#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
পর্ব ০৩ ||
—“পাগল নাকি তুই? তোপর্বরে আমি নরকে তোরে পাঠামু তুই চিন্তা করলি কি কইরা? কোনোদিনও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না!” অত্যন্ত রেগে কথাগুলো বললো দাদীমা। সেহের দাদীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো।
—“দাদী! আমার বই-খাতা সব ওই বাড়িতে দয়া করে বোঝার চেষ্টা করো। আর রিমনটাও ভালো নেই গো, আমার যে ওর এই অবস্থা একদমই ভালো লাগছে না।”
—“তো আমি কি করমু? আর তোর বই-খাতা আমি আবিদরে দিয়া আইন্না নিমু তাও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না।”
—“ফুল দেখ বোঝার চেষ্টা কর। এবার তোর বাবা তোরে পাইলে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবে! তোর কী একটুও প্রাণের ভয় নেই?”
—“দুইদিনের দুনিয়ায় প্রাণের ভয় করে কী লাভ ভাইয়া? এরচেয়ে ভালো নয় কী উপর যিনি আছেন তার উপর ভরসা করে চলতে?”
আবিদ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো। সেহেরের চোখে মিনুতি। আজ অবধি কোনোদিন তারা সেহেরকে এই বাড়িতে রাখতে পারেনি এক অথবা দুইদিনের বেশি। কিসের টানে যে সেহের বারবার ওই বাড়িতে চলে যায় তা তাদের অজানা। কিন্তু কেউ-ই চায় না এই অসহায় মেয়েটাকে ওখানে রাখতে। সকলেই জানে সেহেরকে কতো অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আবিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। দাদীমা হাজার তর্ক, বকাবকি করেও সেহেরের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারলো না। তাই সেও আর কিছু বলতে পারলো না। সেহের রাতের খাবার খেয়েই চাচীর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে সেহের সেই বাড়িতে চলে গেলো। দরজায় নক করার মিনিটখানেক পর সৎমা দরজা খুলে দিলো। সেহেরকে দেখে সে কোনোরকম রিয়েকশন করলো না, সৎমা যেন আগেই জানতো সেহের আসবে। সেহের ম্লান হেসে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,
—“রিমন কোথায় মা?”
—“ঘুমিয়েছে।”
—“কোনো কাজ আছে? আর বাবা আসেনি?”
—“না আসেনি। থালাবাসনগুলো আছে সেগুলো পরিষ্কার কর গিয়ে। আমি গেলাম শুতে।”
বলেই হাত পা টানতে টানতে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলো। সেহের কিছু না ভেবে উপরে রিমনের ঘরে চলে গেলো। গাঁয়ে কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে তার প্রিয় ভাই। সকালে উঠে বোনকে দেখতে পেয়ে রিমন কেমন রিয়েকশন করতে সেটাই ভাবছে সেহের। মুচকি হেসে ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইয়ের মাথার পাশে বসলো। কিছুক্ষণ পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সৎমায়ের কথানুযায়ী চলে গেলো কাজ করতে৷ যদিও সেহের এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয় তবুও কিছু বলেনি। গ্রামের প্রায় সকলেই জানে সেহের কী পরিমাণ অত্যাচারিত হয়। কিন্তু সেহের মুখে স্বীকার করে না দেখে কেউ কিছু করতে পারে না। সেহের স্বীকার করলে হয়তো তার বাবা এবং সৎমায়ের সকল কাড়সাজি একদিনেই ঘুঁচে যেতো৷ থালাবাসন মেজে ধুয়ে উঠতেই কিছু ভাঙার শব্দ পেতেই সেহেরের টনক নড়লো। ওড়না দিয়ে ভেজা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো তার বাবা মাতাল হয়ে এদিক সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে নিজের মাঝে নেই। সেহেরের দিকে চোখ যেতেই কবির বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,
—“কিরে ফইন্নির ঝি! এতদিন কোন নাগরের লগে ছিলি হ্যাঁ? তোর আবুল না কী জানি নাম, ও হ্যাঁ আবিদ। ওর তো তোর লেইজ্ঞা দরদ এক্কেবারে উতলায় পরে। তা আর কতো নাগর আছে রে? মা** বাসায় যে কাজ পইরা ছিলো হেইডি দেখসিলি! আমার বউডা কত্তো কষ্ট করসে দুইডাদিন! তোর এই আবুইল্লা কারণে আমার বউডা কতহানি পালসে আমার পুলারে। খবরদার যদি আমার পুলার গাঁয়ে একটা আঁচড়ও কাডোস তোরে আমি এবার ছাদ থেইক্কা লাত্থি মাইরা ফেইলা দিম!” এমন নানান বিলাপ বকছে কবির। সেহের চুপচাপ শুনছে কিছু বলছে না। বাবার এসব কথায় কষ্ট লাগলেও কেন জানি কান্না পায় না। কান্নারাও ক্লান্ত এইসব শুনতে শুনতে। একসময় এসব বকর বকর থেমে গেলো। কবির সেখানেই লুটিয়ে পরে ঘুমে কাত। সেহের লাইট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে সে চেয়ারে বসে গেলো পড়তে। সারাদিন কাজ করে সেহের এই রাতেই নিজের পড়ালেখা শেষ করতে পারে। সৎমা কখনোই চায় না সেহের পড়ুক তাই সে সারাদিন নানা কাজে সেহেরকে ব্যস্ত রাখে কিন্তু সেহের যে রাতে পড়ে সেটা তার অজানা। পড়াশোনার জন্য সেহের অনেক কষ্ট ভোগ করেছে কিন্তু কেউ তার লেখাপড়া দমাতে পারেনি। জেঠু সেহেরের পড়াশোনার খরচ বহন করে তাই কবির এই বিষয়ে কিছু বলে না। বলা যায়, প্রয়োজনবোধ করে না। সৎমা নানানভাবে সেহেরের পড়াশোনা বন্ধ করতে বললে কবির সবসময় এক কথাই বলে,
—“ওর লেহাপড়া দিয়া আমার কোনো কাম নাই। আমি তো ওর পড়ার খরচ দিতাসি না ভাই দিতাসে! তো খাক স্যারগো জুতার বাড়ি!”
