নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব-১
অনেকটা বাধ্য হয়েই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে ভাবনা। বিবিএ শেষ করার সাথে সাথেই কোনো ধরনের সুপারিশ ছাড়া নিজ যোগ্যতায় ব্যাংকের চাকরিটা পেয়েছিল সে। আজ যখন রেজিগনেশন লেটারটা জমা দিচ্ছিলো কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল তার। অনেক চেষ্টা করেছিল চাকরিটাকে যাতে না ছাড়তে হয় কিন্তু সম্ভব হলো না। দুই বছর বয়সের ফুটফুটে শিশু জারার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টগুলোর গলা চেপে ধরে চাকরিটাকে ছেড়ে আজ যখন সে বাসায় ফিরছিল নিজেকে খুব বেশি অসহায় মনে হচ্ছিলো ।
বাসায় এসে আজ তেমন কিছু রান্না-বান্না আর করলোনা। আলু ভর্তা আর ডাল ভর্তা। আবির খাবার টেবিলের এই বেহাল দশা দেখে ভাবনার দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা যেন নিমিষেই পড়ে ফেলল।
— এত মন খারাপ করছো কেন? তুমি ভালো ছাত্রী। জব আবার পেয়ে যাবে। মেয়েটা একটু বড় হোক। তুমি আবার জব করতে পারবে। একদম টেনশন করো না।
ভাবনা কোন কথা বলছে না দেখে সে আবার বলল,
— দেখো, আমি এমবিএ কমপ্লিট করেও কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে জবটা পেয়েছি। আর তুমি বিবিএ কমপ্লিট করতে না করতেই চাকরি পেয়ে গিয়েছো। তোমার ব্রেইন শার্প। তুমি চাইলেই আরেকটা ভালো জব জোগাড় করতে পারবে।
— টেবিলে খাবার দেওয়া আছে খেয়ে ফেলো। আমি একটু ঘুমাবো, প্লিজ। তাছাড়া বাবুকেও অনেক কষ্ট করে এতক্ষণে ঘুম পাড়িয়েছি। কথা বললে হয়তো জেগে যেতে পারে। আর আমিও একটু ঘুমাবো, প্লিজ!
কিছুটা ভাবলেশহীনভাবে কথাগুলো বলল ভাবনা।
– তুমি খাবেনা?
– নাহ!
আবির ভাবনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আর কোন কথা বাড়ালো না।
ভাবনা চোখ দুটো বন্ধ করতেই চোখের কোনায় চিকচিক করে উঠলো নোনা জল। স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হাতড়াতে ফিরে গেলো সেই শুরুর দিনগুলিতে।
ভাবনা আর আবির একই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে। আবিরের চেয়ে দুই ব্যাচ জুনিয়র ছিল ভাবনা। ভাবনা পড়াশোনার ক্ষেত্রে রেজাল্টের দিক দিয়ে সবসময়ই আবিরের থেকে এগিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পা রাখতে না রাখতেই থার্ড ইয়ারের আবিরের সাথে কীভাবে যেন এক সুতোয় গেঁথে গেল তার চলার পথ। টানা চারটা বছর প্রেম করার পরে ভাবনা পরিবারের সম্পূর্ণ অমতে আবিরকে বিয়ে করে। আবিরের পরিবারের অবশ্য অমত ছিলনা। তারা খুশি মনেই ভাবনাকে মেনে নিয়েছেন।
আবির তখন সবে মাত্র চাকরীতে ঢুকেছে। ওদিকে ভাবনার বাসায় চলছে তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় প্রস্তুতি! ভাবনা খুব ভয় ভয় মনে আবিরের ব্যাপারটা জানায় তার বাসাতে।
আবিরের কথা বললে তার পরিবারে কি প্রতিক্রিয়া হবে এটা ভাবনা আগে থেকেই জানতো। এ জন্যই বলতে খুব ভয় হচ্ছিল তার। এমনটা অবশ্য করারই কথা তাদের। তাদের পরিবারের সাথে আবিরের পরিবারের কোনো দিক থেকেই মিলেনা।
