#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৬

বাতাসে সুতীব্র মিষ্টি প্রেমের ঘ্রাণ। বিয়ে বাড়ির জামকালো আয়োজন। হরিদ্রাভ শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে একটুকরো শরীর। রেলিং বিহীন ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে এক হলদে নর। তাকে অনুসরণ করে এগোলে মিতালী। নিশ্চুপ পা ফেলে তার পেছনে দাঁড়ালো। অত্যল্প সময় স্থির থেকে জুতা খুলে তারই মতো পা ঝুলিয়ে বসলো। তবুও ভাবান্তর হলোনা নির্ভীকের।
প্রিয়ার বিয়েকে উপলক্ষ করেই দুজনের এখানে আসা। আগামীকাল প্রিয়ার বিদায়ক্ষণ। মিতালী ভাবলো নির্ভীককে এক অজানা সত্য জানানো প্রয়োজন। তাইতো নিরবতায় ছেদ ঘটালো। দূর আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিবদ্ধ করলো নির্ভীকের অল্পবয়সী যুবক চেহারায়। তার মধ্যে এখনো পৌরুষভাব, বলিষ্ঠ রূপের আগমন ঘটেনি। মিতালী তেজহীন গলায় শুধালো,

-“তোকে একটা সত্যি জানাতে চাই।”

এবার বোধহয় নির্ভীকের মনযোগ কাঁ*ড়তে পারলো সে। সত্যি জানার আগ্রহ দেখিয়ে চেয়ে রইলো নির্ভীক। নিষ্প্রভ কন্ঠে মিতালীর জবাব,

-“প্রিয়া তোকে ভালোবাসে।”

নির্ভীক ভীষণরকম চমকালো। সাথে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো বোধহয়। কেননা, সে যে অন্যকিছু শুনতে চেয়েছিল। নির্ভীকের স্তব্ধ, হতবিহ্বল চাহনি দেখে মিতালী হাসলো। বলল,
-“তুই কখনো বুঝতে পারিস নি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে ফিরলো নির্ভীক। বলল,
-“বোঝার সময় পাইনি। আমি তখন অন্যকাউকে নিজেকে বোঝাতে ব্যস্ত।”

প্রত্যুত্তরে মিতালী কিছুই বলতে পারলোনা। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। মিতালী নিজ থেকেই বলল,
-“কতদিন কবিতা শোনাচ্ছিস না, বলতো?
আমি একটা কবিতা মুখস্থ করেছি, তোকে শোনাবো বলে। শুনে উত্তর দিস।”

নির্ভীক আগ্রহ দেখালো।
মিতালী নরম কন্ঠে আবৃত্তি করলো,

“তুমি আমার একলা ছাদের কপোত হবে?
সারা দুপুর কানের কাছে
বাকুম বাকুম গান শোনাবে।

কিংবা হবে জংলা ফুলের শিশিরকণা?
আমি তবে জল পিয়াসী ফড়িং হব
তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাব, লক্ষীসোনা।

তুমি হবে চিমটি আঁধার মায়ার আঁধার?
সেই আঁধারে জন্ম নেবে
মৃত্তিকা ফুল খোঁপায় বাঁধার।

তুমি হবে একলা গাঙের হলদে পাখি?
ঝরা পাতায় কান্না দেব,
তিয়াস পেলেই অশ্রু পিয়াই লক্ষী পাখি।

অথবা নীল বুকের মাঝে কালচেটে তিল?
রাখব তবে খুব গোপনে
হব সুখের রোদ কুড়ানো অবোধ শঙ্খচিল।

তুমি আমার রূপোর জড়ো গয়না হবে?
অঙ্গ ভরে রাখবো তোমায়
অথবা খুব সাজবো যখন একটা
নতুন আয়না হবে?

তুমি হবে শেষ বিকেলের হলদে আলো?
কৃষ্ণচূড়ায় মেঘ জমাব
চেঁচিয়ে কবো এমন মায়া কে মাখালো, কে মাখালো?”

