#নীরদের_বিষাদিনী-(৬)

“আমরা কেন ভালোবাসি ডাক্তার?এই অনুভূতি তো খুব ভয়াবহ।একদম শেষ করে দেয় সুন্দর মুহুর্ত, সুন্দর প্রাণকে।তবুও কেন ভালোবাসি ডাক্তার?”

রাফার অগোছালো প্রশ্ন শুনে নীরদ হাসলো।শীতল দেয়ালে পাশাপাশি দুজনে পিঠ ঠেকিয়ে আছে।ফ্ল্যাটের ভেতর হতে আত্মীয়দের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

“হঠাৎ এই প্রশ্ন রাফা?তুমি জানো কখনো আমি রিলেশন করিনি।তবে কীভাবে ভালোবাসা ব্যাখা করবো বলো?”

“অদ্ভূত কথা।রিলেশনে না জড়ালে ভালোবাসা হয়না বুঝি?”

“একপাক্ষিক ভালোবাসার কথা বলছো?”

রাফা ঠোঁট উল্টালো।কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ ফেলে শুধালো,

“ভালোবাসায় এক পাক্ষিক কিংবা দুই পাক্ষিক বলে কোনো শব্দ আছে?”

“পূর্ণতা কিংবা অপূর্ণতার ব্যাপার আছে।তুমি বুঝবেনা মেয়ে।”

নীরদের কণ্ঠের আকুলতা স্পষ্ট বুঝতে পারে রাফা।কিন্তু সে স্বৈরাচারিতা।একবার জীবনে ভুল করেছে।তাই বলে বারবার তেমনটা করবেনা।উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

“বুঝেছি আপনি আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিবেন না।তাইতো?”

“হতে পারে তোমার এই ভাবনা সঠিক?”

“আপনি এমন কেন ডাক্তার?”

“বড্ড নির্বোধ।”

“আমার কথা আমাকে?”

“তুমি শিখিয়ে দিলে একটু আগে।”

নীরদ আরো একবার হাসলো।অগোছালো রাফাকে আরো কয়েকগুণ এলেমেলো করে দিয়েও ক্ষান্ত হলো না।এই নির্জনে, আড়ালে পকেট থেকে একগোছা বেলী ফুলের মালা বের করলো।নীরদ কম্পমান হস্তে তা রমণীর সামনে এগিয়ে দিলো।পকেটের মধ্যে চাপা পড়ায় ইতিমধ্যে মালাটির অবস্থা ভ ঙ্গু র।ফুলের ছে দ ন অংশ মেঝেতে গিয়ে পড়ছে।রাফা অবাক হয়ে সেটি হাতের পিঠে জড়িয়ে নিলো।নীরদ তখন ভালোলাগার সর্বোচ্চ পর্যায়ে।অকস্মাৎ রাফা বলল,

“আমার ভয় হয় ডাক্তার।খুব ভয়।”

“ভয় ভাঙতে হবে।ডাক্তার কিন্তু খুব অভিমানী বিষাদিনী।”

“হলে হবে।কিন্তু আমি পারবো না।”

হাত থেকে বেলী ফুলের মালা অনাদরে মেঝেতে ফেলে ঘরের ভেতর দৌড়ে চলে গেলো রাফা।নীরদ শান্ত,দুঃখিত,আ হ ত মন নিয়ে পূর্বের ন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রাখলো।বহুদিনের পর আজ সাহস করে রাফাকে ভালোবাসার বিষয়টা বুঝাতে চেয়েছিল সে।কিন্তু তার বিষাদিনী কী করলো?উপেক্ষা করে চলে গেলো?মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষকে সুযোগ দেওয়া যায় কিন্তু নীরদ কে দেওয়া যায়না?সে কী এতোটা তুচ্ছ?এতো অবহেলিত।আর ভাবতে পারছেনা সে।অভিমানে জর্জরিত মনটাকে কোনোমতন টেনে ভেতরে প্রবেশ করলো।আজ এখান থেকে গেলে সে কখনো আর বিষাদিনীর দোরগোড়ায় ভালোবাসার ভিক্ষা চেয়ে আসবেনা।কখনো না।

(***)

কেটে গেছে ষড়ঋতুর সময়।এইতো কিছুদিন পূর্বে নাকের ডগা লাল হয়ে থাকা শীতল অনুভূতিকে ছাপিয়ে বসন্তের ঈষদুষ্ণ সমীরণ গায়ে মাখছে প্রকৃতি।কিন্তু রাফার মন থেকে নির্জনতা সরে যায়নি।আজ কতোদিন পর সে নীরদকে দেখলো?এক বছর?হ্যাঁ এক বছরই তো।কিন্তু সময়টা কেন রাফা মনে রেখেছে?কই আগে তো সময়ের পর সময় চলে যেতো কিন্তু দুজনের কথা হতো না।অকস্মাৎ রাফার অন্তর থেকে কেউ বলে উঠলো,

“তুই কী সেই আগের রাফা আছিস?এখন তো তোর নতুন রুপ।বিষাদের রুপ।বিষাদিনী হওয়ার লোভ জেগেছে মনে।”

অপর মন এই মনকে ধমকায়।শা স ন করে।তবে সে কী চুপ থাকবে?বিষাদের মলিনতার ছোঁয়ায় আজ যেন সব নতুন।নীরদ গম্ভীর মুখে রাফার পাশে এসে দাঁড়ালো।উষ্ণ হাতে পালস রেট চেক করতে করতে শুধালো,

“মেয়ে তুমি কাওকে শান্তি দিবেনা বলে পণ করলে নাকী?এই নিয়ে গত দুইমাসে দশ বার হসপিটালে এলে শুনলাম।এটা কী ঠিক বলো?কী এতো চিন্তা করো?”

পাশ থেকে আবিদা সুযোগ পেয়ে বলতে লাগলো,

“কতোকিছু ভাবে ও।জানিস নীরদ একদম খায়না।চেহারা দেখে মনে হয় ইউনিসেফের আশ্রয়ে বড় হওয়া বাচ্চা।এতো রোগা।আর জানিস কী করে?খালি পেটে ঘুমের ঔষধ খেয়ে সারাদিন ঘুমায়।”

“আন্টি ওকে বিয়ে দিয়ে দাও।সব ঠিক হবে।”

রাফা এখনও নীরদের পানে তাঁকিয়ে আছে।লোকটা কী বদলে গেলো?

“কী বলিস বিয়ে দিতে কতো চেষ্টা করেছি।শুন কয়দিন আগে একটা প্রোপজাল এসেছিল।ছেলে ব্যবসায়ী।উচ্চ শিক্ষিত।কফিশপে কথা বলতে ডাকলো।রাফা মণি খুব ভালোমতন গিয়ে কথা বলল।ছেলেটাও খুশিতে গদগদ হয়ে বলল আমি তোমাকে সুখ রাজ্য নিয়ে যেতে এসেছি।ব্যস,অমনি কী হলো কে জানে?ঠা স করে ছেলের মুখে বাটিতে গলে যাওয়া আইসক্রিম ছুড়ে মারলো।ছেলেটা কেন ওকে সুখের কথা বলল এই নিয়ে রাগ।সেই থেকে পাত্র দেখানো বন্ধ আছে।”

নীরদ শব্দ করে হাসলো।বিষাদ শব্দটিকে তাহলে মনে রেখেছে বিষাদিনী।অবশ্য রাফার ভাবান্তর হলো না।সে বেডে নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলো।নার্স এসে তার হাতে ক্যানোলা পরিয়ে দিচ্ছে।অতিরিক্ত টেনশন কিংবা বিষাদে রাফা শারীরিকভাবে খুব দূর্বল।ওজন কম হওয়ায় মুহুর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।এজন্য কম ডাক্তার দেখায়নি রোহান।কিন্তু লাভ হচ্ছে না।নার্সের কাজ শেষ হতেই এগিয়ে এলো নীরদ।রাফাকে দেখে অন্তঃকরণে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।এই মেয়েটা একদিন ঠিক বলেছিল।দুজনে বড্ড নির্বোধ।আবিদা নিজের মেয়ের গায়ে ভালোমতোন চাদরটা টেনে নিলো।ডান হাতখানা এখনও বাহিরে।

“তা নীরদ দেশে কবে ফিরলি তুই?তরীর মতো বাবা-মা কে ছেড়ে চলে গেলে হবে?”

