‘ধূম্রজাল’
চতুর্দশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর
___________
মাস কয়েক পূর্বে…
– আসসালামু আলাইকুম স্যার।
তোহা নিজ কক্ষে চেয়ারে বসে আনমনে কিছু ভাবছেন। সাদি এসেছে টের পাননি তিনি। সাদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার, কেমন আছেন?’
এবার তোহা বললেন, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আছি কোনো রকম। এ সময় তুমি?’
সাদি অবাক হয়ে বললো, ‘আপনিই ডেকেছিলেন স্যার।’
মনে পড়ার ভঙ্গিতে তোহা বললেন, ‘ওহ হ্যাঁ ডেকেছি তো। বসো সাদি। মন আমার ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। নামতে পারছি না, আবার উঠতে পারছি না।’
সাদি চেয়ারে বসে বললো, ‘কি নিয়ে চিন্তা করছেন? নতুন আবিষ্কার?’
– হুম। রণজিৎ ব্যানার্জি চেপে ধরেছেন তার ব্যবসার জন্য। তিনি বলছেন বি অ্যারোমা কোম্পানি ছাড়াও তিনি আর তার ছেলে হিমাংশু আমার নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার বাড়াবেন। আমি যখন বললাম এটা উচিত হবে না, তখন তিনি যু-ক্তরা-ষ্ট্রের নেতা স্থানীয় মানুষদের নাম বললেন যে আমি জানতাম না।
– মানে?
– মানে এর পিছে শুধু রণজিৎ না, পুরো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমার আবিষ্কার পৌঁছে গিয়েছে। তারা জানে না মেলান-স্প্রে বানানোর কৌশল কি তবে তারা জানে আমি কালো মানুষকে ফর্সা তৈরি করার ঔষধ বানিয়ে ফেলেছি।
– কিন্তু আপনি আমাকে বলেছেন এতে মানুষটার মেলানিন ক্ষয় হয় এবং স্কিন ক্যানসারের ঝুঁকি প্রবল। এটা কি তারা জানে না?
– তারা জানে বলেই এই অবস্থা। তারা মনে করে পৃথিবীর সৌন্দর্য নষ্ট হয় কালো মানুষদের জন্য।
সাদি কথা বলার ভাষা পেলো না। কালো মানুষ নিয়ে এতোটা নোংরা চিন্তাভাবনা অমানুষগুলো কীভাবে করে! সাদির কিছু বলার পূর্বেই তোহা বললেন, ‘মেলানিন হরমোনের কারণে মানুষের কালো হওয়ার পরিমাণ বাড়ে, কমে। এই মেলানিন নষ্ট করতে আমার আবিষ্কৃত অণুজীবের খোঁজ তারা পায়নি। পেলে অন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা সহজেই তারা মেলান-স্প্রে তৈরি করে ফেলবে। এই অণুজীব সংখ্যায় এতো সীমিত যে দ্রুত এটার ক্লোন তৈরি না করলে সত্যিই আমার আবিষ্কারের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’
তোহার কথা ঠিক। বাংলাদেশের বান্দরবানে রুমা উপজেলায় তোহা রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে সবাই যখন একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলেরা জীবাণুর নতুন ভেরিয়েন্ট নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েছিল, তখন তোহা স্যার এক শ্বেত রোগে আক্রান্ত মানুষের দেহে উক্ত জীবাণু পেয়েছেন যা এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি। সেই মানুষটার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তিনি বহু বছরের পুরনো একটা পাথর পেয়েছিলেন যা ঝর্ণার পেছনের গুহায় ছিল। সেই পাথর ধরার পর থেকে এই রোগ, পাশাপাশি স্কিন ক্যানসার হয়েছে। তোহা স্যার সেই পাথরের খোঁজ আর পাননি। সেই গুহায় গিয়ে খোঁজ করলেও পাওয়া যায়নি সেই অণুজীব।
তাই লোকটার শরীর থেকে রক্ত নিয়ে তিনি গোপনে অণুজীব সংগ্রহ করেন। তবে তিনি দেখলেন সেই অণুজীব সাধারণ পরিবেশে থাকতে পারে না। গুহায় ছিল স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা পরিবেশ। আবার এর বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা খুব দুর্বল। তিনি এই জীবাণুর উপযুক্ত একটা জায়গা তৈরি করে অণুজীব সংগ্রহে রেখেছেন নিজের গোপন কক্ষে। কিন্তু এভাবে বছরের পর বছর সংগ্রহে রাখা যাবে না। দ্রুতই এর ক্লোন তৈরি করতে হবে। যেটার ঘোর বিরোধী সাদি হাসরাত।
অনাকাঙ্ক্ষিত এই অণুজীবের কারণে মানুষের মেলানিন হরমোন নষ্ট হয়ে যায় পুরোপুরি। তারপর সে স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাই তোহা স্যার মেলান স্প্রে নামের এক ধরণের সংমিশ্রণ তৈরি করার কৌশল গড়েছেন যাতে মানুষ ফর্সা হবে কিন্তু ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। সাদি যখন এ কথা জেনেছে, তখন থেকেই সে বিভিন্নভাবে এই কাজে অনুৎসাহিত করেছে। কারণ সে ধারণা করেছিল, মানুষ এটা খারাপ কাজে ব্যবহার করবে। আর তার ধারণা ঠিক হয়েছে। অমানুষগুলো কালো মানুষদের একবারে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে। শুধু তাই না, এ ধরণের স্প্রে দিয়ে একটা গ্রামে খুব সহজেই মহামারী রোগ ছড়ানো সম্ভব হবে। যাকে বলা হয় জীবাণু অস্ত্র।
তোহা স্যার এখনো স্প্রে তৈরি করেননি, কিন্তু তিনি তা তৈরির কৌশল লিখেছেন কাগজে। এবং সেটা তিনি সাদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার একটা মেয়ে হয়েছিল জানো? খুব সুন্দর, শ্যামলা। কিন্তু আমার স্ত্রী তাকে পছন্দ করতো না। বলতো, সে আমার মায়ের মতো শ্যামলা। অর্থাৎ আমি বা আমার স্ত্রীর মতো ফর্সা নয়। স্টেরির ইচ্ছে অনুযায়ী মেয়েটা মারা গেল খুব দ্রুতই।’
সাদি কাগজ হাতে বসে আছে। তোহা বললেন, ‘আমি আর বাবা হতে পারিনি। স্টেরি এখনো কাঁদে। ওকে আমি ভালোবাসি বলে ক্ষমা করে দিয়েছি, কিন্তু ভুলে যাইনি আমার মেয়েকে। ভেবেছিলাম স্টেরি এখন বদলে গিয়েছে। কিন্তু নাহ! সে এখনো কালো মানুষ অপছন্দ করে। সেও চায় রণজিৎ এর সাথে এক হয়ে এই স্প্রে বাজারজাত করা হোক।’
সাদি চুপচাপ বসে শুনছে। তার মনে আতংক, স্যার স্ত্রীর কথা অনুযায়ী কাজ করবেন না তো? সাদির আতংক কমিয়ে তোহা স্যার বললেন, ‘কাগজগুলো নিয়ে যাও। কাউকে দিবে না। চাইলে ছিঁড়ে ফেলতে পারো বা পুড়িয়ে ফেলতে পারো। কিন্তু কাউকে দিবে না সাদি। আমি আমার স্ত্রীকেও বিশ্বাস করি না।’
সাদি হেসে তোহা স্যারের দিকে হাত বাড়িয়ে কুশল বিনিময় করে বললো, ‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমি মনুষ্যত্ব চেয়েছিলাম, তাই হয়েছে। কেউ পাবে না এগুলো ইন শা আল্লাহ।’
সাদি বিদায় নেয়ার মুহূর্তে নিস্তেজ কণ্ঠে তোহা বললেন, ‘আমাকে কালিমা পড়াতে পারবে সাদি? আমার আল্লাহকে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করছে।’
বিস্মিত সাদি সেদিন জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ছিল তোহার দিকে। আল্লাহ ছাড়া কে জানতো? সেদিন বিকেলেই তোহার মৃত্যু হবে?
_________
অণুজীব সংরক্ষিত কাচের বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে সাদি। বাক্সটা খুবই সাধারণ। দেখে মনে হবে কিছুই নেই, এমনকি এর উপরে কোনো নেমপ্লেট নেই। কিন্তু সাদি আর তোহা জানতেন এখানে কি আছে কারণ এই কাচের বাক্সটা হলদেটে। যে কেউ সাধারণ বাক্স ভেবে পাশ কাটিয়ে যাবে।
গোপন কক্ষে রাখা হয়নি বাক্সটা যেন কেউ সন্দেহ না করে। এটা এখন সাদির কক্ষে। আর কাগজগুলো? সাদি মুচকি হেসে উঠলো। এক হাত পকেটে গুঁজে অন্য হাত আলসেভাবে ঝুলিয়ে রেখে সে মুচকি হাসছে রণজিৎ ব্যানার্জির মুখ কল্পনা করে। ইতিমধ্যে তাহমিদ এসে হাজির। তিনি আগের দিনের মতো বললেন, ‘সাদি, কেমন আছো?’
সাদির উত্তর একই রকম, ‘আলহামদুলিল্লাহ, খুবই ভালো আছি। আপনি?’
তাহমিদ বুঝতে পারেন না, সাদি কি মশকরা করে তার সাথে? এমন একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাদি কিভাবে ভালো থাকতে পারে? তিনি মনের কথাটা প্রকাশ করেই ফেললেন, ‘তুমি কীভাবে এতোটা ঠান্ডা থাকো সাদি? তুমি নিশ্চয়ই জানো তোমার সাথে যা ঘটছে তাতে তোমার জীবন অনেক অন্ধকারে ডুবে যেতে পারে। তুমি মারাও যেতে পারো।’
– জি জানি। কিন্তু যেই অন্ধকারের কথা বলছেন সেটা আমার মুক্তির আলো। আল্লাহ অনুগ্রহ করলে আমাকে কল্যাণময় কিছু দান করবেন। এই বিশ্বাস রেখেই আমি তোহা সেন্টারে কাজ করতে আসি। আমার প্রতিটা মুহূর্তে তাওয়াক্কুলের ভরসা বাণী উচ্চারিত হয়। তাই খুব ভালো থাকা আমার জন্য তেমন কষ্টের বিষয় নয়।
– আমি শুনেছিলাম তুমি হিন্দু ছিলে।
– হুম, এজন্যই এখন খুব ভালো আছি। আগের অবস্থা কল্পনা করলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। যদি সেই অবস্থায় মারা যেতাম, কি হতো আমার?