এক কথা শুনতে শুনতে সেহেরের মা ক্লান্ত। তাই সে আর তার স্বামীকে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে না। নিজে আর তার মেয়ে মিলে দমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।
★
—“উফফ মা বলো না তোমার কী হয়েছে? এভাবে মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে বসে আছো কেন?”। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে সা’দ। সা’দের কথা পাত্তা না দিয়ে মা চোখ বুজে আগের মতোই মাথায় আইসব্যাগ ধরে বসে আছেন। রুবাই হাতে ফাইল নিয়ে ক্যারিডোরে পায়চারি করছে আর ফাইল দেখে দেখে ফোনে কাউকে কিছু বলেই চলেছে। সা’দ ফোনে যখন শুনলো তার মার এই অবস্থা তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছে। এদিকে তার মাও কিছু বলছে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পরেছে সা’দ৷ সা’দ লম্বা শ্বাস ফেলে খুবই দৃঢ় গলায় বললো,
—“মা তুমি বলবে নাকি আমি যাবো? আমার শিডিউল আছে মা প্লিজ চুপ করে থেকো না।”
এবার উনি চোখ মেলে তাকালেন আর কড়া কন্ঠে বলে উঠলেন,
—“সারাদিন এত শিডিউল শিডিউল করে তো ফ্যামিলিকেই ভুলে যাস! মনে থাকে না ফ্যামিলিকেও তোর সময় দিতে হয়?”
—“দেখো মা! আমি যথেষ্ট সময় দেই তোমাদের। কিন্তু হঠাৎ এসব বলছো কেন তুমি? নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে!” ভ্রু কুচকে প্রশ্নটা করলো সা’দ। মা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
—“সামনে কুরবানির ইদ। কতোদিন হলো গ্রামে যাই না, শাশুড়ীর সাথে আলাপ করতে পারি না। তোদের ব্যস্ততা কী এই জীবনে শেষ হবে না?”
—“আহ মা! ইদ আসতে আরও দেড় মাসের মতো বাকি। আর তুমি এই দেড় মাস আগে এসে বলছো ইদ করতে যাবে। এসব চিন্তা ছাড়া আর কিছু কী নেই?”
—“এই তুই চুপ কর। সারাদিন আজারে বসে থাকলে এসব চিন্তা আসবেই। এখন আমায় বল এবার গ্রামে ইদ করবি? বল!”
—” তুমি তাহলে জাস্ট এই কথাটা বলার জন্য আমায় ডেকে পাঠিয়েছো? পাক্কা ১ ঘন্টার জ্যাম সহ্য করে আমি এখানে আসছি তোমার এইসব কথা শোনার জন্য? হায় আল্লাহ!”
—“তাহলে তুই কী বলতে চাস? আমি তোকে ডিস্টার্ব করেছি? হায় আল্লাহ তুমি আমাকে এই দিন দেখালে! সন্তান তার মায়ের জন্য বিরক্ত!”
—“মা প্লিজ বাজে বকিও না। আমি অনেক টায়ার্ড রুমে যাচ্ছি।”
বলেই উঠে যেতে নিলো তখনই মা বলে উঠে,
—“খেয়েছিস?”
