#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ২
________

ইউশ্যান আজ ক্লাসে হাজির হয়ে প্রথমেই আঁড়চোখে দেখে নিলো এভিগ্রিলের অবস্থান। হাহ্! এসেছে তাও তার দিকেই নজর দিয়ে একদৃষ্টিতে। বিষয়টা জটিলাবস্থা ধারণ করছে দিনকে দিন। ছেলেটার সমস্যা কী? মনে মনে ভেবে ক্লাস শুরু করল সে। পড়ার ফাঁকেও দুয়েকবার চোখাচোখি হলো ছেলেটার সাথে। সেই একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে। এভাবে ক্লাস করা যায় নাকি? খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। সে মনোযোগ দিতে পারছে না ক্লাস নেওয়াতে। যেটা বাকিসব স্টুডেন্টদের মজা করার খোরাক হবে। এটা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই সে পানিশমেন্ট দিবে এভিগ্রিলকে। এমনিতেও এতক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে পড়া যে তার মাথায় ঢুকেনি সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল ইউশ্যান। তাই পড়া জিজ্ঞেস করার উছিলায় শাস্তি বরাদ্দ করবে সে।

“এই ছেলে দাঁড়াও।”

এভিগ্রিলের দিকে পেন তাক করে দাঁড়াতে বলল ইউশ্যান। আর সকল স্টুডেন্টরা-ও সেটা লক্ষ করল এবং বুঝতে পারল কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন তাদের ম্যাম। তাই সকলে একদম সাইলেন্ট মুডে চলে গিয়ে এভিগ্রিলের দিকে তাকিয়ে রইল। তবে এভিগ্রিলের সেদিকে কোন হেলদুল নেই। সে যেন আরো গা ঝাড়া দিয়ে বেঞ্চিতে হেলে বসল। যেমন নেতিয়ে পড়া শরীর। তার এতবড় স্পর্ধা দেখে যারপরনাই রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকল ইউশ্যানের গা। দু’দিন ধরে এভিগ্রিলের ব্যবহার-আচরণ নিয়ে প্রচণ্ড পরিমাণে বিক্ষিপ্ত সে। উপরন্তু মানসিক পীড়াও দিচ্ছে বিষয়টা। কারণ এতে তার ভার্সিটির চাকরিতে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সে ক্লাস নিতে পারছে না ভালো করে। এটা ওপর মহলে যদি বিচারের পর্যায়ে যায়? ভাবতেই গা কাটা দিয়ে উঠছে। সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, স্টুডেন্ট তারউপর বয়সে ছোটো একটা ছেলে তার ক্লাসের ম্যামকে’ই বা একনজরে তাকিয়ে থাকবে কেন? এতসব প্রশ্নের মুখোমুখি যদি হতে হয়!

“আউট, গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস।”

রাগ-ক্ষোভ চিৎকার দিয়ে এভিগ্রিলকে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলল সে। অথচ ছেলেটা সেই একই ভঙ্গিমায় বসে বেঞ্চে। রাগের পারদের সীমানা ছেড়ে গেলেও এত বড়ো ছেলের গায়ে তো আর হাত তোলা যায় না। তাই এভিগ্রিলের বেঞ্চের নিচে থাকা ব্যাগ নিয়ে ক্লাসরুমের বাইরে ছুঁড়ে মেরে দরজার দিকে ইশারা করে দ্বিতীয়বারের মতো তাকে বের হয়ে যেতে বলল ইউশ্যান। কিন্তু বিধিবাম এবার-ও এভিগ্রিল চুপচাপ ইউশ্যানের কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল আর শেষে বের হয়ে যাওয়ার কথাটাও চুপচাপ শোনা পর্যন্তই রাখল, বের আর হলো না। এতসব কাণ্ড-কারখানা দেখতে ভারি মজা পেল বাকিসব স্টুডেন্টরা। আর শব্দ করে সকলেই হাসি, রংতামাশা শুরু করে দিলো ইউশ্যানের দিকে কাগজ ছুঁড়ে। যেটা তার জন্য বেশ লজ্জাজনক ব্যাপার। এতক্ষণের ধরে রাখা রাগ এবার মাথা অবনত হয়ে লজ্জায় পরিণত হলো। রাগে-দুঃখে, অপমানে সে-ই ক্লাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আর বাইরে বেরিয়েই চোখ ফেটে জল আসা আরম্ভ করে দিলো। ভাগ্যিস এখন ক্লাস টাইম বলে সকলে ক্লাস নিচ্ছে, নাহলে কী যে এক অবস্থা হতো! তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকল। বেসিনের সামনে গিয়ে নিজের অশ্রুমাখা মুখটা পরখ করে নিয়ে পানির ঝাপটা দিতে লাগল। অতঃপর মস্তিষ্ক শান্ত হলে পাশে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘুরে বেরিয়ে আসতে নিলো সমুখে এভিগ্রিলকে দেখতে পেয়ে আতংকে আঁতকে উঠল সে। কারণ এভিগ্রিল নিজের হাত পিছনে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিচ্ছে। এত আতংকিত হয়েও ইউশ্যান চিৎকার করল না। উলটো কেমন যেন তাকে উৎকণ্ঠা দেখাল!

“ক…কী করছ এভিগ্রিল?”

চাপা কণ্ঠে কথাটা বলল ইউশ্যান। এদিকে এভিগ্রিল তার কথার উত্তর দিলো না। মোট কথা সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মনে করল না। উলটো এক পা এক পা করে ইউশ্যানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সেটা দেখে ইউশ্যান কেন যেন পিছিয়ে যেত লাগল, সে নিজেও জানল না। তার মধ্যে দৌড়ে কিংবা এভিগ্রিলকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো প্রবণতা দেখা গেল না। পিছাতে পিছাতে মুখ ধোয়ার বেসিনের সাথে গিয়ে তার পিঠ ঠেকল। এদিকে এভিগ্রিল তার সামনে এসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

“দ…দেখো এটা কিন্তু ঠিক নয়। আমি টিচার, তুমি স্টুডেন্ট।”

কেন এমনটা সে বলল, নিজেও বুঝল না। আচমকাই মুখ ফসকে এই কথাটা বেরিয়ে গেল। আর তাতেই সে থতমত খেয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। এভিগ্রিল কিছু সময়ের জন্য কথাটা শুনে থমকে গেলেও পরক্ষণেই স্মিত হেসে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে ইউশ্যানের গালে আদুরে স্পর্শে স্ল্যাইড করতে লাগল। সেই স্পর্শে ইউশ্যানের চেতনা লোপ পাওয়া ধরল। কিন্তু তা বেশ সময় বর্ধিত হলো না। চট করে সরে গিয়ে এগিয়ে যেতে নিয়েও বাঁধাপ্রাপ্ত হলো এভিগ্রিলের হাতে। পেছন থেকে এভিগ্রিলের একহাত তার সমুখে এসে গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। সেই অবস্থাতেই ইউশ্যানের বেঁধে রাখা চুলে নাক ডুবিয়ে দিলো এভিগ্রিল। তবে এবার আর চেতনা শক্তি নাশ হতে দিলো না ইউশ্যান। জোর করে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে যেতে যেতে শুধু বলল,

“না, না এটা ঠিক না।”
_______

বাড়িতে ইউশ্যান ছুটি কাটাচ্ছে। সপ্তাহখানেক হবে। সেদিনের এভিগ্রিলের ব্যবহারের পরেও সে সাহস করে টিফিন পিরিয়ডে ফাঁকা ক্লাস রুমে তার সাথে আলোচনা করতে যায়। এভিগ্রিলের সমুখে বসে সে জিজ্ঞেস করেছিল,

“তুমি কী চাচ্ছ?”

এভিগ্রিল আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিল। তার এই একটা স্বভাব, আরেকটাও আছে সেটা হলো চুপচাপ ও শান্ত থাকে সহজে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। যেমন, ইউশ্যানের প্রশ্নের বেলাতেই ধরা যায়। এবারও চুপচাপ বসে রয়েছে। তা দেখে যেন রাগান্বিত বোধ হচ্ছে ইউশ্যানের। তবুও সে ধৈর্যধারণ করে ফের শোধালো,

“এভিগ্রিল! কী চাও বলো?”

ধৈর্য ধরলেও ইউশ্যানের কণ্ঠে অধৈর্য সাথে হয়তো আকুলতার মিশ্রিত আভাস পাওয়া গেল। যেটা ধরতে পেরে এভিগ্রিল এবার মুখ খুলল,

“তুমি কী চাও?”

একে তো তার টিচার উপরন্তু বয়সে বড়ো ‘আপনি’ সম্মোধন তো করলোই না। আবার এটা কোনো প্রশ্ন হলো! ইউশ্যান বিস্মিতচিত্ত ধারণ করল। এবার সে চুপটি ধারণ করলে এভিগ্রিল তার দিকে ঝুঁকে বলে উঠল,

“চাও না? না চাইলে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছ না কেন?”

এতক্ষণ যাবৎ নতমুখ হয়ে তাকিয়ে থাকা ইউশ্যান তার দিকে তাকালো। সে তো তখনকার ঘটনায় লজ্জায় এভিগ্রিলের পানে তাকাতে পারছিল না। অথচ ছেলেটা তাকে এই প্রশ্ন করল! কিন্তু সে কেন কিছু উত্তর দিতে পারছে না। সে কী চাইবে বা চাইতে পারে? জানে নিশ্চয়। প্রশ্ন করার পরেও ইউশ্যান কিছু সময় পার করে ফেললে এভিগ্রিল বলে উঠল,

“তুমি আমার টিচার নও। তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড! যেটা আমি মানি।”

লজ্জায়-অপমানে এই কথার পরেও ইউশ্যান সেখানে বসে থাকার মতো অবস্থায় রইল না। ছেলেটা কী ভাবল তাকে? মুখ বুঁজে থাকে বলে এসব বলবে? করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব ভেবে নিজের ডেস্কে ফিরে ছুটির দরখাস্ত লিখে জমায় দেয় সেদিন।

সেই ছুটি কাটানোর আজ সপ্তাহ হবে। সেদিনের পর থেকে এভিগ্রিল নামক সত্তাকে চিন্তা নিজ চেতনা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টারত ইউশ্যান। আজও সে ছুটিটা উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়বে ঘুরতে। স্থান আর্ট এক্সিবিশনে। বাড়ি থেকে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মন প্রফুল্লচিত্তে আজ তার ছুটে চলেছে। যথাস্থানে পৌঁছে গাড়ি পার্কিংলটে রেখে এগিয়ে গেল ভেতরে। জনবহুল বিহীন সুন্দর পরিবেশের এক্সিবিশনে এসে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল সে। সফেদ দেয়ালে নানা রঙের আর্টওয়ার্ক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ধীর তালে হেঁটে। বলা বাহুল্য, চিত্রশিল্পী দেখতে হলে মনোযোগ দিয়ে নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে দেখতে হয়। তাই এখানে মানুষের আনাগোনা নেহাতই ক্ষুদ্র পরিসরে। দেয়ালের আর্ট দেখতে দেখতেই একটু মুখটা উপরে তুলে কোণা বরাবর চোখ গিয়ে আবার নামিয়ে ফেলে পুনরায় তাকাতে বাধ্য হয়। তার এবারের তাকানোতে একই সঙ্গে বিস্ময়, হতবাকতা, ভীতিকরতা খেলা করছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here