ইউশ্যানের বয়স ত্রিশের কোঠায়। দেখতে লাগে উনিশ বছরের চমৎকার সৌন্দর্যে মণ্ডিত সকল বয়সের পুরুষের বুকে কাঁপন ধরানো যুবতি। সে ইউনিভার্সিটির লেকচারার। সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে ক্লাস নেয়। আজকে পরীক্ষা ক্লাস টেস্ট যাকে বলে। সকলের হাতে হাতে প্রশ্নপত্র পৌঁছিয়ে দেয় সে। অল্প কয়েকজন স্টুডেন্ট সংখ্যা। ইউনিভার্সিটি লেভেলের ক্লাসে যা হয় আরকি। বাচ্চা নয় তারা ওড়ন্ত পতঙ্গ হয়ে যায় তখন। সকলের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দিয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করতে বলে সে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। সেখানে কিছু কাজ করতে থাকে আর মাথা উঁচিয়ে খানিক বাদে বাদে ছাত্রছাত্রীদের দিকে লক্ষ রাখতে থাকে। এমন করতে করতে হঠাৎই তার খেয়াল যায়, শেষের একসারি আগের বেঞ্চে বসা ছেলের দিকে। বেঞ্চে তো বসেছে দু’জন ছেলে। তবে লক্ষণীয় বিষয়বস্তু আপাতত তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা। আরেকবার সকলের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো ইউশ্যান। নাহ, সকলেই তো লিখছে। তাহলে এই ছেলে কেন কলম হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে? সকল ভাবনা মনে মনেই ব্যক্ত করল ইউশ্যান। মাথা থেকে সরিয়ে নিলো বিষয়টা। হয়তো সে-ই বেশি ভাবছে, নিজেরই দেখার ভুল হতো পারে। এসব ভেবে ফের কাজে মন দিলো। কিন্তু মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নামে একটা বিষয়বস্তু রয়েছে, যা তাকে সজাগ করে অজ্ঞাত বিষয় সমন্ধে। সেই হিসেবে তাকে যে ছেলেটা দূর থেকে তাকিয়ে রয়েছে, সেটাই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিয়ে সতর্ক করছে। এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বেশ সময় নিয়ে ছেলেটার হাবভাবযুক্ত গতিবিধির ওপর নজর দিলো। হাহ্! তাকেই ঘুরে-ঘুরে দেখছে ছেলেটা। অথচ পরীক্ষার খাতা যেভাবে দিয়েছিল, সেভাবেই পড়ে রয়েছে। কারণ কী তাকে এভাবে ঘুরঘুর করে দেখার? জানা নেই ইউশ্যানের। ছেলেটা নতুন ভর্তি হয়েছে মাত্র। তার ক্লাসটাও ছেলেটার কাছে প্রায় নতুন। নামটা কী জানি… এভিগ্রিল। মনে পড়ল ইউশ্যানের। এভিগ্রিল একদিন এসেছিল তাও সল্পসময়ে ক্লাস ও পরিচয় দেওয়ার পর পগারপার। তখন তো মাথা নিচু করে ছিল। চোখ তুলে দেখেওনি ইউশ্যানের পানে। আজ এমন অদ্ভুত আচরণ কেন? ভাবনার মাঝে বেলের শব্দে সময়ের সাথে ক্লাসের নিষ্পত্তি জানাল ইউশ্যান।
_______
ক্লাস শেষে মেয়েকে আনতে যেতে হবে ইউশ্যানের। হাসবেন্ড ব্যাংকার। সময় হয় না। তাই ইউশ্যান’ই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে-নিয়ে আসার কাজ করে।
“মম!”
মেয়ের ডাকে ফিরে তাকালে দেখতে পায় ম্যাশাকে।
“হেই ডিয়ার! ক্লাস কেমন হলো?”
“অনেক ভালো। জানো মা আজ না…!”
গল্প করতে করতে মেয়েকে নিয়ে ইউশ্যান স্কুল গেট থেকে বেরিয়ে নিজের পার্কিং করা গাড়ির দিকল এগিয়ে যায়। অতঃপর ড্রাইভিং সিটে বসে পাশে ম্যাশাকে বসায়। আস্তে আস্তে গাড়ি ড্রাইভ করে। উদ্দেশ্য মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে যাবে। এমন সময় গাড়ির মোড় ঘোরাতেই এভিগ্রিলকে দেখতে পায়। হাতে পোষ্য কুকুরের গলার বেল আগে আগে কুকুর চলছে পেছনে সে। এখানে কী করে ছেলেটা? তাকে ফলো করে এতদূর আসলো না কি? মনের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। যার উত্তর ইউশ্যানের জানা নেই। কেবল এভিগ্রিল’ই পারবে উত্তর দিতে। তার জন্য এভিগ্রিলের সাথে কথা বলতে হবে, অবশ্য একান্তেই।
“মম! তুমি শুনছ?”
