নির্জন রাস্তাই দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে থামলো রাত্রি। পা আর চলছে না, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। কিছুক্ষণ আগেই বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে সে। ওর জীবনের অঘটন গুলো শুধু রাতের বেলাতেই ঘটে। রাতকে ও ভীষন ভয় পাই তাই হয়তো বাবা নাম রেখেছিলেন রাত্রি। অন্ধকার যার জীবন সঙ্গী সেই রাত্রি। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের দুঃখ কখনও শেষ হয়না। প্রতিযোগিতা করে আসে যাতে তাকে দুমড়ে মুচড়ে আহত করে ধুকে ধুকে মারা যায়। রাত্রীও তাদের মধ্যে একজন। ওর দুঃখের কথা মনে থাকুক বা না থাকুক দুঃখ ওকে কখনো কাছ ছাড়া করেনা। ও যেনো এক দুঃখগাথার রাজকন্যা। কথাগুলো ভেবেই ঝরঝর করে ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এই বিশাল পৃথিবীতে আপনার বলতে ওর কেউ নেই। যাকে এতদিন নিজের মনে করে এসেছিল এতোদিন পরে জানলো ওরা ওর আপনার কেউ না। আল্লাহ্ সৃষ্টি এই বিশাল পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও ওর জন্য রিজিক ঠিকই লেখা আছে এটা ভেবেই ও অজানার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছে। বাবা মারা যাবার আগে ওকে একটা টিনের বাক্স দিয়েছিল।আসার সময় আম্মা ওটা সঙ্গে দিয়েছেন কিন্তু খুলে দেখা হয়নি। বাক্সের জিনিগুলো নিয়ে ওর মাথা ব‍্যাথা নেই। বাবা গরিব মানুষ ছিলেন,কোনো দামি বস্তু বক্সে থাকবে না এটা ও নিশ্চিত। তাছাড়া এটা শুধুই বাবার শেষ স্মৃতি ওর কাছে তাছাড়া কিছুই না। বাক্সটা আজকের এই কঠিন সময়ে কাজে দিবে কি এখনোতা ভাবা হয়নি। বাক্সটা দুহাতে আকড়ে দৌড়াতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে হয়তো এখন হৈচৈ পড়ে গেছে। টাকার জন্য সজিব ভাইয়া নিজের নেশাখোর মাতাল মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করেছি তাই একপ্রকার বাধ‍্য হয়েই আম্মা ওকে ঘরের জানালা দিয়ে পালাতে সাহায্য করেছেন। আসার সময় জেনে এসেছে ওরা কেউ ওর আপনজন না।অনেক ছোটবেলাতে কোনো এক মধ্য রাতে বাবা ওকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল। কথাগুলো ভাবতেই রাত্রির বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। সজিব ভাইয়া এই জন‍্যই ওকে কখনও সহ‍্য করতে পারতো না। সব সময় খারাপ ব‍্যবহার করতো। রাত্রী চোখের পানি মুছে আচলে থাকা মায়ের দেওয়া ঠিকানাটা দেখে নিলো। আম্মার কোনো এক বড়লোক বান্ধবীর বাড়ির ঠিকানা। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই একটা থাকার জায়গা পাওয়া যাবে। বাড়ির কাজকর্ম যদিও তেমন পারেনা তবে কষ্ট করে মানিয়ে নিবে।কথাগুলো ভেবে ও রেলস্টেশনের দিকে এগুলো। ভোররাতের ট্রেন ওর একমাত্র ভরসা।। যদি লোকজন ওকে খুঁজতে আসে তখন কি হবে ভেবে ও ঢোক গিলল। গায়ে বিয়ের শাড়ি গহনাগুলো চেঞ্জ করা দরকার ভেবে ও আবারও দৌড় দিলো।

অন‍্যদিকে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন রুনু বেগম। উনি নিজের ছেলের কর্মের জন্য লজ্জায় পড়েছেন।বিবাহ উপযুক্ত বাবা মা ছাড়া অনাথ মেয়েদিকে নিয়ে উনার চিন্তার শেষ ছিল না। ভেবেছিলেন মেয়েটাকে দূরে কোথাও পাঠাবেন না কাছেই রাখবেন নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কিন্তু ছেলেটা হয়েছে মহা পাজি। মেয়েটার নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। ঘরের অবস্থাও তেমন ভালো না স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটুকু দিয়েই চলছেন। ছেলেটার এবছর পড়াশোনা শেষ হচ্ছে হয়তো আগামী বছরের মধ্যেই কিছু একটা চাকরি গুছিয়ে নিবে। এমন টানাটানির সংসারে মেয়েটাকে ভাত কাপড় দিয়ে পালন করছেন এটাই অনেক তারপর আবার এতগুলো টাকা খরচ করে বিয়ে দেওয়া কখনও সম্ভব ছিল না। তাই উনি বাধ্য হয়েই সজিবকে বলেছিলেন ” বাবা তুই তো রাত্রিকে বিয়ে করতে রাজি না তাহলে একটা ভালো পাত্র দেখে মেয়েটার যদি বিয়ের ব‍্যবস্থা করতি তাহলে আমি বেঁচে যেতাম। মেয়েটা দেখতে সুন্দর,মহল্লার বখাটেদের চোখে পড়ছে তাই একটা নিরাপদ আশ্রয় ওর জন্য খুবই দরকারি”। সজিব মায়ের কথা শুনে কিছুই বলেনি শুধু মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ থেকেছে। সেদিনের মতো কথাগুলো শেষ হয়েছিল তারপর হঠাৎ আজ সকালবেলায় ও হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে বলল,
> আম্মা রাহুলের সঙ্গে রাত্রীর বিয়ের ব‍্যবস্থা পাকা করে এসেছি, ওরা রাতে আসবে। তুমি বিয়ের ব‍্যবস্থা করো। তোমার আপন ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে রাত্রীর বিয়ে হলে তুমি নিয়মিত দেখতে যেতে পারবে সমস্যা হবেনা।

ছেলের এমন কথায় রুনু বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

> তোর মাথা ঠিক আছে? ছেলেটা নেশাখোর তাছাড়া ওর একটা মেয়ে আছে। ওর এসব খারাপ গুনের জন্যই ওর বউটা ওকে ডিভোর্স দিয়েছে তারপরও তুই রাজি?
> তো কি হয়েছে? পুরুষ মানুষের আবার বউ একটা দুইটা কি আম্মা? বউ চলে গেছে আবার বিয়ে করবে। তুমি চিন্তা করোনা রাত্রি ভালো মেয়ে ও রুহুলকে নিজের মতো মানিয়ে নিবে। আর থাকলো রাহুলের ওই পিচ্চি মেয়েটা? ওর ব‍্যবস্থাও করে ফেলেছি।

> কি ব‍্যবস্থা করেছিস?

> গতকাল ওকে এতিমখানাই দিয়ে দিয়েছি । রাহুল এটা ভালো বেতনের কাজ পেয়েছে,রাত্রি ভালো থাকবে চিন্তা করোনাতো।যাও তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। রাহুলের অফিসের বসও আসবেন বিয়েতে।

> তুই কার মতো হয়েছিস জানিনা।তবে সত্যিই তুই আমার ছেলে কিনা সন্দেহ হচ্ছে। মানুষ এতোটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে। মেয়েটাকে আমি নিজের মেয়ের মতো পালন করেছি।

রুনু বেগম কেঁদে ফেললেন ছেলেটার এমন খাপছাড়া কথা শুনে। উনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সজিবের খুব রাগ হলো। কোথায় ওকে ধন্যবাদ দিবে তানা আম্মা কাঁদছে। তাই ও রাগ করেই বলল,

> আম্মা একদম নাকে কাঁদবে না। আমার ভালো লাগে না। যাও তো এখন।

সজিব রুনু বেগম কে ঝাড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তার কিছুক্ষণের মধ্যে হৈচৈ করে বিয়ের বাজার জিনিসপত্র আসা শুরু করলো। রুনু বেগম বুঝতেই পারলেন না এতগুলো জিনিস রুহুল কিভাবে পেয়েছে তারপর গোপনে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে কথাবলে জেনেছে রুহুল ওর বসের সঙ্গে মিলে রাত্রিকে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছে। আর সজিব টাকার জন্য মেয়েটার কথা না ভেবেই রাজি হয়েছে। তারপর আবার ওকে আর্কষণিয় বেতনের জবের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব কারণেই বিয়েটা হচ্ছে। রুনু বেগম কিছুতেই রাত্রির এতবড় সর্বনাশ করতে দিবেন না তাই বিয়ের কিছুক্ষণ আগে সুযোগ বুঝে জানালা দিয়ে ওকে বাইরে বের করে দিয়েছেন। মেয়েটাকে এভাবে পাঠাতে উনার মনে সাড়া না দিলেও কিছু করার ছিল না। কথাগুলো ভেবে উনি চোখের পানি মুছলেন। বাইরে সজিব একা একা বসে আছে বাকিরা গেছে রাত্রিকে খুঁজতে। এখন সজিবের সামনে যাওয়ার মানেই হয়না। ছেলেটাকে উনি একটুও সহ‍্য করতে পারছেন না। সামনে গেলে যেকোনো ভাবেই রাত্রির সন্ধান নিয়েই ছাড়বে। উনি এটা করবেন না তাই চেয়ারের উপর উঠে সিলিং ফ‍্যানের সঙ্গে শাড়ির এক প্রান্ত বেধে বাকিটাতে ফাঁস লাগিয়ে নিজের গলাই পড়ে নিলেন। চোখের পানি বাঁধ ভেঙেছে মনে হচ্ছে আত্মহত্যা মহাপাপ,তারথেকেও বড় পাপ হচ্ছে ওরকম খারাপ ছেলের মুখে মা ডাক শুনাটা। থাক পৃথিবীতে এতিম হয়ে যেমন আছে রাত্রি। কথাটা ভেবেই উনি ঝুল দিলেন। সজিব বাইরে বসে আছে উদ্দেশ্যে রুনু বেগম যখনই বাইরে আসবে তখনই রাত্রির খবর জেনে নেওয়া। রুহুল ওকে বুদ্ধি করে বাড়িতে রেখে গেছে নয়তো এতক্ষণে ও ঠিকই খোঁজ লাগিয়ে দিতো। কিন্তু আম্মা বাইরে আসছে না কেনো কথাটা ভেবে ও দরজায় গিয়ে দাড়ালো। আম্মা কখনও ওকে নিরাশ করবেন না। ছেলের থেকে আপনার কেউ কখনও হয়নাকি। মাঝে মধ্যেই রাত্রির উপরে রাগ হতো তবুও চুপচাপ ছিল।কিন্তু রাহুল ওকে বুঝিয়েছে রাত্রি সংসারের বোঝা ছাড়া কিছুই না। ওকে দিয়ে যদি ওদের উপকার হয় তাহলে দোষের কি আছে? এসব ভেবেই সজিব রাজি হয়েছিল কিন্তু এখন ঝামেলা বেধে গেলো।

অন‍্যদিকে রাত্রি রেলস্টেশনের ভেতর থেকে বাথরুমে গিয়ে নিজের পোশাক পরিবর্তন করে নিলো। আসার সময় আম্মা সঙ্গে কিছু পুরাতন শাড়ি দিয়েছিল রাত্রি সেগুলো দিয়ে বেশ পরিপাটি হয়ে সেজে নিয়েছে।গায়ের রংটা আম্মা আসার আগেই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেল কালো রং দিয়ে।। আম্মা বলেছেন অসুন্দর কালো মহিলাদের জন্য বাড়ির বাইরে অনিরাপদ খুব একটা হবে না। নিজের আসল চেহারা কোনো অবস্থায় কাউকে দেখানো যাবে না। কথাটা ভেবে ও কাপড়ের পুটলি আর বাক্সটা নিয়ে ট্রেনে গিয়ে বসলো। ঘড়িতে সময় তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট। চারটায় ট্রেন ছাড়বে। মায়ের মুখটা ভীষন মনে পড়ছে। চোখের পানিতে মুখের কালিগুলো ঘেটে আরও কুচকুচে হয়ে উঠেছে। মুক্তার মতো দাঁদগুলো ঝলক দিচ্ছে। অজানা গন্তব্যস্থলে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে ওর জানা নেই। কি হতে চলেছে রাত্রির জীবনে?

#দুঃখগাথার_রাজকন‍্যা
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_১

আসুন নামাজ পড়ি ও কোরআন তেলোয়াত করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here