দলছুট-শেষ
ঢাকায় আসার পর থেকে আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে সেদিনের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে ভীষণ। ইলোরার কাছ থেকে দু’জনে একসাথে ফিরলেও সারাটাপথ কেউ কারো সাথে কথা বলিনি। আমার মনের একান্ত গোপন কুঠুরির খবরটা ইলোরা কি করে পেলো সেসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই বলে সেই ভাবনা বন্ধ। আমার লজ্জা কেবল নাবিলের কাছে সেই অনুভূতির প্রকাশ। তার উপর নাবিলকে ভুল বুঝে অযথা সন্দেহ করে যে হেনস্তা করেছি তাতে তার সাথে নজর মিলানোর সাহস হারিয়েছি। আমি কবে থেকে এতো বোকা হলাম? এতো বড় বড় খুনি আসামি ধরা এই আমি এভাবে ইলোরার ফাঁদে পা দিয়ে পিছলে পড়লাম? বাসায় থাকলে হয়তো শরম আর গ্লানিতে মারা পড়তে হতো। ভাগ্য ভালো এই কেসটা হাতে এলো। তবুও কিছু নিয়ে ব্যস্ত থেকে নিজেকে সামলে নিতে পারছি। ভাগ্যিস নাবিলের সাথে সামনাসামনি দেখা হয় না। নাবিল জেনুইন ভদ্রলোক। তা নয়তো আমি ওকে যেভাবে হেনস্তা করেছি তাতে ওর আমাকে সকাল বিকাল পচানি দেওয়ার কথা। আর ওর কাছে সেই সুযোগও আছে। কিন্তু ও ভদ্রলোক বলে সুযোগ কাজে লাগায়নি।
আজকাল বাসায় ফিরতে আলসেমি লাগে তাই বেশ রাত অবধি অফিসে বসে থাকি। মা বিয়ে করার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। হাতে একটা ভালো পাত্র নাকি আছে। মা সেদিন ছবি আর বায়োডাটা রেখে গেলেও আমি ছুয়েও দেখলাম না। আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছা নেই। এই তো বেশ ভালো আছি স্বাধীন জীবনে। কেন খামোখা পরাধীনতার শেকল পরবো পায়ে। জীবন যেমন যাচ্ছে যাক না।
“ম্যাডাম, বাসায় যাবেন না?”
শিবলীর ডাকে চমকে উঠে বললাম-
“হ্যা যাবো। তোমার হাতের কাজ শেষ?”
শিবলী মাথা নাড়তেই বলি-
“তুমি যাও তাহলে। আমি একটু পরে বেরুবো।”
শিবলী চলে যেতেই আমি উঠে দাঁড়াই। মোবাইলে সময় দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে। অবাক ব্যাপার আজ একবারও ফোন দেয়নি মা। মনেহয় রাগ করে আছে এখনো। আমি হাসলাম, মা পারেও। সব গুছিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। লুকিং গ্লাসে তাকাতেই চমকে উঠলাম। নাবিলকে দেখলাম মনে হলো। আমি জানালা দিয়ে পেছনে তাকিয়ে নাবিলকে খুঁজি। নাহ কেউ নেই কোথাও। আরে! আমি কি ভুল দেখলাম নাকি অবচেতন মনের কল্পনা? তারমানে কি আমি এখনো নাবিলকে নিয়ে ভাবছি? নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেলাম। ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর আদেশ দিয়ে সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজলাম।
“নোরা, আমাকে এতো অসম্মান না করলেও পারতে।”
চমকে উঠে বসলাম, তাকিয়ে দেখি গাড়ি বাসার সামনে দাঁড়ানো। ক্লান্ত পায়ে নেমে এলাম। খুব বুঝতে পারছি নাবিল আবার বহুদিন জ্বালাবে আমাকে।
দু’দিন পর সন্ধ্যা নামতে নামতে অফিস থেকে বেরুলাম। মাকে কথা দিয়েছি তাড়াতাড়ি ফিরবো। আজ মাকে রাগানো যাবেনা, এমনিতেই গত সাতদিন ধরে কথা বলে না আমার সাথে। হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠবো এমন সময় শুনলাম ডাকটা-
“নোরা।”
“নাবিল!”
চমকে পিছু ফিরি। নাবিল শুকনো হাসি দিলো আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কি বলবো ভেবে পাইনা। মানুষটাকে সামনাসামনি দেখে বেশি খারাপ লাগছে। কি ভেবে এই লোককে সন্দেহ করেছিলাম? এই কদিনে নাবিল আরো একটু শুকিয়েছে। গাল জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আভাস, চোখ দুটোতে রাজ্যের অস্থিরতা। নাবিলের ফর্সা গায়ের রং এ সবকিছু মিলে এমন ম্যানলি চেহারা ফুটে উঠছে যে আমার মন চাইছে সব ভুলে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। নাবিল কি বুঝলো কে জানে। শান্ত কন্ঠে বললো-
“তোমার আপত্তি না থাকলে আমরা কি কোথাও বসতে পারি? কিছু কথা ছিলো?”