তিন মেয়ের বাবা হেলাল সাহেব একজন রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তা। উত্তরাতে নিজের একটা বেশ বড়সড় ফ্ল্যাট আছে। সেখানেই থাকেন তারা। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে উপযুক্ত বরের সাথে। বড় জামাই নিউরোসায়েন্সের একজন দেশসেরা ডাক্তার। মেজ জামাই বিশাল বড় ব্যবসায়ী। সেই তুলনায় আবির একদমই চুনোপুঁটি।
আবিরের পরিবার গ্রামে থাকে। গ্রামে কিছু জমি-জিরেত আছে। গ্রাম হিসেবে তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালই বলা চলে। আবিরের বাবা একটা এনজিওতে চাকরি করতেন। উনি এখন বেঁচে নেই। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় বোন স্কুল শিক্ষক আর ছোট বোন গৃহিণী। আবিরের ছোট ভাই আপন ওদের গ্রামের কলেজেই পড়াশোনা করছে।
ভাবনার কাছে আবিরের পরিচয় শুনে মেয়ের এমন নির্বুদ্ধিতায় খুব আহত হন হেলাল সাহেব। তার উপর ছেলেটা একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে মাত্র বিশ হাজার টাকা বেতনে মার্কেটিং অফিসার পদে চাকরি করছে।
তাছাড়া একাডেমিক ক্যারিয়ারের দিক থেকেও আবিরের তুলনায় ভাবনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল । ভাবনার রেজাল্টকে বলা যায় সেরাদের সেরা। সেই তুলনায় আবিরের রেজাল্ট কিছুই না, মধ্যম মানের বলা চলে। মেয়ের মুখে আবিরের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ছেলেটাকে শুধু একবার দেখার সাধ হল হেলাল সাহেবের যে কি দেখে তার বুদ্ধিমতি মেয়ে এমন ছেলের প্রেমে পড়েছে? আবির ছেলেটার মধ্যে কি এমন আছে যার জন্য তার সর্বগুণে গুণান্বিতা চৌকষ মেয়ে পাগল!
ভাবনার পীড়াপীড়িতে হেলাল সাহেব আবিরকে ডাকলেন দেখা করতে। মাত্র দশ মিনিটের সাক্ষাৎকারে হেলাল সাহেবের কাছে মনে হল ছেলেটা দেখতে শুনতে ভাল। কথাবার্তা বলার ধরনও বেশ মার্জিত। হয়তো এটা ছাড়া আর কোনোকিছুই তার মেয়ের উপযুক্ত মনে হয়নি। অন্ততপক্ষে তার বড় দুই জামাইয়ের থেকে দেখতে-শুনতে আবির অনেকাংশেই এগিয়ে। কিন্তু তাতে কি? জীবন সাথী নির্বাচনে শুধু এটা কোনো মাপকাঠি হতে পারেনা।
সে তার মেয়েকে বোঝালো জীবন আবেগ দিয়ে চলে না। বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে যেদিন সেদিন বুঝবে। হেলাল সাহেব ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো তার কথা বোঝার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভাবনার মনের এবং ভালোবাসার জোর এত বেশি শক্তিশালী ছিলো যে পুরো পরিবারের মতামতকে উপেক্ষা করে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিল আবিরের জন্য।
তার পরিবারের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ভাবনা। বিয়ের আট মাসের মাথায় একটা প্রাইভেট ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে জয়েন করে ভাবনা।
ভাবনার বিয়ের বছর না গড়াতেই হঠাৎ তার বাবা হেলাল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই থেকে আজ অব্দি সে বিছানাতেই। হয়তো দেহের জোরের সাথে সাথে মনের জোরও হারিয়ে ফেলেছিলেন একজন বাবা। তাইতো সেদিন আদরের ছোট মেয়েকে আর ফিরিয়ে দিতে পারেননি সে। শত কষ্টের মাঝেও বাবা মেয়ের চোখের পানিতে মিলনের এক আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল।
