#ত্রিকোণ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#প্রথম_পর্ব
অফিসে ঢুকেই ঐশিক তাড়াতাড়ি ছুটল কেবিনে। আজ ক্লায়েন্ট মিটিং আছে, একটু পরেই তারা এসে পড়বে। এত ব্যস্ততার দিনেই রাস্তায় অবরোধ হতে হল!
এই অবরোধের জন্যই ঐশিকের অফিস আসতে এতটা দেরি হল। হন্তদন্ত হয়ে যখন ও ছুটে যাচ্ছিল কেবিনের দিকে, মনে মনে একটাই চিন্তা ছিল তার, অভিনন্দা এসে পৌঁছেছে তো? বেশ কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল অভিনন্দার কাছেই আছে, ও যদি আজ সময়ে না পৌঁছায়, তাহলে সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না কিছু!
বর্তমানে দেশের অন্যতম সোনা ব্যবসায়ী হলেন ওই রায়চৌধুরীরা। রায়চৌধুরী এন্ড সন্স জুয়েলার্সের নাম কে না জানে!ঐশিক রায়চৌধুরীর ঠাকুর্দা আদিত্য রায়চৌধুরী ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন এত বড়ো জায়গায়। তাঁর সুযোগ্য পুত্র রঞ্জিত রায়চৌধুরীর হাত ধরে আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছিল রায়চৌধুরী এন্ড সন্স। ঐশিকও এই বংশের যোগ্য উত্তরাধিকারীর মর্যাদা রেখেছে, এই ব্যবসা তার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে কম কিছু নয়। ঐশিক বিদেশ থেকে পড়াশুনা শেষ করে ফেরার পরেই পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরেছে, আর তারপরেই ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রীও নিয়ে এসেছেন ঐশিকের বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী আর মা তৃষা রায়চৌধুরী। ঐশিকের স্ত্রী গীতালিও ধনী বস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র মেয়ে। ঐশিক আর গীতালির বছর পাঁচেকের পুত্রসন্তানও আছে, যার নাম ইমন।
আর অভিনন্দা হল ঐশিকের পি.এ.। গ্রামে পড়াশুনা শেষ করে শহরে চাকরি করতে আসা। অভিনন্দার মতো স্মার্ট আর কর্মদক্ষ মেয়ে ওই অফিসে আর একটি খুঁজে পাওয়া ভার। ওর কাছেই বেশিরভাগ ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল, কাগজপত্র রেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে ঐশিক, কারণ ওর মতো দায়িত্বশীল আর কর্মঠ মেয়ে কমই আছে ওই অফিসে।
ঐশিক চিন্তান্বিত হলেও এটুকু জানত, যাই হয়ে যাক, অভিনন্দা সঠিক সময়ে অফিসে আসবেই, ওর সময়ানুবর্তিতা সত্যিই প্রশংসনীয়।
যা ভেবেছিল ঐশিক, ঠিক তেমনটাই হল। কেবিনে ঢুকেই ও দেখে, অভিনন্দা আগে থেকেই উপস্থিত।
কোনোরকমে নিজের চেয়ারে বসেই ঐশিক কপালের ঘাম রুমালে মুছে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘কিভাবে পারো বলো তো তুমি অভিনন্দা? আজ রাস্তাতে জ্যাম ছিল, তাও কিভাবে সময়ে পৌঁছলে তুমি?’
— ‘আসলে স্যার আমি কালকেই নিউজে দেখেছিলাম যে আজ অবরোধ আছে, তাই আমি আজ হাতে সময় নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম।’ স্মিত হেসে বলল অভিনন্দা।
— ‘উফ সত্যি, তোমার মতো কাজের প্রতি ডেডিকেশন আমি কমই দেখেছি।’
— ‘স্যার, আমি অফিসের সামান্য কর্মচারী মাত্র, শুধুমাত্র আমার দেরি হওয়ার কারণে কোম্পানির বড়ো লস হয়ে যাবে, এটা কিভাবে মেনে নিই বলুন?’
— ‘আচ্ছা বেশ বেশ। ফাইলগুলো টেবিলে রাখো।’
অভিনন্দা টেবিলে রেখে বলল, ‘আমি সবগুলোই চেক করে নিয়েছি স্যার, তাও আপনি একবার দেখে নিন নিজে।’
— ‘ওকে, দাও ফাইলগুলো।’
সবগুলো ফাইল চেক করে হাসি মুখে ঐশিক বলল, ‘অভিনন্দা মৈত্রকে যখন দায়িত্ব দিয়েছি, তখন আর ভুল হতে পারে কিছু?’
— ‘স্যার, আমার এত প্রশংসা করবেন না প্লিজ, এটা আমার ডিউটি।’ লাজুক হেসে বলল অভিনন্দা।
— ‘ও হ্যাঁ তোমায় আসল কথাটাই তো বলা হয়নি! কাল তুমি ইমনকে ঘুম পাড়িয়ে যখন চলে গেলে, তখন তো কোনো প্রবলেমই হয়নি, ইমন দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু হঠাৎ করেই এক দেড় ঘন্টা পরেই ওর ঘুম ভেঙে গেল, ঘুম ভেঙেই যেই দেখেছে তুমি নেই, ওর সে কি কান্নাকাটি! বাড়ির সকলে মিলে হিমসিম খাচ্ছিলাম ওর কান্না থামাতে। সত্যি, বাচ্চা সামলানো তো আর চাট্টিখানি কথা না, আর গীতালি তো ওইসব পারেই না একেবারে!’
— ‘স্যার, থাক না এখন ওসব কথা! হাজার হোক গীতালি ম্যাডামই কিন্তু সোনাবাবুর মা, আমি তো বাইরের লোক মাত্র! সোনাবাবু আজ শিশু, তাই আমার কাছে থাকার জন্য এত জেদাজেদি করে, একটু বড়ো হতে দিন, দেখবেন ও আর এরকম করবে না।’
— ‘হুম, শিশু বলেই তো ও সবটা বোঝে, যে কে ওকে প্রকৃত ভালোবাসে আর কে নয়! বড়ো হলে হয়ত মানুষ এই বোধটা হারিয়ে ফেলে, বা চাইলেও প্রকাশ করতে পারে না, তাই বড়ো হলে মানুষ বেশি অসহায় হয়ে পড়ে।’
অজান্তেই চোখের কোণটা ভিজে যায় ঐশিকের, কিন্তু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় ও।
এই ঘটনাটা অভিনন্দার চোখ এড়ায়নি, কিন্তু সে যেন ব্যাপারটা দেখেই নি এমন ভাব করে বলল, ‘স্যার প্রেজেন্টেশন গুলো একবার দেখে নেবেন না শেষ মুহূর্তে?’ বলেই ওর ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন গুলো খুলে ঐশিকের সামনে রেখে দিল ও।
একটু পরেই ক্লায়েন্টরা এলেন, মিটিং সাকসেসফুলি শেষ হল, অভিনন্দা আর ঐশিক হাসি মুখে বেরোলো অফিস থেকে, তারপরেই ঐশিক চলল বাড়ির পথে, আর অভিনন্দা চলল যে ফ্ল্যাটে ও ভাড়া থাকে সেই ফ্ল্যাটের পথে।
কিন্তু বাড়িতে গিয়েই ঐশিক দেখে, কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। রঞ্জিত আর তৃষা গম্ভীর মুখে সান্ধ্য চা খাচ্ছেন, আর গীতালি আর ঐশিকের ঘর থেকে ভেসে আসছে রাগী চিৎকার। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই ঐশিক দেখে, ইমন ঘরের এক কোণে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, আর গীতালি চিৎকার করে চলেছে, ওই রাস্তার মেয়েটার প্রতি কিসের এত পিরিত তোর? আমি তোর মা, কিন্তু তুই খালি ওই দু’টাকার মেয়েটার নাম আওড়াস সব সময়! কি যাদু করেছে ও তোর ওপর শুনি?’
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ইমন বলল, ‘আমি অভি আন্টির কাছে যাব!’
— ‘তবে রে!’ বলে গর্জন করে উঠেই ইমনের গালে চড় কষিয়ে দিল গীতালি।
— ‘গীতা!’ ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠল ঐশিক, ‘অতটুকু বাচ্চাকে তুমি মারছ?’
— ‘না, মারব না, ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করব!’ মুখ বেঁকিয়ে গীতালি বলল, ‘সবসময় ওই ভিখিরি মেয়েটার নাম কেন করবে ও?’
— ‘গীতা ভদ্রভাবে কথা বলো! কার সম্পর্কে কি বলছ তুমি? ও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, দিনরাত পরিশ্রম করে খেটে রোজগার করছে, ওর লড়াইটা তোমার মতো মানুষ বুঝবে না! আর ইমন ওকে ভালোবাসবে না ই বা কেন? মনে আছে ওর যখন জ্বর হয়েছিল রাতে, ও কিছুতেই ওষুধ খেতে চাইছিল না, তুমি তো সেদিন নাইট ক্লাবে মদের গ্লাসে ডুবে ছিলে, জানতেই না ছেলের এদিকে কি অবস্থা, সেদিন ওই বাইরের মেয়েটাকেই ফোন করে ডাকতে হয়েছিল, অভিনন্দা এসে তোমার ছেলেকে আদর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন। শুধু কি ওইদিন? সেই সন্ধ্যেটার কথা মনে আছে তোমার যেদিন ইমনের চার বছরের জন্মদিন ছিল? তুমি সেদিন ঘরে নিজের সাজগোজ, মেকাপ নিয়েই ব্যস্ত ছিলে, ওদিকে ছেলেটা যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই, সেই খেয়ালটা পর্যন্ত করোনি তুমি! সেদিনও ওই দু’টাকার মেয়েটা ছিল বলেই ইমন বড়ো অ্যক্সিডেন্টের হাত থেকে বেঁচেছিল, সবটা ভুলে গেছ তুমি?’
(ক্রমশ)