#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি পর্ব : ৪
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৪
______

ইউশ্যানের মাথায় পরিকল্পনা চলছে। অবশ্যই সেটা এভিগ্রিলের সংস্পর্শে থেকে সরে আসার পরিকল্পনা। ছেলেটার কবল থেকে সরে আসা মানেই ছোবল খাওয়া, অর্থাৎ নিজের ক্ষতি। সেটা ইউশ্যানের মস্তিষ্কে ধারণ করছে না। যেই উত্তেজনা আর তীব্র বাসনা ছিল সেটা যেন একলহমায় নর্দমায় পতিত হলো। আগে হলে ভালো হতো। সম্পর্ক যে এখন খুবই গভীরে! কী করবে সে এখন। দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে নিজের ডেস্কে পায়চারি করছে। ম্যাশার অ্যাক্সিডেন্টের ক’দিন সে ভার্সিটি থেকে লিভ নিয়েছিল। আর ততদিন এভিগ্রিল তার দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে ফেলেছিল, হুমকি-ধমকি দিয়ে। ম্যাশার অবস্থার কথা জানানোর পরেও এভিগ্রিলের উগ্র আচরণ কমছিল না। তবুও ঠাট বজায় রেখেছিল ইউশ্যান। মেয়েকে মরণদশা অবস্থায় এরমধ্যে কীভাবে ছেলেটা ডাকছে? মাতৃত্ব কি তার এতোই মরে গেছে? রাগে তাদের মাঝে কয়েকদফা কথা কাটাকাটিও হয়েছিল। মূলে কে ছিল সেটা বলা মুশকিল। তবে দোষ দু’জনেরই ছিল কিন্তু স্বীকার যেতে বাঁধে।

পায়চারি করার মাঝে থমকে দাঁড়াল কারণ উগ্রতা সম্পন্ন এভিগ্রিল টিচার্স রুমের ওপাশের জানলা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। আগেও এমনি করে তাকিয়ে থাকত, সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে গেল তার। কিন্তু আজ-কালের তাকানোতে কেমন যেন করাল গ্রাসী দৃষ্টি! এমন অদ্ভুত দৃষ্টি ইউশ্যানকে ভীতিপ্রদ করে তুলে। এখন তো আরো ভয় করছে, বিশাল কক্ষে টিচার ভরা এরমধ্যে যদি ছেলেটা ঢুকে পড়ে…! আর ভাবতে পারছে না। ঘাড় নুইয়ে কপালে হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে আস্তেধীরে রুম থেকে বের হয়ে গেল। পাছে যদি তাড়াহুড়োতে প্রশ্ন জন্মাতো সকলের মনে।
_____

“কী ব্যাপার এমন উদ্ধতপূর্ণ আচরণের মানে কী?”

ইউশ্যানকে ঠেসে ধরল ওয়াশরুমের দরজাতে এভিগ্রিল। তার কথায় কোনো পাত্তা দিলো না! এটা ভাবতেই তরতর করে রাগ উঠছে ইউশ্যানের মাথায়।

“এভিগ্রিল তোমার আচরণ বড্ড বেপরোয়া!”

“হুঁশশ!”

ইউশ্যানকে একপ্রকার হুঁশিয়ার করল যেন এই মূহুর্তে কোনো কথা বললে ফল ভালো হবে না। ইউশ্যান আর নিতে পারল না ছেলেটার এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এভিগ্রিল রেগে আরো কাছে টেনে চেপে ধরল মেয়েটার কোমল লতানো দেহটাকে নিজের বলিষ্ঠ শরীরে। ব্যথা পেলেও শব্দ বের করার পন্থা আটকে অপর ব্যক্তির ওষ্ঠদ্বারা। ঝড় ওঠার সম্ভাবনা দেখছে ইউশ্যান। যেটা সে চাচ্ছে না এই মূহুর্তে। তার কী মতিভ্রম হয়েছিল কে জানে যার ফলে সে মতিভ্রষ্ট হয়েছিল! এখন পিছু হটবার মতো কোনো পথের দিশা সে খোঁজে পাচ্ছে না। কারণ এভিগ্রিল তাকে অক্টোপাসের মতো পাকড়ে ধরে আছে এবং থাকবে যে সামনে সেটা সম্ভাবনাও তার মনে উঁকি দিচ্ছে। সেখান থেকে বের হবে কীভাবে? উলটো কিছুক্ষণ পরপর যার নিকটে নিজেকে সঁপে দিতে হয়। ঠিক সঁপে দেওয়া নয়, সে-ও তো এমনই সঙ্গ কামনা করছিল নাকি করেনি? করেনি বললে ভুল হবে। ইউশ্যানের আশকারা কি ছিল না? সায় তার পক্ষ থেকেও ছিল বলেই তো আজ এতদূর পর্যন্ত আসা আর এভিগ্রিলের সাহস বাড়া।

“কতদিন হলো তোমাকে কাছে পাই না। তোমার শরীরের গন্ধ নেই না।”

ইউশ্যানের তুলতুলে গালে নিজের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সম্পন্ন গাল দিয়ে চেপে ধরে স্লাইড করতে করতে বলল।

“উঁ!”

ব্যথাতুর শব্দ তুলে আবারো ধাক্কা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে ইউশ্যান বলল,

“এভিগ্রিল, আমরা এখন ইউনিভার্সিটিতে। দূরে যাও।”

কোথায় আছে না আছে সেসব কানে না এলেও এভিগ্রিলের কানে শুধু ‘দূরে যাও’ এদুটো শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পুরুষ মানুষের রাগের সীমা থাকে না, তারা হয় অধৈর্য, অস্থির, ব্যাকুলতা তাদেরই মানায়। সেদিক দিয়ে এভিগ্রিলের শান্ত রূপটাই শুধু ইউশ্যানের চোখে পড়েছে এপর্যন্ত। শান্ত, চুপচাপ থাকার স্বভাবের এভিগ্রিলের বহির্ভূত রূপটা এবার সচক্ষে দেখার মতো দূর্ভাগ্য হলো ইউশ্যানের। আর সেটা খুবই বাজেভাবে এবং বাজে পরিস্থিতিতে।
_____

বিছানায় শুয়ে আছে ইউশ্যান। ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না তার দুদিন যাবৎ। ছুটি নেয়নি ভার্সিটি কর্তৃপক্ষই দিয়েছে, অসুস্থতার কারণে। তবে তিনদিনের দিন তাকে যেতে হবে কারণ পরীক্ষা চলছে ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের। অবশ্য তার প্রক্সি হিসেবে অন্যকেউ রয়েছে তবুও সে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে, সুস্থতা নিশ্চিত করে। কিন্তু আদৌও সে সুস্থ নয়, না শারীরিকভাবে আর না মানসিক দিক দিয়ে। তদুপরি যাওয়ার এই উপলক্ষ্য একমাত্র এভিগ্রিল। সেদিনের করা কাণ্ড ইউশ্যানকে আরো বেশি ভাবিয়েছে এভিগ্রিলের থেকে সরে আসার জন্য সাথে নিশ্চিতও করেছে, ছেলেটা যে একজন সাইকো। সেদিনের রাগে তার সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি করে যা আচরণ করেছিল পুরো স্যাডিস্টের মতো। ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় সেদিন লং কোট পরিধান করে লাঞ্চের সময় চলে এসেছিল অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে। আসলেই সে অসুস্থ ছিল যা দেখে বোঝা যাচ্ছিল আর তাই কর্তৃপক্ষ ভার্সিটির ডাক্তারকে দেখাতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইউশ্যান কৌশলে কাটিয়ে দিয়েছিল, ওয়াশরুমে স্লিপ কাটার কথা বলে।

দৃশ্যটা খুবই চমকপ্রদ এবং হর্ষান্বিত ইউশ্যানের জন্য। এভিগ্রিলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে ইউনিভার্সিটি থেকে। সে ক্যান্টিনে বসে দেখছে দৃশ্যটা। সেটা অবশ্য এভিগ্রিলের অগোচরেই রয়ে গেল। ইউশ্যানের অভিমুখী আরেকজন টিচার বসে। তিনি-ও দেখলেন দৃশ্যটা। সাথে আফসোসের সুর তুলে বললেন,

“ইস! বাবা-মা’হীন ছেলেটার কী অবস্থা!”

“মিস স্টেলা, আপনি কি জানেন তার সম্পর্কে?”

“হুম, এভিগ্রিল নাম। ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে সে বিলং করে তবে এখানকার বাসিন্দা নয়। ওয়াশিংটন থেকে এসেছে নিউইয়র্ক সিটিতে। ছোটোবেলা থেকেই সে বাবা-মা’য়ের ঝগড়াঝাটি, তর্কবিতর্ক দেখে বড়ো হয়েছে। দশ বছর যখন, তখন তার বাবা-মা আলাদা হয়ে যায়। আগে থেকেই তাঁদের এসব অপ্রীতিকর কলহ দেখে ছেলেটার ছোটো মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলেছিল এখন ডিভোর্স হওয়ায় যেন ছেলেটা পুরো বোবা বনে গিয়েছিল। সবচেয়ে দুর্বিষহ দুশ্চিন্তা ছিল একা পড়ে যাবে সে যেটা এতটুকু বয়সের বাচ্চার মস্তিষ্কে বাজেভাবে প্রভাব ফেলে। অবশ্য সে ন্যানির কাছে থেকেই বড়ো হয়েছে। তবুও আপনজন হতে এমন হেয়, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আচরণ পেয়ে ছেলেটা ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেছে।”

বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে এভিগ্রিল সম্পর্কে বলেন মিস স্টেলা। এমন পরিবার থেকে উঠে এসেছে এভিগ্রিল জানার পর থেকে অপরাধবোধ কাজ করছে ইউশ্যানের মধ্যে। হাঁসফাঁস লাগছে, অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু এখন আরেকজনের সামনে বসে এই অস্থিরতা প্রকাশ পাওয়া তার জন্য বিপদজনক। তাই বিষয়টা প্রকাশ না করে আরো অভিনবভাবে জিজ্ঞেস করল,

“এখানে কোথায়, কার কাছে থাকে তাহলে?”

“তার মা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। ফলে সে ওয়াশিংটনের বাড়িটা বিক্রি করে ফেলে এখানে শিফট হয়ে আসে তার ন্যানির সাথে। বিধবা ও সন্তানহীন ন্যানি তাকে আপন সন্তানের মতো পালন করেন। তবুও ছেলেটার মানসিক পীড়ামুক্ত করতে পারেননি। ছেলেটা চুপচাপ, শান্ত ধরনের এমন আচরণ করেছে বিশ্বাস হচ্ছে না।”

মনে মনে ইউশ্যান তখন স্বগোতক্তি করল, ‘হাহ্! আপনি কী জানেন মিস স্টেলা, ছেলেটা কতটুকু চুপচাপ, শান্তশিষ্ট! সাইকো, স্যাডিস্ট একটা!’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here