আবিরের যে বেতন তাতে এই ব্যয়বহুল শহরে একটা ভালো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ভাবনাকে রাখার সামর্থ্য আবিরের নেই। তাইতো বিয়ের পরে তিন বেডরুমের একটা এপার্টমেন্টে এক রুম সাবলেট নিয়ে থাকতো আবির আর ভাবনা।
প্রথম প্রথম ভাবনার কাছে খুব খারাপ না লাগলেও মাস দুয়েক যেতে না যেতেই এই বাসাতে দমবন্ধ হয়ে আসতো ভাবনার। ছোট একটা রুমের মধ্যে থাকা খাওয়া সব। এমন পরিবেশে থাকার কথা কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এর থেকে ভালো পরিবেশের রাখার সামর্থ্য যে আবিরের নেই। প্রতিদিনই রান্নাঘরে চুলো নিয়ে, বারান্দায় কাপড় শুকানো নিয়ে, ঘরদোর ঝাড়ামোছা নিয়ে অন্য ভাড়াটিয়ার সাথে কিছু না কিছু শুনতে হতো ভাবনাকে। খুব কান্না পেত ভাবনার।
রুমে এসে দরজা লাগিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতোও সে। আবির অফিস থেকে ফিরলেই তাকে জড়িয়ে ধরে কষ্টগুলোকে মেলে ধরত আবিরের সামনে। কিন্তু ক্লান্ত আবিরের কাছে তখন এগুলি কেবল-ই অর্থহীন বকবক ছাড়া আর কিছুই মনে হত না। মার্কেটিং অফিসারের কাজ শুধু টার্গেটের পিছনে দৌড়ানো। টার্গেট ফিল আপ করতে না পারলে মাস শেষে বেতনের টাকাটা হাতে নেওয়াটাও যেন বেশ অন্যায়। প্রতিনিয়ত মালিকপক্ষ আর কাস্টমারের বকবকানি শুনতে শুনতে ঘরে এসে আবার বউয়ের বকবক কার কাছে ভালো লাগে! প্রথম প্রথম খুব বোঝাতো সে ভাবনাকে। সে নিজেও ভাবনার কষ্টগুলোকে বুঝতে পারত। ভাবনা বড় ঘরের মেয়ে। খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়েছে। এমন বদ্ধ রুমে সে যে থাকতে পারছে এটাই বড় কথা।
ভাবনাকে এমবিএতে ভর্তি হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করল আবির। হয়তো পড়াশোনার তালে থাকলে কিছুটা হলেও এদিক থেকে তার মনটা ঘুরে যাবে। কিন্তু ভাবনা আবিরের যে পকেটের অবস্থা দেখছে তাতে এক্সট্রা কোন খরচ তার ঘাড়ে ফেলতেই সাহস পাচ্ছে না। তাই আবিরকে বলে দিল এ বছরটা এমবিএতে ভর্তি হবে না সে। তার মন মেজাজ খারাপ। পড়াশোনা হবে না আপাতত । একদিকে বাবার বাড়ির সবার থেকে বিচ্ছিন্ন আরেকদিকে আবিরের এমন দৈন্যদশা আর তার উপর তার প্রতি আবিরের এমন অবহেলা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না ভাবনা। বারবার শুধু তার বাবার কথাগুলি মনে পড়ে তার। সত্যিই আবেগ দিয়ে কি আর জীবন চলে! শুধুমাত্র ভালোবাসাকে পুঁজি করেই সে আবিরের হাত ধরেছিল। ভাবনা মনেপ্রাণে চাইছে এই ভালবাসাটাকে পুঁজি করেই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে। কিন্তু হঠাৎ করে নিজের প্রতি যেন অবিশ্বাস বেড়ে গেল তার। সত্যিই তো মাত্র এই ক’মাসেই ভালোবাসা, আবেগ এত সস্তা হয়ে গেলো তাদের দুজনের কাছেই।
