‘ধূম্রজাল’
ত্রয়োদশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর
________
শ্রুতিহীন শব্দে কীবোর্ডে হাত চালিয়ে সাদি তার কাজে মগ্ন। ল্যাপটপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে রেখে সে চশমা খুলে মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। ক্লান্ত শরীর চলতে চায় না। ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়ার পর শরীরের তেজ কিছুটা হলেও কমে আসে। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের হয়ে থাকে। তবে সাদির উপর এতদিন যা অত্যাচার গিয়েছে তাতে সে যে হাঁটতে পারছে এটাই অনেক বড় নিয়ামত।
চেয়ার ছেড়ে উঠে আছরের সালাত আদায়ের জন্য ওযু করতে গেল সাদি। আযানের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে, তা শুনে সাদির ঠোঁট নড়ছে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার!’ হঠাৎ আযানের সুর শুনেই সে কেঁদে উঠলো। একবার আর্তনাদের মতো সুর শোনা গেল, পরক্ষণেই তার হাহাকার থামিয়ে সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো। যতক্ষণ আযান শোনা গেল, ততক্ষণ সে আযানের উত্তর দিলো অশ্রু ঝরিয়ে। নোনাজলগুলো গড়িয়ে ঠোঁট বেয়ে চিবুক শেষে দাড়ি ভিজিয়ে তুলছে। সাদি দু চোখ বন্ধ করে বললো, ‘আমার পরিবারকে হিদায়াহ দান করুন আল্লাহ। আমার কষ্টের পর নিশ্চয়ই স্বস্তি আছে, আমি আপনাকে ভালোবাসি আল্লাহ। আমি তাওয়াক্কুল রাখি আল্লাহ! স্বস্তি যদি না আসে, তবু আমি দ্বীনের উপর অটল থাকতে চাই। আমার মৃত্যু যেন ঈমান নিয়েই হয়। শেষ পর্যন্ত ঈমান বাঁচাতে চাই আল্লাহ!’
আযান ও ইক্বামতের মধ্যবর্তী এই সময়ে দুআ কবুল হবে কিনা তা আল্লাহই জানেন। তবে সাদির জন্য নিশ্চয়ই কল্যাণ রয়েছে। তা এই দুনিয়া না হোক, চিরকালীন দুনিয়ায় ঠিক আছে।
সাদির সালাত আদায় শেষে প্রত্যাশিত এক কল এলো। সাদির মা রাধিকা ফোন করেছেন। রাধিকার ফোন পেয়ে সাদির হাসি প্রশস্ত হলো। সে বারবার আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলতে কল ধরেই উচ্ছাস মাখা কণ্ঠে বললো, ‘মা, মা! তুমি কেমন আছো?’
রাধিকাও কাঁদছেন। অশ্রু মিশ্রিত হাসি টেনে ভেজা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তুই কেমন আছিস সেটা বল সোনা আমার। আমার প্রিয়!’
কান্না থামানোর চেষ্টা করে সাদি বললো, ‘আমি ভালো আছি মা। তুমি চিন্তা করো না। আমাকে আল্লাহ রক্ষা করছেন।’
রাধিকার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ছে, ‘আল্লাহ রক্ষা করছেন? তাহলে মুসলিম হওয়ার পর থেকে এতো বিপদে কেন পড়ছিস? কেন তোর জীবন এতো কঠিন হয়ে গেল প্রিয়, বাবু আমার?’
