#দুঃখগাথার_রাজকন‍্যা
#কলমে_লাবণ‍্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_২

প্রায় জনশূন‍্য কামরা,বোররাতের ট্রেনে খুব দরকার ছাড়া মানুষ উঠে না। রাত্রি সামনের দিকে তাঁকালো কিছুদূরে কয়েকজনকে ছাড়া কাউকে নজরে আসছে না। সামনে টিনের বাক্সটা রাখতেই হঠাৎ ওর মনে হলো ভেতরে কি আছে দেখিনা। বাবার দেওয়া শেষ সম্বলটুকু নিয়ে যদি কপালের দুঃখ ঘোচে কথাগুলো ভেবে ও আচলে রাখা চাবি দিয়ে বাক্সটা উন্মোচন করলো। ভেতরে রাত্রির ছোটবেলার ছবি সঙ্গে আছে বেশ কিছু অচেনা নারী পুরুষের ছবি। রাত্রী ভালো করে দেখলো কেউ চেনা নেই। নিচে একখানা পুরাতন ডাইরি আর কিছু দলিল যদিও ওর এগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। রাত্রি পেপার রেখে ডাইরি পড়তে মন দিলো। খুব সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখাগুলোকে কেমন টাইপ করা মনে হচ্ছে।নীল কালিতে অক্ষরগুলো ফুটে উঠেছে। রাত্রী ডাইরির প্রথম পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করলো,

” আমি রেহেনা পারভীন, বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। যাকে সবাই ভালোবেসে রেহেনা বলেই ডাকে। বাবার বিশাল বিষয় সম্পত্তি আর তার একমাত্র কন‍‍্যা হবার দরুণ আমার অঘাত চলাফেরাতে খুব একটা বাধা বিপত্তি ঘটেনি। পড়াশোনাই ছিলাম মোটামুটি ভালো। যখন যা চেয়েছি বাবা হাজির করতেন এভাবেই আমার বেড়ে উঠা। সংসারে বাবা মা দাদা দাদি অনেকেই ছিলেন। ভালোবাসাই কখনও অভাব হয়নি আমার। একদিন সব কিছুই শেষ হয়ে যায় ঠিক তেমনিভাবে আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আমার সব ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষ গুলো হারিয়ে গেলো। কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো আমার জীবনে প্রেম এলো আর আমার গোছানো জীবনটাকে এলোমেলো করে আমাকে নরকে ফেলে দিয়ে গেলো। লোকটাকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম সেই লোকটাই আমার স্বপ্নভঙ্গ করলো। আমার পরিবার থেকে আমাকে দূরে করে নিলো। আমিও ভালোবাসাই অন্ধ হয়ে লোকটার সঙ্গে বাড়ি ছাড়লাম। আসার সময় বিশাল অঙ্কের নগদ অর্থ আর মায়ের চল্লিশ ভরি গহনা নিয়ে লোকটার শূন্য হাত পূণ্য করে দিলাম। পালানোর প্রথম দিনকেই আমরা বিয়ে করে নিয়েছিলাম। লোকটা আমার আনা টাকা গহনা গুলো দিয়ে ব‍‍্যবসা শুরু করে। টুকটাক চলছিল আমাদের দিন। খুব মনে পড়তো বাবা মায়ের মুখখানা । কিন্তু কখনও ফিরে যেতে পারিনি। ভয় হতো যদি মেনে না নেয় তখন কি হবে? এভাবেই আমাদের দিন যেতে থাকে। ততদিনে আমাদের অবস্থার বিশাল পরিবর্তন ঘটে। আমার স্বামী কয়েক বছরে শহরের নামকরা লোকদের মধ্যে একজন হয়ে উঠে। আমার কোল জুড়ে আসে ছোট্ট রাজকন‍্যা। স্বামি নামের লোকটার মধ্যেও কেনো জানি আর আমার প্রতি মোহ আসেনা। সে দুদিন পরপর বাড়ি ফিরে। আমি কিছু বললেই আমার উপরে চলে নির্যাতন। চুপচাপ মেনে নিতাম যাবার কোনো যায়গা ছিল না যে চলে যাবো। তারপর একদিন হঠাৎ আমার নামে একটা চিঠি আসলো। আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবার বাড়ি থেকে এই প্রথম চিঠি এসেছে ভেবে আনন্দের সীমা ছিল না। আমি চিঠিটা খুলে নিরাশ হলাম। বাবা লিখেছে উনার শরীরের অবস্থা তেমন ভালো নেই তাই উনার সব সম্পত্তি আমার কন‍্যার নামে উইল করা হয়েছে। এই সম্পত্তিতে আমি বা আমার স্বামী কখনও অংশীদার হতে পারবো না। উনি আমার মুখটাও দেখতে চান না। আমি চিঠি হাতে অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম। তারপর চুপিসারে তাদের খোঁজ নিয়েছি। মায়ের সঙ্গে দেখা করেছি। এভাবেই কিছুদিন পার হলো। আমার মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর চলছে। মেয়ের বাবার এখন আর আমার উপরে নজর নেই। উনি আছেন নিজের খেয়ালে। শুনেছি কোন এক মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে। সম্পতির মালিকানা আমার নামে থাকাই উনি আমাকে ডিভোর্স দিতে পারছেন না। তবে নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কোনো উপাই উনি অচিরেই খুঁজে নিবেন। আমার প্রাণ সংসয় হবার সম্ভাবনা আছে। নিজের প্রতি আমার কোনো মায়া নেই আছে মেয়ের জন্য। আমি ছাড়া মেয়েটাকে কে দেখবে বা ওর যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় এসব ভেবেই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কলেজে আমার পরিচিত একজন বড় ভাই ছিলেন। উনার সঙ্গে আমার বেশ আলাপ আছে। আমার বিপদের কথাগুলো উনাকে বালার জন্য আজ ডেকেছি। উনি দিনের সমস্ত কাজ গুছিয়ে নিয়ে বিকালে আসবেন আমার বাড়িতে”।