আগে তো আবির সুযোগ হলেই ভাবনাকে সাথে করে ছুটে বেড়াতো পাগলের মত। পকেটের অবস্থা খারাপ, টাকা নেই তাতে কি! দুজনে হাত ধরে হেঁটেছে মাইলের পর মাইল। কত আবেগ ভালোবাসা ছিল দুজনের। আবির কথা দিয়েছিল বিয়ের পরেও কোন কিছুই বদলাবে না। কিন্তু না! আবিরও অন্যদের মতো বদলেছে। খুব ক্লান্ত হয়ে সে যখন বাসায় ফিরে তখন তার চোখে কোন ভালবাসা খুঁজে পায়না ভাবনা। অগভীর দুটি চোখ। যে চোখের গভীরতা একদিন তাকে মুগ্ধ করেছিল সে চোখ জোড়া যেন এখন আর তাকে টানে না। সপ্তাহের একটিমাত্র ছুটির দিন তাও হয়তো অফিসের কাজের চাপের জন্য কোনদিন ঠিকমতো ভাবনার সাথে কাটাতে পারে না আবির। নতুন চাকরি। তাই চাইলেই মন মত চলা সম্ভব না। অনেক কাঠ-খড় পেরিয়ে এই চাকরিটা জুটেছে তাও যদি এবার হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে বউ নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে তাকে। ভাবনার কষ্টগুলোকে সে বুঝে। ভাবনার কোনো চাওয়া পাওয়াকেই সে পূর্ণ করতে পারছেনা। যদিও ভাবনার চাওয়া তার কাছে খুব বেশি কিছু নয়। দিন শেষে মিষ্টি হাসিতে একটু ভালোবাসা আর ভাবনার কষ্টগুলোকে খুব কাছ থেকে সন্তর্পনে ছুঁয়ে দেখা। কিন্তু তাতেও যেন সে অপারগ। সারাদিনের ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা তার আর ভাবনার ভালোবাসার মাঝে যেন এক বিশাল দেয়াল গড়ে তুলেছে যেটা সে চাইলেও ভেঙে ফেলতে পারছেনা ।
একসময় বৃষ্টি খুব ভালো লাগতো ভাবনার। আবির আর ভাবনা দুজনে মিলে কত বৃষ্টি উপভোগ করেছে। টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ ভাবনার খুব ভালো লাগে। আবিরদের গ্রামের বাড়ীতে টিনের চালার ঘর। ভাবনা কতবার অনুরোধ করছে আবিরকে, ” বিয়ের পর থেকেই তো কোথাও একদমই যাওয়া হয় না আমাদের। চলনা, এই বৃষ্টির সময়ে কটা দিন তোমাদের গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে আসি ”
আবিরের আর সময় হয়ে উঠে না। বৃষ্টির সিজন প্রায় শেষের দিকেই। ভাবনা এখন আর কিছুই বলে না তাকে। আবির যে ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছে তা না! সে ইচ্ছে করেই ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়ার ভান করছে। মাঝে মাঝে ভাবনার উপর খুব বিরক্ত হয় সে। মেয়েটা যে কেন বোঝেনা! চাইলেই কি ছুটি ম্যানেজ করা যায়!
টিপটিপ বৃষ্টির শব্দে ভাবনার মন উদার হয়, শহুরে মাটিতে বৃষ্টির ফোঁটা মিষ্টি একটা গন্ধ তৈরি করতে না পারলেও যে বিদঘুটে একটা ধুলোট গন্ধ সৃষ্টি করছে তাতেই যেন ভাবনা ডুবে যায় বৃষ্টিব্যঞ্জনায়! আকাশের ঘন কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে সে বলতে থাকে,
“মেঘ তুমি ফিরে যাও-
বৃষ্টি তুমি আর আমার ঘরে এসো না।
কারণ তোমাদের প্রণয় চিঠি দেখে দেখে
আমি খুব ক্লান্ত, বড্ড ক্লান্ত!
তুমি ফিরে যাও মেঘ!
ফিরে যাও!
যেতে যেতে তোমার প্রেয়সীকেও
সাথে নিয়ে যাও।”
বৃষ্টির ফোঁটার মতো তার চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা নোনাজল।
ভাবনা প্রতিদিনই চেষ্টা করতে থাকে নিজের সাথে যুদ্ধ করে আবিরের সাথে তার সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক রাখার। পরিবারের সবাইকে একপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই সে আবেগকে পুঁজি করে বিয়ে করেছে আবিরকে। সে সেখান থেকে কিছুতেই পিছু হটতে চায়না। জীবনের কাছে, নিজের কাছে হেরে চায়না সে!
