেখলাম। উনার মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা অনেক বেশি ছেয়ে গেছে। যেটা স্বাভাবিক মাত্রাকে ছাড়িয়ে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌছে গেছে।
– অস্বাভাবিক মানে! আমার স্ত্রী এখন আমাকে তার জানের শত্রু ভাবে। যাকে আমি প্রাণাধিক ভালোবাসি সে ভাবে আমি তাকে মেরে ফেলবো। বাইরে থেকে দেখলে কেউই বুঝবেনা আশা অসুস্থ! খুব সুখী কাপল ভাবে সবাই। বাচ্চাদের সাথেও ঠিক আছে।সব গোলযোগ আমার সাথে। মানছি আমি একবার ভুল করেছি । তাই বলে তার মাশুল এত বেশি?
– আপনার স্ত্রীর বিষয়টা আমার ফ্রেন্ড ডঃ আতাউল আগেই বুঝিয়ে বলেছে। আপনারা ওর আত্মীয় মানে আমারই আত্মীয়। তাই ফ্রাংকলি বলছি! ইংরেজিতে এই অসুস্থ পর্যায়ের সন্দেহের নাম ডিলিউশন প্যারানয়েড সাইকোসিস এবং মরবিড জেলাসি। এই অসুস্থ সন্দেহের পেছনে না থাকে কোনো বাস্তব প্রমাণ, না থাকে কোনো যৌক্তিক কারণ। তবে ব্যক্তির মনের মধ্যে এই সন্দেহ মাসের পর মাস বেঁচে থাকে অটলভাবে। সাধারণভাবে সন্দেহকে আমরা সাসপিশাসনেস বলে থাকি, যা যেকোনো মানুষের মধ্যেই আসতে পারে যেকোনো সময়ে এবং যেকোনো কারণে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে সুস্থ এবং অসুস্থ পর্যায়ের এই সন্দেহপ্রবণতা দেখা যায়। প্রথমত একজন নারীর সঙ্গীকে নিয়ে সন্দেহ হতে পারে, বিয়ের আগে প্র্রেমের সময় আবার বিবাহিত জীবনেও। বিয়ে-পূর্ববর্তী সময়ে সন্দেহ আসার সুযোগ অনেক বেশি থাকে, আবার তা শেষ করে ফেলারও সুযোগ থাকে। কেননা তখন পর্যন্ত তারা তাদের সম্পর্কে কোনো আইনগত বা সামাজিক রূপ নেয়না। তবে বিয়ে-পরবর্তী যে সন্দেহ জন্ম নেয়, তা শুধু দুজনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নয়, বরং সংসার জীবন, সন্তান যদি থেকে থাকে তাছাড়া পারিপার্শ্বিক সব দিককেই প্রভাবিত করে। স্ত্রীর সন্দেহের শিকার হতে গিয়ে কিছু কিছু পুরুষ প্রচণ্ড রেগে যান, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন, গালিগালাজ ও ভাঙচুর করেন। এমন কি সম্পর্কই নষ্ট হয়ে যায়। আবার কখনো কখনো ঠাণ্ডাভাবে প্রমাণ সহকারে বোঝানোরও চেষ্টা করেন। যেটা আপনি করছেন।
কিছু পুরুষ তার স্ত্রীর সন্দেহের ফলে নিজে প্রথম দিকে সন্দেহের কোনো কাজ শুরু করলেও তাড়াতাড়ি তা গুটিয়ে নেন। অর্থাত্ স্ত্রীর সন্দেহ বাড়তে দেওয়ার রাস্তা বন্ধ করে ফেলেন। আবার কিছু পুরুষ অতি সাবধানী হয়ে ওঠেন এবং নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
যাই হোক, অনেক কথা বললাম। আসল কথা বলা যাবে পেশেন্টকে দেখার পরে। আপনি চাইলে আমি নিজে একদিন আপনার বাসার মেহমান হতে চাই। উনাকে কোনোভাবেই বলবেন না আমি উনার ডাক্তার। আমাকে আপনার ফ্রেন্ড পরিচয় দিয়েই ডাকবেন। যেহেতু উনি আসতে চাইছেন না! তাই বলছি, যে যেমন তার সাথে সেভাবেই ডিল করতে হয় ,জানেনই তো!
– অফ কোর্স! চির কৃতজ্ঞ থাকবো ! কবে সময় হবে বলুন!
– আমি আপনাকে ফোনে জানাবো। আমার নাম্বার অবশ্যই অন্য কোন নামে সেভ করবেন। সন্দেহবাতিকগ্রস্তরা সবকিছুতেই সন্দেহ করে।
– অবশ্যই। মেনি মেনি থ্যাংকস, স্যার!
– ইটস মাই প্লেজার এন্ড মাই ডিউটি, মিঃ রায়হান।
চলবে…
বিঃদ্রঃ মাঝখানে নেটওয়ার্ক প্রবলেম এবং আরো কিছু ব্যস্ততায় এই গল্পটা লিখতে গিয়ে খুব অনিয়মিত হয়ে পরেছি। ক্ষমা চেয়ে লজ্জিত করতে চাইনা আপনাদের। গতকাল কিছুটা সময় পেয়ে প্রায় দুইটা পর্ব লিখে ফেলেছিলাম। কিন্তু ওই যে নিয়তি! কী যে হলো বুঝতে পারছিনা। আমার অসাবধানতার জন্য ল্যাপটপ থেকে পুরো ফোল্ডারসহ গায়েব। মেয়েটা হয়তো কার্টুন দেখতে যেয়ে উল্টাপাল্টা না বুঝে চাপ দিয়ে মুছে ফেলেছে। রাগে আর লিখতেই বসিনি। একটা বিষয় অনেক চিন্তা করে গুছিয়ে লিখতে হয়, সেটা আবার নতুন করে রিপিট করতে আমার খুব বিরক্তি লাগে । এমন আগেও হয়েছে আমার সাথে। ব্যাড লাক! যাই হোক , পরে ভাবলাম আমার পাঠকদের এভাবে অপেক্ষায় রেখে খুব অন্যায় করছি। তাদের কী দোষ? আবার লিখতে বসলাম । মাত্র শেষ করলাম।এ জন্য এত রাতে পোস্ট করলাম। রাগ করছেন সবাই খুব, আমি জানি! খুবই দুঃখিত!
এত দেরী করে পর্ব দেয়ার পরেও যারা সাথে আছেন তাদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আর শুভকামনা প্রিয় পাঠকেরা।
পর্ব- ১১
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/257226436060033/