অন্যমনস্ক থাকা ইউশ্যান এবার সম্বিত ফিরে মেয়ের জবাব দিলো,
“হু…হুম। বলো শুনছি আমি।”
বাড়ি ফিরে ইউশ্যান একটা হট শাওয়ার নিলো। মনমস্তিষ্কের যে বেহাল অবস্থা তাতে এটা বেশ উপকার দিলো তাকে। তার নিজেকে কেমন ফ্রেশ ফ্রেশ ফিল হলো। পোশাক পরিধান করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটা এসেছে ধরে এখনো কিছু নাস্তা দেওয়া হয়নি। নিয়মের যত্তসব বিশৃঙ্খলাবস্থা! আগে এমন ছিল না। স্কুল থেকে এসেই মেয়েকে নাস্তা করাতো। মনযোগ থাকত সবদিকেই। ইদানীং ব্যাঘাত ঘটছে সবকিছুর, এলোমেলাে হচ্ছে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে। নানান ভাবনা-চিন্তায় দিন পার করতে হচ্ছে। আপাতত আবারও চিন্তার মাঝে নিজেকে না হারিয়ে নাস্তা তৈরি করে মেয়ের সাথে আড্ডায় বসলো। তাদের আড্ডা মূলত ম্যাশা সারাদিনে কেমন কাটালো সেইসব তথ্যের বিশ্লেষণ ইউশ্যানের কাছে তুলে ধরা। ইউশ্যান-ও মেয়ের কথায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল। নাহলে দেখা যাবে মেয়ের প্রতি বেখেয়ালের কারণে মেয়ে বখে গেছে। এই বয়সী বাচ্চারা এটেনশন, প্রশংসা খুব পছন্দ করে।
বিকেলের দিকে ইউশ্যানের হাসবেন্ড র্যাংকন এলো। হাতের ব্যাগ ইউশ্যানের কাছে সমর্পণ করে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য রওনা হলো। এরইমধ্যে ম্যাশা নিজের পাপার আগমনের খবর শুনে দৌড়ে গেল। কিন্তু রুম খালি পেল। ওয়াশরুম থেকে শব্দ আসছল ঝর্ণার। বুঝল, তার পাপা ফ্রেশ হচ্ছেন। বিছানায় ওঠে বসে সে। এমন সময় ইউশ্যান এলো র্যাংকনের জন্য নাস্তা নিয়ে। ফ্রেশ হয়ে স্ত্রী-সন্তানকে একসাথে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। প্রথমে স্ত্রীর কপালে পরে মেয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ একে তাদের পাশে বসলো৷ গায়ে টি-শার্ট, টাউজার পরনে। নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে সুকৌশলে ইউশ্যানের সরু কটিদেশে তপ্ত হাতের চাপ বসাচ্ছে র্যাংকন। ইউশ্যান চোখ রাঙিয়ে বুঝাচ্ছে, মেয়ের সম্মুখে এসব বন্ধ করার উচিত। কিন্তু র্যাংকন ঠোঁট চোখা করে বুঝাচ্ছে, মেয়ে দেখছে না। যাকে দেখানোর সে ঠিকই বুঝছে। তাই কথা না বলে আদর নেওয়া উচিত। বিষয়টা ইউশ্যানের বোধগম্য হতেই মুচকি মুচকি হাসতে লাগল আড়ালে। মনে মনে আওড়ালো সে,
“আমরা সুখী পরিবার। কারো নজর না লাগুল আমার পরিবারে।”
অথচ এমনটা বলার সময়-ই তার মনমস্তিষ্কের স্মৃতিতে ভেসে উঠল এভিগ্রিলের প্রতিচ্ছবি।
_______
মাথার ওপর উত্তপ্ত, লোহা গরম করার মতো রৌদ্রজ্বল একটা দিন। ঘাম চুইয়ে পড়ছে ইউশ্যানের গাত্র হতে। জগিং করতে বেরিয়েছে সে। বাপ-বেটি ঘুমে বিভোর। দু’চার চক্কর কাটল বাড়ির পাশের পার্কটাতে। হাঁপিয়ে ওঠে জিরিয়ে নিলো অল্পক্ষণ হাঁটুতে ভর দিয়ে। আবার সোজা হয়ে ধীরগতিতে দৌড়ানো আরম্ভ করল। তারপর দৌড়ের স্পিড বাড়াতে লাগল। যার ফলশ্রুতিতে পার্ক ছেড়ে গাছে ভরা জঙ্গলের মাঝের পাকা রাস্তায় ঢুকে পড়ল। যেতে যেতে খেয়াল হলো সে কোথায় চলে এসেছে। খেয়াল হওয়ার অবশ্য কারণও রয়েছে। তার মনে হচ্ছে, কেউ তার পিছু নিয়েছে। হঠাৎ থেমে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো অদ্ভুত কাউকে দেখতে পেল না। আবার সামনে তাকালো সেখানেও কেউ নেই। কেবল ঝোপঝাড় আশেপাশের মাঝরাস্তায় সে একা দাঁড়িয়ে। ভয় সঙ্কীর্ণ মনা হয়ে জগিং স্যুট আঁকড়ে ধরে নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে, খিঁচে দৌড়ে জঙ্গল থেকে বের হতে লাগল। একসময় পার্ক অল্প-বিস্তর মানুষের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করল। হাঁটুতে হাত ঠেকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। নিজেকে শান্ত করে ফিরে গেল বাড়ির দিকে।
চলবে…
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ১