#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৬

তারপরের দিন গুলো সব স্বপ্নের মতো কাটতে লাগলো। চাকরি থেকে আমি এক মাসের ছুটি নিলাম। আমার চাকরির জীবনে কখনোই ছুটি নেওয়া হয়নি তেমন ভাবে। তাই ছুটি চাইতেই সেটা মনজুর করা হলো। আমার বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আমি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছি। আবিরের সাথে আমার একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। আমার শাশুড়ীও বেস ভালো মনের মানুষ। প্রায় প্রতিদিন আমার পরিবারের সাথে আমার কথা হয়। এরমাঝে একদিন মোহন এসে আমায় দেখেও গেছে। সে কি কান্না আমাকে জড়িয়ে। বলে কিনা,তোমায় ছাড়া থাকতে এতো কষ্ট হবে জানলে কখনোই তোমায় বিয়ে দিতাম না। আমি বললাম তাহলে নিয়ে চল। কিন্তু তখন আবির বললো। শালাবাবু আপনি আর আপনার বোন চাইলেও আমি ছাড়ছি না আমার বউকে। আপনার কষ্ট দূর করতে গিয়ে আমি কষ্টে থাকতে পারবো না। তাই আপনাদের আবদার মনজুর হলো না। মানুষটার কথা শুনে সে কি হাসি আমার ভাইয়ের। সব যেন ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্নের মতো। আমি অনুভব করলাম আমার সুখ নামের ছোট্ট নীড়কে।

———–

রান্নাঘরে আমি আর আমার শাশুড়ী মা খুব ব্যস্ত। কারণ আমার দুই ননদের পরিবার আসবে। আজ সকল দায়িত্ব আমার শাশুড়ী আমার হাতেই দিলেন। তিনি শুধু দেখিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে কি করবো। আমি সেভাবেই সব করছি। গরুর গোশ,মুরগীর গোশ,চিংড়ি মাছ,রুই মাছ,ডিম,ডাল ভাজি পোলাও এসব রান্না করে সব গুছিয়ে খাবার টেবিলে রাখলাম।দুপুর দেড়টার দিকে তাঁরা সবাই চলে এলো। বেশি কথা না বলে তাঁদের খেতে বসিয়ে দেওয়া হলো। বড় ননদ খাওয়া দাওয়া শেষ করেই চলে গেলো,তাঁর স্বামী নাকি অফিসের কাজে আজ রাতেই চিটাগং যাবে! তাই তাঁরা বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। কিন্তু আমার ছোট ননদ তাঁর শাশুড়ী জা এরা খাওয়া দাওয়া করে রাতে যাবেন বলে ঠিক করলো। আবির অফিসে তাই আমার একটু অসহায় লাগছিলো। তুবা,মানে আমার ননদের শাশুড়ী আর তাঁর জা আমার দিকে বারবার কেমন আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না। বিকালটা কাজের অজুহাতে দূরে দূরে থাকলেও মাগরিবের পর আর পারলাম না। সবাই মিলে ড্রইংরুমে আড্ডা দিতে বসলো। বাধ্য হয়ে আমাকেও বসতে হলো। হঠাৎই তুবার শাশুড়ী আমায় খোঁচা মেরে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর প্রথম খোঁচা ছিলো। আমার বয়স কত? এভাবেই তিনি আমাকে খোঁচা মেরে মেরে কথা বলছিলেন। আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। এই প্রথম আমি নিজের কান্না আঁটকে রাখতে পারছি না। আমি না পারছি কিছু বলতে না পারছি সয্য করতে। এক সময় তো তিনি নিজের সীমালঙ্ঘন করে ফেললেন।

_ তা বউমা,শুনলাম তোমার নাকি আগে বিয়ে হয়নি। তা সংসারে ঘানি টানতে গিয়ে বিয়ে করোনি,নাকি ওই যে নষ্টামি করতে গিয়ে লোকসমাজে সম্মান খোয়ানোর পর কেউ তোমায় বিয়ে করতে চায়নি। আরে হয়,হয় বাবা না থাকলে ওই বয়সের মেয়েরা এমন করে। তা তুমিও কি এমন কিছু করেছিলে নাকি। দেখো বাপু আবির আমাদের সোনার টুকরো ছেলে,সেই সোনার টুকরোর সাথে যদি হিরে না এসে কাঁচ আসে তা বাপু আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আরকি যাচাই করে নিচ্ছি। নাকি সম্পর্ক ছিলো কোন ছেলের সাথে। বিয়ে করবে বলে সব কিছু নিয়ে গিয়ে মাঝপথে ফেলে গেছে। যে যুগ চলছে তাতে তো ভালো মেয়ে পাওয়াই দুষ্কর। শুনেছি তোমাদের মতো মেয়েরা সরকারি হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চাও নষ্ট করে নিজের কলঙ্ক ঢাকার জন্য। জানি না বাপু তুবার ভাই,মা কি দেখে তোমাকে বউ করে আনলো। আমাকে বললে, আমি তো খাঁটি বাঙালী ঘরের মেয়ের খোঁজ দিতাম। আর তোমার থেকেও অল্প বয়সী মেয়ের এনেও দিতে পারতাম। আর আমার পোড়া কপাল তখনই আমাকে যেতে হয়েছিল মেয়ের বাড়ি।

