#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৩ ||

সকাল সকাল কারীবের ডাক পরেছে। হাই দিতে দিতে সে ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো তার স্যারের বাসায়। ভোর এখন সাড়ে ছ’টা বাজে। বেচারা কারীব গতকাল তার স্যারের সাথে সব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে তো পড়েছিলোই কিন্তু তার ঘুম হওয়ার আগেই তার স্যারের ডাক। ডাক্তার চোখ কচলে চশমাটা ঠিক করে সা’দের রুমে প্রবেশ করলো। সা’দ তখন পায়চারি করছিলো রুমের মধ্যে। ডাক্তারকে দেখে সে বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তার সেহেরের চেকআপ করে কপালে ক্ষতটা ডেসিং করার কথা বললো। সা’দ সেহেরের পাশে বসে সুন্দরভাবে ডেসিং করে দিলো এবং বললো,

—“রাতে তীব্র জ্বর এলো কেন?”

—“আঘাতটার থেকেই জ্বরটা এসেছে। এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাকে বেশি বেশি খাওয়াতে হবে, অনেকটাই উইক উনি। আর আপনার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যেই ওষুধগুলো দিয়েছে সেগুলো আমাকে একটু দেখান আমি পারলে কিছু মেডিসিন বদলে দিবো।”

সা’দ কারীবকে ইশারা করতেই কারীব সেহেরের মেডিসিনের বক্সটা ডাক্তারের হাতে দিলো। ডাক্তার সব চেক করে নতুন মেডিসিন দিলো। এর মাঝে সেহেরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সামনে অন্য পুরুষকে দেখে সে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। সেহের এভাবে ওঠায় সা’দ সেহেরের বাহু ধরে বলে,

—“কী হলো এভাবে উঠলে কেন?”

সেহের ঘাড় ঘুরিয়ে সা’দকে দেখে পুরো ঘরটা তাকালো। সে এক বিলাসবহুল ঘরে অবস্থান করছে। ডাক্তার সেহেরকে উঠতে দেখে মুচকি হেসে বলে,

—“এখন কেমন লাগছে?”

—“জ্বী ভালো।”

—“নিজের যত্ন নিবে এবং খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করবে কেমন? মিস্টার সা’দ, আমি তাহলে আসি!”

সা’দ কোনো কথা বললো না, শুধু মাথা নাড়ালো। ডাক্তার চলে যেতেই সেহের পুরো ঘরটা হা করে দেখছে। এমন সুন্দর রুম সেহের কোনোদিনও দেখেনি। কতো আলিশান রুমটা, চোখ ধাঁধানো। সা’দকে অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

—“এটা কোথায়? আমি এখানে কী করে এলাম?”

—“তোমায় কিডন্যাপ করে এনেছি বউ, আর এইটা আমাদের ঘর। আর এই বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি!” মুচকি হেসে বললো সা’দ। সা’দের কথা শুনে সেহের বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো।

—“এসব কী বলছেন। দেখুন একদম মশকরা করবেন না!”

—“আহা! মশকরা কেন করতে যাবো, সত্যিই এটা আমার বাড়ি। আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি!”

—“কেউ জানে না?”

—“সবাই জানে। ইভেন আমাদের বিয়ের কথা এখন সকলেই জানে, তাইতো এই বাড়িতে তোমায় নিয়ে এসেছি।” মুচকি হেসেই বললো সা’দ। তবে সা’দ এটা বললো না, কবির বা সুফিয়া সেহেরের আসল বাবা-মা নয়। যতদিন না সেহের সুস্থ হচ্ছে ততদিনে এগুলা বলাও অসম্ভব।
সা’দ এই কয়েকদিনে খোঁজ জারি রাখবে। খোঁজ লাগাবে সেহেরের মাকে কোন হসপিটালে ভর্তি করা হয় এবং সেদিন সেখানে ক’জন রোগীর বাচ্চা হয়েছিলো।

—“কেউ কিছু বলেনি?”