রাত্রি এই পযর্ন্ত এসে থামলো। আপাতত লেখা শেষ। এইটুকু পড়তেই ওর বেশ বিরক্ত লেগে গেছে। মনে হচ্ছে এটা কোনো উপন‍্যাস।। রাত্রি নেড়েচেড়ে দেখলো ডাইরিতে আর কোনো লেখা নেই তবে ভেতরে একটা চিঠি আছে। ও কৌতূহলী হয়ে চিঠিটা খুলে দেখলো, বাবার হাতের লেখা। রাত্রির চোখে পানিতে ছলছল করে উঠলো। বাবা ওর জন্য চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। আগে জানলে এতদিন কখনও অপেক্ষা করতো না। আগেই পড়ে নিতো। কথাগুলো ভেবে ও চিঠিটা পড়তে শুরু করলো,

মা রাত্রি,
জানি তুই ভালো নেই। বাবা পাশে না থাকলে মেয়ে যে ভালো থাকতে পারেনা। তবুও ভালো থাকতে হবে মা। যাইহোক আমি যেই কথাগুলো লিখছি সেগুলো মন দিয়ে শুনবি।তোকে আমি নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছি কিন্তু নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর মা। ডাইরিতে লেখা ওই ভদ্রমহিলাই হচ্ছে তোর নিজের মা। আমি সেদিন রাতে গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করতে। ভেবেছিলাম ফিরে আসবো কিন্তু রাত হবার জন্য রেহেনা আমাকে আটকে দিয়েছিল।আমি যে ও বাড়িতে আছি তোর বাবা এটা জানতেন না। গভীর রাতে তোর বাবা তোর মাকে খুন করে ফেলেন। তুই তখন দরজায় চোখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলি আমিও ছিলাম ঠিক তোর পেছনে। তুই অনেকটাই ছোট ছিলি তাই এতোটা মনে নেই। যখন ওরা তোর মায়ের লাশ গুম করতে নিয়ে যায় ঠিক তখনই আমি তোকে নিয়ে বাইরে চলে আসি। তুমি ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিলি। তোর বাবা তোকে নিজের বন্ধু হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল তাই সেই গভীর রাতে তোকে নিয়ে আমি ট্রেনে চেপে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে কখনও মনে করাতে দিবো না তোর আসল পরিচয় কিন্তু মা তুই তো আমার একার না। রেহেনার উপরে হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ নিয়ে নিজের সব কিছু ফিরিয়ে নিবি এটাই তোর কাছে আমার শেষ চাওয়া। লেখাটা যখন তুই দেখবি তখন হয়তো আমি আর এই পৃথিবীতে থাকবো না তবুও উপর থেকে তোর জন্য আমার দোয়া থাকবে। ভালো থাকিস মা।
“তোর বাবা”

রাত্রি চিঠিটা পড়ে যেমন অবাক হয়েছে তেমন দুঃখও পেয়েছে। বেশ কিছু স্মৃতি ওর চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। ভেবেছিল ওগুলো ওর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু না ওগুলো নেহায়েত স্বপ্ন ছিল না। ওর জীবনে ঘটে যাওয়া কঠিন বাস্তব ছিল যেটাকে ও ভুলে যেতে শুরু করেছিল। রাত্রি চোখের পানি মুছে নিলো। পনেরো বছরে হয়তো ওর বাবা নতুন বিয়ে করে সংসার সাজিয়েছে ফেলেছে। অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটেছে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম আগে করতে হবে।।লোকটার পাপের শাস্তি দিতেই হবে। কথাগুলো ভেবে ও নানু বাড়ির ঠিকানা বের করলো। ওর উদ্দেশ্যে মায়ের বাবার বাড়িতে গিয়ে আস্তানা তৈরী করা।