সাথে সাথে মাথা দুলিয়ে হ্যা বললাম যেন যুগ যুগ ধরে এমন প্রস্তাবের আসায় বসে আছি আমি। বেমালুম ভুলে গেলাম আজ মা জলদি ফিরতে বলেছিলো। নাবিল আমাকে নিয়ে এলো মহাখালীর একটা বড় রেস্টুরেন্টে। নিরিবিলি রেস্টুরেন্টের কোনার দিকে বসে দু’টো কফির অর্ডার দিয়ে ও বসলো। আমি আজ বেহায়ার মতো নাবিলকে দেখছি। নাবিল এমনিতেই ম্যানলি, পাঁচ ফিট আট কি নয় হাইট, উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং, চেহারা গড়পরতা হলেও উজ্জিবিত চোখ দুটো এই কমতি দূর করেছে। আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো তার আগেই নাবিলবলে-
“আমি জানি তুমি কি বলবে। বাট এই মুহূর্তে কথাটার গুরুত্ব নেই আমার কাছে। কষ্ট পেয়েছি খুব। আমাকে নিয়ে এতো উচ্চ ধারণা তোমার এটা ঠিক হজম হচ্ছে না।”
লজ্জিত হয়ে মুখ নিচু করে নিলাম। জীবনে প্রথম এমন লজ্জায় পড়া। আমার মাথায় কি পোকা ঢুকেছিলো সেই সময় কে জানে। নাবিলকে কেন সন্দেহ করলাম এই ভেবে এখন মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
“আমার দুর্ভাগ্য আমি দুইবার দু’জন ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছি। কেউই আমাকে ঠিক বুঝতে পারেনি। ইলোরার ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই কারন ও ওইরকম ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছো তুমি। তোমাকে আমি অনেক সেনসিবল ভেবেছিলাম সেই তুমি এমন ইম্যাচিউর কাজ করবে ভাবিনি।”
নাবিলের কথায় আমার চোখে জল জমতে শুরু করেছে। জীবনে প্রথমবার প্রিয় মানুষের সামনে বসেছি অথচ ভালোবাসা কথা না হয়ে দোষের কথা শুনতে হচ্ছে এমনই সৌভাগ্য আমার। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কিছুসময় পরে যখন মুখ তুললাম দেখলাম সামনের জায়গাটা শুন্য। নাবিল নেই আমাকে না বলেই চলে গেছে সে। হতচকিত আমি এবার সত্যি সত্যি বোকা বনে বসে রইলাম সেখানে।
সেদিন বাসায় ফিরে মায়ের প্রচুর বকা শুনেছিলাম। আমার খামখেয়ালিপনার সাজা হিসেবে সেদিনই মা আমাকে বিয়ের জন্য রাজী হতে বললেন। আমি আর মানা করার কোন কারন খুঁজে পেলাম না। আমার এমন কাজের পর নাবিলকে পাওয়ার আশা নেই। কাজেই রাজী না হয়ে কি করবো? পরের সপ্তাহে ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে হলো। ঘোরের মাঝে কবুল বলে কাবিননামায় সাইন করেছি। কানে বারবার নাবিলের কথা বাজছে, সে দু’জন ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে। আসলেই কি তাই? আমাকে কি সে একবার সু্যোগ দিতে পারতোনা?
“এখনো কি প্রাক্তনকে ভেবে কাঁদছো নাকি নোরা?”
ফুলের সাজে সজ্জিত রুমটায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কি বলবো নতুন মানুষটাকে এমন সময় কথাটা শুনে
চমকে তাকিয়ে দেখি নাবিল সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলাম-
“আপনি!”
“তোকি অন্য কাউকে আশা করছিলে স্বামী হিসেবে? আজব মেয়ে তো তুমি? ভালোবাসবে একজনকে আর বিয়ে করবে আরেকজনকে?”
“কিন্তু আপনি তো বললেন…”
“ওসব না বললে তো তুমি বিয়েতে রাজী হতে না। মায়ের শরীর খারাপ সেটা তো জানোই। অতো আনুষ্ঠানিকতা করার ঝামেলা না করে সহজ সমাধান। তাছাড়া আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো তুমি এটুকু সাজা তোমার পাওনা। আর বাকী সাজা আমি নিজে তোমাকে দেবো সারাজীবন।”
বলেই এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম-
“আমি তো পঁচা তাহলে আমাকে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো?”
নাবিল কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গ্রীবা উঁচিয়ে চোখে চোখ রাখলো-
“পঁচা হলেও তুমি আমার। তোমাকে বিয়ে না করে কাকে করবো?”
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বলি-
“যে ভালো তাকে।”
নাবিল গভীর ভালোবাসা নিয়ে আমায় দেখে, তার উষ্ণ অধর আমার কপাল স্পর্শ করে বলে-
“কিন্তু আমার যে এই পঁচা মেয়েটাকেই চাই বহুকাল ধরে। অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে তাকে পেলাম এটাই জীবনের বড় পাওয়া।”
আমি মোমের মতো গলে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখতেই সে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। কতোদিন স্বপ্ন দেখেছি তার বুকে মাথা রাখার অবশেষে আজ সে স্বপ্ন পূরণ হলো। নাবিল ডাকলো-
“নোরা, একটা কথা বহুবছর ধরে বুকে জমিয়ে রেখেছি। এই ভার আর বইতে পারছি না। কথাটা আজ তোমাকে বলে বুক হালকা করতে চাই।”
আমি ওর চোখে চোখ রেখে বলি-
“কি কথা?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, নোরা।”
আমার আখি মুদে আসে আবেগে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো। কতো কতো দিন ধরে এই কথাটা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম, কতো রাত নির্ঘুম কেটেছে তার বিরহে। আমার সৌভাগ্য শেষ পর্যন্ত তা শুনতে পেলাম। আমি শরীরের সর্ব্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলি-
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি নাবিল।”
সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin