#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-এগারো
মাহাবুবা বিথী
এই পৃথিবীতে যে সব মানুষ মানসিক দিক থেকে অনেক বেশী স্ট্রং তারা আপনজনের কাছে ততবেশী অবহেলিত। মা বাবারও ঐ সন্তানের জন্য মায়া ভালবাসা কম থাকে। ঐ মানুষগুলো কোন সমস্যায় কারো কাছে অনুগ্রহ না চেয়ে আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করে। আর নিজের সমস্যার সমাধান নিজে করে নেয়।
তাদের এই বৈশিষ্টের কারনে তারা সমাজে এবং তাদের আপনজনের কাছে পরিচিত হয় শক্ত মনের মানুষ বলে। তার কোন কষ্ট থাকতে পারে না এটাই তখন এই পৃথিবীর মানুষগুলোর ধারণা হয়। ফলে তার জন্য কোন ভালবাসা আপনজনের কাছে জমা থাকে না।
দুর্বলতা ঢাকতে তারা নিরালায় একাকী আল্লাহ পাকের কাছে কাঁদে।বাইরের খোলসটা তারা শক্ত আবরণে ঢেকে রাখে। তাদের জন্য এই পৃথিবীতে কোন সহানুভূতি থাকে না। সহানুভূতি দেখানোর মানুষগুলো বুঝে নেয় তাকে সাহায্য করার কোন প্রয়োজন নেই। তাকে যত আঘাত করা হোক না কেন সে ঠিক নিজেকে সামলে নিবে। আমার অবস্থাটা তাই হয়েছে।
যাই হোক বাসায় পৌঁছাতে রাত দশটা বেজে গেলো। ওয়াশরুমে গিয়ে আগে শাওয়ারটা সেরে নিলাম।সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদ যন্ত্রণা সব কিছু মুছে ফেললাম। খুব ক্ষিদে লেগেছে।ফ্রিজে ভাত ছিলো গরম করে নিলাম। একটু ডাল ও ছিলো সেটাও গরম করলাম। ডিমভাজি আর বেগুন ভাজি দিয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারগুলো অমৃতের মতো লাগলো।তারপর এশার নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা বাজে।
গতরাতে একদম ঘুম হয়নি। আজকে ঘুমাতে না পারলে প্রেসারটা বেড়ে যাবে। ঘুমানোর ভাগ্য আমার নাই।মা কিভাবে জানলো আমি জাহিদের বাসায় ছিলাম। পুরোটা না জেনে আমার দিকে মা নোংরা কথাগুলো ছুড়ে মারলো। কেয়ারটেকার নয়তো আমার ড্রাইভার এদের কাছ থেকে খবর পেয়েছে।আমি জানি বাবা মা আমাকে ফোন দিলে ব্যস্ততার কারণে ধরতে না পারলে কেয়ারটেকারের কাছে আমার খোঁজ নেয়। আমি সিঙ্গেল বলে আমার ব্যাপারে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী থেকে কেয়ারটেকার ড্রাইভার সবার দরদ উথলে উঠে। আগ বাড়িয়ে তারা আমার খোঁজ রাখে। এদের খোঁজের ঠেলায় আমার জীবনটা যন্ত্রণায় ভরে যায়।বিছানায় শোয়ার পর অনেক কষ্টে দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসলো।
খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফ্রেস হয়ে ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম।এরপর ওটস দুধ আর কলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম।নীচে নেমে গাড়িতে উঠতে যাবো এমন সময় আমার প্রতিবেশী রিতা ভাবীর সাথে দেখা হলো। উনি মর্নিং ওয়ার্ক করে বাসায় ফিরছিলেন। আমাকে দেখে বললেন,
—–কেমন আছেন আপা? দুদিন আগে আপনি মনে হয় বাসায় ছিলেন না। শুনলাম আপনার এক বন্ধু মারা গিয়েছে উনার বাসায় ছিলেন।উনি কি আপনার আত্মীয় হন? মনে মনে মেজাজটা খারাপ হলেও রাগ
চেপে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমি বললাম,
—–আত্মীয়র থেকে বেশী হন। রক্তের সম্পর্ক থাকলেই আত্মীয় হওয়া যায় না। আত্মীয় হতে গেলে আত্মার আপনজন হতে হয়। এই বর্তমান পৃথিবীতে অনেকেই তা হতে পারে না। কারণ এই পৃথিবীর মানুষগুলো কূটকচালে এতো বেশী ব্যস্ত থাকে তারা আত্মীয় হওয়ার সময় পায় না। আবার কূটকচাল না করলে উনাদের পেটের ভাতও হজম হয় না।আচ্ছা ভাবি আমি আসি।আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
প্রচন্ড বিরক্তবোধ করছি।তবুও জীবনের পথে প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিয়ে আমাকে এভাবেই পা
ফেলতে হয়। যাবার পথে জাহিদকে দেখতে গেলাম। মাহিন আজ অফিসে গিয়েছে।জাহিদ আর মৌমিতা কেবিনে ছিলো। আমাকে দেখে মৌমিতা বললো,
—–আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
আমি বললাম,
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।জাহিদ কেমন আছো?