উনার কথা আমি আর শুনতে পারলাম না! আমার দুচোখ ঝাঁপিয়ে কান্না নেমে এলো। এতটা অপমান আমি আমার জীবনে কখনো হইনি। শাশুড়ী মা কাছে নেই, থাকলে কি ভাবতেন তিনি আমায় নিয়ে। আজ মনে হচ্ছে বিয়ে না করলেই ভালো হতো। এমন কথার সম্মুখীন হতে চাইনি বলেই সেদিন আমি না করেছিলাম। কিন্তু কি লাভ হলো মা ভাইবোনেরা মিলে জোর করে আমায় অপমানের মুখে দাঁড় করালো। আমি বসা থেকে উঠে চলে যেতে নিলাম। হঠাৎ নিজের হাতে টান অনুভব হতেই পিছন ফিরে তাকালাম। পিছু ফিরতেই আবিরের চোখে চোখ পড়লো। সাথে আমার শাশুড়ীও। এবার যেন আমার আঁটকে রাখা চোখের জল বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো। আমাকে ও নিজের বাহুডোরে আঁটকে সামনে এগিয়ে গেলো। সবার মুখোমুখি আমাকে দাঁড় করিয়ে বললো।

_ মাউই মা,মোনাকে এতো কিছু শোনালেন! এতোকিছু কিসের ভিত্তিতে শোনালেন সেটা বললেন না। ওকে আপনি বলেননি, আপনার মেয়ে বিয়ের আগে কীভাবে প্রেগন্যান্ট হয়েছিল! তারপর আপনার মেয়ের প্রেমিককে আপনার ছেলে রাস্তায় ফেলে কীভাবে পিটিয়ে ছিলো কুত্তার মতো করে। তারপরও সেই ছেলে আপনার মেয়ের গর্ভের বাচ্চাকে অস্বীকার করেছিলো। আপনার মেয়েকে অকূল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে তাঁর পরেরদিন কীভাবে ছেলেটা এলাকা থেকে পালিয়ে গেলো। আপনারা লোকসমাজের ভয়ে মেয়েকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাচ্চা এর্বোশন করালেন। তারপর কি সুন্দর ভাবে একজন বোকাসোকা একটা ছেলের হাতে নিজের নষ্ট মেয়েকে তুলে দিলেন। মোনারও জানা উচিত আপনি ওকে কেন এগুলো বলেছেন! কারণ আপনি তো এগুলোর সাথে অভ্যাস্ত। আজকালকার মেয়েদের মাঝে তো আপনার মেয়েটাও ছিলো। সে-ও কি ভুলটাই না করলো। মোনার জানা উচিত কেন ওকে আপনি যাচাই বাছাই করছেন। তাই তো ওকে এগুলো শোনালেন আপনি। কিন্তু দুঃখের সাথে আমায় বলতে হচ্ছে,আপনি ভুল জায়গায় ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছেন। আফসোস মাউই মা,সবাই আপনার মেয়ের মতো নয়। সবাই আপনার মতো নিকৃষ্ট মনের মানুষও নয়। আমি হরফ করে বলতে পারি! মোনা ঠিক ততোটাই পবিত্র যতোটা পবিত্র সর্দফোঁটা ফুল হয়। মোনা আমার স্ত্রী, তাই সে ভালো না খারাপ সেটা আমার উপরেই ছেড়ে দিন। আমি না-হয় ভেতর বাহির সবটা যাচাই বাছাই করে আপনায় জানাবো অন্য একদিন। আজ না-হয় এসব বাদ।

আবিরের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তুবার শাশুড়ী, সাথে তুবা। আর অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো তুবার জা। সে মুচকি হেঁসেও দিলো। কাউকে অপমান করার আগে একটু আশপাশ যাচাই বাছাই করে নেওয়া উচিত। তুবার শাশুড়ী বলে উঠলো।

_ বাড়িতে ডেকে এনে এভাবে অপমান না করলেও পারতেন বেয়াইন। আগে বলে দিলে আমরা কখনোই আসতাম না। বউ আসতে না আসতেই আপনার ছেলেকে দেখছি হাত করে নিয়েছে। দেখবেন বেয়াইন আপনাকে না কখন ঘর থেকে বের করে দেয়।

