#নিজেকে_ভালবাসি

#পর্ব-১

–মা, যদি বলি আমি রুহীকে ভালবাসি। তুমি কি খুব কষ্ট পাবে?
–রুহীকে ভালোবাসিস? কিন্তু ও তো….
–হ্যা মা। ও সিঙ্গেল মাদার! ওর দুটো বাচ্চা আছে।কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমি রুহীকে ভালবাসি। এটা আমার আবেগ, মোহ বা করুনা নয়। আমার নিখাদ ভালোবাসা। বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো। এটা হুট করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়, মা। অনেক চিন্তা করেই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রুহীকে কিছু বলিনি এখনও। আগে তোমার মতামত চাই। তুমি তো রুহীকে দেখেছো, ওর সাথে মিশেছো। মেয়ে হিসাবে তোমার কেমন লেগেছে?
—হু, মিষ্টি একটা মেয়ে। এতো ভালো একটা মেয়ের সাথে কে যে এমন নিষ্ঠুর হলো! এমন অল্প বয়সে বাচ্চা দুটোকে সুন্দর মানুষ করছে। অথচ মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। দেখ অর্ক, অতীতে বিয়ে হয়েছিল বা এখন বাচ্চা আছে এসব আমার কাছে একটা মেয়ের প্রধান পরিচিতি নয়। আমার কাছে মানুষটা কেমন সেটাই আসল। তোদেরকেও আমি সব সময় মনুষ্যত্বের শিক্ষাই দিয়েছি। তোর সিদ্ধান্তে আমি কোনো বাধা দেবো না। আমি জানি তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি তা ভেবে চিন্তেই নিবি। তারপরও বলছি আরেকবার ভেবে দেখ। বিষয়টা তোর বা রুহীর কারোও জন্যই ওতো সোজা না। রুহী কিন্তু তোর কাছে আসে নি। তুই নিজ দায়িত্বে ওর কাছে যাচ্ছিস। রুহীর অতীত কিংবা ওর বাচ্চদের নিয়ে যদি তোর কখনো দীর্ঘশ্বাস পড়ে তবে কিন্তু রুহির সাথে অবিচার করা হবে। আল্লাহ তোকে ক্ষমা করবে না।
—তুমি আগে বল মা, তোমার কোনো সমস্যা নেই তো ?
—তোর পছন্দে আমি না করবো কেন? আমি কি তোর ইচ্ছার বাইরে যাই! রুহীকে আমারও অনেক পছন্দ। পরম স্নেহের আদরে ছেলের চুলে বিলি কেটে দিলেন অর্কর মা।

অর্ক একটা এ্যাড ফার্ম চালায়। ওর ভার্সিটির তিন বন্ধু আর তিন জন এমপ্লয়ি মোট সাতজন মেধাবীদের নিয়ে নতুন এ প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। সবাই এতে জান দিয়ে পরিশ্রম করে। এটাকে অফিস কম পরিবার বেশি মনে করে সবাই। তিন বন্ধুর মধ্যে সাদমান ও নওশীন মানিক জোড়। সামনের বছর জানুয়ারীতে ওদের বিয়ে ঠিক । আর পাগলাটে মাহিরা চোখে চশমা পরে পুরো অফিসকে নানান রং দেখায়। মেজাজ খারাপ তো সবাই কারণ ছাড়া ওর কাছে ঝাড়ি খায়। মেজাজ ভাল তো সবাই ব্যাপক আদর পায়।
অর্ক চুপচাপ, চাপা স্বভাবের সুদর্শন একটা ছেলে। সব কিছু টিপটপ থাকা চাই। এমপ্লয়িদের আপনি বলে সম্মোধন করে। কাজের বেলায় যেমন শক্ত মনের দিক থেকে তেমন বাস্তববাদি। আবেগকে দূরে রাখে।

দুজন এমপ্লয়িদের সাথে ছমাস হলো নতুন যোগ দিয়েছে রুহি। অল্প কদিনেই সবার পছন্দের মানুষ হয়ে গেছে। রুহী সদা হাস্যজ্জ্বল মিষ্টি একটা মেয়ে। শখ করে একটু লিপস্টিক কিংবা দুল পরতে কেউ দেখেনি। কিন্তু ওর নির্মল সৌন্দর্য যেন সবার নজর কাড়ে। সাজগোজের বালাই নাই তবে রুচিশীল পোশাকআশাক। তার জমজ দুটি মেয়ে আছে দিশা ও নিশা। মাত্র চব্বিশ বছরের জীবনে ছয় বছরের দুটি মেয়ে, ওদের বাবা কোথায় কিংবা কি হয়েছিল রুহীর জীবনে, কেউ জানে না। রুহী এ ব্যাপারে প্রথমেই এড়িয়ে গেছে বলে কেউ কখনও কিছু জিজ্ঞেস করে নি।
বাকিরা যেখানে রুহিকে অনেক পছন্দ করে অর্ক সেখানে ভাবলেশহীন থাকে রুহীর ব্যাপারে। অথচ সবার মাঝে থেকেও রুহীর জন্য অর্কর হৃদয় স্পন্দন ঠিকই টের পায় রুহি। অর্ক কখনো রুহীর দিকে ঠিকমত তাকায় না, আড়ালেও না। কিন্তু রুহী ঠিকই বুঝতে পারে অর্কর অদৃশ্য চাহনী। অর্কর না বলা ভালবাসা রুহীর মনেও সাড়া জাগায় কিন্তু রুহী তা কোনো ভাবেই প্রশয় দেয় না। ভালবাসা পাবার বা দেবার জন্য রুহী নয়। কোনো মোহে জড়িয়ে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ সে নষ্ট করতে চায় না।
এদিকে অর্ক নিজেকে অনেক সামলে সামলে চলে। রুহীর প্রতি ওর মুগ্ধতা দিনদিন বাড়তেই থাকে। কোথা থেকে এ আবেগ আসে অর্ক নিজেও বুঝতে পারে না।
একজন সিঙ্গেল মাদার যেমন নতুন করে জীবন সঙ্গী খুজে নিলে মানুষ বাঁকা চোখে দেখে তেমনি সিঙ্গেল মাদারের প্রতি কারও ভাল লাগাটাকেও মানুষ বাঁকা চোখে দেখে। ভাবে ছেলেটির নিশ্চয়ই কোনো কুমতলব আছে। অর্ক তাই খুব সাবধানে চলে যেন ওকে কিংবা রুহীকে নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। নিজের আবেগকে সে কোনো ভাবেই প্রশয় দেয় না।

