#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-দুই
মাহাবুবা বিথী

পরদিন আমি হাসপাতালে একাই যাই।ম্যাম আমাকে দেখলেন। রক্ত ইউরিন সনোগ্রাফি আরও অনেক কিছু পরীক্ষা করালেন।এক সপ্তাহ পর আমাকে আবার যেতে বললেন।
যথারীতি একসপ্তাহ পর হাসপাতালে ম্যামকে দেখালাম।উনি বললেন,
—-সারাহ্ তোমার জরায়ুতে টিউমার আছে।বেশ বড় হয়েছে।অপারেশন করাটা জরুরী।টিউমারের লক্ষণটা ভালো না।অপারেশনের সময় অবস্থা বুঝে রুগীর ক্ষতির আশংকা থাকলে জরায়ু ফেলে দিতে হয়।সে ক্ষেত্রে তোমার হাসব্যান্ডের সাথে কথা বলা উচিত।আর তুমি নিজেও তো ডাক্তার।রিপোর্ট দেখলে তুমিও বুঝবে তোমার জরায়ুর অবস্থা ভালো না।তোমার অ্যানিমিয়া আছে।নিজের প্রতি অনেক অবহেলা করেছ।একজন ডাক্তার হিসাবে তোমার আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিল।সারাহ্ ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে থাকে,
আসলে নিজের যত্ন কিভাবে নিবো।সারাক্ষণ সংসারিক টানাপোড়নে থাকতে হয়।প্রতিটি নারী বিয়ের পর স্বামীর কাছে একটু কেয়ারিং আশা করে।বিয়ের আগে আমি পলাশকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলাম
—-আমাকে কোনদিন অবহেলা করো না।কখন যে আমি হারিয়ে যাবো তুমি জানতেও পারবে না।
পলাশের ভালবাসা পাবার আশায় নিজেকে অনেকটা বদলে ফেলেছিলাম।পলাশের পরিবারের সবাইকে ভালোবাসতে চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু ওর অবহেলার মাত্রাটা দিনে দিনে এতই বেড়ে যেতে লাগলো যে আমার ভালবাসাটা হারিয়ে যেতে লাগলো।হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেকেও ভালবাসতে ভুলে গেলাম।
মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে।টেবিলে আমার রিপোর্টগুলো রেখে শুয়ে পড়লাম।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পায়নি।হঠাৎ পলাশের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
—–কি ব্যাপার অবেলায় শুয়ে আছো?
—টেবিলে ভাত বেড়ে দাও।আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।
অনিচ্ছা সত্বেও শোয়া থেকে উঠে পলাশকে ভাত বেড়ে দিলাম।

আমি রুমে এসে আবার শুয়ে পড়লাম।অ্যানিমিয়ার কারনে মাথা ঘুরতে থাকে।আমি অবাক হয়ে গেলাম পলাশ রুমে এসে আমার শরীরের কথা কিছুই জানতে চাইল না।এমনকি টেবিলে রাখা রিপোর্ট ও খুলে দেখলো না।আমি নিজে থেকেই পলাশ জানালাম,
—আজকে ম্যামের সাথে দেখা করেছি।জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়েছে।বেশ বড় হয়ে গেছে।এখনি অপারেশন করাতে হবে।ম্যাম এটাও বলেছে যদি প্রয়োজন হয় আমার শরীর ভালো রাখার তাগিদে জরায়ুও কেটে বাদ দিতে হতে পারে।তোমাকে ম্যাম দেখা করতে বলেছে।আমার কথা শুনে পলাশ শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
— এটা ফাজলামো নাকি।জরায়ু কেটে বাদ দিলে তোমার বেবী হবে কেমন করে?
আমি বললাম,
—-ম্যাম তো বলেছে যদি প্রয়োজন হয়।ম্যাম খারাপ কিছু আঁচ করছেন।হয়তো সেই কারনে বলেছেন।পলাশ বলে
—-তুমি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?তুমি আর কোনদিন মা হতে পারবে না।
আমি বললাম,
—আমার জীবনের থেকেও তোমার সন্তানের চাওয়াটা জরুরী।আমিই যদি বেঁচে না থাকি তাহলে সন্তান দিয়ে কি করবো? আর তুমিও তো আমি মরে গেলে আর একটা বিয়ে করতে একমূহুর্ত অপেক্ষা করবে না।সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তুমিতো বিয়েটা বন্ধ করবে না।আর আকাশ তো আছে।আকাশের সন্তান এ বাড়ির বংশধর।তুমি আমি একটা বেবী adopted করে নিবো।
পলাশ রেগে গিয়ে বললো,
—এক গাছের ছাল কখনও আর এক গাছে জোড়া লাগে না।আর আমি তো অক্ষম পুরুষ নই যে বাচ্চা adopted করে নিবো।
পলাশের সাথে কথা বলার রুচি আমার হারিয়ে গেলো।বড় আফসোস হচ্ছে,বিয়ের আগে কেন ওর এই সংকীর্ন মানসিকতা বুঝতে পারলাম না।ওকে অন্ধভাবে ভালবেসেছিলাম।
প্রিয় মানুষের অবহেলা কখনও মেনে নেয়া যায় না।যতক্ষণ পর্যন্ত এর সমাধান না হয় এক অসহ্য যন্ত্রনা মনটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে।

যাক অপারেশনের দিন পলাশ আমার সাথে হাসপাতালে আসলো।মুখটা সবসময় ভার করে রেখেছে।সবাই ভাবছে আমার শরীরের চিন্তায় ও কষ্ট পাচ্ছে।আমি তো জানি ওর কষ্টটা কোন জায়গায়।আমি আর মা হতে পারবো না।আমি কি কষ্ট পাচ্ছি না?আমার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে।কিছুই করার নেই সবই আমার ভবিতব্য।
সাতদিন পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলাম।এই সাতদিন হাসপাতালে পলাশ ডিউটি করেছে কিন্তু সারাহ্ র সাথে ভালো করে কথা বলেনি।হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলেছে।বাড়ি ফিরে ও খেয়াল করলো, বাড়ির পরিবেশটা বদলে গিয়েছে।চেনা মানুষগুলো আজ বড় অচেনা হয়ে গেছে।

যে সময়টাতে আমার জীবনে পলাশের প্রয়োজন ছিলো সে সময়টাতে পলাশ নিজেকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
কিছুদিন পর আমার শাশুড়ী পলাশ বিয়ে দিতে চায়।আসলে আমারতো বাচ্চা হবে না।আমি জানি পলাশের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে তারপরও মিথ্যা আশা কুহুকিনীর মতো আশা করেছিলাম পলাশ হয়তো বিয়ে করতে চাইবে না।
কিন্তু আমাকে মিথ্যা প্রমানিত করে পলাশ বিয়েতে মত দেয়।পলাশ ডিভোর্স ফাইল রেডী করে।এই কথা শুনে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম।ঐ সময় জাহিদ বন্ধুত্বের দাবিতে পলাশকে বুঝানোর চেষ্টা করে।পলাশ জাহিদকে প্রচন্ড অপমান করে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ভালবাসা এত ঠুনকো হয় কেন?আসলে ভুল মানুষকে ভালবাসলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
বিচ্ছেদ মানেই বেদনার।ডিভোর্সের পর প্রত্যেকেই একটা কঠিন পরিস্থিতীর মধ্য দিয়ে জীবনের সময়গুলো পার করে।নিজেকে মানসিকভাবে শক্তিশালী রাখতে আমি কাজের মধ্যে ডুবে যাই।ঐ সময়টাতে আমি খুব ডিপ্রেশনে থাকতাম।তখন জাহিদের সাথে ওর ফোনে কথা হতো।সে সময় জাহিদ আমাকে অনেক সাপোার্ট দেয়।
বাপের বাড়ি আমার আর ফিরে যাওয়া হয় না।ক্লিনিকে একটা চাকরি যোগাড় করে নেই। ক্লাস মেট টুম্পার সাথে সাবলেটে বাসা ভাড়া নেই।ডিউটি শেষে ম্যাডামদের চেম্বারেও কাজ করে।অনেক পরিশ্রম করে আমি টাকা উপার্জন করি।পাশাপাশি ডিগ্রীগুলো নিয়ে নেই।কালে ভদ্রে বাবার বাড়ি যেতাম।নিজের ঠিকানাটা কাউকে দেইনি।
আজ আমি এই সমাজের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত গাইনি ডাক্তার।অর্থ যশ খ্যাতি সবই হাতের নাগালে।
তারপরও পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের বাসায় গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।না ওরা আমার অসম্মান করে না বরং অনেক বেশী ভালবাসে।কিন্তু ওদের ভরভরান্ত সংসার দেখে আমারও একটা সংসার পেতে ইচ্ছে হয়।ওদের সংসারে কত মায়ার বাঁধন।ঘরে ফেরার কত তাগাদা থাকে।

এই তো সেদিন রিমাকে বললাম,
—কফিশপে আয়।সময় কাটাই।
ও আমাকে বললো,
—-নারে অন্য আর একদিন।রাশেদ আর রাইমা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা তো ডাক্তার মানুষ।ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। আজ একটু সময় পেয়েছি ওদের নিয়ে রাতে ডিনারটা বাইরে করবো।

অথচ আমার জন্য অপেক্ষা করার এই পৃথিবীতে কেউ নাই।বাসায় গেলে ৩০০০ স্কয়ার ফিটের ফ্লাটের আসবাবগুলো আমার একাকীত্ব নিয়ে আমায় উপহাস করে।টেবিলে ভাত বেড়ে কেউ ডিনারে আৃার জন্য অপেক্ষা করে না।আত্মীয় স্বজন অনেকেই আসে ওদের প্রয়োজনে।আমার একাকীত্ব ঘোচাতে কেউ আসে না বরং করুণা করতে চায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here