– মা, আমি মুসলিম। আমি জানি আল্লাহ পরীক্ষা করেন তাঁর বান্দাকে। আমাকেও করছেন। তুমি চিন্তা করে দেখো মা, আমি এতদিন কত জঘন্য অন্যায়ের সাথে ছিলাম! আমি শিরক করতাম মা। আল্লাহর সাথে শিরক করা অবস্থায় মানুষ মারা গেলে আল্লাহ কখনোই তাকে ক্ষমা করেন না। কিন্তু আল্লাহ আমাকে পথ দেখিয়েছেন। তিঁনি চাইলেই আমাকে ধূলিসাৎ করতে পারতেন। কিন্তু…
– দেখ সাদি, আমি এখন ধর্মীয় বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না। আমাকে তোর সাথে যেকোনো উপায়ে দেখা করানোর ব্যবস্থা কর। আমি তোকে জড়িয়ে ধরতে চাই রে সোনা, আমার কোল খালি খালি লাগে।
মায়ের আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে সাদির বুক ভার হয়ে এলো। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বললো, ‘এখন দেখা করা ঝুঁকিপূর্ণ মা। তুমি ফোন করেছো, এটাও উচিত হয়নি। বাবা জানলে তোমাকে অশান্তিতে রাখবে।’
– আমি কি খুব শান্তিতে আছি? আমার ফোন তার কাছে জব্দ থাকে। আজ ফোন করেছি তোর বাপ নামের কলঙ্ক বাইরে গিয়েছে, আমার ফোন নিতে মনে নেই। কখন আবার চলে আসে কে জানে! আমার ভয় ডর বলতে কিছু নেই আর। তুই আমার অংশ, আমার প্রাণ। একটা অংশ বিদেশ গিয়ে বাপের গোলামী করছে, আরেকটা অংশ আমেরিকায় বসে মার্কিন নাগরিক হয়ে বাপ মা ভুলে গিয়েছে। আর আরেকটা কাছে থেকেও নেই। আমি যন্ত্র হয়ে গিয়েছি। আমার প্রিয়র জীবনটা এমন কেন হয়ে গেল? এ কথা ভাবলেই হতাশা ঘিরে ধরে। সাবিত্রী…
থামিয়ে দিলো সাদি, ‘সাবিত্রীর কথা একদম বলো না মা। ওর কথা শুনে আমি আমার কানের পাপ বাড়াতে চাই না। মা, আমি গোপনে দেখা করার চেষ্টা করবো। তুমি এখন ফোন রেখে দাও। যখন তখন বাবা এসে পড়বে। ধরা পড়লে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলা সম্ভব হবে না। এখন রাখছি মা, ঠিকাছে?’
রাধিকা রাখতে চাইছেন না। তার ইচ্ছে করছে, মুহূর্তের পর মুহূর্ত শেষ হয়ে যাক প্রিয় ছেলের কন্ঠ শুনে। একই শহরের অল্প কিছু দূরত্বের পার্থক্য যেন বিশাল আকাশসম। চাইলেই নিজের অংশকে ছোঁয়া যায় না, মন খারাপের সময়টায় মায়ের আদর পাওয়া যায় না। রাধিকা রোদনবিলাস করতে করতেই ফোন রেখে দিলেন। চোখের জল মুছে লাভ নেই, মনের জল যে সমুদ্র স্রোতে গর্জন তুলেছে। ছলছল নয়ন জোড়া দিয়েই ঝাপসা চোখে সাদির নাম্বার মুছে ফেললেন তিনি। একই কাজ সাদিও করলো। তার ফোনে সে কোনো তথ্যই রাখে না। সবকিছু ল্যাপটপে, যা সম্পর্কে এখনো সিআইডি বিভাগ অবগত নয়।
মনের শান্তি আল্লাহ কত সুন্দরভাবেই এনে দিলেন! আল্লাহর মহিমার স্তুতি গেয়ে শেষ হবে না। তিঁনি যে মহান, তিঁনিই বান্দার আপন। সাদি ফোন রেখে দু রাকআত নফল সালাত আদায় করলো। আল্লাহর প্রশংসায় মুখরিত হয়ে সে শুকরিয়া আদায় করলো, দুআ করলো যেন তার মা হিদায়াতের সন্ধান পান।
সাদিকে নিয়ে রণজিৎ আর স্টেরির আজকের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে সাদি তার কাজে সফল হবে কি না। তাই এই মুহূর্তে দুআ খুব প্রয়োজন। ইস্তেগফার আর দুআর সাথে সাদি মাগরিব পর্যন্ত সময়টা ইবাদতে কাটালো। বারান্দার দোলনায় বসে আকাশের রঙের খেলা দেখতে দেখতে গাঢ় নীলের আবির্ভাব ঘটলো। মাগরিবের সালাত আদায়ের সময় হয়েছে। মুয়াজ্জিনের কন্ঠ কেঁপে উঠছে বারবার। সাদি এবার বাসায় নয়, মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করবে। তৈরি হয়ে সে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মুয়াজ্জিনের শরীরের খোঁজও নিতে হবে।
সাত আসমান উপর থেকে সাদির জীবনের ফয়সালা নির্ধারণ করা হয়েছে। সাদির আলোকিত জীবনের নূর শুধু এই ক্ষণকালীন জীবনের জন্য নয়, চিরস্থায়ী পরকালে তা স্বর্ণের মতো উজ্জ্বলতা দেখাবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা সাদিকে দিয়েছেন এমন এক জীবনব্যবস্থার খোঁজ, যা তার বেঁচে থাকার অর্থ এনে দিয়েছে। সাদি এই খুঁজে পাওয়া রত্ন কখনোই হাতছাড়া করতে চায় না। মৃত্যু এলেও না।
________
অফিসে ঢোকার আগে দারোয়ান চাচা সালাম দিলে বাহার মুচকি হেসে বললো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম চাচা। ভালো আছেন?’