তাহমিদ হা করে তাকিয়ে আছেন। সাদি তা উপেক্ষা করে বললো, ‘চলুন, স্টেরি আর তার চাটুকার অপেক্ষায় আছে।’
নিজের বাবাকে এভাবে সম্বোধন করতে বুকে বাঁধলেও সাদির ক্রোধ ভেতরটা গ্রাস করে নিয়েছে। তার মাঝে পিতার প্রতি কোনো মায়া কাজ করে না। এমনকি, মায়ের হিদায়াহ কামনা করলেও পিতার হিদায়াহ মুখ থেকে বের হয় না।
স্টেরির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রণজিৎ একমনে দেখছেন ছেলের পরিবর্তন। ঘন দাঁড়িতে সাদি হাসলে যেই টোল পরে, তা দেখতে আগের চেয়েও বেশি ভালো লাগে। এ কথা স্বীকার করলে তার মান চলে যাবে। তাই তিনি চোখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘প্রিয়ংশু…’
– আমি সাদি হাসরাত।
– আমি প্রিয়ংশুই ডাকবো। তোমার সাদি নামটা আমি ঘৃণা করি।
সাদি কিছুই বললো না। চুপ করে নিজের পায়ের পাতা দেখছে সে। রণজিৎ একটু কেশে বললেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাকে এক মাস সময় দেয়া হবে। আজ থেকে ঠিক এক মাস। তুমি ওই অণুজীব খুঁজে বের করবে, তারপর সেটার কোনো কাস্টমাইজেশন মানে…’
পাশ থেকে স্টেরি বললেন, ‘রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তির সাহায্যের প্রয়োজন পড়লে সেটাও করবে। যেহেতু মেলান স্প্রে তৈরিতে তোহা বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করেছিল। আমি জানি না সেটা কিভাবে তৈরি করতে হয়, হতে পারে সেই অণুজীবের শরীরে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। তাই রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে ওই অণুজীবের সাথে আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিন যুক্ত করতে হলে সেটাও করবে।’
সাদি বললো, ‘এটা এ দেশে সম্ভব নয়।’
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। রণজিৎ বললেন, ‘সেই ব্যবস্থা করবো আমরা। তুমি কাগজ অনুযায়ী কাজ করে যাও। দুটো মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম চালাতে এক মাস সময় লাগবে। তারপর কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে, তোমার পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড এগুলো উত্তোলন করা ছাড়াও আরো কিছু জটিলতা আছে। সব মিলিয়ে এক মাস সময় তো লাগবেই। তাই তুমি আপাতত তোমার কাজ চালিয়ে যাও প্রিয়ংশু। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?’
কোনো উত্তর দিলো না সাদি। রণজিৎ আবার বললেন, ‘প্রিয়ংশু, আমি জানি আমাদের সম্পর্কে শীতলতা চলছে। কিন্তু এটা কাজের কথা। এখানে তুমি রেসপন্স করবে আমাকে, আমাদের কাজ হয়ে গেলে তোমাকে কেউ জ্বালাতন করবে না। শুনেছো তুমি?’
এবারও সাদি কিছুই বললো না। স্টেরি বললেন, ‘স্যাডি, আর ইউ ওকে উইথ দিস প্ল্যানিং? অর ইউ ওয়ান্ট টু গো এগেইন…’
সাদি তাকে থামিয়ে বলে উঠলো, ‘আমার সমস্যা নেই।’
রণজিৎ ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘ঠিকাছে, তাহলে এটাই শেষ কথা যে তুমি তোমার কাজ অনুযায়ী চলবে, আমরা এদিকে সব পরিষ্কার করে ফেলবো। আমাদের একটা চুক্তিপত্র আছে, সেখানে স্বাক্ষর করতে হবে। তাহমিদ!’
– জি স্যার।
– কাগজটা প্রিয়ংশুকে দাও।
তাহমিদ একটা চুক্তিপত্র সাদির দিকে এগিয়ে দিলো। রণজিৎ বললেন, ‘এই পত্র অনুযায়ী তুমি যদি কাগজ হস্তান্তর করতে অস্বীকার করো তাহলে তোমার নামে আবার মামলা দায়ের করা হবে। এখন স্বাক্ষর করো প্রিয়ংশু।’
সাদি পুরো লেখা পড়ে কিছু বললো না, স্বাক্ষরও করলো না। রণজিৎ আবার বললেন, ‘কি হলো? করো!’
সসি তখন চুপ করে বসে আছে। রণজিৎ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘সাদি! আমি কি বলছি শুনতে পারছো না?’
