দুঃখগাথার রাজকন‍্যা
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৫

আরাভ সোনিয়া মির্জার কথা চুপচাপ শুনছে। কি বলবে ভাষা খুজে পাচ্ছে না। এই মূহুর্তে খালামনিকে ওর স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে তবুও বারবার মনকে শাসন করছে ওসব না ভাবতে। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক তৈরী করতে হলে নিজের সুখ সুবিধা ভালোলাগা কে ত‍্যাগ করতে হয় যেটা উনি খুব ভালো করেই জানেন।তবুও এধরনের কথা যেহেতু বলছেন সেহেতু ওর কিছু বলার থাকে না। উনি বোনের ছেলের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে না, নিজের মেয়ের খামখেয়ালি আর নিজেদের স্বার্থ দেখছেন। কথাগুলো ভেবে ওর ভীষণ খারাপ লাগল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আরাভ চোখের পানি লুকিয়ে শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
> তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।
> সত্যি বলছিস তো?
> মিথ্যা বলেছি কখনও?
> আহা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলিস না তো। সোজাসাপ্টা উত্তর বল, রাজি তো?
> হুম।
> বাবা তুই যে আমাকে কতোবড় একটা ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। তুই বিশ্রাম কর আমি যাচ্ছি। চিন্তা করিস না আমি সব আগের মতো ঠিক করে দিবো। আর শোন ওসব নিচু ক্লাসের মেয়েদের কথা ভেবে একদম মন খারাপ করবি না। ওরা ভালো মেয়ে না। মীরার সঙ্গে বিয়ের পরে আমি তোদেরকে জার্মানিতে তোর মামার কাছে পাঠিয়ে দিবো। তোরা ওখানেই থাকবি।আচ্ছা যাচ্ছি এখন।
সোনিয়া মির্জা একাই বকবক করে চলে গেলো। আরাভ মাথার হাত রেখে বসে পড়লো। মীরাকে ওর একটুও পছন্দ না। পছন্দ বড় কথা না ওকে দেখলেই আরাভের মেজাজ খারাপ হয়। মেয়েটা বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত পাকা। মুখের মধ্যে একগাদা মেকাপ পাউডার মেখে উল্লুখ না ভাল্লুক সেজে ঘুরে বেড়ায়। না ওরে বিয়ে করলে জীবন ঝরাঝরা। কিন্তু এই কঠিন বিপদের হাত থেকে বাঁচার উপায় তো নেই। রাত্রীকে এখন খুব দরকার। মেয়েটা থাকলে ওকে নিশ্চয়ই সাহায্য করতো। আরাভের চিন্তা অবসান ঘটলো ফোনের শব্দ শুনে। ও চোখ বন্ধ করেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো। ওপাশে তমাল আছে। আরাভের কথা বলতে একটুও ইচ্ছা করছে না তবুও বলল,
> হুম বল
> ভার্সিটিতে নটকের আয়োজন করা হয়েছে তুই নায়কের চরিত্রে অভিনয় করছিস আমি নাম লিখিয়ে দিয়েছি।
> যা বেডা আমার খেয়ে কাম নেই। আমি ওসব পারবো না। আমার জীবন নিয়ে যেই নাটক চলছে সেই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই জীবন আমার তেজপাতা। ওখানে কি অভিনয় করবো। রাত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না। খালামনি এই সুযোগে মীরার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবছেন। শুধু ভাবছেন না আমাকে রাজী করিয়ে নিয়েছেন।

> বলিস কি? বউ নেই আর অমনি আরেকটা বিয়ের জন্য মনের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে না? ছেলেদের এই এক অবস্থা।

> চুপ করবি? লাথি দিবো আজেবাজে কথা বললে। রাত্রী বিবাহিত ওর স্বামী আছে। বাড়িতে যা হচ্ছে না সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

> আমি কি গোয়েন্দাগীরি শুরু করবো?

> মাফ কর ভাই। ওসব করতে হবে না। রাত্রীকে খুঁজতে সাহায্য করলেই হবে। এখন রাখছি আগামীকাল ক্লাসে দেখা হচ্ছে ওখানেই বলবো।

আরাভ তমালকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দীলো। ছেলেটা বকবক শুরু করলে থামতেই চাইনা। তবুও ওর মনটা ভালো। এরকম বন্ধু সবার ভাগ‍্যে মিলে না। জীবনে চলার পথে হাজারো বন্ধুর দেখা মিলবে কিন্তু শেষ পযর্ন্ত সবাই পাশে থাকে না। যে পাশে থাকে সেই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু। কথাটা ভেবে আরাভ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সারা বিকেলে জুড়ে আরাভের এসব ভেবেই পার হলো। সন্ধ্যার আগে দুচোখ জুড়ে তন্দ্রা এসে ভর করলো। সারাদিনের ঝামেলার জন্য শরীর মন কিছুই ভালো নেই। ঘুমের মধ্যে বিছানার সঙ্গে মিশে গেলো আরাভ। হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে ওর ঘুম ভাঙলো। কিছুতেই চোখ থেকে ঘুম ভাবটা কাটাতে চাইছে না। আঠা দিয়ে কেউ আটকে রেখেছে। ও চোখ বন্ধ করে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই রবি দাঁত বের করে হেসে বলল,

> দুলাভাই রাত হইছে খাইবেন না? আফা আপনার জন‍্যি খাওন নিয়ে বইসা আছে।

> তুই আমাকে দুলাভাই কেনো ডাকছিস? তোর কোন জন্মের বোনের স্বামী আমি?

আরাভের এমন তেড়াবাঁকা কথায় রবি ভড়কে গেলো। মূলত ও আরাভের সঙ্গে রসিকতা করতে চেয়েছিল কিন্তু আরাভ তো নিম পাতার থেকেও তেঁতো। ওর হাসিখুশি মুখটা মূহুর্ত্তের মধ্যেই থতমত খেয়ে গেলো। ও তবুও ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে বলল,

> মীরা আফার লগে আপনার বিয়া হলে আপনে তো আমার দুলাভাই লাগেন।

> তুই সেই আশায় বসে থাক। শোন আমি এখন ঘুমাবো। বিরক্ত করবি না যদি করিস তাহলে কিন্তু খারাপ হবে। আর শোন তোর আফার বলিস ও না খেলেও আমার কিছু যায় আসবে না।

আরাভ একদমে কথাটা বলে ধপাস করে দরজা বন্ধ করে আবারও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। রবি তাড়াতাড়ি নিজের নাকে হাত রাখলো। দরজা প্রায় ওর নাক সোজাসুজি এসে থেমেছে। আর একটু হলে নাক ফেটে যেতো। কি সাংঘাতিক ব‍্যাপার। ও আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করলো না তাই নিচে ফিরে আসলো। ওকে ফিরতে দেখে মীরা জিঞ্জাসা করলো,
> কিরে ও আসছে না?
> আফা ভাইজানের ক্ষুধা নাই। আপনে খাইয়া নেন।
> ওকে বলেসিস ওর জন্য আমি অপেক্ষা করছি?
> হয় বলছি। তবুও না করছে। তয় আমি আর ডাকতে যাবার পারুম না।
টেবিলে সোনিয়া মির্জা মনোযোগ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছিলেন। মেয়ের এমন কান্ডে উনি বিরক্ত হচ্ছেন। ছেলেটাকে কতো কৌশলে রাজি করিয়েছেন তার ঠিক নেই। এই মেয়েটার এমন আবভাবে ছেলেটা না আবার বিগড়ে যায়। ছেলেটা এতোদিন এই বাড়িতে আছে। ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোথায় জমিয়ে প্রেম করবে তানা এখন ছলাকলা করে রাজি করতে হচ্ছে। আর এখন ইনি এমন ভাব করছে জেনো কতো কালের প্রেম। কথাগুলো ভেবে উনি খাবারের দিকে নজর রেখে কঠিন গলাই বললেন,
> মীরা খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে পড়তে বসো। খাওয়া শেষ করতে দশ মিনিট টাইম দিলাম।

মীরা মায়ের এমন আদেশ শুনে হতাশ হলো। ভেবেছিল এমন করলে উনিখুশী হবেন। তাছাড়া এগুলো করলে ভালোবাসা বাড়ে। কিন্তু আরাভ তো ওকে দেখতেই পারেনা। মীরা খাবার শেষ করে উপরে চলে আসলো। অন‍্যদিকে মাঝরাতে আরাভের ঘুম ভেঙে গেলো। অন্ধকার রুম খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের জোছনা এসে রুমটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে।। বেলকনির দরজা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছে তাই হয়তো এখন কেমন শীত শীত করছে। আরাব পাশে রাখা কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। ঘুম পরিপূর্ণ হয়েছে বিধায় ঘুম আসতে ঝামেলা করছে। আরাভ বিছানায় থেকে উঠে গিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। গায়ের কাঁথাটা এখনো জড়ানোই আছে। বাগান থেকে হাসনাহেনা ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। মাদকতায় ভরপুর চাঁদনি রাত, উত্তম সঙ্গী পেলে ছাদে গিয়ে গল্প করতো। ও ভাবনার অবসান ঘটলো ফিসফিস আওয়াজ শুনে। এই সময় বাড়িতে কেউ জেগে নেই তাহলে কথা বলছে কে। কথাগুলো ভেবে ও এদিক ওদিকে উঁকি দিলো। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে যখন ও বাগানের দিকে শিউলি গাছের দিকে তাকালো তখন দেখলো গাছের নিচে একজন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে অবয়বটা চেনা যাচ্ছে না। লোকটা ফিসফিস করে কিছু বলছে। আরাভ তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখলো ওখানে একজন না দুজন লোক। একটা মেয়ে আরেকটা ছেলে। দুজনকে চেনার জন্য আরাভ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসলো টর্চ নেওয়া জন্য। ও দ্রুতগতিতে বেলকনিতে পৌঁছে লাইট ধরলো কিন্তু কাউকে পেলো না। শিউলি গাছের পাতা নড়ছে কিন্তু ওখানে কেউ নেই। ও নিচে গিয়ে দেখে আসলো সন্দেহ করা যায় এমন কাউকেই পেলো না। সারা বাড়িতে নির্জনতা বিরাজ করছে। ডাইনিং রুমের লাইট সাধারণত বন্ধ করা হয়না। বাড়িতে অনেকগুলো মানুষের বসবাস। কখন কে বাইরে আসে তাই সব সময় অন রাখা হয়। আরাভ কাউকে না পেয়ে ফিরে আসলো। এই সময় রাত্রী থাকলে গল্প করা যেতো। ওর হাতের এককাপ চা ভীষণ মিস করছে। মেয়েটা কোথায় গেলো কে জানে। আরাভ একপা দুপা করে রাত্রীর রুমে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। টেবিলের উপরে একটা কালির কৌটা। আরাভ ওটা নেড়েচেড়ে দেখে মনে করার চেষ্টা করলো রাত্রী কি কাজল পড়তো? না তেমন কিছুই মনে পড়ছে না। রাত্রীর মুখাইতো তেমন ভালো করে দেখা হয়নি। কথাটা তমাল জানলে বলতো,”বেডা তুই নিজের বউকে দেখবি কেনো কলেজের আগুন সুন্দরীর দিকে যে নজর পড়েছে। তোর নজর ভালো না আমি আগেই জনতার”আরাভ কথাটা ভেবে মলিন হাসলো। তারপর কৌটা টা সেখানেই রেখে দিল। একটা কালো টিপের পাতা। আরাভ ওটাও যত্ন করে হাতে তুলে নিলো। পাতা থেকে দুইটা টিপ নেই। এসব দেখে ওর রাত্রীকে এখন ভীষন দেখতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটার প্রতি ওর তেমন ভালোলাগা ছিল না কিন্তু এখন এমন বুকের মধ্যে আনচান করছে কেনো? দূরে আছে বলে নাকি ওর প্রতি আরাভ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? আরাভ বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনের মধ্যে রাত্রীর নামটা শতবার জপতে শুরু করেছে। এই এক যন্ত্রণা, মানুষ যখন কাছে থাকে তখন তাকে তেমন অনুভব করা যায় না কিন্তু যখনই দূরে চলে যায় ঠিক তখনই শুরু হয় হূদয়ের দহন।

চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here