তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ৯

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

সেই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। দুই পরিবারের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি হয়েছে। তা রুষ্টতার নয়, আড়ষ্টতা ও সংশয়ের। সেদিনের পর সম্পর্ক গুলো অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। ঐ বাড়ির কারো মুখোমুখি হতে হবে ভেবে সায়রা খুব একটা বাড়ি থেকে বের হয়না। বাড়ি থেকে ভার্সিটি আর ভার্সিটি থেকে বাড়ি অবধি যা! বারান্দায় যাওয়াটাও কমিয়ে দিয়েছে সে। হ্ঠাৎ বিঠাৎ কখনো ঐ বাড়ির কারো সামনে পড়ে গেলে বেশ সাবধানতার সাথে নিজেকে আড়াল করে নেয় সায়রা। চক্ষুলজ্জায়, ভয়, জড়তায় ঐ বাড়ির কারো মুখোমুখি হবার সাহস নেই তার। আরসালকেও অনেকটা এড়িয়ে চলে। কখনো বারান্দায় আরসালের সাথে চোখাচোখি হলে বেশ কৌশল খাটিয়ে এড়িয়ে যায়। যেন তাকে চিনেই না। এর আগে কখনো দেখেনি তাকে।

.
অলস বিকাল। রোদের প্রখরতা তখনো কমেনি। ভার্সিটি থেকে ফিরে, চেঞ্জ করে ড্রইং রুমের সোফায় গাঁ এলিয়ে বসে আছে সায়রা। চোখে নিদ্রাভাব ভর করছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। এ নিয়ে রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি! এমুহূর্তে মায়ের বকুনি তার কর্ণপাত হচ্ছে না। চোখে তখন ঘুমের নেশা, মনে মনে ভেবে নিলো রুমে গিয়ে দুতিন ঘণ্টার একটা ঘুম দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সোফা ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়াতে ডোর বেল বেজে উঠল। রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার,

–” কে এসেছে দেখতো সায়রা! ”

বিরক্তিতে মুখ থেকে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো সায়রার। মায়ের মত করে সমান স্বরে বলল,

–” দেখছি মা”

অলস ভঙ্গিতে হেলে দুলে দরজার সামনে গেল সায়রা। হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলল । দরজার সামনে মুনতাহা বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে যায় সায়রা। ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। এতটাই বিচলিত যে ভিতরে আসতে বলার মত হিতাহিত জ্ঞানটুকু ভুলে গেছে। মুনতাহা বেগম এক গাল হেসে নিজ থেকেই বলে,

–” কিরে মা, ভিতরে আসতে বলবি নাহ?”

মুনতাহা বেগমের কণ্ঠে সায়রার হুশ ফিরে। আড়ষ্ট স্বরে বলল,

–” স..সরি সরি বড়মা হ্ঠাৎ তোমাকে দেখে চমকে গেছিলাম । ভিতরে আসো!”

মুনতাহা বেগম ভিতরে ডুকতে ডুকতে বলল,

–” করমচার টকমিষ্টি আচার বানিয়েছি, তোর তো বেশ পছন্দ তাই নিয়ে এলাম। ইদানীং আমাকে তো একদম ভুলে গেছিস। বেশি বড় হয়ে গেছিস, তাই এখন আর বড়মার কথা মনে পড়ে না! তাই না? ”

মুনতাহার শেষের কথা গুলো বেশ অভিমান জড়ান। সায়রা হেসে ফেলল। পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,

–” তোমাকে একটুও ভুলিনি। সামনে ভার্সিটির ইনকোর্স এক্সাম তাই পড়ালেখা নিয়ে একটু ব্যস্ত তাই আগের মত তোমার কাছে যাওয়া হয়না।”

মুনতাহা পূর্বের ন্যায় অভিমানের স্বরে বললেন,

–” বুঝি, বুঝি। সবই বুঝি!”

বড়মাকে বাচ্চাদের মত রাগ করতে দেখে সায়রা আবারো হেসে ফেলে। মুনতাহা বেগম ভীষণ স্বাভাবিক। সায়রা মাথা তুলে আচমকা মুনতাহা বেগমকে প্রশ্ন করে,

–” তোমার আমার উপর রাগ হয়না বড় মা?”

–” রাগ হবে কেন?”

–” এইযে আমার জন্য এত কিছু ঘটে গেল”

মুনতাহা মিহি হেসে সায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–” কখনো দেখেছিস মায়েরা মেয়েদের উপর রেগে থাকে? তুই আমার মেয়ে সায়রা। তোকে জন্ম না দিলেও, তোর ভেতর বাহির সম্পর্কে আমার বেশ ভালো করে জানা। তোর মনে যে কুমতলব ছিল না তা আমি জানি!”

সায়রা আবেগপ্রবণ হয়ে মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার। আজ সত্যিকার অর্থে মনের সব অপরাধবোধ গ্লানি থেকে মুক্তি পেল সায়রা। আবেগী স্বর তুলে বলল,

–” সরি বড়মা”

মুনতাহা বেগম মাথা হাত বুলিয়ে হেসে বললেন,

–” পাগল মেয়ে কান্না বন্ধ কর। ”

সায়রা ফিক করে হেসে ফেলল। ততক্ষণে মুনতাহার গলার ভাঁজ পেয়ে সিন্থিয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রথমে মুনতাহাকে দেখে তিনি খানিক অবাক হলেন। পরবর্তীতে সবকিছু স্বাভাবিক দেখে নিজেকে সামলে। মুনতাহার সাথে খোশ গল্পে মেতে গেলেন।

.
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?