এইবার সাদি স্বাক্ষর করলো। সবাই এতক্ষণে বুঝেছে সাদিকে প্রিয়ংশু সম্বোধন করায় সে কোনো উত্তর দেয়নি। তাহমিদ না চাইতেও হেসে ফেললেন, চেষ্টা করলেন শব্দ না করতে। রণজিৎ এর মুখ থেকে সাদি তার নাম বের করেই ছাড়লো।
চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের পর সাদি কাগজটা হাতে নিয়ে বললো, ‘আমিও একটা কাগজ তৈরি রেখেছি। ওখানে আপনাদের দুজনের স্বাক্ষর করতে হবে।’
সে কাগজটা এগিয়ে দিলো। স্টেরি সেটা পড়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘শর্তগুলো ঠিক আছে কিন্তু এটা কি লিখেছো? মামলা প্রত্যাহারের পর কাগজ ফিরিয়ে দিলেও অণুজীব দিবে না?’
– হ্যাঁ দিব অবশ্যই। তবে সেটা নিয়ে আমাকে তো বিদেশে গিয়ে কাজ করতে হবে। তাই এ কথা লিখেছি।
স্টেরি আর দ্বিমত করলেন না। চোখের ইশারায় রণজিৎ এর সাথে কথোপকথন সেরে তিনি স্বাক্ষর করলেন। রণজিৎও করলেন। তারা বুঝলেন না, সাদি কথার শেষে ইন শা আল্লাহ বলেনি।
_________
– কি হলো? কথা বলছো না যে?
সিয়ামের কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো বাহারের। কথা বলতে তার এমনিতেও ভালো লাগে না। আজ বৃহস্পতিবার, সিয়ামের ফোন করার দিন। তাই কথা বলতেই হচ্ছে। সপ্তাহে একদিনই কথা বলে তারা। তাতেও বিরক্ত বোধ করে বাহার। সিয়ামের কথাগুলো কেমন একঘেয়েমি ধরণের। সারা সপ্তাহে কি হয়েছে তারই সারাংশ বর্ণনা করতে হয়। এখন কথা বলার মাঝে সিয়াম জিজ্ঞেস করে বাহারের কাজ কেমন চলছে। এর উত্তর সাজাতে গিয়েই দেরি হলো বাহারের।
– আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি সিয়াম।
– কিহ!
এমনই প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল বাহার। সে বললো, ‘আমি চাই না এই চাকরিটা রাখতে।’
– কিন্তু কেন বাহার? কি হয়েছে?
– জানো কি হয়েছে? শাওন স্যার আমাকে ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। যখন তিনি জানলেন তোমার সাথে আমার বাগদান হয়েছে, তখন থেকে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিলেন। একবার আমার কাঁধ চেপে ধরেছিলেন।
– কি বলছো! তারপর?
– তারপর আমি নিজেকে ছাড়িয়ে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে চলে এসেছি।
সিয়াম বললো, ‘কিন্তু বাহার, মেয়েদের চাকরি করতে হলে এসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হবে। তাদের চাকরির অঙ্গনটা এমনই।’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো বাহার, ‘মানে?’
– দেখো, তুমি চাকরি যে কারণে ছাড়ছো সেই কারণ সব জায়গায় আছে। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে। তুমি প্রতিবাদ করতে শিখো বাহার।
– আমাকে তুমি প্রতিবাদ করা শেখাচ্ছ? আমি একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট, আমাকে তুমি কি বলছো এগুলো সিয়াম?
– এই তুমি রেগে যেও না। আমি শুধু বলতে চাইছি তোমার সেই জায়গায় লোক জড়ো করা উচিত ছিল। তুমি চিৎকার করে বলতে পারতে যেন তোমাকে বিরক্ত না করা হয়। কিংবা তুমি এড়িয়ে যেতে পারতে..
ক্রোধে বাহারের শরীর কাঁপছে। সে মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো, ‘তুমি একটা কাপুরুষ সিয়াম। ছি!’