—“বললে কী এখানে আনতে পারতাম? সকলের মত ছিলো দেখেই এনেছি।”

হঠাৎ সেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। দাদীমা, রিমন, জেঠু, চাচী, আবিদ, মানজু সকলকে ছাড়া যে কী করে থাকবে বুঝতে পারছে না। বড্ড মনে পরছে তাদের। সা’দ এর মাঝে কিছু লোককে ফোন করে কিছু একটা বলে দিলো। কল কেটে সেহেরকে বললো,

—“ঘুম না আসলে ফ্রেশ হয়ে নাও, এরপর কিছু খাও!”

—“না কিছু খাবো না। বাথরুমটা কোনদিকে?”

—“রুমেই আছে। ওইতো!” ইশারা দিয়ে দেখালো। সেহের কথা না বলে চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“আমার ড্রেস তো এটা ছিলো না। ড্রেস কে চেঞ্জ করেছে?”

—“সার্ভেন্ট। কী ভেবেছো আমি চেঞ্জ করবো?”

সেহের লজ্জায় আবারও ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর সা’দ সেহেরের লজ্জা দেখে হুঁ হাঁ করে হাসতে শুরু করলো। কারীব সা’দের ঘরে এসে সা’দকে হাসতে দেখে বেক্কল বনে গেলো।

—“স্যার হাসছেন কেন?”

—“কিছু না, এমনি। নাস্তা রেডি করেছো?”

—“হ্যাঁ আপনার মা মানে আন্টি রান্না শুরু করেছে আগেই।”

—“মা এতো সকালে উঠেছে কেন?”

—“সে তো বলতে পারছি না স্যার।”

—“আচ্ছা তুমি নিচে গিয়ে বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি!”

—“জ্বী স্যার।”

বলেই কারীব চলে গেলো। বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। সেহের এখন মোটামুটি সুস্থ৷ সা’দের কয়েকদিন কাজ ছিলো না বিধায় সে সবসময় সেহেরের পাশে পাশে ছিলো। সেহেরের জন্য একসেট শাড়ি এবং ড্রেসও এনেছে, সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সেহের তো ভেবেই পায় না, সা’দ এতো কেয়ার কীভাবে করতে পারে? রাতে সা’দ সেহেরের পাশেই ঘুমায় তবে দুরত্ব বজায় রেখে। এ দেখে সেহের যেন আরও মুগ্ধ হয়। দিনদিন বেশ ভালোই দুর্বল হয়েছে সে সা’দের প্রতি। অবশেষে সা’দ সিদ্ধান্ত নিলো তাদের বিয়েটা আবার নতুন করে হবে। হলুদ, বিয়ে ঘরোয়াভাবে হলেও রিসিপশন বেশ বড় করে হবে। সা’দের প্রস্তাবে সকলেই রাজি হয়। সেহেরও রাজি হলো। তবে এখানে কথা আছে। বিয়ের আগে থেকে সেহের এবং সা’দ আলাদা আলাদা ঘুমাবে। এতে সা’দ রাজি হয়েছে কারণ বিয়ে ছাড়া সে সেহেরের কাছে যেতে পারবে না। পারিবারিকভাবে বিয়ে করেই সে সেহেরকে আপন করে নিতে চায়। সেহের এবং রুবাই একসাথে ঘুমায়। দাদীমা, আবিদ, রিমন, মানজু, চাচী সকলের সাথে প্রতিদিন কথা হলেও জেঠু সেহেরের সাথে কথা বলেন না। এতে সেহের বেশ ব্যথিত।