চাচা বিনীত হেসে আলহামদুলিল্লাহ বললেন। বাহার প্রতিদিন যেভাবে অফিসে প্রবেশ করে আজও তেমনি চলছে সব। কিন্তু আজকের অনুভূতি ভিন্ন। বাহার তার অফিসের বাইরের দৃশ্যটা দেখলো একবার। বড় বড় নামফলকে লেখা ‘অপরাধ মনোবিজ্ঞান ভবন’। তারপর আরেকটু যেতেই দরজার ওপর সাদা পাথরে খোদাই করে শুরুতে লেখা, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। এর ঠিক নীচে এই ভবন ও বিভাগ সম্পর্কে কিছু কথা লেখা আছে। বাহার কোনোদিন এতো ভালো করে অফিসের বাইরের পরিবেশ দেখেনি। প্রথম দিন এই লেখাগুলো পড়েছিল সে, পড়তে খুব ভালো লাগছিল সেদিন। তার ইচ্ছে ছিল, এই বিভাগে নিজের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান সে তৈরি করে নিবে যেন নারীর ক্ষমতায়ন তাকে দেখেই প্রমাণিত হয়।
কিন্তু আজ দীর্ঘশ্বাসের গল্প। আজ উপলব্ধির গল্প। এই গল্পটা সে নিজের জীবনে আলো খোঁজার ভ্রমণের অংশ হিসেবে আজীবন মনে রাখবে। তাই অফিস ঘরে ঢোকার পূর্বে সে ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে বড় প্রশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো, ‘আল্লাহ শক্তি দিন আমাকে।’
গম্ভীর মুখে বাহার হাঁটছে নিজের কক্ষের দিকে। আশেপাশে কেউ হেঁটে গেলেও দেখছে না সে। তিন তলার ডান দিকের একটি সুন্দর কেবিন তাকে দেয়া হয়েছিল তার দক্ষতার পরিচয় দেখে। এর সামনেই শাওন স্যারের কেবিন আর তার পাশে আছে শুভ্রত স্যারের কেবিন। সে নিজের কক্ষে গিয়ে ব্যাগ রেখে চেয়ারে বসলো। আজ এখানে তার শেষ দিন, তাই হয়তো একটু মন খারাপ লাগছে এই ঘরটা দেখে। নতুন করে আবার পুরো ঘর দেখলো সে।
জানালার পাশে কাঠগোলাপের গাছ। মাঝে মাঝে পাখির কলতান শোনা যায় মিহি সুরে। নভেম্বর মাসের এই সময়টায় হালকা শীতল হাওয়া এই ঘরকে প্রশান্তময় করে তুলেছে। ফ্যান বা এসি ছাড়ার প্রয়োজন হয়নি। ঘরের পেছনে ছোট বারান্দা আছে, ওখান থেকে নিচের উঠান মতো জায়গায় থাকা ছোট ছোট ফুলের গাছ দেখা যায়। বাগান বলতে পারছে না বাহার, কারণ এই গাছগুলো মাটিতে নয়, টবে লাগানো। সব গাছে একবার করে চোখ বুলিয়ে দেখলো বাহার। সবকিছুই আজ নতুন মনে হচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে টেবিলে রাখা পদত্যাগ পত্রটা হাতে নিলো। শাওন স্যার এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে এসেছেন।
শাওন এখন তার এসিস্টেন্ট এর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত আছেন। কিন্তু বাহার অপেক্ষা না করে এরই মাঝে ঢুকে গিয়ে বললো, ‘স্যার, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
শাওন মনোযোগ দিতে বাধ্য হলেন, ‘রুমি, তুমি এখন বাইরে যাও।’ তারপর তিনি বাহারের দিকে তাকালেন। বাহার দ্রুত চোখ নামিয়ে বললো, ‘এটা পদত্যাগ পত্র স্যার। আর আমি গতকাল ছুটির আগেই সব রকম কাজ সেরে রেখেছি। আজ সেগুলো বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবো ইন শা আল্লাহ।’
– বাহার, তোমাকে আমি স্ট্রং ভেবেছিলাম। আমার কিছু কথা আর সামান্য কয়েকটা কেসে ব্যর্থতা দেখেই পদত্যাগ করে ফেলছো?
– জি স্যার। আসলে, আমি আমার কাজে মনোযোগ কিংবা বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারছি না। আমার এই কাজের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।
– কেন বাহার? তুমি অনেক দক্ষ আর বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিলে। তোমাকে নিয়ে শুধু আমি নই, অনেকেই আশা করে তুমি অনেক বড় পদ পাবে।
শাওন স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। ধীরে ধীরে তিনি বাহারের কাছাকাছি আসলেন। বাহার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘স্যার, এই পত্রটা আপনাকে দেয়ার জন্য ছিল। আরেকটা অফিস রুমে দিয়ে আসবো যেটা বড় স্যার দেখবেন। আর কাজ নাহয় শুভ্রত স্যারকে…’
তার দুই কাঁধ চেপে ধরেছে শাওন। কেঁপে উঠে বিস্মিত চোখে তাকালো বাহার। শাওন বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও বাহার। তুমি যেও না। তোমার বিয়েতে আমার আপত্তি নেই।’
এক ঝটকায় বাহার নিজেকে ছাড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে বললো, ‘আমি কাজ অবশ্যই ছাড়বো স্যার। এবং আপনাকে ক্ষমা করবো না।’
বাহার চলে গেল। সরাসরি অফিস রুমে গিয়ে সে আরেকটি পদত্যাগ পত্র পেশ করে নিজের চাকরি ছাড়ার আবেদন জানালো। তার জন্য একটি লিখিত পত্রও দেয়া হবে যেখানে তার স্বাক্ষর প্রয়োজন। বাহার সব রকম অফিসিয়াল কাজ শেষে নিজের ঘরে গেল। তবে এবার একা নয়। এসিস্টেন্ট রুমিকে নিয়ে সে পুরোনো কাজগুলো বুঝিয়ে দিলো। রুমি যেন শাওন স্যারকে বুঝিয়ে দেয় এসব বলে সে চিরজীবনের জন্য এই কক্ষ ছেড়ে চলে গেল। পেছন ফিরে তাকায়নি একবারও।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা একটি ছোট ঘটনার মাধ্যমে তাকে সবচেয়ে বড় উপলব্ধির সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছেন। বাহার যখন শাওন স্যারের কাছে পদত্যাগ পত্র নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন কক্ষ ছেড়ে বের হওয়ার মুহূর্তে বেশ মন খারাপ ছিল তার। কিছুক্ষণের জন্য নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল সে। আর শাওন স্যারের অশালীন আচরণ তার দ্বিধা এক নিমিষে দূর করে দিলো। তাকে অনুধাবন করালো, ‘এই খারাপের চেয়ে বেশি খারাপ আর কি আছে? যেখানে সম্মান ও লজ্জার নিরাপত্তা নেই, সেখানে থাকা কি কাজ অব্যাহত রাখার চেয়ে উত্তম হতে পারে?’
না, কখনোই না। বাহার কারো সাথেই বিদায় না নিয়ে দ্রুত সিএস ভবন থেকে বেরিয়ে এলো। ব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা বের করে দারোয়ানকে দিয়ে সে বললো, ‘দু হাজার টাকা আপনি রাখুন। আর বাকি এক হাজার মর্জিনা খালাকে দিবেন। আসছি চাচা, দুআ করবেন আমার জন্য।’
শাড়ির আঁচল মাথায় জড়িয়ে বাহার হেঁটে হেঁটে অফিস ছেড়ে গাড়ির কাছে গেল। মনে মনে আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া জানিয়ে সে বলে উঠলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আমাকে তুমি রক্ষা করেছো আল্লাহ।’
__________
রাত বেড়েছে। অদ্ভুত সব চিন্তায় বাহারের ঘুম আসছে না। এতক্ষণ ফুপির সাথে নানান আলাপ হলো। সব কিছুই আধ্যাত্মিক। ধর্ম, আখিরাহ, পুনরুত্থান এমনই সব আলাপনে বাহারের মন আজ বিক্ষিপ্ত। রাতটা নির্ঘুম কাটবে।
বারান্দার মেঝের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে বাহার। দেয়ালে দুই পা ঠেকিয়ে হাত দুটো বুকের উপর আড়াআড়ি রেখে সে মনে মনে দিন দুনিয়া ভাবছে। আজ আবির ফোন করেছে, সেটা সে ধরেনি। সারাদিন বাসায় থাকার কারণে পুরুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হয়নি। তাই আপাতত তার পরীক্ষায় সে ষাট ভাগ উত্তীর্ণ। কাল সকাল সাতটা পর্যন্ত দেখা যাক কি হয়।
তবে এই পরীক্ষায় বাহার একটা বিষয় অনুধাবন করেছে। পুরুষ চাইলেই নজরের হিফাজত করতে পারে না। এতে তাকে বেশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। আজ বাহার শত চেষ্টা করেও পরিপূর্ণ নজরের হিফাজত করতে পারেনি। সে দেখেছে পুলিশকে, জ্যামে আটকে থাকা বাইকার ছেলেটাকে, শাওন স্যারের মতো কুৎসিত মনের লোককে, দারোয়ান চাচাকে। সে পারেনি নজর নিচু রাখতে।
উঠে বসলো বাহার। না চাইতেও সিয়াম, রিপন আর সাদির তুলনা চলে এলো। সিয়াম বাগদানের দিন তার থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি। সেদিন বাহার পরেছিল আকাশ রঙা পাকি-স্তানি পোশাক, খোঁপায় ছিল বেলির গাজরা। তার ধারালো মুখশ্রী আর কোমল ত্বকের উজ্জ্বলতা সিয়ামের দৃষ্টি কেড়েছিল সেদিন। কিন্তু সেই দৃষ্টি দেখে বাহারের অস্বস্তি হয়নি। কারণ তাতে ছিল শুধুই মুগ্ধতা। বরং হবু জীবনসঙ্গীর মুগ্ধতা তাকে হবু সংসারে নিজের স্থান দৃঢ় হওয়ার আগাম বার্তা দিয়েছে। তাতে সে মৃদু হেসেছে।
কিন্তু রিপনের চাহনি ছিল অর্থপূর্ণ। তার চোখের ইশারায় সে বুঝিয়েছিল, বাহার সত্যিই একজন নারী। শুধু মানুষ নয় সে। নারীকে যারা ব্যবহার্য বস্তু ভেবে চলে তাদের সেই কলুষিত দৃষ্টি রিপনের চোখে দেখেছে বাহার। এই নজরে ছিল অশ্লীলতা, কামভাব।
আর সাদি? সে যে সবচেয়ে উত্তমদের একজন। নারীদের প্রকৃত সম্মান সাদির মতো পুরুষই দিতে পারে। সাবিত্রীকে সাদি খুব ভালোবাসতো, সেটা বাহার নিজের চোখে দেখেছে। অর্ধাঙ্গিনীর অনুপস্থিতিতে সাদি ছিল বিনয়ী পুরুষ যা প্রকাশ করে সে জড়িয়ে আছে অন্য কারো সাথে। উপস্থিতিতে সাদি হয়ে গেল এমন এক পুরুষ যেন তার জীবন জুড়ে শুধু তার প্রিয়া। সাদির চোখে ছিল শান্তির ভাষা, প্রিয়তমাকে কাছে পাওয়ার সুখ। ঠোঁটে ছিল বিজয়ীর হাসি। যেন সে কণ্ঠের ভাষায় না, অনুভূতির ভাষায় বলছে, ‘তুমি একান্তই আমার! আমার অধিকার, আমার সম্পূর্ণা।’
বাহারের বিপরীতে সাদিও আজ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। তার মস্তিষ্কে চলছে সাবিত্রীর ছলনাময়ী রূপ। অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রী তার জীবনে যেমন রং এনেছিল, তেমন রং মুছে চলে গেছে তারই ভাইয়ের হাত ধরে। বিয়ের দুই বছর পর সাদি কোম্পানির কাজের সূত্রে স্কটল্যান্ডে গিয়েছিল। সেখানে আট মাস থেকে বাংলাদেশে আসার পর সাবিত্রীর অন্য রূপ দেখেছে সে। যদিও সাবিত্রী ছিল নির্মল হাস্যোজ্জ্বল মুখের অধিকারিণী। তার ব্যবহারে সাদি কিছুই টের পায়নি।