ফোন কেটে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো বাহার। সে কি ভেবেছিল আর সিয়াম কি বলেছে তাকে! বাহার চায়নি এমন পুরুষ। শেষে কি বললো সিয়াম? এড়িয়ে যাওয়া!
যদি সে প্রতিবাদ করতো, তাহলে হয়তো সেই সময় শান্ত হতো সবকিছু। কিন্তু পরে? হয় তাকে সম্মান বিসর্জন দিতে হতো, আর নাহলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেয়া হতো। এড়িয়ে যাওয়া আর কতদিন সম্ভব? এতদিন তো সে এড়িয়েই চলেছে। আর কত? এগুলো কি সিয়াম কোনোদিন বুঝতে পারবে? অনুভব করবে বাহারের ঝড়?
বাহার নিজের চিন্তাধারার পরিবর্তনে বিস্মিত। আগে সে সিয়ামের মতো ভাবতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে সে ভেবেছিল সব স্থানে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করতে হবে। এখন নারীদের পক্ষেই সব চলে, যেকোনো উপায়ে কোনো পুরুষকে ফাঁসিয়ে দেয়া ব্যাপারই নয়। তবে শেষে বিচার হয় না কোনো, এটা মহান সত্য। শুধু শুধু মিডিয়ার সামনে আসা হয়, একটু পরিচিতি পাওয়া যায়, এই পর্যন্তই। কিন্তু তবু প্রতিবাদী হতেই হবে। তা নাহলে পুরুষতন্ত্রকে দাবানো যাবে না।
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বাহার বুঝেছে, সব স্থানে প্রতিবাদ করলে ফল পাওয়া যায় না। কিছু বিষয় এড়িয়ে চলতে হয়, কিছু বিষয় মেনে নিতে হয়। বাহার মেনে নিতে পারে না। তাই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। কাজ ছেড়ে দেয়া কি কোনো সমাধান? উত্তর হলো ‘না’। তাহলে সমাধান কি? শরিয়াহ আইন কায়েম হওয়া? এর উত্তর বাহারের কাছে দ্বিধায় জড়ানো।
বাহার তাহলে সিয়ামের মুখ থেকে কেমন বাণী আশা করেছিল? চোখ বন্ধ করে সে ভাবলো, কেউ একজন বলছে, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়েছো ভালো হয়েছে। এমন ফালতু জায়গায় থাকার কোনো মানে নেই। আমি চাই আমার রাজ্যে তুমি সম্রাজ্ঞী রূপে থাকো, কোনো দাসী নয়। কারো দাসত্ব করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে তুমি চাইলে জ্ঞান অর্জন করতে পারো। এটা একান্তই তোমার ইচ্ছে। কারণ, আমি তো আছি তোমার জন্য। তোমাকে কষ্ট করতে হবে কেন আমার কাননবতী?’
অদ্ভুত ব্যাপার, কণ্ঠটা সিয়ামের নয়। আবার পরিচিত কারো কন্ঠও নয়। বাহার শুয়ে আছে। চোখ খুলে সে আবার চোখ বন্ধ করলো, কল্পনায় ভাসছে সে। কৃষ্ণচূড়া আর রাঁধাচূড়ার ভেজা পথ ধরে সে হাঁটছে, পেছন থেকে অভিজাত কণ্ঠের ডাক, ‘গুলবাহার, রাগ করো না। রাগ করলে আমার মনমাঝি উন্মাদ হয়ে ওঠে। তার ইচ্ছে করে নৌকা ছেড়ে সাঁতরে তোমার সাগরে অবগাহন করতে। তুমি যে রাগী অপরূপা!’
আশ্চর্যের বিষয়, সিয়ামের প্রতি একদম মন টানে না বাহারের। কল্পনায়ও সে পায়নি সিয়ামকে। পায়নি পরিচিত কাউকে। যেন কল্পলোকেই সৃষ্ট হয়েছে তার মনপুরুষের অস্তিত্বহীন অবয়ব।
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)