আবিরকে জানিয়ে না জানিয়ে নানান জায়গায় সিভি ড্রপ করছে সে। ব্যাংকের এই পরীক্ষাটা দিয়েছিল সে বিয়ের কিছুদিন আগেই। হঠাৎ করে সেদিন মেইল চেক করতেই সে দেখতে পেল দু’দিন আগেই ব্যাংক থেকে একটা মেইল এসেছে। সে রিটেনেও পাশ করে টিকে গিয়েছে। ভাইভার জন্য ডাক এসেছে তার।
আবিরকে বলতেই আবিরও যেন ভাবনার মত খুশিতে গদ গদ। কিন্তু পরমুহুর্তেই যেন এক খন্ড কালো মেঘ এসে ভর করল আবিরের মুখে।
— কী ব্যাপার, তোমার মন খারাপ হয়ে গেল যে? তুমি খুশী হওনি?
হঠাৎ করে চোর ধরা পরলো এমন ভঙ্গিতে আবির বলল,
— কি বলছো! খুশি হব না কেন? খুশি তো হয়েছি। কিন্তু খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না। আমি আমার ওয়াদা রাখতে পারিনি। আজ তোমাকে আমার অপারগতার জন্য চাকরি করতে হচ্ছে।
— আরে বাবা! এখনো তো চাকরি হয়নি। চাকরি হওয়া তো এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
— তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। তুমি ভাইভাতেও টিকে যাবে।
— সত্যি? আমি তো খুব ভয় পাচ্ছি! যদি না হয়? জীবনে প্রথমবার ভাইভা দিতে যাচ্ছি। কিভাবে কি জিজ্ঞেস করে, কি উত্তর দিবো তুমি একটু আমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিবে, প্লিজ!
— অবশ্যই! তুমি একদম টেনশন করো না। তুমি ধরে রাখো তোমার চাকরি হয়ে গেছে।
আবিরের দেওয়া এই সাহসটুকুই ভাবনার সবচেয়ে বড় সম্বল। তার চোখজোড়া ভিজে উঠলো আবিরের এ কথায়। শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল আবিরকে। আবিরও তার দু’বাহু প্রসারিত করল ভাবনার জন্য।
অনেকদিন পর আবিরকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো ভাবনার মন।
সত্যিই আবিরের সেই সাহসটুকুকে পুঁজি করেই ভাইভাতেও টিকে গেল ভাবনা। যেদিন চূড়ান্ত রেজাল্ট আসলো ভাবনা যেন স্বপ্ন ডানায় ভর করে উড়ছে তখন।
দুজনের বেতন তখন একই সমান। দুজনে একসাথে অফিসের জন্য বের হয়। ভাবনার অফিস মতিঝিলে। আবিরের অফিস মিরপুর । বাসাটাও মিরপুর হওয়াতে আবির খুব তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে। বাসায় ফিরে একা একা কি করবে খুঁজে পেত না। ভাবনা এসে দেখত বেশিরভাগ সময়েই আবির ঘুমিয়ে পড়েছে। মতিঝিল থেকে ভাবনার ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত আটটা নটা বেজে যায়। এত জ্যাম পাড়ি দিয়ে অফিস থেকে ফিরেই কোমরে কাপড় গুঁজে রাতের খাবার রান্না করা, সকালের নাস্তার কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখা, পরের দিনের লাঞ্চ সবকিছু রেডি করতে করতে ভাবনার কি যে খারাপ অবস্থা হয়!