অন‍্যদিকে রাহুল সারা রেলস্টেশন তন্নতন্ন করে খুঁজেও রাত্রিকে পেলো না। মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেলো ওকে না পেলে বস ভীষন রেগে যাবেন। ও হন্তদন্ত হয়ে লোকদের জিঞ্জাসা করছে ওর ছবি দেখিয়ে কিন্তু ওরকম কাউকে এদিকে আসতে কেউ দেখেনি। তাছাড়া কিছুক্ষণ আগেই একটা ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে সিলেটের উদ্দেশ্যে। রাহুল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। মেয়েটা ভীষন চালাক। ওকে হাতে পেলে জন্মের শিক্ষা দিয়ে তবেই ছাড়বে। এর আগে সজিবকে ও দেখে নিবে। কথাগুলো ভেবে ও সবাইকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

বিশালাকার মির্জা বাড়িতে একজন কাজের মেয়ে নেই। সকাল থেকে বিকাল পযর্ন্ত সোনিয়া মির্জা চিৎকার করেন। কোন এক অজানা কারণে বাড়িতে কোনো কাজের মেয়ে থাকে না। সব কাজগুলো উনি আর উনার দুইটা কাজের ছেলে, রফিক আর রবি ওদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে করেন। মির্জা সাহেব দোতালায় বসে গিন্নির চিলচিৎকার শুনছেন আর হামি ছাড়ছেন। উনার ভাইরা উজির আলী কিছুদিন বাড়িতে আসছে না এটা নিয়ে উনি বেশ চিন্তিত আছেন। মেয়েটা এখনো ঘুমিয়ে আছে। পড়াশোনার প্রতি প্রবল অনিহা এভাবে চললে কিভাবে আরাভের যোগ্য হবে আল্লাহ্ জানে। বাড়িতে একটা কাজের মেয়ের একান্ত দরকার কিন্তু কোথায় পাবেন? হুটকরে তো আর কাজের মেয়ে পাওয়া যাবে না। একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। দিনটা উনার এভাবেই পার হলো। পড়ন্ত বিকেলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ উজির আলী একটা মেয়েকে নিয়ে হাজির। সোনিয়া মির্জা মেয়েটাকে দেখে বেশ খুশী তবে উনার মেয়ে মিরা বিষয়টাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখছেন না। মেয়েটা স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত কালো। কালো মেয়েদের মন কালো হয়। তবুও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ও চুপচাপ মেনে নিলো। মির্জা সাহেবের কিছুই বলার নেই। উনি উজির আলীকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। মোটামুটি যখন ঠিকঠাক ঠিক তখনই সোনিয়া মির্জা মেয়েটিকে প্রশ্ন করলেন,

> তোমার নাম কি?

> রাত্রি, অন্ধকারের রাত্রি নয় গো এক্কেবারে আলো ঝলমলে জোছনা রাতের রাত্রি।

রাত্রি মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে কথাগুলো বলে থামলো,

> বাহ সুন্দর নাম। যাইহোক বাড়িতে কে কে আছে?

> কেউ নেই। ছোটবেলার মা মারা গেছেন বাবার খবর জানিনা।এতোদিন পালক বাবার কাছে ছিলাম উনিও মারা গেছেন। থাকার জায়গা নাই, রেলস্টেশনে বসে ছিলাম উনি দেখে সঙ্গে এনেছেন। আমাকে কিছুই দিতে হবে না শুধু থাকার জায়গা আর খাইতে দিলেই হবে। খালাম্মা দয়াকরেন,

> এমন মেয়েকেই তো আমার চাই। তুমি যাও রবি তোমাকে সব বুঝিয়ে দিবে। শুনো আগামীকাল আমার বোনের ছেলে আরাভ আসছে। ওর জন্য ভোরবেলায় নাস্তা তৈরী করার দায়িত্ব কিন্তু তোমার। ওতো সকালে আমরা কেউ উঠিনা। ছেলেটার আবার ভোরবেলায় ক্ষুধা পাই।

> জ্বী খালাম্মা।

রাত্রি মাথা নাড়িয়ে রবি নামের ছেলেটার পেছন পেছনে হাটা ধরলো। ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গেছে। সকালবেলার নাস্তা বলতে ও শুধু পরোটা ডিমভাজি আলু ভাজি এগুলো পারে। তাছাড়া কিছুই পারেনা। আম্মা কখনও ওকে এগুলো করতে দেননি। সবকিছু সামলে নিতে হবে। থাকার মতো একটা জায়গা হয়েছে এটাকে হাতছাড়া করা একদম ঠিক হবে না।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here