*******
সফলতার পাশাপাশি অফিসের ব্যস্ততা বাড়ছে। দম ফেলার সময় পায় না কেউই। মিটিংএ নতুন প্ল্যান নিয়ে কথা বলছে অর্ক। কিন্তু রুহী কিছুক্ষণ পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। অর্ক না পারতে বিরক্ত হয়ে বলে, আপনার সমস্যা কি মিস রুহী? মানুষ তাড়া থাকলে বার বার ঘড়ি দেখে আপনি বার বার আকাশ দেখছেন কেন??
রুহী আমতা আমতা করে বলে আকাশে মেঘ করেছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে।
— সমস্যা কোথায়? এখন কেবল দুপুর? আপনি তো আর এখন বাসায় যাচ্ছেন না। তাই না?
রুহী ঠোঁট কামড়ে বসে থাকে। কি বলবে বুঝে পায় না।
মাহিরা বলে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে, তাই না রুহী?
রুহীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
মাহিরা বলে, চল আজ বৃষ্টি বিলাস হবে।
অর্ক সাথে সাথে বলে, মাহিরা তোর কি মাথা ঠিক আছে? দরকারী মিটিং ছেড়ে বৃষ্টি বিলাস করবি?
সাদমান বলে, তোর বোরিং মিটিং পরেও করা যাবে।অনেক দিন একটু প্রাণভরে শ্বাস নেই না। শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। চল ভিজি তো, বলে নওশীনের হাত ধরে টান দেয়। অর্ককে পাত্তা না দিয়ে সবাই ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অর্ক বোকার মত একা দাঁড়িয়ে থাকে।

******
টিপটিপ বৃষ্টি এবার ঝুম হয়ে নামে। সবাই খুশিতে চিৎকার দেয়। সাদমান নওশিনের রোমান্টিক চোখাচোখি কারও নজর এড়ায় না।
সবাই খুশিতে আত্মহারা যেন কিশোর বয়সে ফিরে গেছে।
অর্ক একটু দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ভিজছে। মোবাইলে জোরে রিদমওয়ালা গান ছেড়ে দেয় সে। সবাই বিভিন্ন তালে নাচতে থাকে।
হঠাৎ রুহীর দিকে নজর যায় অর্কর।
সবার সাথে হালকা হাত দুলিয়ে নাচছে রুহী। আজ রুহীর হাসি যেন অন্যরকম। মনে হচ্ছে যেন বাঁধন হারা একটি প্রাণ উচ্ছল মেয়ে নিজের মত হাসছে, নাচছে। এ যেন অন্য এক রুহী যাকে কখনোও কেউ দেখেনি। এতোদিন যা দেখেছে সব যেন তার আবরণ।
এভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা যায় না। অর্ক চোখ বন্ধ করে নেয়। হঠাৎ ওর কানে কেউ যেন ফিসফিস করে বলে ভালবাসি,ভালবাসি!
অর্ক চোখ খুলে। বৃষ্টির এ মুহূর্তে মন, হৃদয়, চিন্তা চেতনা সব যেন এক হয়ে গেছে।
আজ নিজের থেকে পালানোর আর কোনো পথ নেই। সব দ্বিধা পেরিয়ে আজ সে স্বীকার করে নেয়, রুহীকে সে ভালবাসে।
*****
সন্ধ্যায় দোতালার বারান্দায় বসে রুহীর মা মেয়ে ফেরার অপেক্ষা করছেন। বিষন্ন মনে ভাবতে থাকেন মেয়েটি দেখতে দেখতে কেমন বদলে গেল। আগে সারাটা দিন মাথায় তুলে রাখতো। সবসময় শুধু সাজগোজ আর শপিং নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। তিনি রাগ করে বলতেন রুহী, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। অথচ আজ সেই রুহীই পুরুষবিহীন এ সংসারটা সামলাচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেল! একটা ঝড় এসে সবার জীবনটাই বদলে দিল। এত বড় ঘটনার পরও রুহী পড়ালেখা শেষ করে ভাল একটা চাকরি করছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মেয়েটা দিন দিন কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। জীবনটাকে বন্দী করে ও যেভাবে চলছে তা রুহীর মায়ের মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু রুহীকে কিছু বলতে যেন ভয় লাগে। ঐ দিনের ছোট্ট, চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ যেন বড় মানুষ হয়ে গেছে। মেয়েটাকে নিয়ে তার বড় চিন্তা হয় কিন্তু কার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করবেন তা বুঝে পান না। শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন।

চলবে।।

ঝিনুক চৌধুরী

পাঁচ পর্বের গল্প এটি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here