বারান্দার ফ্লোরে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে সায়রা। শরৎয়ের সকাল। ভোরে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। পেঁজা তুলো সাদা মেঘগুলো আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারিদিক শিউলি ফুলের সুগন্ধিতে মো মো করছে। শিউলি ফুল সায়রার ভীষণ পছন্দ। ভোরে পুষ্প সায়রার জন্য শিউলি ফুলের মালা দিয়ে গেছে । পুষ্প পাখির বান্ধবী। ভারী মিষ্টি মেয়ে। সায়রাকে ভীষণ ভালোবাসে। গলির মোরে প্রথম বাড়িটা পুষ্পদের। তাদের বাড়ির উঠানে ইয়া বড় এক শিউলি গাছ। শরৎয়ের প্রত্যেক সকালে উঠান শিউলি ফুলে বিছিয়ে থাকে। পুষ্প তা কুড়িয়ে সায়রার জন্য মালা গেঁথে নিয়ে আসে। তাতেই সায়রা আনন্দে আত্মহারা!
আজকের সকাল অন্যান্য সকাল থেকে একদম ভিন্ন। আজকের দিনটা সতেজতার, মুক্তির! নিজের গ্লানি অনুতাপ থেকে মুক্তির এক সুন্দর সকাল। মুক্তি স্বাদ যে এত সুন্দর হয় তা জানা ছিল না সায়রার। সাজগোজ ছোট থেকেই ভীষণ পছন্দ তার। আজ বেশ শখ করে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরেছে সে। গলায় হাতে শিউলির মালা। হাতে পায়ে রক্ত আলতা। মেঘঘন কোমর অবধি লতানো চুল গুলো স্নিগ্ধ হাওয়ায় উড়ছে। চুলের উপর মাঝে মাঝে ভীষণ অভিমান হয় সায়রার।আরেকটু সোজা কিংবা আরেকটু কোঁকড়ান হলে কি এমন ক্ষতি হতো!
কাজল টানা হরিণী চোখজোড়া আকাশ পানে মেলে ধরে। “আজকের দিনটা সত্যিই খুব সুন্দর! ” এতটুকু বলেই সায়রার রক্তিম ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।

সকাল সকাল চোখ খুলে কড়া করে এক কাপ কফি চাই আরসালের। নাহয় সারাটা দিন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাটে। পুরানা অভ্যাস কিনা! কফির মগ হাতে করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঘুমঘুম বিরক্তি ভাবটা তখনো কাটেনি। আশেপাশে দেখছিল। সামনের বারান্দায় দৃষ্টি যেতেই থমকে যায় আরসাল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিশ্বাস থেমে যায়। বুকটা প্রচণ্ড বেগে কাঁপছে। আরসালের দৃষ্টি তখনো সামনের বারান্দায় শুভ্রপরীতে আটকে। কপালের বিরক্তির বলিরেখা গুলো মিলিয়ে যায়। গাঁ জুড়ে এক অদ্ভুত মুগ্ধকর স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে যাছে। অকস্মাৎ, আরসালের অজান্তে ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি ফুটে উঠল। নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে আনমনা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল আরসাল,

–” বাহ! আমার থেকে মুক্তির উৎসব পালন করা হচ্ছে শুভ্রপরী?”

সায়রা ফোন হাতে তুলে নানা ভঙ্গিতে সেল্ফি তুলছে।
আরসাল তা দেখে মিটমিট করে হাসছে। আচমকা আরসালের চোখ আটকায় সায়রাদের পাশের বাড়ির ছাদে। বাইশ- তেইশ বছর বয়সি এক ছেলে সায়রার অজান্তেই তার ছবি তুলছে। আরসালের মেজাজ গরম হলো। ফোন বের করে ততক্ষণাত ফোন করল।

সায়রা ছবি তুলছিল। আচমকা ফোনটা বেজে উঠল। আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসতে দেখে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো সায়রার। রিসিভ করে ফোন কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে চিরচেনা কর্কশ আওয়াজ ভেসে এলো,

–” ফাজিল মেয়ে! সকাল সকাল শাড়ি পরে , সাজগোজ করে, হাত পায়ে আলতা লাগিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছিস তুই বিশ্বসুন্দরী? এলাকায় তোর মত সুন্দরী দ্বিতীয়টা নেই? আশেপাশের পোলাপান ছবি তুলছে , চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে সেই দিকে খেয়াল আছে?”

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে রইল সায়রা। কিছুতেই তার বিস্ময় কাটছে না। মাথা তুলে আরসালের বারান্দার দিকে চাইল। রেলিং এর উপর হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে আরসাল। ফর্সা মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে আছে। তার অগ্নিদৃষ্টি সায়রার দিকেই। রাগে দাঁত চিবাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাতের কাছে পেলে গিলে খাবে! শুকনা ঢোক গিলল সায়রা। ঘাড় ফিরিয়ে রফিক চাচার বাড়ির দিকে তাকাতে দেখল, ছাদ থেকে এক ছেলে তার ছবি তুলছে। সায়রাকে দেখে মোবাইল লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। সায়রার মেজাজ খারাপ হলো। ইচ্ছে হলো ইট দিয়ে ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অপর পাশ থেকে আবারো রাম ধমক পড়ল,

–” এক্ষুনি রুমে যা। ”

ধমকে কেঁপে উঠল সায়রা। চোখমুখ কালো করে উঠে দাঁড়ায়। নিজ মনে বিরবির করে,

–” ধুর! ভালো লাগেনা। এই জীবনে শান্তি মিলল না।”

হনহন করে রুমে চলে গেল সায়রা। আরসাল রক্তিম দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here