কষ্টের শুরু দেখা দিলো কিছুদিন পর যখন সে প্রেগন্যান্সি কীটে দুটো দাগ দেখতে পেল যেটা ময়লার ঝুড়ির একদম শেষে ছিল। সাবিত্রী ভেবেছিল সাদির তা দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা নিশ্চয়ই সর্বোত্তম! তিঁনি চেয়েছিলেন সাদি সত্য জানুক। তাই সাদির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ সে ভুল করে ফেলে দেয়া কাগজের সাথে ঘরে রাখা ঝুড়িতে ফেলেছিল। ওই ঝুড়িতে শুধু শুকনো জিনিস ফেলে দেয়া হয়। তাই সাদির হঠাৎ মনে পড়ায় ঝুড়ি উল্টো করে কাগজটা খুঁজতে গিয়ে সে পেয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কার খুঁটি। গোপনে স্ত্রীকে লক্ষ্য করতে গিয়েই জানতে পারে সাবিত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং সেটা তার ভাইয়ের সন্তান।
এমন প্রতারণার পর সে সাবিত্রীকে ক্ষমা করতে চেয়েছিল, কিন্তু যখন সে জানতে পারলো তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্কের এবারই প্রথম নয়, তখন সে চাইলেও পারেনি নোংরা সাবিত্রীকে গ্রহণ করতে। সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠেছিল সে, আর কখনোই ব্যানার্জি প্যালেসে যায়নি সে। যেখানে প্রতারক ভাই থাকবে সেখানে সে থাকবে না।
তারপর কি হলো? তারপরের ঘটনাগুলো নকশিকাঁথার গল্পগাঁথার মতো। সাবিত্রীকে হারিয়ে নেশাক্ত প্রিয়ংশু উন্মাদ পৃথিবী গড়েছিল, আর সৃষ্টি জগতের একচ্ছত্র অধিপতি আস সামাদ গড়েছিলেন কল্যাণের আহ্বান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রিয়ংশু থেকে সাদির যাত্রা। কোম্পানির কাজের সূত্রে দুবাই ভ্রমণ, সেখানে সাদের সাথে পরিচয়। সাদও তার মতো স্ত্রী হারিয়েছিল, কিন্তু তার গল্পটা ভিন্ন। স্ত্রীর মৃত্যুতে সাদ গ্রহণ করেনি কোনো নেশা বস্তু, হারিয়ে ফেলেনি জীবনের গতি। সে মত্ত ছিল আল্লাহর ইবাদাতে। সাদের এই বিষয়টা প্রিয়ংশুকে মুগ্ধ করেছিল। তারপর ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই সে ইসলামে বৈবাহিক বিষয়গুলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। এরপর আরো জ্ঞান অর্জন, আরো আগ্রহ, আকর্ষণ, সবশেষে হৃদয়ে ধারণ – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
সাদকে প্রিয় বন্ধু ভেবে সে নিজের নাম সাদি রেখে দিলো। হাসরাত অংশটা সাদের পছন্দে রাখা। এভাবেই ইসলামের দীপশিখায় সে আলোকিত হলো পরিপূর্ণ রূপে।
এসব ভেবে সাদির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। বারান্দায় রাখা তোশকের উপর শুয়ে দুই পা দেয়ালে ঠেকিয়ে সাদি ভাবছে তার জীবনের মোড় সম্পর্কে। কাল হয়তো আরো বড় সংবাদ আসতে চলেছে। সাদি চোখ দুটো বন্ধ করে বললো,
‘সব ধোঁয়াশা কেটে যাক,
মলিন সূর্য হলদে আলোয় মেখে যাক।
আমার ঠিকানায় চিঠি না আসুক,
ভুলে গিয়ে পেয়েছি সুখ।’
অন্যদিকে বাহার চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো,
‘ধূম্রজালের মায়ায় বেঁধেছি মন,
সূর্যটাকে হারিয়ে অন্ধকারে কাটছে ক্ষণ।
ঠিকানা ভুলেছি, প্রদীপের অভাব,
মানুষের ভিড়ে আমার অন্ধ সাজার স্বভাব।’
_________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
[খুব প্রিয় আপু বললেন এখন দিয়ে দিতে আরেকটা পর্ব। তাই দিয়েই ফেললাম।]