অবশেষে হলুদের দিন এলো। সেহের হলুদ শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে সে। সেহের কখনো শাড়ি পরেনি, তার উপর আজ তার গায়ে হলুদ, ভাবতেই কেমন শিউরে শিউরে উঠছে। সা’দকে সেও যে চায়, ভিষণভাবে। সা’দ তাকে যতোটা ভালোবাসা দিয়েছে, কেউ কোনোদিন তাকে এতো ভালোবাসা দেয়নি, বুঝেওনি। সেহেরের বিয়ে মানা নিয়ে সময় প্রয়োজন ছিলো কিন্তু সা’দ সেটা মুখ থেকে না শুনেই যথেষ্ট সময় দিয়েছে সেহেরকে। সেহের এখন আগের মতো চুপচাপ নয়, খুবই প্রাণ্যোচ্ছ্বল সে। সে যেন নতুনভাবে, নতুনরূপে বাঁচতে শিখেছে। সেহের ভাবনায় মগ্ন ছিলো এই ফাঁকে সা’দ রুমে প্রবেশ করলো। আয়নায় সা’দকে আসতে দেখে সেহের আৎকে পিছে ফিরে তাকালো। সা’দ মুগ্ধ হয়ে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন হলুদ পরী দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। এতো সুন্দর কেন মেয়েটা? সেহের আমতা আমতা করে বলে,

—“কী হচ্ছে কী আপনি এখানে কেকেকেন!?”

—“বউকে হলুদ মাখাতে এসেছি।” বলেই সেহেরকে ইচ্ছামতো হলুদ লাগিয়ে দিলো। সেহের চোখ ছানাবড়া করে বলে,

—“হলুদের অনুষ্ঠান তো এখনো শুরুই হয়নি আর আপনি আমাকে হলুদ লাগিয়ে নাজেহাল অবস্থা করেছেন! আপনিও না!” বলেই সেহের টিস্যু দিয়ে হলুদ মুছতে শুরু করলো৷ মুছতে মুছতে আবার বললো,

—“কী হলো চুপ কেন? এখন সবাইকে কী বলবো এই হলুদের ব্যাপারে?”

সা’দ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে সেহেরকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। সেহের ভয়ে রীতিমতো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। সা’দ তার হাতদুটো সেহেরের কোমড়ে রাখতেই সেহের সাথে সাথে চোখমুখ খিঁচে জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো। সা’দ সেহেরের কোমড়ে হলুদ লাগাতে লাগাতে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠে,

—“বলবা তোমার জামাই তোমাকে প্রথম হলুদ ছুঁইয়েছে। আর তুমি সামান্যতে এই অবস্থা করছো কেন বলো তো? সামনের ডোজ তো আরও বেশি হবে! একবার বিয়েটা হতে দাও, এরপর বুঝবা এই সা’দ বিন সাবরান কী জিনিস!”

বলেই সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। সেহের সেখানে দাঁড়িয়ে লজ্জায় মাথা নত করে আছে। সা’দ হেসে আবার সেহেরের সামনে গিয়ে সেহেরের থুঁতনি উঁচু করে বললো,

—“একবার বলেছি না মাথা নত করবা না! সা’দ বিন সাবরানের বউয়ের মাথা নত থাকাটা বেমানান। তুমি আমার বউ, সবসময় মাথা সোজা রাখবা ওকে?”

বলেই সেহেরের মাথায় টুপ করে কিস করে বেরিয়ে গেলো। আর সেহের সেখানে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর রুবাই আসলো। সেহেরকে হলুদ মাখা দেখে হেসে বললো,

—“নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কাজ তাই না?”

সেহের লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। রুবাই আবারও হেসে সেহেরকে সাথে নিয়ে নিচে চলে গেলো। গ্রাম থেকে কেউই আসেনি, বলা যায় আসতে পারবে না। সেখানকার অবস্থা নাকি ভালো না। কবিরও নাকি কোথাও গাঁ ঢাকা দিয়ে বসে আছে, পুলিশ এখনো তাকে খুঁজছে। নিচে হলুদ নিয়ে কথা উঠলে রুবাই কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেয়। সা’দ হলুদে ইনভাইট করেছেন একমাত্র ফারুক হোসাইনকে। ফারুক হোসাইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে সা’দ তাই সে একদিন কথা দিয়েছিলো তার বিয়ের সকল অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম তাকে ইনভাইট করবেন। সেই কথা অনুযায়ী সা’দ তা-ই করলো।

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here