জাহিদ বললো,
—–ভাল আছি।তবে ডাক্তার এই সপ্তাহে বাইপাস করবে।
আমি বললাম,
—-তোমার টেনশন হচ্ছে।চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।
মৌমিতা আমাকে বললো,
—-আন্টি অপারেশন থিয়েটারে আমি মেডিকেল পারসন বলে ডাক্তার আমাকে থাকতে বলেছে।
আমি বললাম,
—-বেশ ভাল। এতো বড় একজন সার্জেনের সাথে পরিপূর্ণ ডাক্তার হওয়ার আগেই অপারেশনে থাকতে পারছো তোমার সৌভাগ্য বলতে হবে।
মৌমিতা বললো,
—-আমিও খুব এক্সাইটেড।আবার টেনশনও হচ্ছে।
জাহিদ আমাকে বললো,
—–সম্পার মৃত্যুর তিনদিনের দিন মিলাদ মাহফিলের আয়োজন মাহিনকে করতে বলেছি। তুমিও অংশ নিও। আমি তো যেতে পারবো না।ডাক্তার আমাকে দু একদিনের মধ্যে বাইপাসের তারিখ জানিয়ে দিবে।
আমি বললাম,
—–জাহিদ আমার হাসপাতালের ডিউটি, আবার চেম্বার করে যেতে পারবো কিনা বলতে পারছি না। আমি সবসময় সম্পার জন্য দোয়া করি।আল্লাহপাক ওকে বেহেশত নসীব করুক।
জাহিদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও একটু মন খারাপ করেছে। আমারও একটু খারাপ লাগছে।একে তো ও অসুস্থ তারপর আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কি জাহিদকে শুধুই বন্ধু ভাবি নাকি বন্ধুত্বের আবরনে ওর জন্য আমার হৃদয়ে একটা জায়গা তৈরী হয়েছে। আসলে আমার কিছু করার নেই।এই পৃথিবীর মানুষগুলোর বাঁকা কথা আমার আর নিতে ইচ্ছা করে না।
আমি ওদের কাছে বিদায় নিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা হলাম। হাসপাতালে পৌঁছে আমি এক কাপ চা খেলাম।মাথাটা ধরেছে। পিয়নটাকে ডেকে আর এক কাপ চা দিতে বললাম।
সময়ের গতিপথে আমরা সবাই ব্যস্ত। দু,মাস হলো জাহিদের অপারেশন হয়েছে।অনেকটা সামলে উঠেছে। আজকে হাসপাতালে আসার সময় জাহিদকে দেখে অনেক ফ্রেস লাগলো।বেচারা বহুদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিলো। এর মধ্যে সম্পাও মারা গেলো।ওকে নিয়ে তখন আমার খুব দুঃচিন্তা হয়েছে। ও শারীরিক কন্ডিশনে সম্পার শোক সামলে উঠতে পারবে তো এটা নিয়ে খুব ভাবনায় ছিলাম।আসলে আল্লাহ হায়াত রাখলে মানুষ যেভাবেই হোক বেঁচে থাকে। হায়াত না থাকলে সহস্রবার চেষ্টা করলেও মানুষ বেঁচে ফিরতে পারে না।আল্লাহর কাছে অনেক শোকরিয়া।
আজকে চেম্বারে পলাশ আর তানিয়ার আসার কথা।একমাস আগে তানিয়ার জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করেছি। সাকসেসফুলি কাজটা হয়েছে। বিশেষকরে তানিয়া খুব খুশী। একজন ডাক্তার হিসাবে রোগীর খুশীতে আমারও খুব আনন্দ অনুভব হচ্ছে।
একজন নারীর জীবনে জগতের সবচেয়ে সুখের অনুভূতি হচ্ছে মা হওয়া। সন্তান জন্মদানের বিষয়টি এতো সহজ নয়। অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে তবেই একজন নারী মা হন।