বিকেল চড়ুই।

অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নির্ভীকের। অনিমিখ নেত্র বিচরণ করলো মিতালীর সারা মুখশ্রীতে। আর সে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়।
কন্ঠনালি রোধ হয়ে এলো নির্ভীকের। অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,

-“তুই…”

মিতালী হাসলো। লজ্জা মিশ্রিত হাসি। চোখে খুশির চিকচিক ঝিলিক।

প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে চিত্তচাঞ্চল্যকর ভাবে নির্ভীক বলল,
-“একবার জড়িয়ে ধরি।”

অনেকটা পিছিয়ে গেলো মিতালী। চোখ পাকিয়ে বলল,
-“একদম না।”

নির্ভীক নিটোল ঠোঁটে মিটিমিটি হাসলো। আজ তার সুখের দিন। সেদিন বাড়ি গিয়ে জানতে পারলো মিতালী ইশরাককে বিয়ে করবেনা বলে না করে দিয়েছে। তখন খুশি হলেও প্রচন্ড অভিমান হয়েছিল তার। কেন মিতালী কিছু শেয়ার করেনি? আজ আর সেই প্রগাঢ় অভিমান স্থায়ী নেই।

★★★

রীতি ধরে রাখতে বছর ঘুরে শীত ঋতুর আগমন। সকাল সকাল খেঁজুর রসের মিষ্টি ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে বাড়ি। দু’বেয়ান সাথ জুড়ে রসের শিরনি আর ভাপা পিঠা তৈরি করছেন, সাথে একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টা।
মাহা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে নিলো।
বোনের মতো স্টুডেন্ট অবস্থায় নিজের পড়ার খরচ নিজেই বহন করছে।

নির্ভীক আর মিতালী নিজেদের কাজের উদ্দেশ্যে বের হলো।
তাদের ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে নির্ভীক নানু-দাদির কাছেই থাকে।
মিতালী, নির্ভীক দুজনই পেশায় শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছে। যদিও দুজনে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।

প্রিয়ার বিয়ের কয়েকমাস পরই মিতালীর বাবা পরলোক গমন করেন। এরপরই শুরু হয় মিতালীর নতুন লড়াই। মাহবুব এসে বাড়িতে জায়গা দখল নিয়ে ঝা*মে*লা বাঁধায়। যেহেতু মিতালী আর মাহা দুজনের সমান সম্পত্তির মালিক মাহবুব, তাই সে ভেবেছিল দুবোন হয়তো কোন এক সময় তার কাছেই সম্পত্তি বিক্রি করে দেবে। আর সে ও অল্প দামে কিনে নেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। মাহা, মিতালী কেউই সম্পত্তি বিক্রি করলোনা। বাবার শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে রইলো।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই নির্ভীকের পিড়াপিড়িতে দুজনে বিয়ে করে নিলো। ব্যাপারটা বছরখানেক গোপন থাকলেও পরক্ষণে সবাই জেনে গেলো। লুকিয়ে বিয়ে নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে একদফা গন্ডগোল বাঁধলে নির্ভীক মাকে নিয়ে ও বাড়ি থেকে ভাড়া বাড়িতে গিয়ে ওঠে। যেহেতু বিয়ে সম্পর্কে জানাজানি হয়ে গিয়েছে, তাই মিতালীকে ও নিয়ে গেলো। মিতালী একা গেলোনা। তার মা-বোনকে সাথে নিলো। দুজনের রোজগারে সংসার চললো বেশ। মাহা নিজের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজে নিয়ে নিলো।

দুজনের বাকি পড়াশোনা, সংসার, খুনসুটি ভালোবাসায় দিন চললো বেশ। ততদিনে দুজনের মাঝেই পরিপূর্ণতা চলে এলো।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। দুজনের আয়ে এক টুকরো জমি কেনা হলেও বাড়ির কাজ এখনো ঠিকঠাক হয়নি। অর্ধেক কাজ হয়ে আপাতত কাজ স্থগিত রাখা হলো অর্থসংকটের কারণে। বাকি টাকার ব্যবস্থা হলেই বাড়ির কাজ সম্পন্ন হবে।

★★★

শুক্রবার ছুটির দিন। দল বেঁধে সবাই আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে আসলো। পূর্বের মনমালিন্য এখন আর নেই। মাঝেমধ্যে সবার বাসায় সবার আসা যাওয়া হয়।
খাবার টেবিলে গোল হয়ে যখন ইশরাক, নির্ভীক, চেয়ারম্যান সাহেব সহ বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা বসলো, তখন মিতালী ইশরাকের স্ত্রীর সাথে খাবার বেড়ে দেওয়ার কাজে হাত লাগালো। মাথায় আঁচল টে*নে গিন্নি রূপে খাবার পরিবেশন করলো দুজনই। খাওয়ার মাঝে ইশরাক নিজের স্ত্রী আর মিতালী দুজনকেই দেখলো। মিতালীকে একটা সময় সে চেয়ে থাকলেও এখন আর চায়না। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে সে। হৃদয়ের এক কোনে মিতালী নামটি পড়ে রইলো, আর সমস্ত ভালোবাসার প্রকাশ স্ত্রীর জন্য। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মাহা এতবছরের জমানো আবেগ সন্তর্পণে গোপন করে গেলো। কাউকে হারিয়ে ফেললো প্রথম প্রথম আমরা যতটা উন্মাদনায় মরিয়া হয়ে উঠি, কয়েকমাস কিংবা বছর কে*টে গেলেই বি*ষা*দ গুলো সয়ে যায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নিজের জীবন নিয়ে মাহাকে এখন খুশি বলা চলে।