ইদানিং এটা খুব বেশী চোখে পড়ছে আবিরের।
মেসে থাকার সুবাদে টুকটাক কাজবাজ সেও পারে। ভাবনা অফিস থেকে ফেরার আগেই সে কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখে। ভাবনা অফিস থেকে ফিরে এটা দেখে মুখে আবিরকে বকাঝকা করলেও মনে মনে আবিরের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হয়।
আবির নাকি বউয়ের রোজগার খাবার আশায় ঘর গৃহস্থালীর কাজে ভাবনাকে সাহায্য করছে এমন কথা বলে হাসিঠাট্টার ছলে অপমান করতে ভুল করেনা ভাবনার সাথে থাকা ভাড়াটিয়া মহিলা। ভাবনার খুব কষ্ট লাগে, অপমানিত বোধ হয়। সে মনে মনে খুব চায় এ মহিলার থেকে দূরে যেতে।
হঠাৎ গ্রাম থেকে খবর আসে আবিরের মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আবিরের ছোট ভাই চিকিৎসার জন্য তার মাকে নিয়ে ঢাকাতে আসে।
বেশ কিছুদিন থাকতে হবে উনাদেরকে। বিয়ের পরে এই প্রথম ভাবনার সংসারে তার শাশুড়ি আর দেবর এসেছে। নিজে সারাদিন বাসায় থাকেনা। কীভাবে শাশুড়ি আর দেবরের সেবা যত্ন, আদর আপ্যায়ন করবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই যেনো ভাবনার। এক রুমে খুব গাদাগাদি করে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। ভাবনা তার শাশুড়িকে নিয়ে খাটে আর মেঝেতে আবির আর তার ছোট ভাই আপন ঘুমায়।
সারাদিন অফিস করে এসে বাসায় এসে কাজকর্ম করে হাঁপিয়ে ওঠে ভাবনা। আবির মেসে থেকেছে আগে। তাই এমন পরিবেশে ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা এটা ভাবনা বুঝতে পারে।
কিন্তু এই এতটুকু ঘরে তার শাশুড়িরও যে ওর মত খুব অসুবিধা হচ্ছে এটা উনাকে দেখলেই বুঝা যায়।
প্রথম মাসের বেতনের টাকাটা তুলে এনে সে আবিরের হাতে দিয়ে আবিরকে বলল,
— আবির, এই বাসাটা ছেড়ে দাও। আগামী মাসে নতুন ফ্লাটে উঠতে চাই। আর কোনো সাবলেট বাসা নাহ, প্লিজ!
ভাবনার শাশুড়ি অমনি বলে উঠলেন,
— বউ মা, আমার ছেলের বেতন কত জানা আছে তো তোমার?
— কেন থাকবেনা, মা!
— এই বেতনে আলাদা ফ্লাটে থাকতে চাও কোন সাহসে?
— কেনো মা? আমি তো ইনকাম করছি এখন। একজনের টাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে আরেকজনের টাকায় বেশ চলে যাবে আমাদের সংসার।
— বাহ! আবির আজকাল বউয়ের টাকায় সংসার চালাবে? ভালো তো!
— মা, এভাবে বলছেন কেনো? আমার টাকা কি আবিরের টাকা না?
আবির মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
— তা তো অবশ্যই। এজন্যই তো আজকাল দেখছি আমার ছেলে ঘরের মেয়েদের কাজকর্মও করছে। এতই পয়সা তবে একটা বুয়া রেখে নিলেই তো হয়! আমার ছেলেটা অনন্তপক্ষে ছোট হতোনা অন্যের সামনে!
— মা, আমরা সারাদিন বাসায় থাকিনা। বুয়া কাজ করবে কীভাবে? আর এতে অপমানের কি হলো, বুঝলাম না!
— মান অপমান বোঝার ক্ষমতা সবার থাকেনা। সোজা কথা আবির তোমার টাকায় সংসার চালাতে পারবেনা। তাহলে জীবনেও আমি আর ওর কাছে আসবোনা। কাজী বংশের ছেলে হয়ে কি করে এত ছোট হচ্ছিস, আবির! ছিঃ! ভাগ্যিস তোর বাবা বেঁচে নেই।
— মা, তাহলে আমি এই টাকা দিয়ে কি করবো?
— সেইটা তোমার ব্যাপার! তোমার কত শখ আহ্লাদ আছে। সেগুলি মিটাও। আমার ছেলেটা তো কিছুই দিতে পারছেনা তোমাকে। তাই বলে আমার ছেলেকে এত ছোট করোনা যে তোমার থেকে হাত পেতে তাকে বাজার সদাই করতে হবে।
আবিরকে চুপচাপ দেখে ভাবনার চোখ দিয়ে গলগল করে নোনাপানি বয়ে চলছে।
চলবে……