সা’দ থেমে পিছে ফিরে বলে,
—“নাহ খাইনি। তবে আপনার যদি এই অবলা পুত্রের উপর দয়া হয় তাহলে অতি দ্রুত আমার কক্ষে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমায় ক্ষুদামুক্ত করতে পারেন।”
সা’দের কথায় মা আইসব্যাগ নামিয়ে হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। সা’দও মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো সেন্টার টেবিলে খাবার এবং কফি রাখা। সা’দ আগে গিয়ে কফিটাই নিয়ে নিলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে কারীবকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ আর সে বেরোবে না। একেবারে কাল ১১টা নাগাদ যেন সে চলে আসে। সা’দের কথায় ওকে বলে কারীবও কল রেখে দিলো। সা’দ কাজের সময় বেশি কথা পছন্দ করে না তাই কারীব কিছু বলে নি। কারণ সে তার স্যারকে ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনে। সা’দের থেকে ৩ বছরের জুনিয়র সে। একবার সা’দের ব্যবহারে কারীব তাকে বেশ পছন্দ করেছিলো। তাই সে দিনরাত লেগে থাকতো সা’দের মন জয় করার জন্য। একবার সা’দ বেখেয়ালিভাবে ফোন চালাতে চালাতে হাঁটছিলো। সেদিন কারীবের জন্যই আরেকটুর জন্যই ট্রাকের নিচে যায়নি সে। সেই থেকে সা’দের আলাদা মমতাবোধ জম্মায় কারীবের প্রতি। সা’দ এবার লক্ষ করলো কারীব তার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে তাই সা’দ কারীবের সাথেই মিশলো। সা’দের বন্ধু-বান্ধব ছিলো না বললেই চলে। যতো বন্ধু আছে কেউই তার ক্লোজ না। কিন্তু কারীব হয়ে উঠলো তার ভালো বন্ধু এবং ছোট ভাই। সা’দ তার প্রফেশনে কারীবকে নিয়েই শুরু করেছিলো। কেন জানি না সা’দ তাকে বড্ড ভালোবাসে, আর হয়তো এও জানে তার প্রফেশনে কারীবই তার প্রকৃত বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে।
প্রতিদিনের মতো সেহেরের আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বাম হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সে বই হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলো। সেহের অসুস্থ বিধায় বেশিক্ষণ চেয়ারে বসে পড়তে পারেনি। তাই সে বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই পড়ছিলো। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার জানা নেই। নামাজ পড়ে সে নাস্তা বানাতে চলে গেলো। নাস্তা বানানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে নিলো। এতে যেন তার মন ফুরফুরে এবং সতেজ হয়ে গেলো। শরীরের ম্যাজম্যাজ ভাবটাও কেটে গেলো। রুটি ভেজে বেরিয়ে এসে দেখলো কবির মেঝেতে নেই। নিশ্চয়ই উঠে গেছে সে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছুটলো তার প্রিয় ভাই রিমনের কাছে। এখন বাজে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট। রিমনকে হালকা ডাকতেই সে পিটপিট করে তাকালো। সেহেরের হাসিমুখটা দেখে রিমন লাফ দিয়ে উঠে বসলো। যখন দেখলো সত্যি সত্যিই সেহের বসে আছে তখন জাপটে ধরলো সেহেরকে। সেহেরও পরম সুখে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।
—“বুবু তুমি এসেছো! তুমি এসেছো আমার কাছে?”
—“হ্যাঁ ভাই আমার এসেছি। এখন উঠ দেখি ৮টায় স্কুল আছে তো। খাবে কে শুনি?”
স্কুলের কথা শুনে রিমন বিরক্তের সাথে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর নাক ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
—“আমার খুশির সময় কেন স্কুলটা নামটা টেনে আনো বলো তো? যাও কথা নেই!”
সেহের হেসে দিলো রিমনের কথায়। এরপর রিমনের নাক টেনে মুচকি হেসে বলে,
—“ওরে আমার ভাইটা! বাস্তবজীবনে পড়াশোনা অনেক জরুরি সোনা, তাই এসব বলতে নেই। এখন উঠুন খেতে হবে তো নাকি?”
রিমন মাথা নেড়ে উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমে। সেহের নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়তে থাকলো। কিছুক্ষণ পর রিমন স্কুলের ইউনিফর্ম পরে নিচে নামলো। রিমন চেয়ার টেনে বসতেই সেহের অতি যত্নে ভাইকে খাওয়াতে শুরু করলো। রিমনও মজার সাথে খাচ্ছে। রিমনের খাওয়ার মাঝেই সৎমা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ডাইনিং এ আসলো। জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে রিমনের দিকে না তাকিয়েই আবার ঘরে চলে গেলো। তার চোখে এখনো ঘুম আছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সেহেরকে বললো,
—“আমার ঘরের পানির জগটায় পানি নেই। পানি ভরে দিয়ে যাস তো!”
সেহের উত্তরে শুধু “আচ্ছা” বললো। কিন্তু সৎমা উত্তর শোনার আগেই রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। তার যেন প্রয়োজনবোধ নেই সেহেরের উত্তর শোনার।
চলবে!!