বিকেলেই দু’বোন বাবার ক*ব*র দেখার উদ্দেশ্যে বের হলো। একটা সময় মিতালী জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর জীবনে এমন কেউ আছে? যে তোকে সবকিছুর বিনিময়ে পেতে চায়।”

মাহা জবাব দিলোনা। মৃদুস্বরে হাসলো।
মিতালী তা লক্ষ করে বলল,
-“এমন কেউ থাকলে ফিরিয়ে দিসনা। তাকে আঁকড়ে ধরে রাখিস। একদিন আমার মতো গর্ব করে বলতে পারবি তুই সত্যিই সুখে আছিস।”

★★★

কুয়াশার রাতে গায়ে চাদর জড়িয়ে হাতে হাত গলিয়ে হাঁটছে দুজন। মিতালীর ঠান্ডা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষে চলেছে নির্ভীক।
-“তোমার হাতগুলো এমন সাপের গায়ের মতো ঠান্ডা হয়ে থাকে কেন?”

মিতালী আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি সাপের শরীর ধরে দেখেছো?”

নির্ভীক বিড়বিড় করে বলল,
-“ধরতে গেলেই তো ফনা তোলে ফোঁসফোঁস করে।”

কথাটি মিতালীর কর্ণধার এড়ালো না। হেসে নিজ থেকেই নির্ভীককে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
-“আমি ফনা তোলে ফোঁসফোঁস করি? নিজে যে সময়ে-অসময়ে কাছে আসো, তার বেলায়?”

নির্ভীক ফিসফিস কন্ঠে বলল,
-“একটা কবিতা শোনাই?”

মিতালী মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। নির্ভীক আওড়ালো,

“উত্তপ্ত খরায় আমি তৃষ্ণার্ত,
তুমি একফোঁটা জল।
তৃষ্ণা মেটাতে ছুঁয়ে দিই
তোমার আধখোলা খোঁপার চুল।
তুমি মধুচক্র – স্বেদজলে তেজস্বী
আমি মধুলোভী মৌমাছি,
তোমারই অধরসুধায় তৃপ্তি খুঁজি।”

মিতালী আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নির্ভীককে।
তুই থেকে তুমিতে এসেছে ছেলের জন্মের পর। ছেলের সামনে একে অপরকে তুই করে ডাকাটা বেমান। সেজন্যই তুমিতে এসেছে।

★★★

সকাল সকাল মা – বোনকে সাথে নিয়ে বাবার ভিটায় গেলো মিতালী। মাহবুবা এখন বড় হয়েছে। আগে বাবার ভ*য়ে ফুফুদের সাথে কথা না বললেও এখন বলে। বুঝ হয়েছে তার।
ভেতর ঘর থেকে মাহবুব আর পিয়ালীর ঝ*গ*ড়া শোনা যাচ্ছে। মাহবুব দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। কাজে যায়না, ঠিকঠাক বাজার করেনা। খেয়ে না খেয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়ে থাকে পিয়ালী। মাহবুবকে কিছু বললেই দুজনের মধ্যে ঝ*গ*ড়া বাঁধে।
যে যতটুকু করবে, সে ততটুকু ফল পাবে। কর্মফল একদিন সবাইকেই ভো*গ করতে হয়।

বাড়িটি দেখে নিয়ে মামা শশুর বাড়ি তথা চেয়ারম্যান বাড়ি গেলো মিতালী। সেখান থেকেই নির্ভীক সহ তাদের ভাড়া বাসায় চলে গেলো। আগামীদিন থেকে আবার ও চলবে পূর্বের নিয়ম। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
দাম্পত্য জীবনের এতবছরে এসেও নির্ভীক আর মিতালী কেউ এখনো ভালোবাসি বলেনি। তারা অন্তঃকরণে বিপরীত মানুষটির আনাগোনা উপলব্ধি করছে। কিছু ভালোবাসা মুখে বলতে হয়না, প্রতিটি কাজে প্রমাণিত হয়। নিরবে অন্তঃকোণে বেঁচে থাকে।

#সমাপ্ত।

(কয়েকদিন যাবত অসুস্থ থাকায় গল্প পোস্ট করতে পারিনি। তার জন্য দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here