#দুঃখগাথার_রাজকন্যা
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৭
আরাভ অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে। এই বাড়িতে এরকম কোনো মহিলার যাতায়াত নেই। তাছাড়া এই বাড়ির প্রায় সদস্যের খবরাখবর ওর জানা। কে হতে পারে এই মহিলা কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলো। ততক্ষণে সেই সাদা চুলের মহিলা ওদের গেট পার করে ভেতরে চলে এসেছে। গেটের দারোয়ানকে দেখা যাচ্ছে না। না আর অপেক্ষা করা চলবে না,কথাটা ভেবেই ও তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসলো। সারা বাড়িতে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সবাই ঘুমিয়ে বিভোর। আরাভ সাবধানে পা ফেলে ডাইনিং রুমের দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। আকাশে চাঁদ আছে তবে মেঘ থাকার জন্য জোছনা তেমন নেই। ও গুটিগুটি পায়ে গেটের কাছে এসে দেখলো দারোয়ান গেটের দরজায় বসে ঝিমাচ্ছে। রাস্তায় কোনো গাড়িতো দূর কোনো মানুষের টিকিটাও নেই। ও ভ্রু কুচকে বকশির গায়ে হাত রাখতেই লোকটা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসলো। ওর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আরাভ ওসবে পাত্তা না দিয়ে বলল,
> কিছুক্ষণ আগে যেই ভদ্রমহিলা এসেছিল উনি কোথায় গেলেন?
> জ্বী সাহেব কার কথা বলেছেন?
> বৃদ্ধ মহিলাটা কোন দিকে গেলো জানো কিছু?
> ভাইজান কেউতো আসনি আসলে নিশ্চয়ই বলতাম।
> বসে বসে ঝিমালে কিভাবে ঠিক পাবে কেউ এসেছিল কিনা। আরেকজন লোকের ব্যবস্থা করতে হবে।
> ভাইজান আমি থাকতে আরেকজনের কি দরকার। আপনার চোখের ভুল সত্যিই কেউ আসেনি।
আরাভ সময় নষ্ট করলো না দ্রুত ফিরে আসলো। বকশীর সঙ্গে তর্কাতর্কি করে সময় নষ্ট হবে শুধু।। ও টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে যখন মুখে ধরলো ঠিক তখনই পেছন থেকে ধুপ করে একটা আওয়াজ পেলে। ও দ্রুত পেছনে তাঁকিয়ে দেখলো রাত্রি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আরাভ কৌতূহলী হয়ে পানির গ্লাস নামিয়ে পিছিয়ে এসে জিঙ্গাসা করলো,
> এতরাতে তুমি এখানে কি করছো?
> বাইরে আওয়াজ শুনতে পেলাম তাই ঘুম ভেঙে গেলো। আপনে কি করছেন?
> পানি খেতে এসেছি। বসবে আমার সঙ্গে? আমার ঘুম আসছে না।
আরাভের এমন প্রস্তাব শুনে রাত্রি কিছুটা ভয় পেলো। এই ছেলেটার বুদ্ধি একটু বেশিই। কি দিয়ে কি প্রশ্ন করবে তখন জীবন যাবে উত্তর দিতে । কিন্তু মানা করবেই বা কিভাবে? ওর এমন নীরবতা দেখে আরাভ কিছুটা হেসে বলল,
> ভয় পেতে হবে না। আমি তোমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন বা হাত দেখতে চাইবো না। যদিও লোকের মুখের উপরে প্রশংসা বা খারাপ কথা বলতে হয়না তবুও বলছি তোমার কালো রঙটা ঠিক তোমার সঙ্গে যায় না।
আরাভ কথাগুলো বলতে বলতে সোফায় গিয়ে বসলো। রাত্রিও আসলো ওর পিছু পিছু। আরাভকে ওর দেখে ওর কেমন লাগলো। লোকটাকে দেখে সুখী মনে হলেও আসলেই কি লোকটা সুখী নাকি সুখে থাকার অভিনয় করে। কথাগুলো ভেবে ও জিঙ্গাসা করলো,
> আচ্ছা আপনার বাবা ঘনঘন আসেন কিন্তু এই বাড়িতে আপনার আম্মা আসেন না কেনো?