আমার বুকটা ধক করে উঠলো এই কথা শুনে। না জানি এবার শাশুড়ীর মুখে কি শুনতে হয়। কি ভাববে আমার শাশুড়ী। আমার জন্য তাঁর মেয়ের শাশুড়ীকে তাঁর ছেলে অপমান করেছে। হে আল্লাহ আপনি রহম করুন। আমার এই আকাশকুসুম ভাবনার মাঝে আমার শাশুড়ী বলে উঠলো।

_ বেয়াইন, সবারি উচিত নিজের স্বামীকে নিজের কন্টোলে রাখা! যাতে স্বামী পরনারীতে আসক্ত, আর ভুল পথে হাঁটতে না পারে। সেখানে আমার ছেলের বউ যদি আমার ছেলেকে কন্টোল করেই থাকে তাহলে ভুল কিছু করেনি। ইট মারলে পাটকেল তো খেতেই হবে, তাই না। আমার ছেলে যদি আজ ওর স্ত্রীর হয়ে প্রতিবাদ না করতো! তাহলে আমি নিজেই ওকে বলতাম, বউমা’কে ওর বাপের বাড়ি দিয়ে আয়। কারণ নিজের স্ত্রীর সম্মান যে স্বামী রক্ষা করতে পারে না। সেই স্ত্রীর স্বামী হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই আমার ছেলের। মনে রাখবেন বেয়াইন ভালো খারাপ সব কিছুর মাঝেই থাকে। বাক্সের একটি আপেল পঁচা হলে বাকি আপেল গুলোও যে পঁচা হবে এটা কে বললো আপনায়? উল্টো ওই পঁচা আপেল ওই বাক্সে থাকলে অন্য আপেল গুলো নষ্ট হওয়ার চান্স থাকে। তাই ওই আপলটা বাক্স থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু আমার বউমা যে বাক্স থেকে মানুষ হয়েছে যেখানে কোন পঁচা আপেল তো দূরে থাক পঁচা আপেলের গন্ধও ছিলো না। তাই তাঁকে অপমান করার কোন অধিকার আপনার নেই। রইলো বাকি আমাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার। আমার নিজের মেয়েই তো ক’দিন পরে আপনাকে বের করে দিবে,সেখানে পরের মেয়ে আমাকে বের করে দিবে এটা তো স্বাভাবিক। পয়সার এপিঠ ,ওপিঠ। আজ যা আমি করবো,তা একদিন আমিই ফেরত পাবো! সেটা ভালো হোক বা খারাপ। তাই ভবিষ্যতে কাউকে কিছু বলার আগে ভেবে বলবেন।

আমার শাশুড়ী কথা শুনে আমার ননদ রেগে গিয়ে বললো।

_ বাহ্ মা, বাহ্ ছেলের বউয়ের জন্য দেখছি দরদ উথলে পড়ছে,তা কয়দিন সেই দরদ থাকে আমিও দেখবো।

_ হ্যা দেখিস,তোর মতো নিশ্চয়ই দুই নৌকায় পা দিয়ে আমার বউমা চলবে না। এসেছিস ধরেই তো কানের ধারে শাশুড়ীর বদনাম করেই যাচ্ছিস। গেয়েই যাচ্ছিস একগান। এবার তোমার জামাই এলে বলবো,তাঁর মা’কে অন্য ভাইয়েদের কাছে পাঠিয়ে দাও, আরো কত কি? এখনি রূপ বদলে গেলো।

_ নিজের মেয়ের থেকে আজ তোমার কাছে এই মেয়ের মূল্য বেশি হয়ে গেছে।
হ্যা দেখবো বিছানায় পড়লে কে দেখে তোমায়,এই মেয়ে নাকি বউ।

_ খবর পাবি তারপর আসবি সেবা করতে। আর লোকচক্ষুর ভয়ে হলেও এই ছেলের বউই আমার সেবা করবে! সে হোক ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায়। কিন্তু করতে কিন্তু তাঁকে হবেই। তোদের যখন খবর দিবে আমার অসুস্থতার। তখন নিজের সংসার, স্বামী, শাশুড়ী, বাচ্চা সামলে আসবি। আর এই যে এই মেয়েটা, এই মেয়েটা সব রেখে আমার সেবা করবে। ভালোবাসা এমনি এমনি পাওয়া যায় না,আদায় করে নিতে হয়। যেমন ভাব না, আজ যদি ওর হয়ে আমি প্রতিবাদ না করে তোদের অন্যায়ের পক্ষ নিতাম। ওর মনে আমার জন্য সৃষ্টি হতো আকাশ সমান দূরত্ব। কিন্তু সঠিক প্রতিবাদ করায় ওর মনে আমি একটা বিশাল ভালোবাসার জায়গা করে নিলাম। এটাই বাস্তবতা। ভালোবাসা আদায় করে নিতে হয়। কেউ এমনি এমনি দেয় না। এসেছিস ভালো কথা। রাতে খেয়ে বিদায় হ। আর কখনোই এমন কিছু বলার চেষ্টা করবি না! যেটা শোনার পর এই বাড়িতে তোর আসা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here