চমকে গেলো রাফা।লোকটা এতোদিন দেশে ছিলনা?

“চারদিন আগে ফিরেছি আন্টি।আম্মু খুব কান্নাকাটি করতো।আমি জানতাম মা অনেক শক্ত।কিন্তু এখন দেখি সব অভিনয়।কতো নরম মনের মানুষ সে।”

আবিদা অভিমানের সুরে বলল,

“তোরা সন্তানরা কী বুঝবি?মায়ের মন বড় বিচিত্র।”

রাফা অনেকক্ষণ পর মুখ খুলে বলল,

“মা,আব্বু কিন্তু বাহিরে অপেক্ষা করছে।”

“চলে যাবো।”

“উহু,তুমি যাও।রাত বেশী হয়ে যাবে।”

আবিদা মেয়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।হসপিটালে সাথে থাকার নিয়ম নেই।নীরদ পাশে রাখা একগাদা ঔষধের মধ্যে কিছু একটা করছে।হুট করে রাফা শুধালো,

“আপনি এতোদিন দেশে ছিলেন না?”

হায় হায় করে উঠলো নীরদের মন।নারীটি কীনা এটাও খোঁজ রাখেনি?মুখে অন্যভাব নিয়ে বলল,

“নাহ।”

“অদ্ভূত।আমাকে কেউ বলেনি।”

“তুমি হয়তো জানতে চাওনি।”

রাফার হঠাৎ মনে পড়লো নীরদের অভিমানের কথা।আচমকা সে বড্ড শূন্য অনুভব করলো।এক বছরকে তুচ্ছ ভাবতে লাগলো।নীরদ তাকে ঘুমের ই ঞ্জে ক শ ন দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে থামিয়ে বলল,

“আমি তো ঘুমের ঔষধ খাই ডাক্তার।অভ্যেস হয়ে গেছে।পরিবর্তন করতে চাচ্ছি।”

নীরদ সন্দেহের সুরে বলল,

“বুঝিনি।তাছাড়া তো তুমি ঘুমাও না।”

রাফা মলিন কণ্ঠে বলল,

‘আমি ঘুমাতে চাই ডাক্তার।ঔষধ ছাড়া।”

কী সাবলীল আবদার বিষাদিনীর।নীরদকে মন থেকে নাড়িয়ে দিলো।এক বছরের অভিমান গলিত হয়ে সুখের নদীর রুপ ধারণ করলো।হাতে থাকা বস্তুটি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এলো সে।অতি সন্তপর্নে মেয়েটির কপালে হাত রাখলো।রাফা অসুস্থ দৃষ্টিতে বলল,

“আপনার জ্বর আসছে ডাক্তার।শরীর এতো গরম কেন?”

“উহু,আমার বিষাদ লাগছে বিষাদিনী।”

নীরদ অন্তত নিচুসুরে কথা বলল।যেন একথাটি সকলে শুনলে বড্ড বি প দ হয়ে যাবে।

চলবে।
লেখাঃ সামিয়া খান প্রিয়া

এডিট ছাড়া পর্ব।আমার চতুর্থ বই “পরব প্রিয়ার বেণী বাঁধন” বইটির প্রি-অর্ডার চলছে।সকলে চট জলদি অর্ডার করে ফেলুন।

সকলে রেসপন্স করবেন ঠিকমতো।ভালোবাসার ইমোজি তো রোজ দেন।আজ একটু গঠণমূলক কিছু লিখবেন।

ছবিয়ালঃ Surio Pintu

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here