>রাত্রী আমার আম্মা নেই।। যখন আমার বয়স পনেরো মাস তখন উনি মারা গেছেন। তারপর থেকেই আমি খালামনির আছে মানুষ হয়েছি। যদিও আমার নতুন মা আমাকে খুব একটা অপছন্দ করেন না তবুও খুব খারাপ লাগে মায়ের জন্য। উনি থাকলে হয়তো এখানে থাকতে হতো না।
> আফসোস করবেন না তবুও তো আপনার বাবা আছেন আমার যে কেউ নেই। যার কেউ নেই সেই কিন্তু সুখী। কিছু হারানোর ভয় থাকে না। নিজেকে নিয়ে যেকোনো জায়গাই ঠাই নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। দেখছেন তো আমি কেমন ভালো আছি।
> হুম। রাত্রী তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছো?
> তেমন আর কোথায় পড়তে পারলাম। সামান্য পাড়েছি আরেকদিন বলবো। আচ্ছা সাহেব একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন।
> হুম বলো।
> খালাম্মার ছেলে সৌরভ ভাইজান কি রাতে ঘুমাননা?
> কেনো?
> কিছুক্ষণ পরপর সে বাইরে এসে হাঁটাহাটি করছে। হয়তো উনি কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত।
> তুমি রুমে যাও আমি ওর সঙ্গে কথাবলে নিবো।
> জ্বী।
রাত্রী চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসলো কিন্তু পেছনে থেকে হুকুম আসলো রাতে যেনো ও আর কখনও বাইরে না আসে। এই বাড়ির কেউ রাতে চা কফি খাই না। যার ইচ্ছা হয় রুমে গরম পানি করে রাখে। রাত্রি মাথা নাড়িয়ে সাড়া দিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করলো। আরাভ এখনো বসে আছে। সৌরভের চলাফেরা খুব একটা বোঝা যায় না। নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। এরা দু ভাইবোনের মাথায় সমস্যা আছে। একটা বাইরে ঘুরতে পছন্দ করে আরেকজন ঘরে থাকতে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ঘড়ির কাটা তিনটা ছুই ছুই। এখন ঘুমের প্রয়োজন। এভাবেই রাতটা পার হলো। খুব সকালবেলায় হঠাৎ চিৎকার চেচামেচিতে আরাভের ঘুম ভাঙলো। ও তাড়াতাড়ি বাইরে এসে অবাক হলো। ডাইনিং রুমে বড় ধরণের ঝটলা। সোনিয়া মির্জা মেয়ের উপরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছেন কিন্তু সমস্যা কোথায় আরাভ বুঝতে পারছে না। ও চোখ মুছে নিচে নেমে এসে জিঙ্গাসা করতেই সোনিয়া মির্জা কাঁদতে কাঁদতে আরাভকে জড়িয়ে ধরে বলল,
> বাবা তুই একমাত্র পারিস আমার সম্মান রক্ষা করতে। এই মেয়েটা আমার চরম সর্বনাশ করেছে। মান সম্মান বলতে কিছুই থাকবে না।
> খালামনি হয়েছে কি এটা আগে বলবে? মীরা আবার কি করেছে?
> বাকী রেখেছে কি এটা বল? টিউশন পড়াতে আসা ছেলের সঙ্গে…ছি আমার বলতেও কেমন বমি আসছে।
আরাব সোনিয়া মির্জাকে পাশে সরিয়ে রেখে মীরার দিকে তাঁকালো। মেয়েটা চুপচাপ অপরাধীর মতো মাথ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে যারা ছিল সবাই চুপচাপ তবে রেগে আছেন। মির্জা সাহেব সোফায় বসে হুঙ্কার দিচ্ছেন। আরাভ মীরার কাছে গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> ছেলেটাকে ভালোবাসিস?
আরাভের কথার উত্তর আসলো না পাশ থেকে সোনিয়া মির্জা মীরার চুল ধরে বলল,
> ভালোবাসে বললেই হলো। পেটে অজাত কুজাতের বংশধর নিয়ে ঘুরছে আমার বাড়িতে ওসব হবে না। হয় ওকে বাড়ি ছাড়তে হবে নয়তো আমি যা বলবো তাই ওকে করতে হবে।
> খালামনি ওর উপরে চাপ দিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। ও যদি চাই তাহলে ছেলটাকে ডেকে আমরা বিয়ে পড়িয়ে দেই কি বলো?
আরাভের কথা শুনে মিরা তাড়াতাড়ি এসে আরাভের পা জড়িয়ে ধরলো। ও কান্নাকাটি করে বলল,” আমি ওকে ভালোবাসি না। ওই ছোটলোকের সঙ্গে সম্পর্ক করবো আমি? কখনও না। ও জোরকরে হুমকি দিয়েছে তাই। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। প্লীজ তুমি আমাকে গ্রহণ করো।
আরাভ পড়লো মহা বিপদে। কিভাবে এদেরকে এড়িয়ে যাবে। মীরাকে ও নিজের বোনের মতো ভাবে আর তাকে বিয়ে করতে হবে ভাবতেই ওর গলা শুকিয়ে আসছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে তবে এটা পরে।এখন পরিস্থিতি সামলাতে হবে ভেবে ও মীরাকে পায়ের উপর থেকে তুলে বলল,
> তুই রুমে যা। আমি দেখছি কি করা যায়।
ওর ভরসা পেয়ে মীরা চুপচাপ চোখ মুছে নিজের রুমে চলে আসলো। আজহার মির্জা সোফায় আয়েশ করে কফি খাচ্ছেন উনার কোনো হেলদোল নেই। সৌরভ মাথায় হাত রেখে বসে আছে। মোটামুটি সবাই চুপচাপ একমাত্র সোনিয়া মির্জা ছাড়া। উনি সেই ছেলেটাকে দেখে নেবেন সেই হুমকি দিচ্ছেন বিভিন্নভাবে। আর সেগুলোই আপন মনে বিড়বিড় করছেন। রাত্রি রান্নাঘরে রান্না করছে। আরাভ রাত্রির কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল,
> এককাপ চা দিতে পারবে?
> আপনার চা তৈরী করাই আছে।
কথাটা বলে রাত্রি চায়ের কাপটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো। রাত্রী ওকে চা দিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। বড়লোকদের বাড়িতে বড়বড় সমস্যা। এগুলো নিয়ে ভাবলে ওর চলবে না। এদের বিষয় এরা বুঝবে। আরাভ চা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। মাথার উপরে একটা বড় বোঝা এসে উপস্থিত কিভাবে কি করবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না। তমাল যদি বুদ্ধি দিতে পারে ভেবে ও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আরাভ রিকশা নিয়ে কলেজ গেটে এসে নামলো। তমালকে ফোন করেছিল ছেলেটা ঘুমিয়ে ছিল রেডি হয়ে আসতে আসতে ওর বেশ ঘন্টা খানেক দেরি হলো।
তমাল দেরিতে আসলে আরাভ ওকে খুব বকাবকি করে কিন্তু আজকে করলো না। আসার মাত্রই নির্জনে নিয়ে গিয়ে বসলো। আরাভের সারা মুখে বিষণ্নতার ছাপ। তামাল অবাক হয়ে জিঞ্জাসা করতেই ও সব খুঁলে বললো। দুজনে মিলে অনেক ভাবলো তবুও তেমন কিছুই উপাই মিলল না। অবশেষে তমাল বলল,
> ভাই আমার মাথায় দারুন একটা বুদ্ধি এসেছে।
>কী শুনি
> তুই কাউকে বিয়ে করে ফেল। দেখ যদি তোর বউ থাকে তাহলে তো সমস্যা হবে না। যার যার বাচ্চা কাচ্চা সেই সেই সামলা। কারো ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলবে না। ওইটুকু একটা মেয়ের পেটে কি বুদ্ধি।
> তোর পেটেও কমনা। এই মুহূর্তে আমি বউ কোথায় পাবো শুনী। এসব ছাড় আগামীকাল আমি বাড়িতে চলে যাবো। আপাতত কিছুদিন গায়েব।
> শোন ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আজকের মধ্যেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। পরে ঠিক একটা উপাই পেয়ে যাবো।
আরাভ হাতাশ মনে উঠে আসলো। সারাদিন ক্লাস করে এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করে পড়ন্ত বিকালে ও বাড়িতে ফিরলো কিন্তু বাড়ির গেটে আসতেই ওর চোখ ছানাবড়া। ও ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে আসতেই রাত্রি হাসিমুখে বলল,
> যার বিয়ে তার খোঁজ নেই পাড়া পড়শির ঘুম নেই। বাড়িতে আপনার বিয়ের আয়োজন চলছে আর আপনিই নেই। আসুন সবাই অপেক্ষা করছে।
রাত্রীর কথাশুনে আরাভের বুকের মধ্যে ধপ করে উঠলো। ওর মনে হলো এখুনি দৌড়ে পালিয়ে যায়। কি হবে এখন?
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন তেলোয়াত করি।