এখানে পলাশের স্ত্রীর কোন শারীরিক জটিলতা নেই।
পলাশের শারীরিক জটিলতা ছিলো। অথচ পলাশের কোন মানসিক যন্ত্রণা ছিলো না। ওর যে সমস্যা থাকতে পারে এটাই ওর পরিবারের মানুষগুলো ভাবেনি। অক্ষমতার সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়েছে ওর স্ত্রীর উপর। আর হতভাগী তানিয়া অন্যের দায় মাথায় নিয়ে একরাশ মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়।
এতদিন চৈত্রের দাবদাহের পর ওদের দু,জনের জীবনে এক চিলতে মেঘ আসে। অবশেষে আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে ওর বউ গর্ভধারণ করে। কিছুক্ষণ পরেই তানিয়া আমার চেম্বারে আসলো।
—–আসসালামুআলাইকুম আপু।
ওকে একা দেখে
আমি বললাম,
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।এরকম একটা সুখের দিনে আপনার হাসবেন্ডের আসা উচিত ছিলো।
তানিয়া বললো,
—– ও আসতে চেয়েছিলো।হঠাৎ করে একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।তাই আসা হলো না।
আপু আসলে আমি আপনার কাছে আমার মনের কথাগুলো বলতে চাই। তাই ও না আসাতে আমি মনখুলে আপনার সাথে কথা বলতে পারবো।
আমি একটু চমকে উঠলাম।ও কি আমার আর পলাশের সম্পর্কের বিষয়টা জেনে গেছে।
অতঃপর ও বলা শুরু করলো।
—-আপু আজকে যে আমার কতটা আনন্দের দিন আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না। আমি ঢাকার সব ডাক্তারের অলি গলি ঘুরেছি। তবুও আমার কোন সমাধানের রাস্তা মেলেনি। ভারতে গিয়েও চিকিৎসা করিয়েছিলাম। সেখানেও আমার রেজাল্ট শুন্য। সমাজ কি আর এতো কিছু বোঝে। আকার ইঙ্গিতে আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলো মা হতে না পারা যেন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে আমিও মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিলাম।
অবশেষে গত রমজানে ওমরাতে গিয়ে আল্লাহপাকের কাছে অনেক কাঁদাকাটি করেছি।
অতঃপর আমার এক সুহৃদের সহায়তায় আপনার কথা জানতে পারি।আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি আল্লাহ আপনার জীবনটা খুশীতে ভরিয়ে দেন।
আমি বললাম,
—-আল্লাহপাক আপনার প্রার্থনা কবুল করে আপনাকে সন্তান দান করেছেন। আল্লাহ পাক যদি আপনাকে সন্তান না দিতেন তাহলে আপনি সন্তান পেতেন না। পৃথিবীতে বহু নিঃসন্তান দম্পতি আছেন।যার জন্য যেটা মঙ্গল আল্লাহপাক সেটাই দান করেন।
আপু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি,
আমি চমকে উঠলাম,তানিয়া আমাকে কি বলতে চায়।
চলবে